আমার কন্যার বয়স এখন তেরো আর পুত্রের বয়স ছয়। চেহারায় এবং স্বভাবচরিত্রে দু’জন
একেবারেই স্বতন্ত্র। কন্যা পুরোপুরি বাপের মত আর পুত্র উল্টো। স্কুলে সবাই ওদের
জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দু’জনের চেহারা মোটেই মিলেনা। Are you sure you are brother and sister?’ এতদসত্ত্বেও
ওরা দু’জন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারেনা, দুইজনে ঝগড়া লাগলে যদি বলি আলাদা রুমে
যেতে তবু কেউ একে অপরকে রেখে নড়তে চায়না, আবার একজনকে বকা দিলে অন্যজন এসে তার
তরফদারী করে। বয়সের অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও দু’জনে একসাথে অনেক মজার মজার কান্ড
করে। তার কিছু কিছু এখানে শেয়ার করলাম।
১/
‘আম্মু, আম্মু’, করে ডাকতে ডাকতে কন্যা আমার রুমে ঢুকে নিজে নিজেই বলল,
‘ওহ! নামাজ পড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ, ভাল মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে!’ ওর কথা শুনে হাসি চেপে
রেখে বাকী নামাজটা শেষ করতে খুব কষ্ট হয়েছে!
২/
জুতো কিনতে গিয়েছি, সাথে পুত্র এবং কন্যা। কন্যা আমার উপর মহাবিরক্ত, ‘তুমি
সব বুড়া মানুষদের জিনিস পছন্দ কর’। বুঝাতে ব্যার্থ হলাম যে আমার বয়স হয়েছে, ওরা
মাকে এখনো যথেষ্ট ইয়াং মনে করে। তবে আসল কথা হোল, বুড়ো মানুষের সামগ্রী আরামের কথা
খেয়াল রেখে তৈরী করা হয়, আমার মত আরামপ্রিয় মানুষের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর
কি হতে পারে? যাই হোক, এক দোকানে ঢুকে একটা ঘিয়ে রঙের জুতো দেখে হাতে নিলাম। এবার
পুত্র সোচ্চার হয়ে উঠল। জুতোটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রেখে দিতে দিতে বলল, ‘No, no, no, definitely not!’ ওর কান্ড দেখে দোকানী
পর্যন্ত হাসতে লাগল!
৩/
রান্নাঘরে কাজ করছি, কিন্তু ঘাড়ের ব্যাথার জন্য যুৎ করতে পারছিনা। রাদিয়াকে
বললাম, ‘ঘাড়ে ক’টা চাপ দে তো মা!’ তো রিহাম কিছুতেই মাতৃসেবা থেকে পিছিয়ে থাকতে
রাজী না। রাদিয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, ঘাড়ের নাগাল পাচ্ছেনা বলে টুল নিয়ে এসে ঘাড়
টিপে দিতে প্রস্তুত হয়ে পড়ল। বললাম, ‘বাবা, তুমি এত ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ঠিকমত
চাপ দিতে পারবেনা, রাদিয়া আপুকে দিতে দাও’। সে অপমানিত বোধ করল, ‘What do you mean?’ তারপর ঐ পিচ্চি পিচ্চি হাত দু’টো দিয়ে রাদিয়ার চেয়েও
জোরে জোরে ঘাড় টিপে দিল! ওর হাত মাশাল্লাহ অনেক ভাল, ঘাড়ের ব্যাথাটা আসলেই সেরে
গেছিল!
আরেকদিন রাদিয়াকে বললাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সাথে সাথে রিহাম এসে হাজির,
‘রাদিয়া আপু, তুমি সর, আমি আমার আম্মুকে হাত বুলিয়ে দিব’। বললাম, ‘তুমি পারবেনা বাবা, রাদিয়া আপুকে দিতে দাও’। তখন পুত্র বলল, ‘ না আমি
দিব’। বললাম, ‘কেন বাবা? রাদিয়া আপু দিক না!’ সে তখন বলল, ‘Because you are My Mummy! I love you!’ এর পর আর কি বলার আছে? এলোমেলো হাত বুলানোর
মাঝেই প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে পড়লাম!
৪/ আমার একটা বদ অভ্যাস হোল, আমার বাচ্চারা যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ আমি
ঘুমাতে পারিনা সে ঘুমের যতই ঘাটতি হোক না কেন। এমনকি রাতে ঘুমের মধ্যে ওরা ওদের
রুমে বিছানায় পাশ ফিরলেও আমি জেগে উঠি। তবে ইদানিং মাঝে মাঝে রিহামকে রাদিয়ার
জিম্মায় দিয়ে বিশ্রাম নেই। সেদিন বিকালে রাদিয়া ঘুমাচ্ছে, তাই আমি বসে আছি রাদিয়া
উঠলে রিহামকে ওর তত্ত্বাবধানে রেখে শোব, নইলে এশার নামাজ পর্যন্ত এনার্জি ধরে রাখা
মুশকিল হয়ে পড়ে (এখন এখানে এশা রাত সাড়ে এগারোটার পর)। রিহাম এসে বলে কিনা, ‘Mummy, go to sleep, don’t worry about me, I’ll be fine
by myself!’ বুড়ো বাবাটার কথা শুনে ভাবলাম উনি যে কবে এত বড় হয়ে গেলেন তা তো টেরই
পাইনি!
৫/
রাদিয়াকে বিবাহের মাসয়ালাগুলো বুঝাচ্ছিলাম, কাদের বিয়ে করা যাবে, কাদের
যাবেনা ইত্যাদি। রিহাম বলে, ‘আম্মু, আপুর সাথে তোমার এত কথা বলার দরকার নেই, তুমি
আমার সাথে কথা বল’। রিহাম যখন এমন করে তখন আমি সাধারনত ওর দিকে তাকিয়ে ওর সাথে কথা
বলার ভঙ্গীতে রাদিয়ার সাথে কথা চালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ মনোযোগসহকারে আলোচনা শোনার পর
রিহাম বলল, ‘আম্মু, তুমি এসব কথা আমাকে কেন বলছ? আমি তো এখনো অনেক ছোট, আমি বুঝি
এখন বিয়ে করতে পারব?!’
৬/
রিহামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি আল্লাহকে ভালোবাস?’
সে বলল, ‘Of course I do!’জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আল্লাহকে কতটা ভালোবাস?’
সে নির্দ্বিধায় বলল, ‘A lot’.
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি আল্লাহকে আম্মুর চাইতে বেশি ভালোবাস?’
সে চিন্তা করে জানাল, ‘No, I love you both the same amount.’
বুঝিয়ে বললাম, ‘কিন্তু তোমার আল্লাহকে আব্বু, আম্মু, আপু সবার চাইতে বেশি ভালবাসতে হবে’।
সে কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। বললাম, ‘তুমি আস্তে আস্তে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে শিখবে, ঠিক আছে?’
সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘okay!’
৭/
আমার কন্যা নিজের
রুমটাকে এত অগোছালো করে রাখে যে গুছাতে বললে আর নিজেই কুলকিনারা করতে পারেনা কোথা
থেকে শুরু করবে। একদিন শুদ্ধি অভিযান চালাতে গিয়ে সে মাঝপথে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পুত্র
গিয়ে বলে, ‘রাদিয়া আপু, you are not a muslim!’ রাদিয়া তো থ! বলে, ‘কেন?
আমি আবার কি করলাম?’ রিহাম বলে, ‘মুসলিমদের ডানপাশে ফিরে শুতে হয়, তুমি বামদিকে
ফিরে শুয়েছ!’
আজ আমার এক নয়
বছর বয়সী ছাত্রী দেখাচ্ছিল সে ডে-কেয়ারে ক্রিসমাস ট্রি বানিয়েছে। পরে সে ভুলে ওর
শো পিসটি ডাইনিং টেবিলের ওপর ফেলে রেখে চলে যায়। আমি রিহামকে ভাত মেখে দিয়ে ড্রয়িং
রুমে বসে পড়ছি। পুত্র জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু এটা এখানে কে এনেছে?’ বললাম, ‘আমার
ছাত্রী’। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ছাত্রী কি মুসলিম?’ বললাম, ‘হ্যাঁ?’ সে বলল, ‘তাহলে
সে কি জানেনা মুসলিমরা ক্রিসমাস করেনা?’ বললাম, ‘আব্বু, আসলে ও অনেক ছোট তো, ও
বুঝতে পারেনি’। পুত্র অবশ্বাসের সুরে বলে, ‘What?! আমি তো ওর চেয়েও ছোট, কিন্তু
আমি তো জানি আমরা ঈদ করি, ক্রিসমাস করিনা!’
এত বিজ্ঞ আলেমদের
নিয়ে যে কি করব!
এদের দু’জনের
জন্য দু’আ করবেন।
No comments:
Post a Comment