গত শুক্রবার আমাদের মসজিদে খুতবা দিলেন প্রখ্যাত বক্তা এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপস। তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রথমে প্রশ্ন করলেন, ‘গত এক সপ্তাহে যারা কোন না কোন সময় শুকরিয়া করে সিজদা করেছেন- একটিমাত্র সিজদা, কোন ওজুর প্রয়োজন নেই, কোন নির্দিষ্ট সময় বা দিকের প্রয়োজন নেই, শুধুই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে- তাঁরা হাত তুলুন’। সাতশতাধিক পুরুষের মাঝে গোনাগুনতি দশটি হাত উঠল। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ওপরতলায় শ তিনেক মহিলার মাঝেও হয়ত এমন দশজন ছিলেন যারা দৃষ্টির আড়ালে থাকায় এই সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত হননি। তা হলেও একহাজারের মাঝে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় বিশজন। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে , ‘এই এক সপ্তাহে কি বাকী নয়শ আশি জনের জীবনে এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি যার জন্য তাঁরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন?’ উত্তরটা স্পষ্ট। আমরা সারাক্ষণ হিসেব করি আমার কি পাওয়ার কথা, আমার কি পাওয়া উচিত ছিল, আমি কি পাইনি, আরেকজন কি পেল, কেন পেল, আমি কেন পেলাম না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি কি পেলাম, কিভাবে পেলাম, কেন পেলাম, কি যোগ্যতার বলে পেলাম এই হিসেবগুলো আমাদের করা হয়না। আমাদের ভাবার সময় নেই এই সুস্থ শরীর মন পাবার কি যোগ্যতা আমার ছিল বা আছে যেখানে পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবন্ধী, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বা হয়ত সাধারন রোগব্যাধিতেই কষ্ট পাচ্ছে। আমরা খাবার টেবিলে বসে ভেবে দেখিনা এই মূহূর্তে কতজন মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে অথবা ক’জন ডাস্টবিনে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে অথচ আমি পাঁচরকম তরকারী দিয়ে খেয়েও ভাবছি পাশের বাসায় পনেরো রকম তরকারীর কথা। আমরা বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার সময় স্মরন করিনা এই বাতাসটুকু যে এমন অনায়াসে আমার ফুসফুসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে চুপটি করে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেয়া যায়। সহজ কথায় আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মত কোন ঘটনা খুঁজে পাইনা কারণ আমরা অকৃতজ্ঞ।
পরিচিত জনেরা প্রায়ই নালিশ করেন জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিকোণ অতিমাত্রায় সরল যেটা হয়ত সহজ জীবনের বাইপ্রোডাক্ট। তাদের বলব, কষ্টগুলোকে হাইলাইট না করা আর কষ্টের অনুপস্থিতি এক জিনিস নয়। কষ্টগুলোকে যত হাইলাইট করা হয় ততই তা বদ্ধ জলাশয়ে ব্যাঙাচির মত অসংখ্য দুঃখের জন্ম দিতে থাকে, সমস্যাগুলোতে যত রঙ চড়ানো হয় ততই তা কচুরীপানার মত চারিদিক থেকে ছেঁকে ধরতে থাকে, জীবনকে যতই কমপ্লিকেটেড করে দেখা হয় ততই তা দুর্বিসহ বোধ হতে থাকে। আর একে সহজ করে নিলে রহস্যোপন্যাসের শেষাংশের মত সকল জট একসময় খুলেই যায়, সব হিসেব আপনিই মিলে যায় যদিও তা সহজবোধ্য বা আদৌ বোধ্য হবে এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে বাধ্য নন। উভয়ক্ষেত্রেই জীবনকে বুঝতে চাওয়া বা জোরপূর্বক এর হিসেব মিলাতে যাওয়া এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা। উপরন্তু জীবন ক্যালকুলেটরে হিসেব কষার বস্তু নয়, কাজে লাগাবার এবং উপভোগ করার জিনিস। তাহলে শুধু শুধু এত চিন্তা, এত আলোচনা পর্যালোচনা, এত হাহাকার, এত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব মিলিয়ে কি হবে? তার চেয়ে যদি আজকের এই মূহূর্তটিকেই সকল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু, সকল সফলতার উৎসমুখ ধরে নিয়ে কাজে নেমে পড়া যায় তাহলে কিছু ফলাফল আশা করা যেতে পারে। যা চাইলাম তাই পাওয়াই কিন্তু শুধু সফলতা নয় বরং অনেকক্ষেত্রে প্রচেষ্টাটাই সফলতার ইন্ডিকেটর, ফলাফল শুধু এর ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র। এইটুকু বুঝে নিলেই জীবনের হিসেবটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আর প্রচেষ্টার গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে শেষতক সাফল্য পাওয়াটা নিশ্চিত করা যায়।
গতকাল ছিল এই বছরের সবচেয়ে অসহ্য উষ্ণ তপ্ত আবহাওয়ার দিন, তদুপরি ছিল দাওয়াত। দাওয়াতে যাওয়া আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক সামাজিক দায়িত্বগুলোর একটি, তবু নিষ্কৃতি নেই। ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথা চুপচুপ করে ভিজিয়ে গরম আর সারাদিন ছাত্রছাত্রী পড়ানোর ফলে উদ্ভুত মাথাব্যাথাটাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এনে শুধু উপস্থিতি জানান দিয়ে চলে আসার উদ্দেশ্যে ও’বাসায় গেলাম। কিন্তু যাবার পর উৎসুক শ্রোতাগোষ্ঠীর প্রশ্নাবলি আটকে রাখল সন্ধ্যা পর্যন্ত। তন্মধ্যে এক ভাবী খুব দুঃখ করে বললেন তাঁর এক আত্মীয়া মারা যাবার কিছুদিনের ভেতর তাঁর স্বামী পুণর্বিবাহ করেন, এতে করে ভাবীর মনে প্রশ্নের উদয় হয়, ‘পুরুষের মনে ভালবাসা বলতে আদৌ কিছু কি আছে?’ ভাবীর ছেলেমানুষি প্রশ্নে হাসি পেয়ে গেল। তাঁকে বললাম, ‘যে দু’জন মানুষের মাঝে সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বার্থনির্ভর- যে স্বার্থের পরিমাপ হয় সম্পদের পরিমাণে, দেয়ার ক্ষমতার পরিমাপে, চুলের দৈর্ঘ্যে, চামড়ার রঙে কিংবা কাজ করার যোগ্যতায়- তাকে কি ভালবাসা বলা যায়? বিশুদ্ধ ভালবাসা তো শুধু সেক্ষেত্রেই হতে পারে যেখানে একজন শুধু দেবে, আরেকজন শুধু পাবে, এমন সম্পর্ক শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার সাথেই সম্ভব। এর একটা প্রতিফলন দু’জন মানুষের মাঝে সৃষ্টি হতে পারে যদি দু’জনের বন্ধুত্ব সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, যদি দু’জন ব্যাক্তি পরস্পরকে ভালবাসে কেবল তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই। সেক্ষেত্রে সম্পর্কটা কেবল পার্থিব চাওয়া পাওয়ার বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনা, তাই একে অপরের অনেক ত্রুটি সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ওভারলুক করে যেতে পারে, একজনের পার্থিব জীবন সময়ের সীমাবদ্ধতার কাছে হার মানলেও সে চায় অপরজন স্রষ্টাপ্রদত্ত সীমাবদ্ধতাগুলো মেনে চলে বাকী জীবন অতিবাহিত করুক অতঃপর অনন্ত জীবনে আবার উভয়ে নতুন সংসার পাতবে, তাই সে মারা গেলে তার স্বামী বা স্ত্রী বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে এটা তার কাছে অস্বাভাবিক বা এমনকি কষ্ট পাবার মত কোন ব্যাপার মনে হয়না’। এভাবেই আমাদের যেকোন অ্যাকশন রি-অ্যাকশন যদি সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত মূলনীতি দ্বারা বিচার করে জীবনকে পরিচালিত করা যায় তাহলে জীবনকে আমরা সহজ এবং আনকমপ্লিকেটেডরূপে দেখতে পারি।
তখন প্রশ্ন আসে- পৃথিবীতে এত কলুষতা, এত পঙ্কিলতা, এত আবিলতা, এত অরাজকতা- এর মাঝে কি করে ভাল থাকি? সেক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন করা যায়, এর জন্য দায়ী কে, এর সমাধান কোথায়? যেকোন পরিবর্তনেরই তো শুরু করতে হয় নিজেকে দিয়ে! আমি কি নিজেকে কলুষমুক্ত, পঙ্কমুক্ত, অনাবিল এবং সুশৃঙ্খল করার প্রয়াস নিয়েছি কিনা তার জবাব না দিয়ে কোন অধিকারে অন্যের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করি? আমি যদি কেবল আমাকে সুন্দর করতে পারি তাতে পৃথিবী থেকে একটি অসুন্দর তো কমে যায়! আমি যতই নিজেকে একক মনে করিনা কেন, আমার চারপাশে কতজন আমাকে অনুসরন করে তা জানতে পেলে আমরা হয়ত ভয়ে হার্টফেল করতাম। সুতরাং, শুদ্ধি অভিযানের শুরুটা হতে হবে আমাকে দিয়ে, বাকীটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘটবে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হোল আমরা নিজে করার চেয়ে অন্যকে করার নির্দেশ দিতে ভালবাসি। তাই নিজের তো পরিবর্তন হয়ইনা, অপরের পরিবর্তনের সূচনার প্রশ্নও উদয় হয়না কারণ আমার দ্বিমুখিতা তাকে বীতশ্রদ্ধ করে ফেলেছে- তাহলে পরিবর্তনের সম্ভাবনাটুকুই বা সৃষ্টি হবে কোথা থেকে? আমরা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন না করেই পাওয়ার আশা করি, চুপ করে থেকে পরিবর্তনের আশা করি, নিজেকে ভুলের উর্দ্ধে মনে করে অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা করি। ফলে তাই হয় যা হবার কথা। স্থবিরতা, হতাশা, নিরাশা, দুরাশা নামক নেগেটিভ শব্দগুলো আমাদের ভাইরাসের মত ছেঁকে ধরে। এর থেকে পরিত্রাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হোল আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তা সততার সাথে করে যাওয়া এবং বাকীটুকুর ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থা রাখা।
ছোটোবেলায় আমি ছিলাম এক ঘরকুণো বইপোকা, পৃথিবীর সাথে আমার কোনপ্রকার সম্পর্ক ছিলোনা। আবুধাবীতে ক্লাস সেভেনে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলে এক ব্রিটিশ শিক্ষকের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে হ্যান্স ক্রিশ্চান অ্যান্ডারসনের ‘দ্য আগলি ডাকলিং’ গল্পটি রিডিং পড়তে দেন এবং এর থেকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এই শিশুতোষ গল্পটি তিনি যেভাবে বুঝিয়ে বলেন তাতে ঐ কয় মিনিটেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। আমরা সারাজীবন অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকি- অন্যের প্রতিভা, সাহস, সৌন্দর্য্য সবকিছু আমাদের নিজের যোগ্যতার ব্যাপারে উত্তরোত্তর সন্দিহান করে তোলে। কিন্তু আমরা নিজেদের ভেতরে সুপ্ত গুনাবলী শানিয়ে তুললে খুব সহজেই কদাকার হংসশাবক থেকে নিজেকে রাজহাঁসে রূপান্তরিত করতে পারি। পরবর্তীতে জানতে পারি স্যার যখন নিজ দেশে থাকতেন তখন তাঁর প্রতিবেশি ছিল এক বিদেশি পরিবার। তাঁরা প্রতিদিন দেখা হলে তাঁকে কি যেন বলত, তিনি বুঝতেন না তাই পাত্তাও দিতেন না। একদিন তাঁর দিনটি খুব খারাপ যাচ্ছিল, অথচ যার সাথেই দেখে হচ্ছে সে বলছে, ‘গুড মর্নিং’। মেজাজ তিরিক্ষি হতে হতে যখন প্রতিবেশির সাথে দেখে হোল আর তাঁরা সেই একই দুর্বোধ্য সম্ভাষনে তাঁকে অভিবাদন জানাল, তিনি রাগে ফেটে পড়লেন, ‘কি বলছেন ইংরেজিতে বলেন, কিছুই বুঝিনা আপনারা কি বলতে চাইছেন!’ প্রতিবেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘আমি বলেছি আসসালামু আলাইকুম, এর অর্থ আল্লাহ আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত করুন’। এবার স্যারের থতমত খাবার পালা, উনি বললেন, 'আহ! শান্তি, একটু শান্তি। হ্যাঁ, এটাই তো আমার চাই! যে জাতির অভিবাদন এত সুন্দর, তার রীতিনিতি না জানি কত সুন্দর!’ তখন তিনি ঐ প্রতিবেশির সাথে কথাবার্তা বলে জানতে পারেন এটি কোন নির্দিষ্ট দেশের বা জাতির নয় বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সম্ভাষন। পরবর্তীতে তিনি লেখাপড়া করে, জেনে, বুঝে ইসলাম গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন আমাদের সকল শিক্ষকের আদর্শ। কেন তা বুঝতে পারি যেদিন আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক আমাদের তাঁর ঘর পরিদর্শন করতে নিয়ে যান। স্কুলের মাঠের অন্যপাশে ছিল তাঁর আর ভি যেখানে তিনি বসবাস করতেন। একজন ব্যাচেলরের বাসার পরিচ্ছন্নতা দেখে অবাক হলেও আমরা আরো বেশি অবাক হলাম যে তাঁর কোন খাট নেই, টেবিলও নেই। তিনি রাসূল (সা)এর জীবনী পড়ে নিজের জীবনকে ঠিক সেভাবেই সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। নরম বিছানায় শুয়েও যার ঘুম আসতনা তিনি এখন মাটিতে বিছানা পেতে মহা আরামে ঘুমাতেন, সারাজীবন দু’হাতে কাঁটাচামচ দিয়ে খেয়ে অভ্যস্ত এই ব্যাক্তি ডান হাতের তিন আঙ্গুল ব্যাবহার করে খেতেন, স্কুলে শার্টপ্যন্ট পরলেও স্কুলের বাইরে সবসময় আলখাল্লা পরতেন, প্রতিদিন কুর’আন এবং হাদিস পড়তেন এবং এই জ্ঞান ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর ফাঁকে আর বন্ধুদের আড্ডায় বিতরণ করতেন। তাঁর পরিবার তাঁকে পরিত্যাগ করে কিন্তু মানুষ তাঁকে বরণ করে নেয়। সবচেয়ে বড় কথা সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য তাঁকে সকল দুঃখ অনুযোগ ভুলিয়ে দেয়। এভাবেই মানুষ নিজেকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে অপরকে পরিবর্তিত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে!
সুতরাং, আমার যে বন্ধুরা জীবনকে কঠিন অকাট্য বাঁধার শেকলে দেখতে অভ্যস্ত তাদের আহ্বান জানাই, পৃথিবীটাকে একবার আমার এবং আমাদের মত সাধারন মানুষগুলোর দৃষ্টি দিয়ে দেখুন, পরিবর্তনটা নিজেকে দিয়েই শুরু করুন, হয়ত হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা পৌঁছে যাব আমাদের আকাঙ্খার স্বর্নশিখরে- সত্ত্বর না পৌঁছলেও ক্ষতি নেই, পথটা ভালই লাগবে, ভ্রমণটাও কঠিন মনে হবেনা।
No comments:
Post a Comment