Saturday, September 18, 2010

আজান

আল্লাহু আকবার (৪ বার)- আল্লাহ মহান
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (২ বার)- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (২ বার)- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল
হাইয়া আলাস সালাহ (২ বার)- নামাজের জন্য এসো (জাগো)
হাইয়া আলাল ফালাহ (২ বার)- সাফল্যের পথে এসো
আল্লাহু আকবর (২ বার)- আল্লাহ মহান
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (১ বার)- আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই
(শুধুমাত্র ফজর নামাজে)
আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাউম (২ বার)- নামাজ নিদ্রা অপেক্ষা উত্তম

জন্মের সময় মুসলিম শিশুর কানে যে আজান দেয়া হয়, তারপর থেকে কত লক্ষবার যে আজানের ধ্বনি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে তা আমরা হিসেব করে দেখিনা কখনো। আজান শুনতে শুনতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে যাই যে এর কথাগুলো আমাদের কাছে আর দশটা শব্দ থেকে পৃথক করে ধরা পড়েনা। কথাগুলোর অর্থ কি আমরা ভেবেও দেখিনা হয়ত! অথচ এই আজানের প্রতিটি শব্দ যে কত অর্থপূর্ণ … আরেকবার পড়ে দেখুন! আমরা যদি মহান আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য স্বীকার করে নেই, নামাজের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচবার তাঁর কাছে জবাবদিহিতার তাগাদা অনুভব করি – আমরা কাউকে ভয় করবনা সঠিক কাজটি করার ব্যাপারে, কোন চেষ্টার ত্রুটি রাখবনা অন্যায় থেকে দূরে থাকার। মুহাম্মাদ (সা)কে রাসূল হিসেবে মেনে নিলে আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথের ওপর অবস্থান করার চেষ্টা করব সদাসর্বদা। এই পথ ধরেই আমাদের জীবনে আসবে পরম সাফল্য। ভোরবেলা নরম বিছানা ছেড়ে উঠে শুরু হবে প্রবৃত্তির দমন, তাহলে দিনব্যাপী আর কোন প্রবৃত্তি কি আমাদের কাবু করতে পারবে?

এই আজানের পেছনে যে চমকপ্রদ কাহিনী তা আমরা অনেকেই জানি। বিলাল (রা) যখন ইসলাম গ্রহন করেন তখন তিনি উমাইয়া ইবন খালফের ক্রীতদাস। উমাইয়া ছিলেন ইসলামের প্রধানতম শত্রুদের একজন। তিনি ইসলামকে নির্মূল করার প্রচেষ্টায় রত আর তাঁরই ঘরে কি’না ক্রীতদাস ইসলাম গ্রহন করে বসে আছে! তিনি প্রথমে বিলাল (রা) কে নানা প্রলোভন দিয়ে ইসলাম হতে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। বিলাল (রা)র এককথা, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ”। ব্যর্থতার জ্বালা সইতে না পেরে উমাইয়া বিলাল (রা)কে নানাভাবে নির্যাতন করতে শুরু করেন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে বিলাল (রা)কে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর ওপর বুকে ভারী পাথর চাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হত। তিনি পানি চাইলে তাঁকে বলা হত ইসলাম এবং রাসূল (সা)কে অস্বীকার করতে। তিনি কালেমা বলা শুরু করতেন। যখন গলা শুকিয়ে আর কালেমা বলতে পারতেন না তখনো তিনি বুজে আসা গলায় ‘আহাদ, আহাদ’ বলতে থাকতেন। কিছুদিন পর এই খবর রাসূল (সা)এর কানে পৌঁছলে তিনি এই ব্যাপারে প্রিয় বন্ধু এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক আবু বকর (রা)র সাথে আলাপ করেন। আবু বকর (রা) উমাইয়ার সাথে কথা বলেন। কিন্তু উমাইয়া কোন মূল্যেই বিলাল (রা)কে ছাড়তে রাজী হচ্ছিলেননা। তখন আবু বকর (রা) অনেক বেশীগুন মূল্যে, একটি খেজুর বাগানের বিনিময়ে বিলাল (রা)কে উমাইয়ার কাছ থেকে মুক্ত করে আজাদ করে দেন।

মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা) একদিন সাহাবাদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন, এবার যেহেতু ইসলামের চর্চায় আর কোন বাঁধা নেই, সকলকে একসাথে নামাজে সমবেত করার জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তখন আবু বকর (রা), মতান্তরে আব্দুল্লাহ ইবন জায়েদ (রা) বলেন আজানের কথাগুলো তিনি স্বপ্নে শুনেছেন। তখন বিলাল (রা)র পাথরচাপা অবস্থায় এই কথাগুলো বারবার বলতে থাকার স্মৃতি অনেকের মনে পড়ে যায়। তাছাড়া তাঁর সুললিত কন্ঠ ছিল সর্বজনবিদিত। সর্বসম্মতিক্রমে বিলাল (রা)কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করা হয়। আল্লাহর কি মহিমা, একজন হাবশী ক্রীতদাসকে আল্লাহ সেই সম্মান দান করলেন যার জন্য হয়ত অনেক সাহাবী প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হতেন না! মক্কাবিজয়ের পরও প্রথম আজান দেন বিলাল (রা)। বেচারার জন্ম যেহেতু আরবের বাইরে, তাঁর আরবী উচ্চারণ বিশুদ্ধ ছিলোনা। কিন্তু এ’ বিষয়ে রাসূল (সা)কে বলতে গেলে তিনি বলেন, “আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চারণ স্পষ্ট কেননা আল্লাহ নিয়ত দেখেন, উচ্চারণ তাঁর কাছে মূখ্য নয়”। রাসূল (সা)এর মৃত্যুর পর বিলাল (রা) আর কখনো আজান দিতে রাজী হতেন না। দামেস্ক বিজয়ের পর সাহাবীবৃন্দ উমার (রা)কে গিয়ে ধরেন বিলাল (রা)কে আজান দিতে অনুরোধ করার জন্য। খলিফার অনুরোধে বিলাল (রা) জীবনে আর একবার তাঁর অসাধারণ কন্ঠে আজান দিলেন, কিন্তু তাঁর অনুভূতির প্রাবল্যে সমবেত সাহাবাবৃন্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

আজানের ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি এতখানি তীব্র না হলেও, আজান আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে নানান স্মৃতি আর হরেক অভিজ্ঞতার হাত ধরে। ছোটবেলা থেকে আজানের শব্দ আমাদের রক্তে ঝংকার তোলে আল্লাহর কাছে ছুটে যাওয়ার উদগ্র আকাংক্ষায়। আজানের শব্দ শুনে আমরা বুঝতে পারি, জাগার সময় হোল, খাবার সময় হোল, বা বাড়ী ফেরার সময় হোল। আমার কাছে আজানের গুরুত্ব আরেকটু বেশী কারণ এই বিদেশের মাটিতে আজান শুনিনা বহুদিন। আজানের প্রতি আমার অনুভূতি সেই ব্যক্তির মত যে দীর্ঘকাল অভুক্ত রয়েছে অথচ খাবার পাবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা।

আমার প্রথম আজানের স্মৃতি অনেক ছোটবেলার। হয়ত ছয় বা সাত বছর বয়সের। ঢাকা তখন অনেক সুন্দর খোলামেলা নগরী যেখানে চোখ খুললেই আকাশ দেখা যায়, গাছপালা আর খোলা প্রান্তর-জলাশয় অহরহ, বাড়ীর আশেপাশেই আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বরই, কলা, ডালিম, কৎবেল, বাতাবীলেবু নানান ফলের গাছ আর নানান ফুলের সমারোহ। ভোরের আজানের সাথে সাথেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা পড়িমরি করে নামাজ পড়ে ছুটতাম মালা গাঁথার জন্য হিজল আর শিউলি ফুল কুড়াতে, সাথে কখনো কয়েকটা গোলাপ, গাঁদা, বেলী, জবা, মালতী বা কাঠগোলাপ। ঢাকা তখন এতখানি নিরাপদ যে ছোট ছেলেমেয়েদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মায়েরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিত আরো কিছুক্ষণ। কখনো গাছতলা থেকে ফুলগুলো গামলায় ভরে বাসায় নিয়ে আসতাম। কখনো সুঁইসুতা সাথে নিয়ে যেতাম। পাড়ার সবাই গাছতলে বসে মালা গাঁথতাম একসাথে। কিছুক্ষণ পরে এগুলো হাতের কানের গলার পায়ের গহনায় রূপান্তরিত হয়ে যেত। মাকে নানীকে বুয়াকে সাজাতাম স্কুলে যাওয়ার আগে। কখনো আমাকে সাজিয়ে ছবি তুলে দিত মা। হিজলের তুলতুলে লালসুতোর মত পাপড়ি, শিউলির নরম স্পর্শ, কাঠগোলাপের মনমাতানো গন্ধ সবই আজও ফিরে আসে আজানের শব্দের সাথে। এখন যখন ঢাকায় যাই, আমার মেয়েকে বলি আমার ছোটবেলার ঢাকার গল্প, সে মুচকি মুচকি হাসে। আম্মু মনে হয় পাগল হয়ে গেছে! এখানে তো সব বিল্ডিং, মানুষগুলো পর্যন্ত ইটপাথরের মত নিষ্প্রান! এখানে কি কোন প্রাণের ছোঁয়া আছে, কোন খোলা জায়গা আছে, গাছপালা কোথায় যে তুমি ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, এই শহর এখন এত ব্যস্ত যে এখানে মানুষ নিয়তই ছুটে চলেছে জীবিকার উদ্দেশ্য, যেখানে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে মাঝপথে কোথাও। এখানে মানুষের এখন আজানের শব্দ শোনার সময় নেই, ফুলগাছ লাগানোর জায়গা নেই, মালা গাঁথার শখের তো প্রশ্নই ওঠেনা। শিশুরা এখানে জেগে ওঠে কাক ডাকার শব্দে। আমাদের ছোটবেলার মত পায়রা, ঘুঘু, টিয়ে, ময়না, দোয়েল, শালিক, চিল এই ঢাকা শহরে আর দেখা যায়না। তাই আমার কথাগুলো এখন আমার নিজের সন্তানের কাছেই রূপকথার মত লাগে!

সেই ঢাকাতেই, আরেকদিন আকাশে মেঘের সতত পরিবর্তন দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। মেঘগুলো যখন গর্জন করে বর্ষন শুরু করল তখন আমি ঘুম। ঘুমের মধ্যে মনে হোল যেন দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি বিটিভিতে আসরের আজান দেখাচ্ছে যদিও আকাশের রঙ দেখে মনে হচ্ছিল এশার আজান। বাইরে মেঘের গর্জন আর প্রবল বর্ষনের শব্দের সাথে আজানের শব্দ মিলে এক অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি হোল। যে মসজিদটা দেখাচ্ছিল তার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে যেন তারার মেলা। সাদা দেয়ালের ওপর নীল সবুজ অসংখ্য তারা! বাবা বল্ল এটা বিখ্যাত তারা মসজিদের আজানের ছবি। মন ছুটে গেল সেই মসজিদে যেখানে হাজার তারার মেলার মাঝে মুসল্লীরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে আসেন। বাবাকে বললাম আমি ঐ মসজিদে যেতে চাই। আপাতত আমার জ্বালাতন থেকে বাঁচার জন্য বাবা বল্ল, “ঠিক আছে, নিয়ে যাব একদিন”। কিন্তু আমার আজও সেই তারা মসজিদ দেখা হয়নি।

এর কিছুদিন পর আমরা ফিরে গেলাম আবুধাবী। আমাদের সব বেডরুমের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত। আমার জানালার সামনে রাস্তা, রাস্তার আইল্যান্ডে এই বালুকাময়, উষর, নিষ্প্রাণ নগরীতে প্রকৃতির সাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করত পাঠান মালি একমুঠো ঘাস আর কয়েকটা খেজুর গাছকে জিইয়ে রাখার জন্য, ২৪ ঘন্টা ঘাসের ওপর স্প্রিঙ্কলার দিয়ে আর প্রতিটি গাছের নীচে পাইপ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেয়া হত। রাস্তার পরে কর্নিশ রোডের বাগান, তারপরই ঘেরা দেয়া সমুদ্র যেখানে বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম প্রায়ই। বিকেল হলেই নানা দেশের মানুষে ছেয়ে যেত এলাকাটা। দিনের অস্বস্তিকর গরমের পর বিকেল বেলা একটু বাতাসে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসতেন সবাই। তখন আবুধাবীতে একটাই ঋতু ছিল- গরমকাল। ঘরে চারটা এসি চলত ২৪ ঘন্টা। কিন্তু কেউ বেল দিলে ঝগড়া লেগে যেত কে দরজা খুলবে। কেউ রাজী হতনা। কারণ ঐ কয়েক সেকেন্ডে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘেমে যাবে।

আরবীরা মসজিদ বানাতে খুব ভালোবাসে। যে যার সামর্থ্যমত মসজিদ বানিয়ে দেয় কিছু টাকা জড়ো করতে পারলেই। তাই শেখদের বিশাল বিশাল মসজিদের পাশাপাশি দেখা যায় রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর বানানো মসজিদ যেখানে হয়ত চারজনের বেশী লোকের জায়গাই হবেনা! ভারী সুন্দর কিছু মসজিদ দেখেছি আবুধাবীতে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগত ভোরবেলা। যখন ফজরের আজান শুরু হত তখন মনে হত সম্পূর্ণ নগরীতে আজানের শব্দ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়ছে। আমার জানালার পাশেই ছিল এক মসজিদের মিনার। তাই নামাজ মিস হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিলনা। ক্লাস নাইনে একবার আমার গান শোনার শখ বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে গেল। রাতে গান না শুনলে ঘুমই হতনা। আবার গান শুনতে শুনতে কবে যে অনেক রাত হয়ে যেত কিছুতেই ঠিক করতে পারতাম না। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠে গিয়েছে। আমার জানালার পাশে মসজিদের মিনার আর আমি সেই শব্দ শুনতেই পাইনি! এত মেজাজ খারাপ হোল গানের ওপর! মনে হোল এটা শয়তানের অস্ত্র মানুষকে আল্লাহর স্মরন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। সুন্নত নফল তো পালন করার প্রশ্নই ওঠেনা, ফরজটুকুও যদি ছেড়ে দেই- আমার তো আর মুক্তির কোন আশাই থাকবেনা! দিলাম ছেড়ে গান গাওয়া শোনা সব! সেই প্রথম আমার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন। তাই এই ঘটনাটা আমার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আমাদের বাসার পেছনদিকে ছিল আবুধাবীর সবচেয়ে বড় বাগান যেখানে কয়েকটা বাদামগাছ আর নানা ধরণের ঝোপঝাড় বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশাল এক দঙ্গল মালী কাজ করতেন প্রায় চব্বিশঘন্টাই। বিকেল বেলা বা ছুটির দিনে সময় কাটাতে বা ছোটখাট পিকনিক করতে অসংখ্য মানুষ আসত এই বাগানে। এই বাগানে ঢোকার মুখেই ছিল ছোট্ট একটা মসজিদ। এই মসজিদের মুয়াজ্জিনকে আমি কোনদিন দেখিনি। কিন্তু অসংখ্যবার দেখেছি আজান শুরু হওয়ার সাথে সাথে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলে সব ভুলে কোন এক অদৃশ্য টানে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে যেতে, শিশুদের কান্না বন্ধ করে তন্ময় হয়ে শুনতে, ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা বন্ধ করে আজান উপভোগ করতে। ওনার আজানে কি যে ছিল আজও জানিনা, কিন্তু সেই আজানের সুরের সাথে কোন গানের তুলনা হয়না, হাজারবার শোনার পরও প্রতিবারই এই আজান মানুষের অন্তরকে বিমোহিত করে ফেলত যদিও সে আজানের অর্থ না বোঝে। মনে হত এটি বেহেস্ত থেকে ভেসে আসা আলৌকিক কোন শব্দ। আমি অনেক মানুষকে এই আজান শুনে প্রকৃতিস্থ হবার পর দোয়া করতে শুনেছি, “হে আল্লাহ, তুমি এই মুয়াজ্জিনকে বেহেস্তে আজান দেয়ার তৌফিক দিয়ো”। এই আজানের তুলনায় আমার অন্যান্য মুয়াজ্জিনের আজান কর্কশ, বেসুরো মনে হত। তাই প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে আমি ছুটে যেতাম পেছনের বারান্দায়, বাগানের মসজিদের আজান শোনার জন্য। দিনের বেলা গাড়ীর শব্দের জন্য ঐ মসজিদের আজানের শব্দ আমাদের বাসা থেকে শোনা যেতনা। কিন্তু ফজরের সময় যখন চারিদিক নিরিবিলি তখন স্পষ্ট শোনা যেত। যতবারই শুনতাম, মন অতৃপ্ত রয়ে যেত। মনে হত আরো একবার যদি উনি আজান দিতেন! আজান শেষে যখন ঘরে ঢুকতাম তখম মাথা থেকে পা পর্যন্ত টপটপ করে ঘাম ঝরত!

এই আজান যে শুধু আমাকেই নয়, আরো অনেককে একইভাবে প্রভাবিত করেছে তার প্রমান মিলল কিছুদিন পর যখন অনেক বড় বড় মসজিদের আজান বাদ দিয়ে আবুধাবী টিভিতে এই মসজিদের আজান দেখাতে শুরু করল। আমরা আজান দেখার জন্য দুপুরে যখন টিভি ছেড়ে রাখতাম, আমার দুই বছরের পিচ্চি ভাই মোহাম্মদ আজান শুরু হতেই খেলা বাদ দিয়ে টিভির পাশে দাঁড়িয়ে যেত। মাথায় টুপি দিয়ে সুরে সুরে আজান দেয়ার চেষ্টা করত, “আন্নাবাব্বা!” আজও ঐ মুয়াজ্জিন সাহেবের কথা মনে পড়ে, ওনার জন্য বেহেস্তের দোয়া করি। মনে হয় আর একবার যদি ঐ আজান শুনতে পেতাম!

আজানের ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি ইণ্ডিয়ায় বসবাসের দিনগুলো। দিল্লী যখন যাই তখন মাত্র বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। চারদিকে খুব টেনশান। কিন্তু এর মধ্যেও ওখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী দাপটের সাথে চলছে। মাদ্রাজ এসে দেখলাম, এখানে কোন জাতিগত সমস্যা নেই। এখানকার মুসলিম এবং হিন্দু জনগোষ্ঠী যুগ যুগ একত্রে বসবাস করতে করতে একীভুত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একীভুত হওয়ার ধরণটা এমন যে তাদের খাবার দাবাড়, পোশাক আশাক, চলাফেরা কিছু দেখেই তাদের মুসলিম বলে সনাক্ত করার উপায় নেই। মসজিদ এত কম যে আমি চারবছরে হয়ত দশটা মসজিদও দেখিনি যেখানে আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মসজিদ ছিল এগারোটা। আমাদের পাড়াটা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। বিশাল বিশাল সব বাড়ী চারটা রাস্তার দুই ধারে বিন্যস্ত। পাড়ার নিজস্ব দোকানপাট, খেলার মাঠ, দু’টো দুধের রেশনকেন্দ্র সব ছিল। কিন্তু পুরো এলাকা জুড়ে কোথাও কোন মসজিদ ছিলনা। আজানের শব্দবিহীন পরিবেশে এ’ আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। দিনের বেলা গরমের কারণে ঘরে থাকা যেতনা, বারান্দায় কাটত আমাদের অধিকাংশ সময়। সব বাড়ীর লোকজনই থাকত বারান্দায় তাই প্রতিবেশীদের সাথে কথা হত প্রচুর। মাদ্রাজীরা ভীষণ শিক্ষিত আর ভদ্র। তাই ওদের সাথে বন্ধুত্ব করা ছিল সহজ। মাদ্রাজ খুব পরিবেশসচেতন নগরী যদিও কোন অজ্ঞাত কারণে এখানকার ৫০% মানুষ ঘরে বাথরুম করার চেয়ে রাস্তায় হাগু করতে পছন্দ করে বেশী। ফুটপাথে হাঁটা অসম্ভব। সবাই তাই রাস্তায় হাঁটে। এখানে শহরের মধ্যখানে বিশাল বিশাল সব গাছপালা, গাছে গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখীর বসবাস, বানর অসংখ্য। কিছুদিন পর পর সমুদ্রের পাড়ে, বড় বড় মন্দির দেখতে, প্ল্যানেটেরিয়ামে বা আশেপাশের শহরগুলিতে বেড়াতে চলে যেতাম আমরা। এতকিছুর মধ্যে থেকেও কেমন যেন শুন্যতা অনুভব করতাম। মনে হত কি যেন নেই।

একদিন বাবার সাথে কোথায় যেন যাচ্ছি। সময়স্বল্পতার কারনে বাবা পাড়ার বাউন্ডারীর বাইরে কোন এক গলি দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হোল যেন আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত চেহারা দেখে বাবা দেখালো গলির একপাশে গাছপালার পেছনে ছোট্ট, প্রায় অদৃশ্য একটা মসজিদ। আর পায় কে? প্ল্যান করা শুরু করলাম কি করা যায়। দিনের বেলা টিয়ের চেঁচামেচি, বানরের নাচানাচি, গাড়ীর ক্যাঁচক্যাঁচানির জন্য কিছু শোনা সম্ভব না। সুতরাং আমার একমাত্র সুযোগ হোল ভোরবেলা উঠে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এসি থেকে বেরিয়ে এই গরমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা মনে হতেই সারা গা শিউরে উঠলো। কিন্তু আর কোন উপায় নেই। প্রথমদিন পরীক্ষামূলকভাবে দাঁড়িয়ে দেখলাম খুব ভালোভাবে কান পেতে শুনলে, খুব হাল্কাভাবে আজানের শব্দ ভেসে আসে। ঐ হাল্কা একটু শব্দ কান পেতে শুনে থাকতাম যতক্ষণ শোনা যায়। মনে হত পিপাসার্তের মত ঐ শব্দ শুষে নিতাম সারাদিনের জন্য। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে নামাজ পড়তে চলে যেতাম।

আজানের শব্দের অভাব যে কাউকে এভাবে তাড়িত করতে পারে, নিজে অনুভব না করলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো এই কষ্ট করবনা। কিন্তু আমার ইচ্ছায় তো আর পৃথিবী চলেনা! তাই আবার এসে পড়েছি ক্যানাডায়। কতগুলো মসজিদ! অথচ আজানের শব্দ নেই। মসজিদের ভেতরে আজান শোনা যায়, কিন্তু বাইরে নিস্তব্ধ। কেউ কেউ কম্পিউটারে আজান শোনার ব্যবস্থা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। আমি ভাবি আমার ছেলেমেয়েদের কথা। ওরা কি কখনো অনুভব করবে “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম”- এর সেই অদৃশ্য টান যা বিছানার আরাম থেকে আমাদের টেনে নিয়ে যায় ‘সাফল্যের পথে’? ওরা কি কোনদিন শুনবে সেই আলৌকিক শব্দ যা তাদের এই পৃথিবীর ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাবে বেহেস্তের কোন এক প্রান্তরে? ওরা কি কখনো জানবে ওরা কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিদিন, দিনে পাঁচবার করে এক অসাধারন আহবান থেকে যার সাথে সময় দেখে নামাজ পড়ার কোন তুলনা হয়না!

No comments:

Post a Comment