আইসল্যান্ডের এক যুবক, বয়স ২৭, পেশায় জেলে। নিজের নৌকা নেই তাই অন্যদের নৌকায় ভাড়া খাটে।
সেদিন প্রচন্ড ঠান্ডা হলেও আবহাওয়া শান্তই ছিল। ওরা চারজন যখন নৌকা নিয়ে রওয়ানা দিল তখন সমুদ্রের পানি হ্রদের মত শান্ত। আধঘন্টা পর ফিয়র্ডের খাঁজে মাছ শিকার করছিল ওরা, মাছ পাওয়া যাচ্ছিল ভালই। হঠাৎ ফিয়র্ডের পানি অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা দেখতে পেল সাগরের শান্ত পানিগুলো নৌকার খুব কাছেই চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। ইঞ্জিনে জোর টান দিয়ে ঘুর্ণিপাকের কাছ থেকে নৌকা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ক্যাপ্টেন। প্রাণপনে চেষ্টা করেও যখন সে বুঝতে পারল নৌকা ঘুর্ণিপাকে প্রবেশ করছে, তখন নিরুপায় হয়ে সে সবাইকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা করতে নির্দেশ দিল। পানি ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা, দ্রুত পানি থেকে শুকনো জায়গায় উঠতে না পারলে হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু সলিল সমাধি থেকে প্রাণরক্ষা করতে চাইলে এর কোন বিকল্প ছিলোনা। আশেপাশে কোন নৌকার চিহ্ন পর্যন্ত নেই, মাটি অনেক দূরে, সাঁতার দিতে গেলে দেহ তাপশূণ্য হয়ে নিশ্চিত মৃত্যু। তবু যদি ভাগ্যক্রমে কোন নৌকা চলে আসে! তিনজন পানিতে লাফিয়ে পড়ল, একজন নৌকা থেকে বেরোতে পারলনা, নৌকার সাথেই তার সলিল সমাধি হোল। ভেসে রইল ওরা এক জায়গায় যেন শরীরের তাপ সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্ত দিগন্তে কোন নৌকা দেখা গেলনা।
অপেক্ষার প্রহর সাঙ্গ হোল খুব দ্রুত। সাত মিনিটের মাথায় যুবকের দুই সঙ্গীর একজন হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যু বরন করল, দশ মিনিটের মাথায় ক্যাপ্টেন। যুবক আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল সে কবে মারা যাবে। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগলেও সে যখন দেখল সে মারা যাচ্ছেনা তখন সে তীরের উদ্দেশ্যে সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নিল যদিও পথেই হয়ত সে মারা যাবে। আড়াই মাইল সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছল সে, না সে তখনো মরেনি। প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত সে অথচ আশেপাশে কোথাও কোন জনবসতি নেই। কিছুদুর হেঁটে এক চারণভূমিতে পৌঁছল সে। দেখতে পেল গরুছাগলের জন্য বালতিতে যে পানি রাখা হয়েছিল তার ওপরটা জমে বরফ হয়ে আছে কিন্ত নীচে সামান্য পানি টলটল করছে। কোন সহায়ক বস্তুর অভাবে সে খালি হাতে বাড়ি দিয়ে এই বরফ ভেঙ্গে সেই প্রচন্ড শীতল পানি পান করল। তারপর আবার হাঁটতে লাগল। আরো প্রায় ১৬ কিলোমিটার হেঁটে সে জনপদে পৌঁছল, তারপর নিজে নিজেই গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোল। সমুদ্রতীর থেকে হাসপাতালের দুরত্ব ছিল মোট ২৬ কিলোমিটার।
তাকে দেখে তো ডাক্তারদের চক্ষু চড়কগাছ! এই লোকের তো বেঁচে থাকারই কথা না! তাকে সম্পূর্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হোল। সামান্য সর্দিজ্বর ছাড়া এই সম্পূর্ন ঘটনায় তার আর কোন শারিরীক সমস্যা হয়নি!
কিন্তু যুবক নিজে ব্যাপারটাকে এত সহজে ছেড়ে দিতে পারলনা। তাকে জানতেই হবে সে কিভাবে বেঁচে গেল যেখানে একজন সুস্থ মানুষ এই তাপমাত্রায় দশ মিনিটের বেশি বাঁচার কথা নয়। সব ছেড়েছুড়ে সে আবার লেখাপড়া শুরু করল। প্রচন্ড অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের ফলে আট বছরের মাথায় সে ডাক্তারী পাশ করল। ডাক্তার হবার পর সে গবেষনা করতে শুরু করল কিভাবে সে সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। বিশ্বব্যাপী নানান সময় প্রচন্ড শীতে দীর্ঘসময় এক্সপোজ হবার পরেও প্রাণে বেঁচে গেছে বা কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এমন লোকজনের রিপোর্ট নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল যারা বেঁচে যায় তাদের প্রায় সকলেই শিশু- সে ছাড়া। তখন সে গবেষনা করতে শুরু করে শিশুদের এবং বড়দের শারিরীক কাঠামোয় এমন কি পার্থক্য আছে যার ফলে শিশুরা শীতল আবহাওয়াতেও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকে অথচ বড়রা মারা যায়। সমস্ত শারীরবৃত্তিয় তথ্য একত্রিত করে তুলনামুলকভাবে সাজানোর পর সে দেখতে পেল পার্থক্যটা খবই সাধারন- শিশুদের শরীরে চর্বির স্তরগুলো শরীরের প্রায় সর্বত্র সমভাবে ব্যাপ্ত থাকে, কিন্তু মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চর্বিগুলো শরীরের কিছু নির্দিষ্ট অংশে গিয়ে জমা হয় এবং কিছু কিছু জায়গা থেকে চর্বি একেবারেই সরে যায়। চর্বির স্তর সর্বত্র সমভাবে বন্টিত হওয়ায় শিশুদের শীতে মৃত্যু বা ক্ষতি হয় কম। কিন্তু বড়দের শরীরের কিছু অংশ চর্বি দ্বারা সুরক্ষিত হলেও চর্বিশূন্য অপরাপর অংশ শরীরের ভেতর হতে তাপ ঠাণ্ডা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনা। তাই শীতে বড়দের মৃত্যু বা ক্ষতির পরিমাণ বেশি।
এই গবেষনার মাধ্যমে সে জানতে পারল কিভাবে শরীর শীতলতা হতে নিজকে রক্ষা করে কিন্তু সে কিভাবে রক্ষা পেল তার তো কোন সুরাহা হোলনা। সে তখন নিজের শরীরের ওপর নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে এক বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করল। ওর শরীরে চর্বির স্তরগুলো অজ্ঞাত কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হয়নি, বরং শিশুদের মত শরীরের সর্বত্র সমভাবে ব্যাপৃত! আর একারণেই সে সেদিন কোনপ্রকার সমস্যা ছাড়াই বেঁচে গেছিল, অথচ ওর সঙ্গীরা ওর চোখের সামনে মারা গেল।
যুবক তখন ভাবতে শুরু করল সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন যেখানে সে সহজেই মারা যেতে পারত, কেন সে ডাক্তার হোল যেখানে জেলে জীবনের সহজতার বাইরে জীবনের কাছে কিছুই চাওয়ার ছিলোনা তার? তার এই বর্ধিত জীবনের উদ্দেশ্য কি? তখন সে সিদ্ধান্ত নিল সৃষ্টিকর্তা তাকে যে নতুন জীবন দিয়েছেন তাকে সে সৃষ্টির সেবায় ব্যায় করবে। রোগীদের সুষ্ঠু সেবা দেয়াই হয়ে উঠল তার জীবনের নতুন লক্ষ্য।
আমাদের বাসায় আমার দাদার আমল থেকে আমার আমল পর্যন্ত রিডার্স ডাইজেস্টের কালেকশন ছিল। এগার বছর বয়সে একবার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আবুধাবীতে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে রোগীর সাথে কেউ দেখা করার নিয়ম ছিলোনা, তাই সময় কাটানোর জন্য বাবা ক’টা রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে যায়। তখন থেকেই আমার এই ম্যাগাজিনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ম্যাগাজিনে ‘ড্রামা ইন রিয়েল লাইফ’ নামে একটা কলাম ছাপা হত যেখানে এমন কোন সাহসী মানুষের ঘটনা দেয়া হত যে নিজের বা অপরের কোন প্রতিকুলতাকে জয় করেছে বা করতে সাহায্য করেছে। কলামটা পরে বন্ধ হয়ে গেল কেন জানিনা। হয়ত এখন আর তেমন সৎ বা সাহসি মানুষ জন্মায়না! এই ঘটনাটা মনে গেঁথে গেছিল তাই আজ এতদিন পর আবার মনে পড়ল। পড়েছিলাম বিশ বৎসরাধিক আগে, তাই কবেকার সংখ্যা মনে নেই, সম্ভবত বাবার আমলের। যুবকের নাম মনে নেই, কিন্তু ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে প্রতিটি মিনিট, দুরত্ব, বছর আর বয়সের হিসেব কষা। কিন্তু ঘটনাটা শুধু পরিসংখ্যানভিত্তিক কারণে এতটা নাড়া দেয়নি। নাড়া দিয়েছিল এজন্য যে এটি কেবল একজন মানুষের বেঁচে যাবার কাহিনী নয় বরং বেঁচে যাবার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার কাহিনী।
আমরা আমাদের জীবনটাকে বড় সহজভাবে নেই। পৃথিবীতে যেখানে প্রতিদিন জন্মের আগেই অসংখ্য মানবশিশু ভ্রূন অবস্থায় বিদায় নিচ্ছে, অসংখ্য শিশু শৈশব পেরোবার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, অসংখ্য কিশোর কিশোরি যুবক যুবতী মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করছে প্রতিনিয়ত, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে আমাদেরই চেনাপরিচিত লোকজন বয়সের হিসেব বাতিরেকে- সেখানে আমি কেন, কোন অধিকারে বেঁচে আছি, কি উদ্দেশ্যে তা নিয়ে ভাবার জন্য আমরা ঠিক কতটুকু সময় ব্যায় করি? প্রতিদিন কতটুকু সময় আমরা চিন্তা করি কিভাবে সৃষ্টিকর্তার এই উপহারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা যায়, কিভাবে একে নিজের এবং মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানো যায়? জীবনের হিসেব বাদ দেই, সে অনেক দীর্ঘ কাহিনী- আমার আজকের এই দিনটি আমি কি ভাল কাজে লাগাতে পারি, আজ কি আমি অন্তত একটি ভাল কাজ করতে পারি কিনা- দিনের শুরুতে এই ভাবনাটুকু কি আমাদের মাথায় আসে? এলে হয়ত আমরা নিজেরাই খুঁজে পেতাম আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য- ঠিক ঐ যুবকটির মত যে বছরের পর বছর হণ্যে হয়ে খুঁজেছে সেই সোনার হরিণ কিন্তু হাল ছাড়েনি, অবশেষে সেই সোনার হরিণ তার হাতেই ধরা দিয়েছে!
No comments:
Post a Comment