আমার একমাত্র খালাশ্বাশুড়ী প্রায়ই খুব দুঃখ করতেন আমরা ঢাকা গেলে আমাদের তাঁর ছোট্ট সরকারী কোয়ার্টারে রাখতে পারতেন না বলে। শততমবার আক্ষেপ করার সময় বলেই ফেললাম, 'খালা, কাউকে রাখার জন্য ঘরে নয়, মনে জায়গা হলেই হয়'। উনি খুশীতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন- এত দীর্ঘ সময় যে আমার মনে হচ্ছিল দমবন্ধ হয়ে মারা যাব! তারপর খালার বাসায় ৭ দিন ছিলাম। আমার দুই ননদসহ ঢালাও বিছানা পেতে সারারাত গল্প, কি যে মজা করেছি! ক’দিন আগে খালা চলে গেলেন, কিন্তু এই স্মৃতি রয়ে গেল আমাদের মাঝে।
আমি তখন ফ্রক পরে ছুটোছুটি করি। একদিন দরজায় বেল বাজতে হুট করে দরজা খুলেই ভড়কে গেলাম। ইয়া লম্বা দু’টো ছেলে দরজায় দাঁড়ানো! বলল, 'খুকী, তোমার আম্মুকে ডাক, আমরা একটু কথা বলব'। মা দরজায় এলে ওদের একজন বলল ওরা অনেক দূর থেকে এসেছে, ঐ এলাকায় প্রায়ই বন্যায় ফসল ভেসে যায়, নিজেদের চলার মত কিছু থাকেনা, কিন্তু ওদের পড়াশোনার খুব শখ। একজন এক বাসায় কথা বলার পর তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আরেকজন এখনো কাউকে খুঁজে পায়নি। মা খানিকক্ষণ কথা বলে ঠিক করে দিল কিছুদিন পর পর এসে সে যেন কয়েকমাসের পড়ার খরচ নিয়ে যায়। সে থেকে ঐ ভাই আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন। তাঁর চাকরী, বিয়ে, সন্তান হয়ে এখন তিনি দেশের বাড়ীতে দোকান দিয়েছেন। আমরা আবুধাবী, ইন্ডিয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম যেখানেই ছিলাম সেখানেই যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। আমার বিয়ের পর, আমার বাচ্চাদের দেখতে আমার ভাইদের মত তিনিও আমার শ্বশুরবাড়ী এসেছেন। ক্যানাডায় আসার আগে আর সব আত্মীয়স্বজনের মত তাঁর সাথেও আমরা দেখা করতে গিয়েছি। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে এক অনবদ্য সম্পর্ক।
এক সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমন হত। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন একসময় ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে গেলে বাবা ফুপুচাচাদের কাছ থেকে বাবার দাদার বাড়ীটি কিনে নেয়। এ’বাড়ীতে থাকাকালীন আমার কত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে হিসেব নেই যারা বাবার দাদীর আমলে এ’বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া করেছে, চাকরী করেছে, বিয়ে করেছে। তাঁরা আসতেন সেই স্মৃতিবিজড়িত বাড়ীটি দেখে যেতে, দেখাতেন কোন রুমে তারা থেকেছেন, লেখাপড়া করেছেন। আমার মাও দাদীশ্বাশুড়ীর মত লোকজনকে সাহায্য করতে পছন্দ করত। একটি মেয়ে একবার আমাদের বাসায় দশদিন কাজ করেছিল। ওর বাবা গ্রামের কাঠমিস্ত্রী। মেয়েটির বিয়ের সময় মা তাবত যা লাগে কাপড়চোপড়, গহনা, ফার্নিচার থেকে থালাবাটি পর্যন্ত সব দিয়েছিল। অনেকেই থাকতেন, চিকিৎসার জন্য এসে আস্তানা গাড়তেন, লেখাপড়ার জন্যও বসবাস করতে মানা ছিলোনা।
বিদেশে বড় হওয়ায় এত লোকজন আমি ঠিক চিনে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কান্ড করে বসতাম। একবার এক লোক এক ছাগল নিয়ে উপস্থিত। ভেবেচিন্তে হিসেব করে ঠিক করলাম উনি নিশ্চয়ই মা’র খালু। মা তখন বাইরে ছিল। তাই, আমি গিয়ে ওনাকে বসালাম, শরবত নাস্তা দিলাম। ওনার সাথে কথা বলতে বলতে কেন যেন মনে হতে লাগল আমার হিসেবে কোথাও গড়বড় হয়ে গেছে। মা’র খালু সবসময় কেতাদুরস্ত থাকতেন, ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরতেন পাম্পসু দিয়ে, চোখে ঝকঝকে পরিস্কার চশমা, হাতে লম্বা কালো ছাতা। এই ভদ্রলোক জুতো পরেননি, লুঙ্গি পাঞ্জাবী ছাগলের সাথে ধস্তাধস্তি করে কাদায় একাকার, চোখের ঘোলাটে চশমার দু’টো কাঁচের একটা ভাঙ্গা, দাঁতে পানের দাগ! মা’র খালু চোস্ত বাংলা বলতেন, আর এই ভদ্রলোক আমার অধিকাংশ কথাই বুঝতে পারছেন না, যা বলছেন চাঁটগাঁইয়াতে বলছেন। আমি চাঁটগাঁইয়াতে কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্তু একটু পর পর আটকে যাচ্ছি। একটু পর মা বাইরে থেকে এসে খুশী হোল যে আমি ওনার যথেষ্ট যত্ন আত্তি করেছি। মা ভেতরে গেলে মাকে বললাম, 'তোমার খালু জুতো পরেনি কেন? ওনার চশমাটাও ভেঙ্গে গেছে! কিন্তু আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে উনি বাংলা ভুলে গেছেন!' মা হাসতে হাসতে বলল, 'উনি তো আমাদের গ্রামের চাষী! উনি আমার খালু হলেন কবে?!'
আমার বাবা এই দিক থেকে আমার চেয়ে আরেকটু উন্নততর ছিল। একদিন ড্রয়িং রুমে এক মেহমান বসা যাকে আগে বা পরে আর কখনো দেখিনি। আমরা ভাইবোন খুব হাসিহাসি মুখ করে ওনার গল্প শুনছি যদিও কোন রেফারেন্সই আমাদের কাছে পরিস্কার না। একটু পর কাকভেজা হয়ে বাবা বাসায় ঢুকলো। মটরসাইকেল নিয়ে গ্রামে গেছিল। আসার পথে বৃষ্টির কবলে পড়েছে। এসেই ভদ্রলোকের সাথে হ্যান্ডশেক করে বাড়ীর সবার খবর নিয়ে বলল, 'বদ্দা, আমি পুরো ভিজে গেছি। আপনি একটু বসুন, আমি কাপড় বদলে আসি'। ঐ ভদ্রলোক সোৎসাহে বললেন, 'জ্বী, আপনি কাপড় বদলে আসেন, তারপর গল্প করব'। মা কাপড় দিতে ভেতরে এলে বাবা জিজ্ঞেস করল, 'উনি কে?' আমি তো থ! বললাম, 'বাবা, তুমি না চিনলে এত কথা বললে যে?' বাবা বলল, 'আমি চিনতে পারিনি বুঝতে পারলে উনি মনে কষ্ট পেতেন না?' এই পদ্ধতি আমি যে কতবার ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সবসময় সফল হতে পারিনি।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ী এসেও দেখলাম একই ব্যবস্থা। অনেক লোক এ’বাসায় থেকে লেখাপড়া, চাকরী, বিয়ে করেছে। একজন কাকা তো আমাদের পরিবারের একজন হয়ে থেকে গেছেন। ওনার বিয়েতে আমরা সবাই মহাধুমধাম করে বরিশাল গেলাম, সে প্রথম সবাই একসাথে! উনি থাকলে আমাদের চিন্তা করতে হয়না বাসায় কোন সমস্যা হলে কে দেখবে।
কিন্তু আজকাল এসব চল ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘরের আয়তন বেড়েছে, কিন্তু কমে গেছে মনের প্রসারতা। এই সুদৃশ্য বিল্ডিংয়ের সুসজ্জিত খোপগুলোতে এখন দুইভাইবোনেরই একরুমে জায়গা হয়না, গ্রামের আনকালচারড আত্মীয়স্বজনের জায়গা হবে কোথা থেকে? এত দামী দামী জিনিসের মাঝে কোথায় যেন আমাদের আত্মাটা হারিয়ে গেছে। জিনিস খোয়া যাবে বলে আমরা কাউকে বাসায় জায়গা দেয়ার ভরসা করতে পারিনা, বিপদেও না। বাসার ফার্নিচারে দাগ পড়বে দেখে তাদের জন্য আলাদা চেয়ারের ব্যবস্থা যেন তারা ঐখান থেকেই দূর হয়ে যান। নিজেদের জন্য সুদৃশ্য সুবিশাল খাট, অথচ যে মেয়েটি দিনরাত আমাদের সেবা করে তার ক্লান্ত শরীরটি রাতের বেলা এলিয়ে দেবার জন্য একটি ভালো বিছানা আমরা কেনার সামর্থ্য রাখিনা।
এত ধনসম্পদের পাহাড় গড়তে গড়তে আমরা মানবতা হারিয়ে তাদের রোষানলে পড়ি যারা একবেলা খেতে পায়না, একটুকরো পরনের কাপড়ের জন্য কাঁদে। চায়ের কাপে ধোঁয়া তুলি আমাদের দেশের দরিদ্র লোকগুলোর জ্বালায় পথ চলা মুস্কিল হয়ে যাচ্ছে, এই লোকগুলোর একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। কিন্তু আমার সম্পদের একাংশও আমি তাদের জন্য খরচ করতে নারাজ। অথচ বুঝিনা, আজ যদি আমি তার অভাবে সাড়া দেই, কাল আমার সম্পদের নিরাপত্তার জন্য আমায় ভাবতে হবেনা, আজ যদি আমি তার একটা কাজের ব্যাবস্থা করি কাল সে আমার সাহায্যের মুখাপেক্ষী থাকবেনা, আজ যদি আমি তার প্রতি একটু মানবতা দেখাই কাল আমার ভাইবন্ধুর অভাব হবেনা। আসলে কি একটি জীবন পার করার জন্য কারো এত ধনসম্পদ ঐশ্বর্য প্রয়োজন হয়? আমার মেয়ের বিয়েতে আমার বাহুল্য যদি টাকার অভাবে বিয়ে না হওয়া কাজের মেয়েটির দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয় তাহলে আমার মেয়ে কি আসলে সুখী হবে? আরেকজনের ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে যদি আমরা একটি পরিবারকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি, দেশের উন্নয়নে কিছু অবদান কি রাখা সম্ভব হবেনা? একজন অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা সহযোগিতা দিয়ে সারিয়ে তোলা গেলে সমাজে একটি পরিবারের ভার কি লাঘব হবেনা?
একবার রোজার দিনে কাজের চাপে ইফতারের জন্য বাসায় যাওয়া সম্ভব হোলনা। পারলে হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের মাথা চিবিয়ে খাই। ঐ উদ্দেশ্য নিয়েই রুমের বাইরে বেরিয়েছি, দেখি উনি চেক করতে যাচ্ছেন দারোয়ান সিঁড়ির বাতি জ্বালায়নি কেন। অস্পষ্ট শুনতে পেলাম দারোয়ানকে অনেকক্ষণ তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বকা দেয়ার পর সে আমতা আমতা করে বলল, 'স্যার, একহাজার টাকা বেতন পাই, ঘরে এতগুলো মানুষ। আমি যদি বাইরে ইফতার কিনে খাই তাহলে সংসার চালাব কেমন করে? ইফতারে আমি শুধু পানি খাই, কেউ দেখবে বলে সিঁড়ির বাতি জ্বালাইনা'। সন্ধ্যা হয় হয়। ঐ আবছা আলোয় হেড চোরের মত একখানা পাঁচশ টাকার নোট বের করে দারোয়ানের হাতে গুঁজে দিয়ে চকিতে দেখে নিলেন কেউ দেখে ফেলল কি’না, তারপর অসম্ভব মোলায়েম স্বরে বললেন, 'টাকা শেষ হয়ে গেলে আবার আমার থেকে নিয়ে নিয়ো, সারাদিন রোজা রেখে না খেয়ে থেকোনা'। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। আমি তাড়াতাড়ি সরে গেলাম। মনে হোল, উনি যতই চিল্লাচিল্লি করুক, আর কখনো ওনার সাথে রাগারাগি করবনা।
আমরা কি চাইনা মৃত্যুর পর কারো স্মৃতিতে জ্বাজল্যমান হয়ে থাকতে যেন কেউ বলে, 'আহারে! মানুষটার একটা সুন্দর মন ছিল!' সম্পদ গড়ার পেছনে জীবন ব্যয় করে ফেললেও শেষপর্যন্ত ঐ সম্পদের কোন অংশই আমরা সাথে নিয়ে যেতে পারিনা। কিন্তু একটু হাসি, একটু সুন্দর কথা, একটু সান্তনা, একটু সাহস, একটু সহমর্মিতা, একটু সাহায্য দিয়ে গড়ে তোলা যায় আজীবন সম্পর্ক যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে ওপাড়ে চলে যাবার পরও। সেটাই হোক প্রচেষ্টা।
No comments:
Post a Comment