আমার এক মেধাবী দাদী বলতেন, ‘পরিষ্কার থাকতে হলে ময়লা ঘাটতে হয়’। একেবারে খাঁটি কথা। নিজকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার একটা শর্ত হোল আশেপাশে সবকিছু পরিচ্ছন্ন রাখা। কেবল নিজের শরীরের ব্যাপ্তিটুকুই ফিটফাট রাখতে গেলে ঘরে, উঠোনে, রাস্তায় জঞ্জাল জমবে; তাকে নিজ হাতে পরিষ্কার না করলে কোনা ঘুপচি থেকে একসময় পুরো এলাকাতেই ময়লা বাসা বাঁধবে। ঠিক যেমন নিজের কার্যক্রম হামেশা পর্যালোচনা না করলে বুঝে ওঠা কঠিন আমি সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছি না ভুল। একটা দু’টো মিথ্যা, দুয়েকটা ফাঁকি, খান কয়েক অন্যায় একসময় পুরো আত্মাটাকেই কলুষিত করে ফেলে। একটি দু’টি করে আত্মা কলুষিত হতে হতে একসময় গোটা জাতিই দূষিত হয়ে পড়তে পারে। তাই সাময়িকভাবে দু’হাতে ময়লা ঘাঁটাই স্থায়ীভাবে পরিষ্কার পরিছন্ন থাকার একমাত্র উপায়।
আমার ভারী প্রিয় কাজগুলোর একটি হোল ঘর পরিষ্কার করা। ঘর পরিষ্কার করতে তো আর মাথার কোন কাজ করতে হয়না। তাই এই সময়টা কাজে লাগাই দু’ভাবে, হাত দিয়ে ঘর পরিষ্কার করি আর মাথা দিয়ে মন। হাত দু’টো যখন ধুলোবালি, মাকড়ের জাল আর ঝোলের দাগ সাফ করে ঘরকে তকতকে ঝকঝকে করতে থাকে তখন মাথাটা ভাবতে থাকে আমি কোন কাজগুলো ঠিক করেছি, কোনগুলো আমার করা উচিত হয়নি, কি করলে ভবিষ্যতে এমন ভুল থেকে বাঁচা যাবে আর ফাঁকে ক্ষমা চেয়ে নেই সৃষ্টিকর্তার কাছে- প্রত্যেক ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত আছে আর সেটা মৃত্যুর পূর্বেই করে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ, অন্তত আমার তাই মনে হয়।
একদিন ঘর পরিষ্কার করা শেষে ধুলিমলিন আমাকে সাবান শ্যাম্পু ইত্যাদি উপাদানের সহযোগিতায় যথাসম্ভব পরিছন্ন করার অভিযানে নেমে হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে গেল। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে হাত পরিষ্কার করার সময় কাদাপানি গড়িয়ে যেতে দেখে হেসে গড়াগড়ি যাবার উপক্রম। আমার এই মাটির তৈরী দেহ, ফিরে যাবে মাটিতেই, আর এতে লেগে থাকা ধুলিমাটি কি যত্নেই না ধুয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছি! এইটুকু মাটির ঢেলা আমরা কত দামী কাপড়, কত রকম প্রসাধন, হরেকরকম গহনা দিয়ে সাজাই! এর বেঁচে থাকার পেছনে খরচ করি লক্ষকোটি টাকা! এই পচনশীল নশ্বর দেহখানা নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা অহঙ্কারের অন্ত নেই! অথচ এর ভেতরে অবস্থানরত যে অমর আত্মাটা সত্যিকার আমি- এই দেহটা যার কাজ করার একখানা মেশিন মাত্র- তাকে নিয়ে আমরা কি নির্বিকার! অবিনশ্বর আত্মা বেচারা ক্ষিদেয় মরে আমাদের কোন খবর নেই, আমরা কেবল তার নশ্বর বাহনখানাকে হৃষ্টপুষ্ট করতেই ব্যাস্ত!
একবার দুর্ভাগ্যক্রমে এক ধনীর বাসায় তিনদিন থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। ঘরভর্তি দামি শোপিস, সোনাদানার ছড়াছড়ির মাঝে কোথাও একখানা বই খুঁজে পেলামনা। আমার দমবন্ধ হয়ে মরার জোগাড়! কারণ আমাদের বাসায় আর কিছু থাক বা না থাক, ঘরভর্তি বই না থাকলে আমরা শ্বাস নিতে পারিনা। বাসার বুয়া থেকে শুরু করে বাচ্চাদের পর্যন্ত সময় কাটে বিভিন্ন বই পর্যালোচনা করে। কথায় কথায় আসর বসে যেকোন বিষয়কে কেন্দ্র করে, তবে সেই আলোচনা যে কোন বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। প্রতিটি মুহূর্ত যদি শেখার বা শেখানোর সুযোগ না থাকে, জীবনটাকে কেমন যেন অর্থহীন মনে হতে থাকে। আর যারা সার্টিফিকেটের জন্য পড়ে বা ঠেকায় না পড়লে পড়েনা তাদের জীবনটা কিভাবে কাটে চিন্তা করতেই হাঁপিয়ে উঠি!
শরীরের যেমন খাবারের প্রয়োজন হয়, তেমনি আত্মারও খাবার প্রয়োজন হয়। জ্ঞান আত্মার খাবার। জ্ঞান মানুষের হৃদয়ের দিগন্তকে প্রসারিত করে যদি তাকে আত্মস্থ করা যায়। তবে যে জ্ঞান কেবল পার্থিব উদ্দেশ্য বা আর্থিক উন্নতির জন্য হাসিল করা হয় তার কথা আলাদা। কারণ তাতে ব্যাক্তির মনমানসিকতায় কোন পরিবর্তন আসেনা এবং এই জ্ঞান তার পরিপার্শ্বে অবস্থানকারীদের কারো কোন উপকারে আসেনা। তাই আমরা প্রায়ই দেখি অনেক মাস্টার্স পি এইচ ডি করা লোকজন বৌ পিটায়, ঘুষ খায়, অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়; আবার অনেক অল্পশিক্ষিত অথচ বিবেকবান মানুষ আমাদের চমৎকৃত করে। এখানে পার্থক্যটা সার্টিফিকেট অর্জন আর জ্ঞানের আত্মীকরণের ব্যাবধানে নিহিত। কি ধরণের জ্ঞান অর্জন করা হচ্ছে, সেটাও ব্যাপার বটে।
একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। সাতাশ বছর বয়সী প্রাণচঞ্চল একটা মেয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থেকেও সবার চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মরে গেল। স্বামী সন্তান, বাবা মা, ভাইবোন কেউ তার যাওয়া ঠেকাতে পারলোনা। তার এক ঘুষখোর আত্মীয় এই মৃত্যুর বর্ণনা দিতে দিতে বললেন, ‘আমি রিটায়ার করার পর ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে হজ্জ্ব করে রেগুলার নামাজী হয়ে যাব’। আশ্চর্য হলাম! চোখের সামনে একটা প্রাণোচ্ছল তরতাজা মেয়ে তড়পাতে তড়পাতে মরে গেল, আর এই দৃশ্য নিজ চোখে দেখেও তিনি কিনা ভবিষ্যত পরিকল্পনা করছেন! আল্লাহ কি তাকে এমন কোন চুক্তিপত্র দিয়েছেন যে তিনি সে পরিমাণ আয়ু পাবেন, বা তিনি হজ্জ্বে যাবার সুযোগ পাবেন, বা তিনি নামাজ পড়লেই যে মানুষগুলোকে এত বছর ধরে কষ্ট দিয়েছেন সে তাবৎ গুনাহ মাফ হয়ে যাবে?! কি অদ্ভুত বিবেক বিবেচনা আমাদের! যে নশ্বর দেহের এতটুকু ভরসা নেই যে তা আগামি মূহূর্তে আত্মার সাথে থাকবে না আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তার ওপর কি অসামান্য বিশ্বাস আমাদের! একটি অন্যায় কাজ করতে, একটা রূঢ় কথা বলতে, কারো অধিকার হরন করতে, কারো সম্পদ আত্মসাত করতে এক মূহূর্ত আমরা ভেবে দেখার জন্য সময় ব্যায় করার প্রয়োজন মনে করিনা, ‘এই সম্পদ কি আমি কবরে নিয়ে যেতে পারব? আমার বৌ-সন্তান, আত্মীয় স্বজন আজ মিথ্যা বলে আমাকে পুলিশের কাছ থেকে বাঁচাতে পারে, কিন্তু কবরে গেলে বা বিচারদিবসে তারা কি আমাকে রক্ষা করতে পারবে?’ স্বার্থ স্বার্থ করে পাগল আমরা আসলে নিজের স্বার্থই বুঝিনা!!
মনে পড়ে, আমার সদ্যজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে মুগ্ধ ভাবনায় ডুবে গেছিলাম- কি অদ্ভুতরকম নিখুঁত হাত, পা, চুল, নখ, ত্বক এই শিশুর! কি নিখুঁত সৃষ্টি আল্লাহর! কিছুদিনের ভেতর সে নখ দিয়ে নিজের চেহারা আঁচড়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করল, ত্বকের পার্ফেকশান শেষ। ফলশ্রুতিতে নখ কেটে দিতে হোল। এই নখ কিছুতেই আর সেই নিখুঁত চন্দ্রাকৃতি হোলনা, নখের পার্ফেকশান শেষ। চুল কাটার পর যে চুল গজাল তাও আর সে নরম সিল্কি চুলের মত হোলনা যা নিয়ে সে জন্মেছে, চুলের পার্ফেকশান শেষ। এভাবে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মৃত্যুর বীজ আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে বুনে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি মূহূর্তেই আমরা একটু একটু করে মারা যাচ্ছি। অথচ বিবিধ অ্যান্টি রিঙ্কল ক্রীম, অ্যান্টি এজিং ভিটামিন, আর বাহারী উপাদান দিয়ে আমরা এই কঠোর সত্যটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি!
আমরা দীর্ঘজীবনের আকাঙ্খা করি অথচ এই দীর্ঘজীবন অনেক সময় হয় ভুলে পরিপূর্ণ, পঙ্কিলতায় ভরপুর, অপূর্ণতায় জালি জালি হয়ে যাওয়া খোলসের মত। তার চেয়ে এমন একটি জীবন কত শ্রেয় যার স্থায়িত্ব হয়ত অনেক কম কিন্তু যার পরিধি অনেক বিস্তৃত! পৃথিবীর জন কীটস, জোন অফ আর্করা শারীরিকভাবে খুব বেশিদিন বাঁচেনি কিন্তু মৃত্যু তাদের গ্রাস করতে পারেনি আজও। অপরদিকে অনেক মানুষ অনেক শতবর্ষী জীবন খেয়েদেয়ে ফূর্তি করে কাটিয়ে মিশে গেছে মাটির সাথে, তাদের নামটুকু পর্যন্ত কেউ মনে রাখেনি। আমরা কি কখনো ভেবে দেখি এর কোনটি আমাদের পছন্দ? আমাদের কি মনে আসে খেয়েদেয়ে মরে যাওয়া ছাড়াও এই জীবনের কোন higher purpose আছে? এই উদ্দেশ্য আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে পারে একমাত্র স্পিরিচুয়ালিটি বা ধর্মবোধ। একমাত্র এটাই আমাদের এই নশ্বর দেহের কামনা বাসনা চাহিদার উর্ধ্বে অমর আত্মার জন্য উপযুক্ত ও শোভন একটি অবিনশ্বর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে পারে।
আমার ব্যাক্তিগত স্বপ্নটা আমার মতই আরেকটু ছোট কলেবরের। আমি স্বপ্ন দেখি, আমি মারা গেলে আমার বিরুদ্ধে কারো কোন নালিশ থাকবেনা। কেউ বলবেনা, ‘মানুষটা বড় ভাল ছিল’ কিন্তু কেউ এটাও বলবেনা, ‘মানুষটা হাড়বজ্জাত ছিল’। কেউ বলবেনা ‘সে কোনদিন কোন অন্যায় করেনি’ কিন্তু কেউ যেন বলে, ‘সে অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করত’। কেউ বলার প্রয়োজন নেই, ‘সে ধার্মিক ছিল’, সবাই যেন বলে, ‘আমরা ওর গুনাহ মাফ হবার জন্য দুয়া করি’। কেউ আমাকে মনে না রাখলেও, কেউ যেন আমাকে মনে রাখে, ‘সে ভাল কথা বলতে না পারলেও খারাপ কথা বলতনা’। কেউ আমার দ্বারা উপকৃত হবার কথা মনে করতে না পারলেও যেন অপকৃত হবার কথা মনে করতে না পারে। ছোট্ট একটা স্বপ্ন, ছোট্ট একটা আশা। এইটুকুই সম্বল করে পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জাল দু’হাতে ঠেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত।
No comments:
Post a Comment