Sunday, December 9, 2012

এক গুচ্ছ গোলাপ

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে নীনা, কিসের দিকে বা কতক্ষণ তা সে নিজেও জানেনা। গত একটা বছর ওর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে এই জানালাটার পাশে। দিনরাত সে কি ভাবে সে নিজেই জানেনা। বেশিরভাগ সময় সে মনে করার চেষ্টা করে ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই মনে করতে পারেনা। যতটুকু মনে পড়ে খুব নগন্য কিছু একটা বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক বেঁধে যায় রাশেদের সাথে। কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে আচমকা ঐ তিনটি নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করে বসে রাশেদ, বাকহারা হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নীনা, হঠাৎ ওর খেয়াল হয় রাশেদের দিকে তাকাবার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে সে, দ্রুত মাথায় কাপড় দিয়ে সরে পড়ে অন্যঘরে। সেদিনই মা বাবা গিয়ে ওকে এই বাসায় নিয়ে আসে, আর সেদিন থেকেই এই জানালাটা হয়ে যায় ওর দিনরাতের সঙ্গী।

ও জানে ওকে নিয়ে বাবামার চিন্তার অন্ত নেই, কিন্তু কেন যেন নিজেকে দিন দিন হারিয়ে ফেলছে নীনা, এখন আর স্বাভাবিক হবার চেষ্টাও করতে ইচ্ছে করেনা। কানে এসেছে রাশেদ আবার বিয়ে করেছে, মাস তিনেক হবে। এবার তো সে ওকে ভুলে যেতে পারে, জীবনের পাতা উল্টে নতুন ছবি আঁকা শুরু করতে পারে, কিন্তু কেন যেন কিছুই করা হয়না ওর। সে ভেবে অবাক হয় কেন রাশেদের ওপর ওর কোন রাগ হয়না। আরো অবাক হয় কেন ওর সব ক্ষোভ বিতৃষ্ণার রূপ ধারণ করে রাশেদের নতুন বৌয়ের প্রতি যে রাশেদের জীবনে ওর স্থান দখল করে নিয়েছে। সে মেয়েটার নামও জানেনা, কিন্তু তাকে মনে মনে ঘৃণা করে। ভাবে হবে হয়ত কোন গরীব বাপের অশিক্ষিত কালো কুৎসিত মেয়ে, নইলে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দেবে কেন যার আগে একটা বৌ ছিল? কিন্তু এতেও মনের ভেতর আগুনটা প্রশমিত হয়না।

মা ঘরে ঢুকেছেন বুঝতে পারে নীনা, কিন্তু জানালার দিক থেকে চোখটা ফেরাতে ইচ্ছে হয়না।
‘নীনা’, আদর করে ডাকেন মা, সাড়া দিতে ইচ্ছে হয়না।
এবার মা সামনে এসে দাঁড়ান, হাতে এক গুচ্ছ তাজা টকটকে লাল গোলাপ। এক ঝলক তাকিয়ে আবার জানালার দিকে চোখ ফেরায় নীনা।
‘নীনা, দেখ, এইমাত্র ফুলের দোকান থেকে ডেলিভারী দিয়ে গেল এই তোড়াটা’।
হাসার চেষ্টা করতে গিয়ে মুখটা সামান্য বাঁকা হয় নীনার, কিন্তু এর বেশি আর ম্যানেজ করতে পারেনা সে।
‘তোর জন্য’, বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোড়াটা নীনার কোলে রেখে চলে যান মা।

কতক্ষণ কেটে যায় বলতে পারেনা নীনা, বাথরুমে যাবার জন্য উঠতে গিয়ে কোলের ওপর গোলাপের তোড়াটার অস্তিত্ব টের পায়, অলসভাবে টেবিলের ওপর সরিয়ে রাখতে গিয়ে চোখে পড়ে তোড়ার নীচে যেখানটায় প্লাস্টিকের র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো ওখানে একটা ছোট কার্ড। কার্ডটা খোলাই আর তাতে লেখা, ‘নীনার জন্য- ইতি, এক শুভাকাঙ্খী’। তার মানে ফুলগুলো মা দেননি? তাহলে কে হতে পারে এই শুভাকাঙ্খী? কেন সে নিজের নাম লেখেনি? কেনই বা এতদিন পর কোন উপলক্ষ্য ছাড়াই নীনাকে ফুল পাঠাল সে? তাও আবার একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ? সামান্য একটু কৌতুহল জাগে নীনার মনে। বাথরুমে যাবার সময় হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়ে যায়। আয়নাটা গত একবছর ঐখানেই ছিল, তাকানো হয়নি কোনদিন। আজ আয়নায় দেখা চেহারাট চিনতে পারেনা নীনা। কে এই মেয়েটা? শুকনো চেহারা, চোখের চারপাশে গভীর কালো দাগ, চুলগুলো উস্কোখুস্কো - মা গতকাল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সংসারের তাবৎ ব্যাস্ততার মাঝে ওর সকল পরিচর্যা করার সময় করে কুলিয়ে উঠতে পারেন না তিনি।

মনটা খুব খারাপ নাসরিন বেগমের। মেয়েটা দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। যা ঘটেছে তা ছিল নেহাৎ একটা দুর্ঘটনা, রাশেদ নিজেও এতে এতটা শকড হয়ে গেছিল যে তিনি ওকেও কোনপ্রকার দোষ দিতে পারেন না। তার ওপর আজ এই উটকো ঝামেলা, কে যে ফুল পাঠাল নীনাকে! যেই পাঠাক, তিনি ভেবেছিলেন এতে সে কিছুটা আশ্চর্য হবে, হয়ত খুশিও হতে পারে, অথচ সে কোনভাবে রিঅ্যাক্টই করল না! সংসারের এত দায়িত্বের মাঝে ওকে একটা শিশুর মত করে দেখাশোনা করা এই বয়সে তাঁর জন্যও কঠিন ব্যাপার, ভবিষ্যতে কি হবে এই চিন্তা তো আছেই। কিছুই খায়না মেয়েটা, তাই একটু দুধ নিয়ে ওর রুমের দিকে যান তিনি, যদি আধ গ্লাস খাওয়াতে পারেন। রুমের দরজা খুলে থমকে যান তিনি, দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে দরদর করে- আজ একবছর পর নীনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনভ্যস্ত হাতে চুল আঁচড়াচ্ছে!!


তিনমাস পর
কে যেন প্রতিদিন ফুল পাঠায় নীনাকে! প্রতিদিনই এক গুচ্ছ তাজা টকটকে লাল গোলাপ। অনেক খোঁজখবর করেছে ওর বাবা মা ভাইরা, ফুলের দোকানেও গেছিল, ওরা কিছুই বলতে পারলোনা। কিন্তু এতে যে নীনার কি পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখে তাঁরা হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন। এই তিনমাসে নীনা স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া, নিজের পরিচর্যা, টুকটাক কথা বলা, বাসায় মা ভাবীদের সামান্য সাহায্য করা শুরু করেছে; পড়াশোনা প্রায় ভুলতে বসেছিল, নিজের নামটাও লিখতে কষ্ট হত, এখন সে বিভিন্ন জায়গায় চাকরীর জন্য দরখাস্ত পাঠাচ্ছে। নাসরিন বেগম ছেলেদের মানা করে দিলেন ফুলের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে- ফুল যেই পাঠাক তাঁর মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠছে, এর বেশি তিনি আর কিছু চান না।


ছয়মাস পর
দু’মাস হোল নীনা চাকরী করতে শুরু করেছে। ওর সহকর্মীরা সবাই অবাক হয় যে সে প্রতিদিন সকালে এক গুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ হাতে নিয়ে অফিসে আসে। লায়লা আপা তো একদিন বলেই ফেলেন, ‘তোমার বুঝি লাল গোলাপ খুব প্রিয়? প্রতিদিন সকালে তুমি কোথায় পাও এমন তাজা তাজা গোলাপ?’
নীনা হাসে, ‘লাল গোলাপ আমার প্রিয় ফুল আপা, কিন্তু এগুলো আমি কিনিনা, আমাকে কে যেন পাঠায়’।
খুব অবাক হন লায়লা, ‘মানে? কে পাঠায়?’
‘আমি নিজেও জানিনা আপা, আমার পরিবার ফুলের দোকানে গিয়েও খোঁজখবর করেছিল, ওরাও কিছু বলতে পারেনা। কিন্তু বৃষ্টি হোক বা বর্ষা, হোক কাঠফাটা রোদ কিংবা কনকনে শীত- প্রতিদিন সকালে আমার দরজায় ফুল হাজির, আজ অবধি একদিনও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি’।
‘কোনো সিক্রেট অ্যাডমায়ারার নয়তো?’, চোখ টিপে হেসে ফেলেন লায়লা আপা।
মাথা নাড়ে নীনা, ‘নাহ আপা, কার্ডে লেখা থাকে ‘তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী’, আর কিছুই না। আমি নিজেও খুব অবাক এই ব্যাপারটাতে। স্পষ্টতই যে ফুল পাঠায় সে আমার কাছে কিছু চায়না, কিন্তু যে আমার এত উপকার করল সে কেন নিজের পরিচয় দিতে চায়না তা আমার বোধগম্য না’।
কাজের সময় হয়ে যায়। কাজের ব্যাস্ততার মাঝে হারিয়ে যায় রহস্যময় শুভাকাঙ্খীর ব্যাপারে সকল কৌতুহল।


একবছর পর
শেষ পর্যন্ত সফল হলেন লায়লা আপা। বৌ মরা ছোট ভাইটার জন্য প্রথম দিন দেখেই নীনাকে পছন্দ হয়ে যায় ওনার। মেয়েটা সবসময় চুপচাপ থাকে, মনে হয় যেন কি এক আঘাত তাকে ঝড়ে নুয়ে পড়া নারকেল গাছের মত বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল, মাত্র সে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তারপর ওর সাথে বন্ধুত্ব, ওর কাছাকাছি আসা আর ওর একগুচ্ছ লালগোলাপের অদ্ভুত কাহিনী। ওর ঘটনা জানার পর তিনি ভাবেন এই মেয়েই তার ভাইয়ের জন্য পার্ফেক্ট কারণ দু’জনই জীবনে কঠিন আঘাতে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তিনি ভাবেন এই দু’জন পরস্পরের দুঃখের সাথী হতে পারবে কারণ দু’জনই জানে দুঃখ কি জিনিস। মধ্যখানে ওর লাল গোলাপের কাহিনী শুনে তার সন্দেহ হয় এর পেছনে কোন পুরুষ আছে কি’না, কারণ যে এত কষ্ট করে মেয়েটিকে সুস্থ করে এনেছে তার কাছ থেকে তিনি ওকে কেড়ে নিতে চান না। কিন্তু এক সময় তাঁর প্রতীতি জন্মায় যে ফুলপ্রেরক আসলেই কিছু চায়না যদিও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয় সে কেন ফুল পাঠায়। তখন তিনি একদিন সুযোগ বুঝে নীনার কাছে তাঁর ভাইয়ের কথাটা পাড়েন। ওর চেহারা দেখেই তিনি বুঝতে পারেন ওর ভয় এখনও কাটেনি। তাই তিনি ওকে আর না ঘাটিয়ে ওর বাবামার সাথে যোগাযোগ করেন। ওর পরিবারের সহযোগিতায় এবং তাঁর সহমর্মী আচরনে তিনমাস পর শেষপর্যন্ত নীনা বিয়েতে রাজি হয়।

আজ নীনার বিয়ে, ভোর থেকে সে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে, সে নিজেই বুঝতে পারছেনা সে কি করতে যাচ্ছে, কেনই বা সে আরেকবার নিজের মনকে এমন পরিস্থিতিতে যেতে দিচ্ছে যেখানে সে ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেতে পারে। সকাল আটটায় নিয়মমাফিক দরজায় বেল বাজল, দৌড়ে গেল নীনা। খুব অবাক হয়ে সে দেখল আজ ফুলের তোড়াটা বিশাল, তাতে হরেক রঙের গোলাপ, আরো নানা জাতের ফুলের মিশেল। আজ কার্ডটাও অনেক বড়, কিন্তু আজকের কার্ডটা খামে বন্ধ। নীনা তোড়াটা নিজের রুমে নিতে নিতে বিয়ের আয়োজনে ব্যাস্ত ভাবীদের চোখমুখ হা হয়ে গেল আজকের ফুলগুলো দেখে- হবেই না বা কেন, একবছর ধরে প্রতিদিন ঠিক সাতটা ফুলের একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ আসছিল, একটা ফুলও কম না, একটা ফুলও বেশি না, কিন্তু আজ তো হুলস্থুল অবস্থা! তার মানে যে ফুল পাঠায় সে জানে আজ ওর বিয়ে!

রুমের ভেতর ত্রস্তে খাম খুলে কার্ড বের করে নীনা, বিরাট কার্ডের মধ্যখানে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা, ‘দু’আ করি তোমার আগামী জীবন সুখের হোক, দু’জনে মিলে যেন পৃথিবীতে স্বর্গ রচনা করতে পারো এবং পরবর্তীতে একসাথে জান্নাতে বসবাস করতে পারো’, সেই একই হাতের লেখা, তাড়াতাড়ি কার্ডের নীচে তাকায় নীনা যেখানে লেখা, ‘শুভকামনায়...’- নাহ, আজও লেখা, ‘তোমার শুভাকাঙ্খী’। কিন্তু কেন যেন সবকিছু ছাপিয়ে ওর মাঝে বিশ্বাস জন্মায় ও পারবে ওর নতুন সংসারে স্বর্গ রচনা করতে, যদি না পারে তবু সে একা নয়, সাথে আছে কোন এক শুভাকাঙ্খী যাকে সে চেনেনা কিন্তু যে সর্বাবস্থায় ওর ভাল চায়।


পঁচিশ বছর পর
হাসিবের সাথে নীনার বিয়েটা যদিও উভয়ের জন্যই ছিলো কিছুটা সংশয়ের ব্যাপার, কিন্তু পরবর্তীতে উভয়ই অত্যন্ত সুখি হয়। এই বিয়ের মাধ্যমে উভয়ের জীবনে আসে পজিটিভ কিছু পরিবর্তন। নীনা ওর আদরযত্ন দিয়ে হাসিবের জীবনে আবার হাসি আনন্দ ফিরিয়ে আনে, সে হাসিবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে ওর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর কথা স্মরন করে সার্বক্ষণিক দুঃখবোধ করার পরিবর্তে ওদের একসাথে থাকার সময়টুকুকে একটি সুখকর স্মৃতি হিসেবে স্মরন করা শ্রেয়। হাসিবও একইভাবে নীনার প্রতি সহনশীল এবং উৎসাহমূলক আচরন করার মাধ্যমে ওর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। নীনা আবার পড়াশোনা শুরু করে। পরবর্তীতে ওর দুই ছেলে আর এক মেয়ের জন্মের পর সে একটি কলেজে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেয় যেন সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারে। সত্যি সত্যিই স্বর্গীয় সুখে ভরে ওঠে নীনার ছোট্ট সংসার। কিন্তু মাঝে মধ্যেই সে কল্পনা করার চেষ্টা করে কে তাকে ফুল পাঠাত, কেনই বা পাঠাত, কি করে সে জানল কবে ওর বিয়ে, আর কেনই বা সে কোনদিন সামনে এলোনা। ওর বিয়ের দিনই শেষ ফুলের তোড়াটা আসে। তারপর আর কোনদিন আসেনি।

এক গাদা খাতা নিয়ে বসেছে নীনা। মাঝে মাঝে মনে হয় কলম দিয়ে না কেটে বটি দিয়ে খাতা কাটা গেলে ভালই হত! একটা খাতা দেখতে পায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, মুক্তোর মত হাতের লেখা, কেমন যেন পরিচিত পরিচিত ধাঁচের। এই খাতাটা দিয়েই শুরু করে সে। বাহ! মেয়েটার ব্যাকরণে কোথাও কোন ভুল নেই! এমন খাতা দেখতেও ভাল লাগে! পর্যায়ক্রমে রচনা আসে খাতার শেষে। বেশ দীর্ঘ রচনা লিখেছে মেয়েটা। মাকে নিয়ে লিখতে দিলে এমনিতেই কেন যেন ছাত্রছাত্রীদের রচনার দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়, কিন্তু এই খাতাটা দেখে মনে হচ্ছে বাকি প্রশ্নোত্তর তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়াতেই সময় নিয়ে রচনা লেখা হয়েছে- মেধাবী মেয়ে! মেয়েটা লিখেছে ওর মা দীঘলদেহী, সুন্দরী, শিক্ষিতা, মেধাবী নারী কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা তাঁর সৌন্দর্য্যের আসল উৎস। অনেকেই মায়ের অনেকরকম প্রশংসা করে কিন্তু এমন প্রশংসা সে কোনদিন পড়েনি, রচনাটা ওর কৌতুহল উদ্রেক করে। সে পড়তে থাকে, মেয়েটার মা অত্যন্ত বড়লোকের মেয়ে হওয়ায় তাঁর জন্য অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব আসে কিন্তু তিনি এমন জায়গায় বিয়ে করতে আগ্রহী হন যেখানে তিনি কিছু অবদান রাখতে পারবেন। তাই তিনি এমন এক ব্যাক্তিকে বিয়ে করেন যে নিজের একটি কৃতকর্মের জন্য মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিল। বিয়ের পর তিনি ওর বাবাকে স্বাভাবিক করে তোলেন। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন ওর বাবার আগের স্ত্রী মানসিকভাবে অত্যন্ত অসুস্থ। তখন তিনি তাকে প্রতিদিন ফুল পাঠাতে শুরু করেন, এভাবে তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন, তিনি সুস্থ হয়ে যান এবং আবার বিয়ে করেন। ওর মা ওর আদর্শ এবং এই আদর্শই সে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নিজের জীবনে। এমন মহীয়সী মায়ের সন্তান হিসেবে জন্মাতে পেরে সে অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী। রচনা পড়ে স্থির হয়ে যায় নীনা। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে ওর।

পরদিন সে রোল নাম্বার ধরে মেয়েটিকে ডেকে পাঠায়। আধঘন্টা পর পিয়ন এসে বলে মেয়েটি আজ কলেজে আসেনি। অস্থির লাগে নীনার। সে ঐ ক্লাসের এমন কাউকে ডেকে আনতে বলে যে মেয়েটিকে চেনে। কিছুক্ষণ পর সোনিয়া এসে হাজির হয়। ‘আচ্ছা, এই রোল ১২৭ কে বল তো?’, খাতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নীনা যেন ওর অস্বস্তিটা চোখে না পড়ে।
সোনিয়া বলে, ‘ম্যাডাম, এটা তো আয়শার নাম্বার’।
বুকটা ধক করে ওঠে নীনার। আয়শাকে সে ভালই চেনে- লম্বা, ফর্সা, মেধাবী, হাসিখুশি, স্মার্ট মেয়েটা কলেজের প্রথমদিন এসেই ওর সাথে দেখা করে, ‘ম্যাডাম, এখানে নাকি মেয়েদের নামাজের কোন জায়গা নেই! আমাদের একটি রুম দিন যেন আমরা যারা আগ্রহী তারা নামাজ পড়তে পারি’।
শিক্ষকদের কক্ষের পাশে একটি খালি রুম ছিল, সেটা খুলে দেয়ার ব্যাবস্থা করে দেয় নীনা। তারপর থেকে ক্লাসেও সে লক্ষ্য করে মেয়েটি লেখাপড়া, শিষ্টাচার, যেকোন কাজে এগিয়ে আসা সবদিক থেকেই চোখে পড়ার মত। খুব মনোযোগের ভঙ্গীতে খাতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে নীনা, ‘আমার ওর ব্যাপারে কিছু জানা প্রয়োজন ছিল... উমম... অফিসিয়াল ব্যাপার... তুমি কি জান ওর বাবার নাম কি?’
সোনিয়া হেসে বলে, ‘জ্বি ম্যাডাম, ওর বাবার নাম রাশেদ চৌধুরী’।
পৃথিবীটা দুলে ওঠে নীনার।
‘ওর মা?’
‘আন্টির নাম সিতারা জাহান’।
‘সিতারা, সিতারা’, মনে মনে বিড়বিড় করে নীনা,। ‘আচ্ছা যাও’, পরক্ষণেই মনে হয় শিক্ষক হিসেবে ওর জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল আয়শা কেন অনুপস্থিত তাই সোনিয়াকে ডাক দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, ও আজকে আসেনি কেন?’
সোনিয়া যেতে যেতে বলে, ‘ম্যাডাম, গতকাল সকালে হঠাৎ ওর মা মারা গেছেন। ওরা মনে হয় বাড়ী চলে যাবে, এখানে আর থাকবেনা’।
নীনার কেমন যেন লাগে। ওর মনে হয় ওর আকাশে একটা তারা ছিল- তারাটাকে সে কোনদিন চিনতে পারেনি, কিন্তু তার আলো সবসময় ওকে পথ দেখাত; তারাটার কোন নাম ছিলোনা, কিন্তু আজ তারাটা হঠাৎ নিভে গেছে- যার অস্তিত্বই সে কোনদিন জানতনা তার অনুপস্থিতি কেন তাকে এত ব্যাথা দেয়?

1 comment: