এক দাওয়াতে উপস্থিত নারীগোষ্ঠির কথোপকথনের এক পর্যায়ে একজন বললেন, ‘কাল আমাদের দোকানে এক বাংলাদেশী পরিবার এসে অনেক কেনাকাটা করে নিয়ে গেল’। শুনে আরেকজন অত্যন্ত উৎসাহের সাথে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি পরিচয় দেননি যে আপনি বাংলাদেশী?’ তিনি নাক কুঁচকে বললেন, ‘নাহ! কি বলব? ‘আমি বাংলাদেশী’? কেমন ক্ষেত ক্ষেত লাগে!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাওয়াতে উপস্থিতির বিরক্তির মত এটাও গলাধঃকরণ করলাম। জীবনের অর্ধেকের বেশি দেশের বাইরে থেকেও আমি আমার গায়ে ক্ষেতের গন্ধটা বড় উপভোগ করি, কোথাও কাউকে ফোনে বাংলা বলতে শুনলেও দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলি, CELTA ক্লাস নিতে গিয়ে একজন বাংলাদেশী ছাত্র পেয়ে আমার সেকি আনন্দ! অথচ আমাদের এই ‘দেশী’ ভাইবোনরা গ্রাম থেকে ক্যানাডা এসে কয়েকমাসের ভেতর ক্ষেতের গন্ধ ঝেড়ে ফেলেন এমনভাবে যে তাতে পাকা ধানের সুঘ্রান, আমের বোলের সুবাস, ঘাসফুলের মাতাল করা গন্ধ সব এক ঝটকায় দূর হয়ে যায়। পরিচয় না দিলে তাদের পোশাক আশাক চালচলন থেকে কথাবার্তায় চেনার কোন উপায় থাকেনা যে তারা বাংলাদেশী। আর পরিচয় তারা দেননা।
এই যেমন ক’দিন আগে এক দু’আ মাহফিলে এক মহিলাকে দেখে বান্ধবী তানজিন (ব্লগার সুলতানা) বলল, ‘এই মহিলা তো অমুক দোকানে কাজ করেন, যেখানে অফিসের ফাঁকে আপনি আপনার চাইনীজ বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন, যেখান থেকে আমি নিয়মিত আমার বাচ্চাদের কাপড় কিনতাম। কতবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘আপনি কি বাংলাদেশী?’ উনি গা ঝাড়া দিয়ে বলতেন, ‘No, I’m Indian!’ উনি মিথ্যা বললেন কেন?’ সরল সহজ বান্ধবীটিকে বোঝাতে পারলাম না এক্ষেত্রে নীরবতা পালনই শ্রেষ্ঠ পন্থা, উনি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি বাংলাদেশী?’ সবার সামনে উনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। তখন তানজিন বলল, ‘রেহনুমা, এই মহিলা হাতাকাটা টিশার্ট আর টাইট জিন্স পরে দোকানে কাজ করেন, আর এখানে তিনি একেবারে মাথায় স্কার্ফ বেঁধে চলে এসেছেন! আমার সাথে এই কপটতা করে ওনার কি লাভ? উনি আমাকে সত্য বললে ওনার কি ক্ষতি হত?’ কি উত্তর দেব বেচারীকে? এই একই প্রশ্ন তো আমারও! গতকাল এই প্রশ্ন আবার উত্থাপন করলেন আমার এক ছাত্রীর মা। তাকে বললাম, ‘আসলে আমি নিজেই বুঝিনা, হয়ত যেহেতু আমি নিজেই মাটির টান উপেক্ষা করতে পারিনা তাই। কিন্তু যখন দেখি ক্যানাডিয়ানরা আট দশ পুরুষ আগে ইউরোপের মাটি থেকে উপড়ে আসা দাদা পর দাদাদের কথা বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, ‘আমি অর্ধেক ফ্রেঞ্চ এক চতুর্থাংশ জার্মান, এক চতুর্থাংশ হাঙ্গেরিয়ান ক্যানাডিয়ান। আমার অষ্টম পুরুষে দাদা দাদী ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন, নানা ছিলেন জার্মান এবং নানু ছিলেন হাঙ্গেরি থেকে আগত রিফিউজি’, তখন চিন্তা করি আমাদের কেন এক পুরুষ পেরোবার আগেই শেকড় কেটে দেয়ার এত তাড়া? আর শেকড়বিচ্ছিন্ন হলে আমাদের সন্তানরা কিভাবে তাদের পরিচয় দেবে? জানিনা। একুশে ফেব্রুয়ারী আর পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরে গান গেয়ে বছরের বাকী দিনগুলো জিন্স আর টিশার্ট পরে ইংরেজী চর্চা করলেই কি আমরা স্বদেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করে ফেলতে পারব না ক্ষেতের গন্ধ মুছে ফেলে পুরোদস্তুর ক্যানাডিয়ান হয়ে যেতে পারব? এদেরই ছেলেমেয়েরা বলে, ‘I hate Bangladesh’, এরাই বাংলাদেশের আলোহাওয়া গন্ধ লোকজন সব অপাংক্তেয় ভাবে। ওরা rice খায়, grocery করে, mallএ যায় আর দেশের সব আত্মীয়স্বজনকে uneducated unsophisticated brutes মনে করে কারণ ওরা English বলতে পারেনা। পাশাপাশি আমরা যারা এখনো ভাত খাই, বাজার করি, বাজারে যাই এবং নির্দিষ্ট দিনগুলো ছাড়াও বাংলা বলি তারাও তাদের কাছে ক্ষেত। ক’দিন আগে এক ভাই দুঃখ করে বললেন, ‘বুঝলেন ভাবী, আমি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম ক্যানাডিয়ানদের মধ্যেও স্বজনপ্রীতি আছে!’ আমি ওনার আশ্চর্য হওয়া দেখে আশ্চর্য হলাম! শত শত বছর ধরে পৃথিবীব্যাপী শুধুমাত্র শ্বেতচর্মকে পুঁজি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন গান্ধী আর ম্যান্ডেলারা? কাদের বিরুদ্ধে এখনো লড়ে চলেছে কৃষ্ণচর্ম, হিস্পানিক থেকে বাকী বিশ্বের লোকজন? তাহলে ওদের দেবতা মনে করার কি কারণ থাকতে পারে? ওদের সাথে আমাদের সম্পর্ক একটাই- আমাদের দেশে খাবারের অভাব, ওদের দেশে লোকবলের অভাব- আমরা ওদের প্রয়োজন পূরণ করব, ওরা আমাদের প্রয়োজন পূরণ করবে। ওরা কখনো আমাদের buddy হবেনা, আমরা কখনো ওদের friend হবনা। সুতরাং, আমরা যতই শেকড় কেটে মাটির গন্ধটা দূর করার চেষ্টা করিনা কেন তাতে আমাদের একুল ওকুল দুকুল যাবে, এছাড়া আর কোন লাভ হবেনা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল, এখানকার সংস্কৃতির সাথে মিলে যাবার জন্য এখানে সরকারের দিক থেকে কোন চাপ নেই। দিব্যি মেয়েরা লম্বা কালো বোরকা পরে ব্যাঙ্কে অফিসে ডেকায়ারে কাজ করছে; শিখরা মাথায় বিশাল পাগড়ী বেঁধে অফিসে যাচ্ছে, দোকানে কাজ করছে; সালোয়ার কামিজ পরা মহিলারা সরকারী অফিসে কাজ করছে। যেকোন সময় মলে গেলে এক জায়গায় অন্তত জনা বিশেক হিজাবপরা মহিলা দেখতে পাওয়া যায়- সেলসম্যান এবং ক্রেতা উভয় গ্রুপে। প্রচুর শ্বেতচর্ম ক্যানাডিয়ান আছে যারা মদ এবং শুকরের মাংস স্পর্শ করেনা, নারীপুরুষ হ্যান্ডশেক করেনা, মেয়েরা আদিকালের মত হাতেবোনা লম্বা ম্যাক্সি আর স্কার্ফ পরে চলে- কিন্তু অনেক বাংলাদেশী আছেন যারা এসব restrictions মেনে চলাকে ক্ষেত মনে করেন। এখানে শিখ মহিলারা সালোয়ার কামিজের সাথে মাথায় বিশাল ওড়না দিয়ে সর্বত্র চলাফেরা করে- কাজ থেকে বাজার, সর্বত্র; আরবী মহিলারা বোরকা পরে বিরাট বিরাট গাড়ি চালায়; আফগান মহিলারা নিকাব দিয়ে পাঁচছ’টা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একাই বাজার সাজার সারে; সোমালী মহিলারা তাদের ট্রেডিশনাল রংবেরঙের জামা পরে প্রজাপ্রতির মত অফিস বিল্ডিংগুলো রাঙ্গিয়ে দেয়। সমস্যা কেবল আমাদের, আমরাই কেবল identity crisisএ ভুগি যেন কেউ বুঝতে না পারে আমরা বাংলাদেশী, যদিও আমাদের চামড়া যত ফর্সা হোক না কেন ওদের চোখে আমরা ‘কালোচামড়া’ ছাড়া আর কিছুই নই, হওয়া সম্ভবও নয়। আমার যেটা দুঃখ লাগে তা হোল আমরা কেন ওদের কাছ থেকে এই জিনিসগুলো নিতে পারিনা যে ওরা অসম্ভব ভদ্র, ওরা পরিচিত অপরিচিত সবার সাথে হেসে কথা বলে, ওরা যেকোন দরজা খুললে পরবর্তী অন্তত আধাডজন মানুষের জন্য দরজা খুলে ধরে রাখে, যেকোন জায়গা দেখিয়ে দিতে বললে নিজের কাজ বাদ দিয়ে ঐ জায়গা পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসে, বরফের ভেতর উলটো পথে ঘুরে আপনার বাজার আপনার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে যায় যদিও সে কোনদিন আপনাকে দেখেনি বা চেনেনা... । আমরা কেবল তাদের টাইট জিন্স, মিনি স্কার্ট আর ক্ষুদ্র টপটাই দেখি কিন্তু বুঝিনা এটা তাদের জন্য choice নয় availabilityর ব্যাপার, cultureএর প্রশ্ন- তাই দেখা যায় মাইক্রোমিনিস্কার্ট পরা মেয়েটা ট্রেনে সম্পূর্ণ পথ দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু পাশে খালি সীটটাতে কোন অপরিচিত পুরুষের পাশে বসেনা, সর্বত্র মেয়েগুলো জামাকাপড় একটু পর পর একবার নীচে একবার ওপরে টানাটানি করে অস্বস্তি জানান দেয়, কিন্তু তাদের সামনে আর কোন বিকল্প নেই এবং বিকল্প পেলে ওরা তাকে গ্রহণ করতে এক মূহূর্তের জন্যও দ্বিধা করেনা। আমি ইন্ডিয়াতে থাকাকালীন বা চট্টগ্রামেও দেখেছি এরা কত দ্রুত সালোয়ার কামিজের সুন্দর কালেকশন গড়ে তোলে। আর আমরা সুযোগ পেলেই নিজের শেকড় উপরে ফেলে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকি! হা কপাল! বিদেশে মানুষ নানাকারণেই থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়, (আমার প্রবাস জীবন) অনেকে হয়ত সারাজীবনই থেকে যেতে বাধ্য হন। একসময় তারা সেদেশের অধিবাসী হয়ে যান এমন ইতিহাসে অনেকেই হয়েছে। যেমন আমাদের রাসূল (সা.) স্বয়ং স্বদেশবাসীর অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেদেশেই কবরস্থ হয়েছেন কিন্তু তাই বলে নিজের জন্মস্থানকে অস্বীকার করেননি। তাহলে আমরা কেন এত তৎপর আমাদের শেকড়ের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে মাটির সাথে প্রাণের অদৃশ্য সুতোর টানটা কেটে দিতে? মানুষ একে জিইয়ে রাখার জন্য কি প্রাণান্তকর কষ্টটাই না করে! তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অ্যালেক্স হেইলির ‘রুটস’ উপাখ্যানটি। আর আমরা যদি একে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেই, হয়ত একসময় আমাদের আর কোন পরিচয়ই থাকবেনা! থাকবেনা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মাটিটুকুও! | |
No comments:
Post a Comment