Sunday, December 9, 2012

বিজ্ঞাপন

Advertisement- ছোটবেলায় চার syllable এর এই শব্দটা উচ্চারণ করতে বেশ বেগ পেতে হত। আজকাল দেখি বাচ্চারা অনেক চালাক, এত্ত লম্বা করে না বলে শ্রেফ ‘অ্যাড’ বলে চালিয়ে দেয়। এর বাংলা ‘বিজ্ঞাপন’ (Big+জ্ঞাপন), এই শব্দটাও ওরকমই বাগাড়ম্বরপূর্ণ। এতে ‘জ্ঞাপন’ করার মত সারবস্তু যা থাকে তার চেয়ে বেশী থাকে ‘বিগ’ কথাবার্তা। প্রমাণ চাই?

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, আবুধাবীতে থাকি। টিভিতে একখানা বাসনমাজা সাবানের কেরামতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তেলচটচটা হাড়ির ভেতর একফোঁটা সাবান ‘টিং’ করে দিতেই সব তেল আপনিই সরে যেতে লাগল, স্পঞ্জ হাড়ির ভেতর একবার চারপাশে ঘুরিয়ে নিতেই সব তেল অদৃশ্য, পানির নীচে হাড়ি ধরতেই ঝকঝকে পরিষ্কার। বাবাকে বললাম, ‘তাহলে আমরা হাড়ি ধুতে এত কষ্ট করি কেন? ঘষে ঘষে হাতের চামড়া উঠে যায় অথচ দাগ ওঠেনা, স্পঞ্জ ক্ষয়ে যায় অথচ তেলের কিছু হয়না!’ বাবা পরদিন ঐ সাবান কিনে নিয়ে এলো। আমিও বিজ্ঞাপনের মত ডিমভাজার ফ্রায়িং প্যানটা নিয়ে তাতে ‘টিং’ করে একফোঁটা সাবান দিলাম, কই কিছুই হোলনা! বাবা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার কান্ড দেখে হাসে, বলে, ‘তুমি কি ভেবেছ সব বিজ্ঞাপনের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে? আরো কয়েক ফোঁটা সাবান দাও’। ভ্রূ কুঁচকে বললাম, ‘কিন্তু বিজ্ঞাপনে তো শুধু একফোঁটাই দেয় আর সব কেমন ফকফকা হয়ে যায়!’ নাহ, কিছুই হচ্ছেনা। দিলাম আরো একফোঁটা, তারপর আরো একফোঁটা, তবুও তেল সরেনা। বাবা বলল, ‘স্পঞ্জ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে’। বললাম, ‘কিন্তু বিজ্ঞাপনে যে দেখায় তেল নিজে নিজে সরে যায়!’ কিছুই মিলছেনা। স্পঞ্জ দিয়ে হাল্কা করে মেজে পানির নীচে ধরলাম, দেখি তেল দাগ সব রয়ে গেছে। বাবা বলল, ‘ভাল করে না ঘষলে তেল উঠবেনা’। আবার সাবান দিয়ে, ভাল করে ঘষে, প্রচুর পানি দিয়ে ধোয়ার পর তেলের কড়াই পরিষ্কার হোল। আমার মাথার চুল ছেঁড়ার জোগাড়, তাহলে আমাদের পুরোনো সাবানের কি দোষ ছিল? ‘তাহলে তো ওরা যা দেখাল সব ভন্ডামী, যা বলল সব মিথ্যা আর যা করল পুরাটাই ভাঁওতাবাজি!’ বাবা হাসে, ‘বিজ্ঞাপনে কি সত্যি কথা বলে নাকি?’ আমার মাথায় ঢুকলোনা, ‘সত্যি না হলে বলার দরকার কি?’

আবুধাবীতে অ্যাড দেখাত হাতেগোণা। বাংলাদেশে এসে তো দেখি অ্যাডের বন্যা আর কি তার বাহার! অন্য নারী গায়ের ওপর ঢলে না পড়লে শেভিং ব্লেড কেনা সার্থক হয়না (নারীর সংখ্যা একাধিক হতে পারে, আর একাধিক বিয়ে করলেই যত সমস্যা!), অপবিত্র মুখভঙ্গি না করলে খাবার জিনিসের মজার প্রমাণ মেলেনা (এই নোংরা অ্যাড বাচ্চারাও দেখছে), গায়ের রঙ ফর্সা না হলে মেয়ের বিয়ে হয়না (বাহ, আর কোন গুণের প্রয়োজন নেই, গায়ের চামড়া ঘষে একপরত তুলে ফেললেই বিয়ে সুনিশ্চিত), পাউডারের সুবাসে অন্য পুরুষকে বিমোহিত করতে না পারলে চাকরী মেলেনা (তাহলে পাউডার লাগালেই হয়, লেখাপড়া করে মেধা, টাকাপয়সা আর সময় নষ্ট করার দরকার কি?) এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার ত্রিশ সেকেন্ডের একখানা অ্যাডের শেষে একখানা টুথপেস্টকে কেন্দ্র করে দাদি নানি থেকে রাস্তার লোক পর্যন্ত সব নাচতে থাকে- সুখী সম্বৃদ্ধ বাংলাদেশের সার্থক চিত্র! এই চিত্র নিত্যদিন রাস্তাঘাটে দেখা যায়না এটাই দুঃখ।

বাংলাদেশে আরেকপ্রকার অ্যাড দেখলাম যেটা আরো মজার। শহীদ মিনার থেকে রাস্তার মোড়ে পর্যন্ত যেনতেন জায়গায় যখনতখন লোক জমে যায় একজনের কথা শুনে। সবাই জানে লোকটা যে টোটকা ওষুধ বিক্রি করার চেষ্টা করছে সব ভুয়া, যে কথাগুলো বলছে সব ফাঁকা বুলি, তেমন কেউ এই ফাঁদে পড়ে বলেও মনে হয়না। কিন্তু তার যাদুকন্ঠের আহ্বান উপেক্ষা করে কেউ চলে যাবার সংকল্পও করেনা, কেউ ভেবেও দেখেনা জীবনের কতটুকু সময় চলে যাচ্ছে বেকার কান পেতে থেকে।

একই প্রকৃতির লোকের দেখা মেলে সভাসমিতি থেকে পথেঘাটে বা দাওয়াতের অনুষ্ঠানে। কোনক্রমে একজন শ্রোতা পাওয়া গেলে বা হাতের মুঠোয় একখানা মাইক বন্দি করা গেলেই আমরা হয়ে উঠি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক একজন জ্ঞানী, গুণী, বাগ্মী ব্যাক্তি। ট্রেনে, বাসে, বন্ধুর অফিসে একেকজনের বক্তব্য শুনে মনে হয়, ‘আহা! কোথায় ছিল এই মহান ব্যাক্তি আর কোথায় ছিলাম আমি?’ একবার কোনক্রমে ডায়াসের সামনে দাঁড়াতে পারলে আমাদের উদ্দেশ্য হয় কষ্টার্জিত তাবত জ্ঞান এক বক্তব্যে শ্রোতার কর্ণকুহরে ঢেলে দিয়ে তাকে জোরপূর্বক শিক্ষিত করে তোলা। একবার ইউনিভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল। বসতে বসতে দেখি পরিচিত এক বক্তা বক্তব্য দিচ্ছেন আর একটু পর পর মূহূর্মূহু তালির আওয়াজ, একেকবার তালি শুরু হলে আর থামেই না। আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘ওনার বক্তব্য যতটুকু শুনলাম মনে তো হোলনা এমন আহামরি কিছু, ছাত্ররা এত তালি দিচ্ছে কি বুঝে?’ সাথে ছিল ফাহমিদা, দুষ্টুবুড়িটা মুখ টিপে হেসে বলে, ‘আপা, আপনি কিচ্ছু বোঝেন না। ওরা কি খুশি হয়ে তালি দিচ্ছে? ওরা তো তালি দিচ্ছে যাতে উনি কথা বলতে না পারেন, যাতে উনি স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে ওদের প্রাণরক্ষা করেন’। তবে বক্তাও কম যান না, উনি পূর্ণ একঘণ্টা জ্ঞানদান করেই ক্ষান্ত দিলেন, গজর গজর করলেন আরো একঘন্টা, ‘বাঙ্গালীর জ্ঞানের প্রতি কোন আগ্রহ নেই’। অথচ আমি এই ব্যাক্তির মুখোমুখি বসেও কোনদিন তাঁর কথার অর্ধেকের বেশী উদ্ধার করতে পারিনি, শ্রোতাদের আর কি দোষ দেব?

বিজ্ঞাপন বলুন আর আত্মপ্রচারণা বলুন, এর উদ্দেশ্য কিন্তু খুব সুক্ষ্ণভাবে কোন বস্তু বা ব্যাক্তির তরফদারী করা। ধরুন এই মূহর্তে টেলিভিশনে একখানা বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে যার চড়া মিউজিক আর কড়া রঙ কেবল আপনার বিরক্তির উদ্রেক করছে। কিন্তু এটাও বিজ্ঞাপণ নির্মাতার সাফল্য, যেকোন উপায়েই হোক তিনি আপনার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। আপনি যখন বাজারে যাচ্ছেন তখন একই বস্তুর অনেক ব্র্যান্ডের ভিড়ে আপনি টিভিতে দেখা পরিচিত ব্র্যান্ডটি দেখে একটু হলেও ঝুঁকে পড়বেন। আপনি যদি বস্তুটি একবার কেনেন সেই একবারই বিজ্ঞাপনটি সার্থক। কার্যত অধিকাংশ মানুষ, জেনে হোক বা অজান্তে, বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয় আর তাই পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতারা বানিয়ে চলেন নানান বিজ্ঞাপন, তাতে উদ্ভট উদ্ভট পরিস্থিতি দেখিয়ে তাঁরা আমাদের মত সাধারন মানুষদের বোকা বানান। আত্মরপ্রচারক জনগোষ্ঠী আমাদের উদ্দেশ্যহীন সময়ের ফায়দা নিয়ে নিজেদের দেবদূত প্রমাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। আর আমাদের মত সাধারন জনগণ একই জিনিস শুধু ব্র্যান্ডের নাম দেখে বেশি দামে কিনে আনি। সুতরাং, পরের বার যখন উপস্থাপক বলবেন, ‘ফিরে আসছি এই কমার্শিয়াল ব্রেকের পরই, কোথাও যাবেন না যেন’, নিজেকে তুলুন, একটি বই নিয়ে বসুন, ঐ পাঁচ মিনিট বেকার টিভির দিকে তাকিয়ে না থেকে পাঁচমিনিট জ্ঞানার্জনে ব্রতী হোন, আজ কি কি কাজ করলেন আর কি কি বাকী আছে পর্যালোচনা করুন, হতেও পারে এটা আপনার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অথবা শেষ পাঁচমিনিট। এরপর যখন কারো আত্মপ্রচারণা শুনবেন, চিন্তা করুন ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগেনা, যে ব্যাক্তি কার্যতই গুণী বা ভাল তাকে তো তার কাজ দেখে আপনি আমি সবাই চিনতে পারব, তাঁর নিজের কেন বলতে হবে?’ চলুন, আমরা আমাদের বিবেককে কাজে লাগাই, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করি, বেরিয়ে আসি ‘বিগ’ জ্ঞাপনের অশুভ প্রভাব থেকে, নিজের জীবনটাকে সার্থকভাবে সাজাই নিজের হাতে।

No comments:

Post a Comment