Sunday, December 9, 2012

পিকনিক ২০১১



ক্যানানাস্কিস- কেন এই জায়গাটি পছন্দ করলাম বুঝতে পারছেন নিশ্চয়

গত সপ্তাহে পিকনিক নিয়ে মিটিং বসল। ভাইরা তিনটা অপশন দিলেন পিকনিকের ভেন্যুর জন্য। আমরা ঠিক করলাম ক্যানানাস্কিস যাব। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন মেন্যু কি হবে। আমরা ঠিক করে দিলাম- সকালে ভাজি, ডালচচ্চরি আর রুটি; দুপুরে পোলাও, গরুর মাংস, মুরগীর রোস্ট, কাবাব আর সালাদ; বিকেলে মিষ্টি, ঝালমুড়ি আর চা। রান্না করবে কে? মিষ্টি বানাবে কে? আমাদের যারা বড় বড় রাঁধুনী- আসমা আপা, আমিনা আপা, কেয়া আপা সবাই হয় দেশে নয় ক্যাল্গেরীর বাইরে। সুতরাং সিদ্ধান্ত হোল রান্না করবেন ভাইরা। সব ভাই মিলে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হয়ে বুধবার মিষ্টি বানালেন, বৃহস্পতিবার গরুর মাংস রাঁধলেন, শুক্রবার মুরগীর রোস্ট আর পোলাও। মহিলাদের মধ্যে একমাত্র মোনালিসা আপা এই খাদ্যযজ্ঞে অংশগ্রহণ করলেন কাবাব বানিয়ে। কেউ কেউ বাজার করতে যাচ্ছে বলে বাসা থেকে বেরোতেন। কারণ বৌ যদি জানতে পারে যে ব্যক্তি বাসায় কুটোটা ছেঁড়েননা তিনি নব্বইজনের জন্য মিষ্টি বানাতে যাচ্ছেন, তাহলে আর বলতে? শনিবার সব ভাইদের গোমর ফাঁক হয়ে গেল। তারপর আর পায় কে? খাবার দাবাড়, মালপত্র তাঁরাই গাড়ীতে তুললেন। তারপর শুরু হোল যাত্রা।



জাহাঙ্গীর ভাই জিনিসপত্র গাড়ীতে বোঝাই করার জন্য প্রস্তুত করছেন


ক্যাল্গেরী থেকে বের হতেই রকি পর্বতমালার কোলে সবুজের খেলা, পথের দু’পাশ জুড়ে সাদা গোলাপী নীল বেগুনী ফুলের সমারোহ, গরুঘোড়ার ফার্ম, খোলা প্রান্তর, কোথাও মাথা উঁচু করে আছে ন্যাড়ামাথা পর্বত, উঁচু জায়গাগুলোতে কোথাও একটু বরফ এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আগামী শীত পর্যন্ত টিকে থাকার। এখানে কোথাও পরিবেশকে বিঘ্নিত করা হয়নি তাই রাস্তায় শাঁ শাঁ করে চলতে থাকা গাড়ীর ফাঁকে ফাঁকেই দৌড়ে বেড়ায় খরগোশ, কাঠবিড়ালী বা হরিণের দল।



ক্যাল্গেরীর বাইরে, ক্যানানাস্কিসের পথে



উৎসুক হরিণছানা দেখার চেষ্টা করছে কে যায়


ক্যাল্গেরী থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে সোয়া একঘন্টার দুরত্বে ক্যানানাস্কিস ভিলেজ। এখানে একপাশে রিসোর্ট, আরেকপাশে খোলা মাঠে পিকিনিক স্পট। বাচ্চাদের বাথ্রুম সারিয়ে আনতে আনতে গিয়ে দেখি ভাইরা ছায়ায় আসন পেতে বসে পড়েছেন। কি আর করা? প্রচন্ড গরমে আমাদের গিয়ে বসতে হোল রোদেই। বেশী ছোট বাচ্চাদের জন্য তাঁবু খাটানো হোল। মাঠে অনেক ব্যস্ততা। একপাশে ভারতীয় একদল বনভোজনকারী ক্রিকেট খেলছে, আরেকপাশে বসেছে বিশাল একদল চাইনীজদের মেলা, মাঠের মধ্যখানে এক ক্যানেডিয়ান বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য টেবিলচেয়ার সাজানো হচ্ছে।



মা এবং বাচ্চারা

প্রথমেই নাস্তার পালা। ভাইরা কাজে নেমে পড়লেন, তাই আমরা আমাদের দায়িত্বের কথা বিলকুল চেপে গেলাম। নাস্তা খেয়ে মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বাচ্চাদের অনুষ্ঠান নিয়ে। প্রথমে কুর’আন থেকে তিলাওয়াত, তারপর সমবেত সঙ্গীত, তারপর বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের খেলার প্রতিযোগিতা। খেলা শেষ হতে হতে দেখি বিয়ের মেহমানবৃন্দ আসতে শুরু করেছেন। আমাদের দেশের মত পোশাক আর গহনার প্রতিযোগিতা নেই, কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন পিকনিকে এসেছে! আমরা ভাবলাম পনেরো মিনিট হেঁটে আসি, এসে বিয়ে দেখব। একমিনিট যেতেই দেখি বৌ আর বৌয়ের বান্ধবীরা যাচ্ছে। আমরা সবাই তাকে হাত নেড়ে শুভকামনা জানালাম, ওরাও খুশী হয়ে হাত নাড়ালো। বাচ্চারা কিছুতেই ঝর্ণার ওপর থেকে নামবে না। তাই আমরা ঠিক করলাম ঘুরে এসে বিয়ের বাকীটুকু দেখব।



ভাইরা নাস্তা বাড়ছেন



বাচ্চাদের সমবেত সঙ্গীত



গরমে অস্থির বাচ্চারা ঝর্ণার ওপরে উঠে আর নামতে চাইছেনা

আরেকটু হেঁটে যেতেই বনভূমিতে ঢাকা পথ, পাখীর কলকাকলী, ঝর্ণার কুলুকুলু ধ্বনি, এখানে সেখানে টাঙ্গানো ফুলঝুড়ি, পেছনে রকি পর্বতের ফারগাছ ঢাকা মাথা, কোথাও টাকের ওপর একটু বরফ আমাদের মন কেড়ে নিলো। ছবি তুলতে তুলতে মনে হোল চোখ যা দেখে, ছবি কখনো তাকে আয়ত্বে আনতে পারেনা। এত সুন্দরের ভিড়ে কোন এক সুন্দরকে ক্যামেরার শাটারে বন্দী করার চেষ্টাই বৃথা। ফিরে এলাম আধঘন্টা পরই। ফেরার পথে দেখি বৌ ফিরে আসছে, বিয়ে শেষ! মাঠে গিয়ে দেখি টেবিল চেয়ার সব উধাও, মেহমান সব চলে গেছে!



ঝর্ণার পাশ ধরে আমাদের হাঁটাপথ



যে তিনচারমাস গরম থাকে ওরা সবখানে এভাবে ফুলের ঝুড়ি ঝুলিয়ে দেয়



কাছে থেকে ফুলঝুড়ি মন কেড়ে নেয়


রোদের তাপে টিকতে না পেরে আমরা অন্যদিকে গিয়ে বসলাম। বাচ্চারা মায়েদের থেকে ছাড়া পেয়ে মা্ঠে গিয়ে খেলতে লাগল। আমরা এই সুযোগে মহিলাদের খেলার প্রতিযোগিতা সেরে ফেললাম। প্রত্যেকে একটি করে হাদিস বা কুর’আনের আয়াত পেলেন চিরকুটে। যে যে যার যার হাদীস বা আয়াত পড়ে শোনালেন, সবাই সংক্ষেপে এই বিষয়ে আলাপ করলেন, সবার পড়া শেষ হলে যার যতগুলো মনে পড়ল সবাই লিখে ফেললেন, যার সবচেয়ে বেশী সংখ্যক এবং সবচেয়ে বেশী ডিটেলস মনে থাকবে সে প্রথম হবে। শারিরীক প্রতিযোগিতায় আমি কখনো পুরস্কার পাবার কল্পনাও করতে পারতামনা, এই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়ে সেই ব্যর্থতা পুষিয়ে নিলাম।



বাচ্চারা স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছে


খেলার মধ্যখানে এক ভাই এলেন তার স্ত্রীর খোঁজে, সালাদ কাটার জন্য- আমরা মজা পেয়ে বললাম, “ভাই, সব যখন করলেন, এটাও আপনারাই করেন!” উনি বিরস বদনে চলে গেলে আমরা হাসি সামলাতে পারলাম না। খেলা শেষ হতে হতে ভাইদের খাবার গরম করাও শেষ। সবাই খেয়েদেয়ে ভাইদের বিশেষ ধন্যবাদ দিলাম জীবনের প্রথম এমন পিকনিকের আয়োজন করার জন্য যেখানে আমাদের কোন কাজ করতে হয়নি। খাওয়ার পর মিষ্টি। মাশাল্লাহ, সব খাবারই মজা হয়েছে!



ভাইরা সালাদ কাটছেন



অতঃপর পরিশ্রমের ফল উপভোগ করার পালা


দুপুরের খাবারের পর পুরস্কার বিতরণী। সব বাচ্চারা খুশী কারণ যারা জিতেছে তারাও পুরস্কৃত হয়েছে, যারা জেতেনি তাদের জন্য্ও রয়েছে সান্তনা পুরস্কার। আমার মেয়ে পেলো একটি ফুলদানি আর আমি পেলাম মদের ডিক্যান্টার! এই নিয়ে কতক্ষণ হাসলাম সবাই। আপারা বললেন, “আপনার যে স্বাস্থ্য, আমরা বুঝতে পারছি আপনাকে মোটা করার এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই!” তবে সাজানোর জন্য ভারী সুন্দর বোতলটি! এরপর আমরা ছড়িয়ে পড়লাম একটু ছায়ার জন্য। বরাবরের মতই আমি গিয়ে পড়লাম এমন মেয়েদের দলে যারা মহিলাদের দলেও না আবার বাচ্চাদের দলেও না। ওদের সাথে আড্ডা দিতে মজা কারণ ওরা এখন পৃথিবীকে আবিস্কার করছে, জানার আগ্রহ প্রবল, বোঝার আগ্রহ জীবিত, ওদের মনে কত যে প্রশ্ন! আড্ডা জমে উঠতে ভাবীরাও একে একে ঘিরে বসতে লাগলেন। একে একে আলাপ হোল পৃথিবীতে মহাদেশগুলোকে স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে পাহাড়ের ভূমিকা, পৃথিবীকে আমাদের বাসোপযোগী করার জন্য ডাইনোসরদের ধ্বংস করা কেন জরুরী ছিল, কেন কেয়ামতের দিন পাহাড়ের মত সৎকাজের ভান্ডার নিয়ে উঠেও অনেকে বেহেস্তে যেতে পারবেন না, কেন সৎকাজ করার চেয়েও অনেক সময় ছোট ছোট খারাপ কাজগুলো এড়িয়ে চলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি ইত্যাদি।



ক্যানাডায় বলে কি পান খাওয়া বাকী থাকবে?



অবশেষে পুরস্কার বিতরণী


একটু বিশ্রামের পর সবাই চাঙ্গা হয়ে হাঁটতে বের হলাম। বিকেলের স্তিমিত হয়ে আসা আলোয় পাহাড়ের ওপর গাছগুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল- নীচের গাছগুলো বেশ চাঙ্গা বড়সর, ওপরের দিকে গাছের সংখ্যা ফিকে হয়ে এসেছে, পাতাগুলোও একটু লালচে, পাহাড়ের মাঝে এঁকেবেঁকে চলে গেছে শীর্ণকায়া এক নদী, পথের দু’ধারে জংলী ফুলের আঘ্রানে মন আমার উন্মাতাল। ততক্ষণে আমার ক্যামেরার ধারণক্ষমতা শেষ, মনের পর্দায়ই সব ধারণ করে নিলাম।

ফিরে এসে দেখি ভাইরা আমাদের ভরসায় বসে না থেকে ঝালমুড়ি আর চা করে ফেলেছেন। বান্ধবী তানজিন খুব মজা পেল যে ভাই বাসায় কোন কাজ করতে চান না অথচ এখানে বসে বসে এতগুলো মানুষের জন্য চা বানাচ্ছেন!

চা খেয়ে সামান্য জিরিয়ে নিয়ে এবার সবাই লেগে পড়লাম গোছগাছ করতে। ভারতীয় আর চাইনীজরা বিদায় নিয়েছে অনেক আগে। আমরা শেষ চকলেটের ছিলকাটিও তুলে ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে এলাম। এই আমরাই কিন্তু বাংলাদেশে যত্রতত্র ময়লা ফেলি। আমাদের ময়লা ফেলার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই এটাও ঠিক, আবার সঠিক জায়গায় ময়লা ফেলার আগ্রহ নেই এটাও ঠিক। এখানে কোথাও লিখতে হয়না, “এখানে থুথু ফেলিবেন না” অথবা “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ”। এরা এদের দেশকে এত ভালোবাসে, এত সুন্দর করে রাখে যে আপনার লজ্জা লাগবে একে পরিস্কার না করে নোংরা অবস্থায় ফেলে যেতে।

পিকনিক শেষে ফিরে আসার সময় সবার মন পরিতৃপ্ত- সবকিছু এত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে, বাচ্চারা এত ক্লান্ত যে বাসায় গিয়ে ঝামেলা না করে শুয়ে পড়বে এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার হোল আমরা মহিলারা একদিনের জন্য রান্নাবান্নার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলাম! সৌন্দর্যে অবগাহন করে তাকে ফেলে ফিরে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তাকে বুকের ভেতর ধারণ করে ফিরে আসছিলাম সেই সান্তনা!

No comments:

Post a Comment