Sunday, December 9, 2012

নূসরাতের সাথে তিনটি দিন

আমার কেন যেন মনে হয় মানুষের জীবনগুলো ছোটবড় রঙবেরঙের সতত সঞ্চারমান বৃত্তের মত। সন্তরণশীলতার একেক পর্যায়ে এরা কখনো কখনো পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে, নিজের রঙের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে যায় একে অপরের গায়ে, আবার কখনো এক বৃত্ত অপর বৃত্তের সাথে জুড়ে যায় জীবনের মত। কখনো বা কয়েকটি বৃত্ত পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় একেকটি মহাবৃত্ত। আবার একই বৃত্ত বেশ কয়েকটি মহাবৃত্তের অংশ হতে পারে। সব মিলিয়ে বেশ মজার ইকুয়েশন!




কাহিনীর শুরু ব্লগার মনপবনের বিয়ে দিয়ে। বিয়েতে আমি ছিলাম মেয়েপক্ষ। মেয়ে বাংলাদেশে আর আমি ক্যানাডাতে, মেয়েকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি, কিন্তু মনের মিল হলে রক্ত সম্পর্ক ছাড়াই বোন বানিয়ে নেয়া যায়। ব্লগার নূসরাত রহমান ছিল মনপবনের সহপাঠিনী। নূসরাত আর ওর স্বামী পি এইচ ডির ছাত্রছাত্রী, অ্যামেরিকায় পড়াশোনা করছে। মনপবনের বিয়ের পর দেশে বেড়াতে গিয়ে বৌয়ের মুখে আমার গল্প শুনে এসে নূসরাত আমাকে যোগাযোগ করে। সেটা ২০১০ সালের কথা। ওরা স্কলারশিপের স্বল্প পরিমাণ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়েছে আইলা দুর্গতদের জন্য। জানতে চায় আমার পরিচিত কেউ আছে কিনা যে ঐ এলাকায় টাকাটা এমনভাবে বিলি করার ব্যাবস্থা করতে পারে যাতে মাত্র কয়েকটি পরিবারকে সাহায্য করা সম্ভব হলেও যে পরিবারে সহযোগিতা দেয়া হবে তাদের যেন আর কখনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়। যথাসম্ভব সহযোগিতা করলাম। এই প্রক্রিয়ায় ওর সাথে পরিচয়। পরিচিত হয়ে আমার ভীষণ ভাল লাগল যে ওরা বিদেশে থেকেও দেশের মানুষগুলোর জন্য ভাবে, অনুভব করে, কিছু করতে সচেষ্ট হয় যদিও সামর্থ্য হয়ত এখনো সীমিত।

কাজ শেষ হয়ে গেলেও ফেসবুক আর ইমেলে সম্পর্ক অগ্রসর হতে থাকে। আপনি থেকে তুমি, ফর্মাল থেকে ইনফর্মাল, কাজের কথা থেকে ব্যাক্তিগত কথাবার্তা। জ্ঞানের পথের অগ্রপথিকদের আমি শ্রদ্ধা করি, আরো বেশি সম্মানবোধ কাজ করে তাদের জন্য যারা নিজের যা কিছু আছে তাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে মানবতার কল্যাণের জন্য, যারা অপেক্ষা করে থাকেনা এমন কোন অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতের জন্য যা বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই, বরং আজকের দিনটিকেই বেছে নেয় সমস্ত ভাল কাজের জন্য। ফেসবুকে নূসরাতের দু’একটা লেখালেখি দেখে বললাম এই লেখা ব্লগে দিলে আরো বেশি পাঠক উপকৃত হতে পারেন। ব্লগে লেখা শুরু করল নূসরাত। ব্যাস, আমরা বনে গেলাম ব্লগবন্ধুও!

এ’বছর জুনের ২৬ তারিখ নূসরাত কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে জানালো ঈদের পর পর ব্যানফে একটা কনফারেন্সে যাবে। শুনেই তো আমার মাথা খারাপ! ব্যানফ ক্যাল্গেরীর পাশের শহর, দেড়ঘন্টার পথ, যেতেও হবে ক্যাল্গেরি এয়ারপোর্ট হয়েই। সাথে সাথে বললাম কনফারেন্সের পর আমার বাসায় ক’দিন থেকে যেতে হবে, তখন নাহয় মেসেজের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করব।

নূসরাত প্রথমদিকে কি ভাবছিল জানিনা কিন্তু পরে রাজী হয়ে গেল, ভিসার ব্যাবস্থা করল আর যতই দিন যেতে লাগল সেও দেখা হবার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। রোজার সময়টা তেমন বিশেষ যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি নানান ব্যাস্ততায়। ঈদের পর পরই একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে দেখি নূসরাত! ব্যানফ থেকে ফোন করেছে!

যে মানুষটার চেহারা দেখিনি কখনো অথচ ভালবেসেছি আপন বোনের মতই, তার গলা শুনলাম প্রথমবারের মত। কি কি যে কথা বলেছি তার ঠিক নেই, কিন্তু আধঘন্টার আলাপে কিছুই যে বাদ পড়েনি তা নিশ্চিত। জিজ্ঞেস করলাম ব্যানফ গিয়ে নিয়ে আসব কিনা, বলল, ‘না আপু, আমরা নিজেরাই চলে আসতে পারব’। বললাম, ‘তাহলে তোমরা বাস থেকে নেমে ট্রেনে আমার এলাকার স্টেশনে চলে এস। স্টেশন বাসার সামনেই, আমি গিয়ে নিয়ে আসব’, বলল, ‘না আপু, আমরা নিজেরাই চলে আসতে পারব’।

সাতাশ তারিখ যখন ওর আসতে দেরি হচ্ছে হাফিজ সাহেব আর আমি টেনশনে অস্থির; যে কাজ আমার কখনো হয়না তাই হোল, মনের ভুলে হাত কেটে ফেললাম; মনে মনে ওকে বকা দিচ্ছি, ‘বেশি কাবিল, বললাম স্টেশনে গিয়ে নিয়ে আসি, নিশ্চয়ই পথ খুঁজে পাচ্ছেনা!’ সাড়ে ছ’টার পরিবর্তে সাড়ে আটটায় আমার বাসায় বেল বাজল, দরজা খুলে দেখি ওরা উপস্থিত!

বকা দেব কি, ওদের মায়া মায়া চেহারাগুলো দেখে সমস্ত উদ্বেগ মূহূর্তে উবে গেল। ওর স্বামী শামস বেচারা হাইকিং করতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি ওদের ঘরে ঢুকিয়ে আরামের ব্যাবস্থা করলাম। বেডরুম দেখে নূসরাত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘বাহ! এ তো দেখি হোটেলের চেয়েও চমৎকার!’ তখন হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। বিয়ের চৌদ্দ বছরে আমরা কোন নতুন ফার্নিচার কিনিনি, এতেই এত প্রশংসা করার মত মন যার আছে তাকে নিয়ে তিনটি দিন ভালই কাটবে!

মাগরিবের সময় হয়ে এসেছিল। নূসরাত দেখি দ্রুত ওজু করে পাশে এসে হাজির, একসাথে নামাজ পড়বে। পুত্র মেহমান দেখে খুশিতে লাফাচ্ছে, আমাদের পেছনে বিছানায় প্রলয়নাচন চলছে, আমি মহাবিরক্ত, আর নূসরাত কি করল? নামাজ শেষ করেই আমার বাঁদর ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিল।

ঈদের খাবার, ঈদের পরের কিছু রান্না আর ওদের আসা উপলক্ষ্যে যা রান্না করেছিলাম তাই দিয়ে রাতের খাবার ব্যাবস্থা করলাম। খাবার টেবিলে বসে বুঝলাম ওরা দু’জনেই এত একহারা কেন, যা দিয়েছিলাম প্রায় সবই মনে হয় রয়ে গেল। শামস খুব কম কথা বলে। কিন্তু দু’টো কথা এমনভাবে বলল যে মনে হোল আমার ভাইটিই যেন আমার বাসায় এসেছে। প্রথমেই বলল, ‘আপু, আপনি নূসরাতকে যেমন নিজের বোন মনে করেন সেভাবে আমাকে কি ছোটভাই মনে করে নেয়া যায়না? আপনি আমাকে তুমি বলবেন’। তারপর মুরগীর মাংস খেয়ে বলল, ‘মনে হয় যেন অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি, আমার মা ঠিক এভাবেই মুরগী রান্না করেন’। চোখে পানি এনে দিল ছেলেটা, আমি নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারিনা, কিন্তু অনুভব করতে পারলাম যারা বাইরে থাকে তারা একটু স্নেহের জন্য কতটা কাতর থাকে।

আমাদের প্ল্যান ছিল ওরা সাড়ে ছ’টায় এসে পৌঁছলে ওদের কক্রেনে হাতে বানানো আইসক্রীম খেতে নিয়ে যাব। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর এত দেরী হয়ে গেছে যে এই প্ল্যান আর সম্ভব নয়। হাফিজ সাহেব তখন বললেন, ‘চল, ওদের ক্যাল্গেরী ঘুরিয়ে দেখাই’। ওদের আসা উপলক্ষ্যে উনি সেদিন ছুটি নিয়েছিলেন। ক্যাল্গেরীর বিভিন্ন প্রধান সড়ক এবং দর্শনীয় স্থানগুলো আমরা সবাই গাড়ীতে করে ঘুরে দেখতে বেরোলাম। সেদিন ছিল প্রচন্ড গরম। পথে এক বন্ধুর বাসা থেকে ঠান্ডা কোমল পানীয় সংগ্রহ করা হোল। তারপর নিয়ে গেলাম বান্ধবী ব্লগার সুলতানার বাসায়। সুলতানা অনেক আগে থেকেই আটাশ তারিখ নূসরাতকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছে- কিন্ত ওর আগমন উপলক্ষ্যে বেচারী এত এক্সাইটেড যে সকাল থেকেই ফোন করছে এখন কি করছি, ওরা কবে আসবে, ওরা এলো কিনা, ওদের কবে ওর বাসায় নিয়ে যাব, ওরা এখন কি করছে- তাই ভাবলাম ওদের দু’মিনিটের জন্য নিয়ে গিয়ে বেচারীর কালিজাটা ঠান্ডা করার ব্যাবস্থা করি। যখন সুলতানার বাসায় বেল দিলাম তখন সে ব্লগে বিচরণ করছে। আমাদের দেখে কি করবে না কি করবে অস্থির হয়ে পড়ল। পরে এদের ক্যাল্গেরী দর্শন অসমাপ্ত রয়ে যাবে, আগামীকাল তো ওরা আসছেই ইত্যাদি বলে সুলতানাকে নিরস্ত করা গেল।

বাসায় ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত চারজনে গল্প করলাম। বিভিন্ন ব্লগারের গল্প, ব্লগের গল্প, বাংলাদেশের গল্প। হঠাৎ খেয়াল হোল শামসের তো সকালে ভিসার জন্য এম্বাসীতে যাবার কথা। তখন সভাভঙ্গ করে ওদের ঘুমাতে পাঠালাম। রাতে হাফিজ সাহেব ওদের জন্য মিষ্টি বানালেন, কিন্তু ক্লান্তির কারণে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়ায় মিষ্টি পোড়া লেগে গেল।

সকালে ওদের নাস্তা দিতে উঠে দেখি নূসরাত আমার পেছন পেছন চলে এসেছে রান্নাঘরে। ওর একটা শর্তই ছিল মেহমানের মত ট্রিট করা যাবেনা। কি আর করা? দিলাম ডিম ভাজতে। সে ফাঁকে রিহামকে তুলে, রেডী করে স্কুলে দিয়ে এলাম। এসে দেখি নূসরাত সেই পোড়া মিষ্টি মহাযত্নে তুলে তুলে রাখছে। পরের দু’দিন এই মিষ্টি যে কি মজা করে খেয়েছে বেচারী! ঈদে বানানো ভাল মিষ্টিও ছিল, কিন্তু এটা নাকি আরো বেশি মজা! ওর স্বামীর পছন্দ বুন্দিয়া, সুলতানার তৈরী বুন্দিয়া ছিল ফ্রিজে, তাই দু’জনকেই খুশী করা সম্ভব হোল।

শামস এম্বাসীতে চলে গেলে আমরা দু’জন গল্প করতে বসলাম। পরস্পরের পরিবার সম্পর্কে জানা, জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা, মূলত পরস্পরকে বোঝার প্রয়াস। রান্নাবাড়া কিছু হোলনা। কেবল একটা ডাল করলাম শুটকী দিয়ে, চট্টগ্রামের স্থানীয় তরকারী যা ওরা কোনদিন খায়নি। পরে ভাবলাম এই তরকারী খাওয়ার সাথে অভ্যস্ততার একটা ব্যাপার আছে, আদৌ খেতে পারবে কিনা। কিন্তু খাবার টেবিলে বসে যখন দেখলাম দু’জনেই খুব আগ্রহ করে খেল তখন মজা পেলাম, আমার মেহমান এত উদারহৃদয় যে ওদের খাওয়া নিয়ে আমার কোন টেনশনই নেই!

বিকালে সুলতানার বাসায় দাওয়াত কিন্তু হাফিজ সাহেব কাজ থেকে ফিরে আমাদের নিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা তিনবন্ধু সবসময় সবকিছু একসাথে করি- ইফতেখার ভাই, সুলতানা আর আমরা। দু’জনের সাথে নূসরাতের আগেই পরিচয় ছিল, দাওয়াতে ইফতেখার ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হয়ে গেল। সুলতানার বাগানে অ্যাপল গাছ থেকে অ্যাপল পেড়ে খাওয়া, বারান্দায় বসে গল্প করা, আর তারপর ওর যাদুর হাতের রান্না খাওয়া! বেশ মজার একটা সময় কাটল। বেচারী সুলতানা চেয়েছিল নূসরাতের আসা উপলক্ষ্যে ছুটি নিতে যেন মন ভরে গল্প করতে পারে। ছুটি না পাওয়ায় আমি কিছুক্ষণের জন্য ওদের নিবিড়ভাবে গল্প করার সুযোগ দিয়ে একপাশে সরে গেলাম।

তবে অতটা ভাল মানুষ আমি নই যে সময়টুকু পুষিয়ে নেবনা। বাসায় ফিরে নূসরাত আর শামস দু’জনের সাথেই শুরু হোল গল্প। ওদের বিয়ের গল্প, বাল্টিমোরে ওদের বন্ধুদের গল্প, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওদের চিন্তাভাবনার গল্প। একপর্যায়ে দেখলাম আমার মতই শামসের পড়ার খুব শখ, সাহিত্যের প্রতি অশেষ আগ্রহ। রাশিয়া থেকে রোম, মডার্ন থেকে প্রাচীন সাহিত্য, দুই বাংলার সাহিত্য সব চষে ফেললাম কিছুক্ষণের ভেতরেই। তাই তো বলি সে এত সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাষায় কথা বলা শিখল কিভাবে! বললাম ওর লেখালেখি শুরু করা উচিত। তারপর ওকে ঘুমাতে পাঠিয়ে নূসরাতের সাথে গল্পে বসে পড়লাম। শামস যাবার পরই দেখি রাদিয়া চিরুনী নিয়ে এসে হাজির। কোন ফাঁকে যে নূসরাত ওর সাথে এত বন্ধুত্ব করে ফেলেছে বুঝলাম না। কিন্তু সে মহা আগ্রহে কন্যার চুল আঁচড়ে বেণী করে দিচ্ছে আর বলছে ওকে দেখলে নিজের ছোট বোনটার কথা মনে হয়! ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শামসের খুব মন খারাপ ছিল, তাই নূসরাতকে বেশিক্ষণ আটকে রাখলাম না। ওকে বললাম পরামর্শ করে একটা উপায় নির্ধারণ করতে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু পরদিন ব্লগে ওর ‘সেলফ এস্টিমঃ পর্ব ৫’ দেখে বুঝলাম ও নিজের সমস্যার চাইতে বরং জনগণের সমস্যার সমাধান করতে ব্যাস্ত ছিল।

পরদিন আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা ছিল, নূসরাতদের হিসেবে অতিরিক্ত ঠান্ডা। আগের ক’দিন খাবার মেন্যু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি যেন পেটের ওপর চাপ না যায় কারণ ভ্রমণের সময় অতিরিক্ত বা তৈলসম্বৃদ্ধ খাবারে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। আজ ভাল আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে সামান্য রান্না করলাম ওদের জন্য। নূসরাত কিছুতেই আমাকে একা কাজ করতে দেবেনা। পেঁয়াজ কাটা, সব্জী কাটা সব করতে চায়, নিজেও একটা কিছু রান্না করতে চায়। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে কাজ করতে দিলাম, আর সেই সাথে চলল মজার মজার গল্প। দুপুরে হাফিজ সাহেবকে লাগিয়ে দিলাম বারবিকিউ করতে। যখন খেতে বসলাম তখন টেবিলে পোলাও, বারবিকিউ, মুরগীর তরকারী, মুড়োঘন্ট, সব্জীভাজি, রাদিয়ার ডিম তরকারী আর নূসরাতের স্পেশাল বেগুনভাজি মিলে মজাদার আয়োজন। প্রশংসায় পারদর্শী শামস বলল এটা ওর জীবনে খাওয়া সেরা বারবিকিউগুলোর একটি। কিন্তু সবার আগে শেষ হয়ে গেল নূসরাতের বেগুনভাজি। খাবার পর সবারই চোখে লেগে এলো। বিকেলে আমার বাসায় সবাই ঘুম!

সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি। বহুদিন পর আবহাওয়া একটু আরামদায়ক মনে হচ্ছে। নূসরাত এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এই আবহাওয়া আপনার আরামদায়ক মনে হচ্ছে?’ তখন বুঝতে পারলাম আমাদের শরীর কিভাবে এই আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে যেটা আমার আরামদায়ক মনে হচ্ছে সেটা নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল থেকে এসে নূসরাতের প্রচন্ড শীতল মনে হচ্ছে। মাগরিবের নামাজের পর ও নতুন জামা পরে এলো ছবি তোলার জন্য। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এলেন। আবার সবাই মিলে জম্পেস গল্প। হাফিজ সাহেব চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ চলল মজার গল্প যদিও পরদিন সকালে নূসরাতের ফ্লাইট। মাঝখানে লালবৃত্তকে নেটে পেলাম কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু নূসরাত চলে যাবে শুনে সে আর আলাপ দীর্ঘায়িত করল না। আমার চারপাশে এত সেলফ স্যাক্রিফাইসিং মানুষ যে এদের দেখলে আমার আশা জাগে এই পৃথিবীটাতে এখনো ভাল কিছু হবার সম্ভাবনা আছে। গল্প শেষ হোল রাত দেড়টায়।

ভোরে নামায পড়ার জন্য উঠিয়ে দিলাম ওদের। সামান্য একটু নাস্তার আয়োজন করে রিহামকে স্কুলে পাঠাবার জন্য রেডী করতে চলে যেতে হোল ওপরতলায়। আমার বাসায় শেষবার ওরা কি খেল না খেল খেয়াল করতে পারলাম না। নিজে রেডি হবার সময় কি মনে করে যেন নূসরাতের দেয়া স্কার্ফটা পরলাম। বেচারি ছাত্রীমানুষ,অথচ হাফিজ সাহেবের জন্য শার্ট, আমার জন্য স্কার্ফ আর বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছে। বকা যা দিলাম সব নিরবে হজম করল, কিন্তু মোটেও লজ্জিত মনে হোলনা ওকে।

সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। স্কার্ফটা পরতে দেখে এত খুশি হোল বেচারী! রিহামকে স্কুলে দিয়ে ওদের নিয়ে রওয়ানা হলাম এয়ারপোর্টে। যখন ওরা গাড়ী থেকে নেমে গেল, মনে হোল যেন আমার অতি আপন কেউ এসেছিল, কয়েকটা দিন রাঙিয়ে দিয়েছিল ওদের আপন আপন রঙে, আবার বৃত্তগুলো সঞ্চারমান হয়ে গেল আপন আপন পথে, কিন্তু এই রঙগুলো স্থায়ী হয়ে গেল আমার বৃত্তে, একটু পর পর চমকে চমকে ঝিলমিল করে উঠছে সে রঙ!

No comments:

Post a Comment