Sunday, December 9, 2012

গন্ধবিশারদ আমি

আমার ঘ্রানশক্তি প্রখর। বিশাল নাকের বদৌলতে যেকোনপ্রকার গন্ধ সুরুৎ করে ঢুকে পৌঁছে যায় সোজা মগজ পর্যন্ত। এর একটা অসুবিধা হোল অনেক অদৃশ্য গন্ধ নাকে টের পেয়ে আমার মগজ যখন নাক বাবাজীকে কুঁচকে ফেলেন, আমার পাশে বসা আর কেউ বুঝতে পারেনা আমার কি সমস্যা। আমার বোঁচা নাকখানাকেই ‘নাক উঁচু’ বলে বদনাম করে! তবে এর একটা ভালো দিক হোল এমন অনেক গন্ধ আমাকে মোহিত করে যা অনেকেই টের পান না বা খেয়াল করার উপযুক্ত মনে করেন না।

বিজ্ঞানীরা বলেন আমাদের মগজ অন্যান্য স্মৃতির পাশাপাশি গন্ধের স্মৃতিও সংরক্ষণ করে। ফলে কোন পরিচিত গন্ধ তার সাথে সংশ্লিষ্ট স্মৃতিগুলোও ফিরিয়ে আনে। তাহলে চলুন আমার সাথে। আমার প্রিয় গন্ধগুলোর সাথে আমার প্রিয় স্মৃতিগুলোতেও ঘুরিয়ে আনি আপনাদের। হয়ত অনেকের সাথে মিলে যাবে- অনেকে খুঁজে পাবেন স্মৃতির পাতায় ম্লান হয়ে যাওয়া কিছু গন্ধ!




আমাদের প্রথম পরিচিত এবং সবচেয়ে ভালো লাগা গন্ধ কি বলতে পারেন? মায়ের শরীরের ঘ্রান, তাইনা? এই সুবাস আমাদের সব দুঃখ যাতনা কষ্ট ভুলিয়ে দিত, সব চাহিদার প্রাপ্তি হয়ে যেত এই গন্ধ নাকে এলে। কখনো খেয়াল করেছেন যখন খুব মন খারাপ হয় আমরা নিজেকে নিজে জাপ্টে ধরে দুলতে থাকি? বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন, এই দোলার সময় আমরা ঠিক সেই আকৃতি ধারণ করি যেভাবে আমরা ছিলাম ভ্রূণ অবস্থায়। দোলার মাত্রাটাও হয় ঠিক ততটাই যতটা আমাদের মায়েদের নড়াচড়ার পরিমাণ ছিল। যাদের মায়েরা বেশী চঞ্চল ছিলেন তারা বেশী ফ্রিকুয়েন্সীতে দোলেন, যাদের মায়েরা অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিলেন তারা অপেক্ষাকৃত কম ফ্রিকুয়েন্সীতে। কিন্তু মূল কথা হোল, মা যতই দুরে চলে যান না কেন, তাঁর প্রতিটি অভ্যাস, বাক্য, গন্ধ মিশে আছে আমাদের প্রতিটি রক্তকণায়!

শহরাঞ্চলে বড় হয়েছি। শহুরে গন্ধগুলো কেমন যেন একঘেঁয়ে। দামী পারফিউমের হাল্কা আমেজ, কড়া পারফিউমের ঝাঁঝালো গন্ধ, পাউডারের মৃদু সুবাস, খাবারের দোকান থেকে ভেসে আসা জিভে জল আনা গন্ধ… ময়লা উপচে পড়া ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া আমকাঁঠালের ছিলকা পঁচার গন্ধ যেখানে একটু ফল খাবার লোভে হাতড়ে বেড়ায় কয়েকটা ময়লা কাপড় পরা লিকলিকে ছেলেমেয়ে, রিক্সাওয়ালা ভাইয়ের সিন্থেটিক কাপড়ের শার্টে শুকনো ঘামের গন্ধ, আধাশুকনো ড্রেন থেকে অ্যামোনিয়ার গন্ধ… এর মাঝে মাঝে কোন বন্ধুর দেয়া একটি গোলাপের সুবাস, দাদুর বিছানায় তসবীহর পাশে ঝোলানো শুকনো বকুলের মালার ফিকে হয়ে আসা সুগন্ধ, ঝুম বর্ষায় ছোট্ট শিশুদের কদমের গাছ থেকে পেড়ে আনা তাজা কদমের সোঁদা গন্ধ স্মৃতির কোণে কোণে বসবাস করে।

এবার গ্রামে চলুন। গ্রামে থেকেছি খুব কম, সাকুল্যে তিনমাস হবে হয়ত। কিন্তু এর স্মৃতিগুলো কেন যেন খুব উজ্জ্বল। ধানক্ষেতে পাকা ধানের গন্ধ, আলুক্ষেতে নতুন আলুর গন্ধ, হাট থেকে কিনে আনা তাজা শশার গন্ধ… ক্ষেত থেকে নিজ হাতে তুলে আনা সীম, আলু, মরিচের তরকারীর গন্ধ… পুকুরের জল ঘোলা করে মাছ ধরার পর কাদার আঁশটে গন্ধ, চড়ুইভাতিতে ছোট মাছ রান্নার মুখে লালাঝরানো গন্ধ… কাঁঠালগাছের ঝরাপাতার মৃত্যুর গন্ধ, বসন্তে আমগাছে নতুন বোলের গন্ধ… ভাপাপিঠার ভেতর গুড় গলার মিষ্টি গন্ধ, আমদুধ দিয়ে ভাতে লালচে চিনির গন্ধ, মিস্রীর গন্ধ… পেঁপের ফুলের তীব্র সুবাস, কলার মোচার হাল্কা গন্ধ…

এর অনেকগুলোই আমার ছেলেমেয়ে কোনদিন পাবেনা। আমাদের জীবনের আর সবকিছুর মত অনেক কিছুতেই এখন ভেজাল। ছোটবেলায় দেখেছি এক ফার্লং দূরে আম পাকলেও গন্ধ পেতাম, এখন আমের ভেতর নাক ডুবিয়ে বোঝার চেষ্টা করি আম না পেঁপে। ছেলেবেলায় দেখেছি মাছির ভয়ে দরজা জানাল বন্ধ করে কাঁঠাল ভাঙ্গা হত, এখন মাছিও কাঁঠালের ওপর বসে টের পায়না এটা সত্যিই কাঁঠাল কিনা। শরীফা ছিল আমার ভারী প্রিয় ফল, এখন আর শরীফা দেখিই না, দেখলেও কোন গন্ধ পাইনা। একদিন হয়ত আমাদের সন্তানেরা বা তাদের সন্তানেরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করবে যেখানে দুর্গন্ধ ছাড়া আর কোন গন্ধ থাকবেনা…

কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় দু’টো গন্ধের কথা তো আপনাদের বলাই হয়নি!




প্রথমটার কথা শুনলে হেসেই ফেলবেন। এই গন্ধ এখন আর অজ পাড়াগাঁ ছাড়া সচরাচর গ্রামাঞ্চলেও পাওয়া যায়না। অথচ এই গন্ধটা ছোটবেলায় পেয়েছি স্ব্য়ং ঢাকায়। এখনকার ঢাকা ইট কাঠ লোহা পাথরের শহর, এখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই, প্রাণের গন্ধ পাবেন কোথায়? আমি যে গন্ধের কথা বলছি সেটা অনেকপ্রকার প্রাণের সমাহারের গন্ধ। নানাপ্রকার আগাছার সম্মিলিত যে ঝাঁঝালো গন্ধ, শুঁকে দেখেছেন কখনো? এতে মিশ্রিত থাকে ঘাসফুলসহ নানান জাতের আগাছার ঘ্রাণ। ছোট্ট ছোট্ট রংবেরং-এর ফুল ফোটে এসব আগাছায়। এর ওপর খেলে বেড়ায় ঘাসফড়িং মৌমাছিসহ আরো নানাপ্রকার পোকামাকড়। ছোটবেলায় এগুলো দিয়ে কত কি যে খেলতাম, সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত কিন্তু ঘরে ফেরার নামই নেয়া হতনা! এই গন্ধ এখন আর পাইনা…




দ্বিতীয়টি হয়ত পেয়েছেন কিন্তু ব্যস্ত জীবন সময় দেয়নি উপভোগ করার বা এর সাধারণত্বের কারণে একে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার উপযোগী মনে করেননি কখনো। গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তপ্ত সূর্য যখন দিনের পর দিন মাটির জীবন শুষে নিতে থাকে, একদিন আকাশ কালো করে মেঘ হয়, সেই মেঘের বুক চিরে মাটিতে নেমে আসে প্রথম বর্ষার কয়েকফোঁটা জল, তৃষিত মাটি তাকে শুষে নেয় প্রচন্ড আগ্রহে, ছেড়ে দেয় তার বুকভরা দীর্ঘশ্বাস- উত্তপ্ত মাটিতে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটার হাল্কা সোঁদা গন্ধ শুঁকে দেখেছেন? একটু সময় করে ঘ্রাণ নেবেন। আমার মনে হয় এটাই জীবনের গন্ধ!


(উৎসর্গঃ আমার ভাইকে- যিনি গ্রামকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন)

No comments:

Post a Comment