Saturday, August 14, 2010

ওরা পাকিস্তানী


২০০৮ সালের নভেম্বরে আমরা যখন ক্যাল্গেরী এসে পৌঁছলাম তখন শীত শুরু হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে সেবারের শীত ছিল গত দশ বারো বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। বাংলাদেশের ভয়াবহ গরম থেকে সবেমাত্র এসে হঠাৎ মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতে তখনো আমরা কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় খুব একটা বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য ছেলেকে স্ট্রলারে নিয়ে বেরিয়েছি। তাপমাত্রা মাইনাস ৩০/৩৫ হবে। কিন্তু মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো বরফের স্তুপ। তখন মাত্র একপশলা স্নো পড়েছে। সাধারণত স্নো পড়া বন্ধ হলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা শুরু হয়। কিন্তু দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত বরফ তখনো সরানোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছেনা। বহু কষ্টে বরফের স্তুপ ঠেলে ঠেলে স্ট্রলার নিয়ে পাড়ার ভেতর দিয়ে রাস্তার কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছলাম। কিন্তু রাস্তা থেকে তিনচারহাত দূরে স্ট্রলার যে আটকে গেল, সামনেও নিতে পারিনা, পেছনেও আসেনা। নির্জন রাস্তা, বরফের মৌসুমে লোকজন দেখাই যায়না, মেয়ের স্কুলের ছুটির সময় হয়ে এলো প্রায়, ছেলেকে কোলে নিয়ে এতদুর যেতে পারবনা, কিন্তু ছেলে এই বরফের মধ্যে হাঁটতে গেলে ডুবে যাবে – ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। ব্যাতিব্যস্ত হওয়াতে খেয়ালই করিনি কখন এক ক্যানাডিয়ান লোক রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে বিরাট পা ফেলে বরফের দেয়াল পেরিয়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছ?” বললাম, “রাস্তার ওপাড়ের স্কুলে”। সে বাচ্চাসহ স্ট্রলার খেলনার মত তুলে নিয়ে রাস্তার ওপাড়ে নামিয়ে দিয়ে বল্ল, “তুমি বললে আমি তোমাদের স্কুলের সামনে নামিয়ে দিতে পারি”। এদের সাহায্য করার স্বভাব এত বেশী যে ওর অফারে মোটেই আশ্চর্য হলাম না। তবুও ধন্যবাদ দিয়ে তাকে যেতে দিলাম।

লোকটা চলে যেতেই দেখলাম রাস্তার অন্যপাড়েও একই সমস্যা। স্ট্রলার সামনেও যায়না, পেছনেও যায়না! কি করব ভাবছি এমন সময় দেখি একজন লোক মুখেচোখে মাফলার বেঁধে দৌড়াতে দৌড়াতে কাছে এলেন। আমাদের দেশে হলে ভয় পেতাম। কিন্তু এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ থেকে নীচে চলে গেলে এটা না করে উপায় নেই, মুখের মাংসপেশী জমে যেতে পারে। লোকটা বল্ল, “তুমি মনে হয় নতুন এসেছ, নইলে এমন আবহাওয়ায় কেউ স্ট্রলার নিয়ে বের হয়? তুমি কিছুতেই এই স্নোর ভেতর স্ট্রলার ঠেলতে পারবেনা। যাচ্ছ কোথায় তুমি এই ঠান্ডার ভেতর এত ছোট বাচ্চা নিয়ে? বাচ্চা বাসায় রেখে এলেনা কেন?” এতগুলো প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থা তখন নেই আমার। বললাম, “মেয়েকে আনতে স্কুলে যাচ্ছি। বাসায় কেউ নেই যার কাছে বাচ্চা রেখে আসতে পারি”। লোকটা বল্ল, “আমিও স্কুলে যাচ্ছি আমার ছেলেমেয়েদের আনতে। এক কাজ কর। তোমার ছেলেকে আমি কোলে নিয়ে নিচ্ছি। তুমি খালি স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে আস। তাহলে তোমার আর কষ্ট হবেনা”।

অনেক রাতে যেমন লোকজনের কথা বলার মুড থাকেনা, অনেক ঠান্ডায়ও ঐরকম হয়। উনি আমার ছেলেকে ওনার জ্যাকেটের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন, উষ্ণতার স্পর্শে যেন সে একটু প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। আমি খালি স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে চল্লাম। স্কুলে গিয়ে দেখি ওনার বড় মেয়ে জায়নাব আমার মেয়ের এক ক্লাস জুনিয়র আর ছেলে তার এক ক্লাস নীচে। ফেরার পথে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাসা কোথায়?” আমি ঠিকানা বললে উনি বললেন, “আমরাও তো ঐপাড়ায় থাকি! চল, একসাথে যাওয়া যাক”। আমার ছেলেকে এতদুর কোলে নিয়ে উনি একটু কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। তাই এবার ওকে স্ট্রলারে বসিয়ে উনি গলা থেকে মাফলার খুলে স্ট্রলারের সামনে বেঁধে নিলেন। তারপর উনি সামনে থেকে টেনে নিয়ে চল্লেন আর আমি পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে চল্লাম। দেখলাম ওনাদের বাসা আমাদের পাড়ার পেছন দিকটায়। বাসার কাছাকাছি গিয়ে উনি ওনার স্ত্রীকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্ত্রীর পোশাক দেখে এতক্ষণে বুঝলাম ওঁরা পাকিস্তানী। শীতকালে কেউ দরজা বেশীক্ষণ খুলে রাখতে চায়না ঘর ঠান্ডা হয়ে যায় বলে। কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই ওনার স্ত্রী বললেন আমি চাইলে রাদিয়াকে ওনার বাচ্চাদের সাথে স্কুলে পাঠাতে পারি অথবা রিহামকে ওঁদের বাসায় রেখে রাদিয়াকে আনতে যেতে পারি। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বাসায় চলে গেলাম।

আমরা যারা একাত্তুরের অব্যবহিত আগে বা পরে হয়েছি, পাকিস্তানীদের প্রতি বিদ্বেষ তাদের মন মগজ মজ্জায় মিশে আছে। ৫২র ভাষা আন্দোলনের সময় আমার দাদার ছোটভাই, আমার প্রিয় ছোটদাদা ঢাকা মেডিকালের ছাত্র। পাকিস্তানীরা যখন গুলি চালালো তখন একটুর জন্য দাদা রফিক সালাম বরকতদের সারিতে গিয়ে মেশেনি। একাত্তরে ওরা আমার বাবা আর আমার চাচাকে ধরে নিয়ে যায় মেরে ফেলার জন্য। বাবা যদি পাকিস্তানে পড়াশোনার সুবাদে উর্দু বলতে বা বুঝতে না পারত আর এফ কে চৌধুরী যদি দাদার বন্ধু না হতেন, তাহলে আমার আর পৃথিবীতে আসতে হতনা। আমি নিজেও তাদের জ্বালা কম ভোগ করিনি যদিও আমার জন্ম স্বাধীনতার পরে। আবুধাবীতে আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে ছিল যার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধারা ঠ্যাং ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ে সুযোগ পেলেই আমার পেছনে লাগত যেন আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওর বাবার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিয়েছি!

পাকিস্তানের পাঠানদের খুব ভালো দেখেছি। তাদের আহামরি কোন জ্ঞানবুদ্ধি নেই। কিন্তু আমি আবুধাবীতে প্রায়ই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম রাস্তার আইল্যান্ডে যে খেজুর বাগান, তাতে একজন পাঠান সকালসন্ধ্যা কাজ করতেন। প্রতিদিন আজানের সাথে সাথে উনি জামা বদলে ওজু করে বাগানেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমার দেখতে যে কি ভালো লাগত! জুমার রাত এবং জুমার দিন পাঠান ট্যাক্সিচালকরা মুসলমানদের থেকে কোন টাকাপয়সা নিতেন না। ঈদের দিন খেজুরবাগানে যেসব পাঠান কাজ করতেন তারা বাবাকে নামাজ শেষে বাসায় যাবার পথে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ভোজ খাইয়েছিলো। আর আমার ক্লাসের ঐ বজ্জাত মেয়েটার থেকে আমাকে সারাক্ষণ ছায়ার মত আগলে রাখত বিশালকায় একটা পাঠান মেয়ে। কিন্তু পাঞ্জাবীরা হাড়বজ্জাত। ওরা আমাদের যেমন জ্বালিয়েছে, পাকিস্তানের বাকী অঞ্চলের লোকজনকে ঠিক সেভাবেই জ্বালিয়ে খাচ্ছে। সব মিলে সাধারণভাবে পাকিস্তানীদের আমার খুব একটা পছন্দ না। তাই ওদের সাথে আর যোগাযোগ হয়ে উঠলোনা।

শীত যাই যাই করছে এমন সময় একদিন ঐ লোক একবাটি ফিরনী নিয়ে উপস্থিত, সাথে বন্ধুত্বের আহবান! ততদিনে স্কুলে আমার মেয়ের সাথে জায়নাবের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ওনাদের মিষ্টি আহবানে আমি ঝাল ঝাল পাকোড়া দিয়ে সাড়া দিলাম। পরে জানতে পারলাম ওনাদের বাড়ী পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে। তখন নিজেই লজ্জা পেলাম। ঐ অঞ্চলের লোকজন খুব সহজসরল আর ভালো হয়। যেমন তার কিছু দিন পর আমরা পাড়ার মধ্যেই আরেকটা বাসায় শিফট করলাম। বেচারা, ওনার নাম শাফকাত, বৃষ্টির মধ্যে নিজে মাথায় করে ভারী বিছানা আগের বাসা থেকে নতুন বাসায় এনে আমাদের সাথে ধরাধরি করে সেট করে দিলেন। শিফট করার শেষদিন রান্না করতে কষ্ট হবে দেখে ওনার স্ত্রী হাবিবা আমাদের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ালেন। আমাদের পাড়ায় দু’টো বাংলাদেশী পরিবার আছে। তাদের কাছেও আমরা এই সহযোগিতা আশা করিনি। তাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই সাহায্য আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে দিল।

বাসা গোছগাছ হওয়ার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমরা তাঁদের দাওয়াত দিলাম। আমার জানা ছিলোনা যে ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের লোকজন ঝাল খায়না। ঝাল কমিয়ে রান্না করার পরও তাঁদের মুখ ঝালে লাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা আচার আচরণ কথাবার্তায় বুঝতেই দিলেন না যে তাঁদের খেতে কষ্ট হয়েছে। যখন ধারণা করলাম ঘটনা কি, আমি নিজেই লজ্জায় মারা যাচ্ছি। কিন্তু তাদের ভদ্রতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

কিছিদনের মধ্যে দেখা গেল হাবিবা পাড়ার ছেলেমেয়েদের ক্কুর’আন পড়তে শেখায়। আমাদের বাংলাদেশীদের অধিকাংশই বিদেশে এসে হালাল হারামের ধার ধারেননা আর ইসলামিক লোকজন আমরা তখনো খুঁজে পাইনি। তাই আমরা খুব বিপদে পড়ে গেছিলাম যে কাকে জিজ্ঞেস করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। প্রত্যেকটা খাবার কেনার জন্য প্যাকেটের ওপর ইনগ্রেডিয়েন্টস পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। প্রতিবেলা বাসায় রান্না করতে করতে মনে হচ্ছিল এর থেকে বুঝি আর নিস্তার নেই। শাফকাত ভাই আমাদের অনেক মসজিদ, হালাল দোকানপাট চিনিয়ে দিলেন। দেখলাম ক্যাল্গেরীতে ভুড়ি ভুড়ি মুসলিম দোকানপাট আর হালাল রেস্টুরেন্ট আছে। বিভিন্ন দোকানে যে কাঁচা খাবারের প্যাকেট পাওয়া যার তার ওপরেই কোম্পানীর ফোন নাম্বার দেয়া থাকে। ফ্যাক্টরীতে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যায় এতে শুকরজাত কোন উপাদান বা জেলাটিন আছে কি’না ইত্যাদি। শিখলাম নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলো কোনটা কোন কোম্পানীর কিনলাম সেটা মুখস্ত করে ফেলতে হবে আর তার পর থেকে সবসময় একই কোম্পানীর কিনতে হবে, নতুবা নতুন ব্র্যান্ড কিনতে হলে আবার ফ্যাক্টরীতে ফোন করতে হবে। আমাদের যতদিন গাড়ী ছিলনা ততদিন উনি আমাদের বাজারে নিয়ে যেতেন আবার বাসার সামনে বাজার নামিয়ে দিয়ে যেতেন নিজের হাতে।

সেবার স্কুল শুরু হওয়ার পর থেকে রাদিয়ায় তাদের সাথে স্কুলে যেতে শুরু করল। হাবিবা প্রায়ই নানারকম তরকারী নাস্তা বানিয়ে পাঠায়। পরে দেখলাম শুধু আমাদের নয়, পাড়ার যত পরিচিত লোকজন, অসুস্থ রোগী সবাইকে সে নিয়মিত খাবার পাঠায়, কারো অসুবিধা থাকলে তাদের বাচ্চাদের ওদের বাসায় রেখে যায়। আমি নিজেও একবার এক মৃত ব্যাক্তিকে দেখতে যাওয়ার সময় আমার ছেলেমেয়েদের হাবিবার কাছে রেখে গেলাম। তখন রাদিয়া জানালো শাফকাতভাই বাচ্চাদের জন্য নানারকম খেলনা বানান আর পাড়ার তাবৎ বাচ্চাদের খেলতে দেন। বিশেষ করে ওনার হাতে বানানো প্লেন আর অটোমেটিক স্কিপিং রোপ বাচ্চাদের খুব পছন্দ হোল।

কিছুদিনের মধ্যে আমার হাবিবার সাথে এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে রান্নার মাঝে লবণ মরিচ পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেলে আমি নির্দ্বিধায় ওর বাসা থেকে নিয়ে আসতে শুরু করলাম। বাচ্চাদের খেলনা, রিহামের সেই বিখ্যাত স্ট্রলার আদানপ্রদান হোল।

এর কিছুদিন পর আমি একটা কোর্সে ভর্তি হলাম। হাবিবা বারবার অনুরোধ করল রিহামকে ওর কাছে রেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি পারতপক্ষে লোকজনকে কষ্ট দিতে পছন্দ করিনা। তাই ওকে ডে-কেয়ারে রাখার ব্যাবস্থা করলাম। কোর্সের শেষাংশে দেড়মাস চাকরী ছিল। আমার ভাগ্য ভাল। একটা বড় গ্যাস কোম্পানীতে কাজ পেলাম। যাওয়া হত সকাল সাতটায় যেখানে সূর্যোদয় হয় সকাল ন’টায়। বাচ্চাদের ঘুমে দেখে যেতাম। বাড়ী ফিরতাম সন্ধ্যা পাঁচটায় অথচ সূর্যাস্ত হত সাড়ে চারটায়। চাকরীটা ভালোই ছিল। নামাযের ব্যাপারে কোন অসুবিধা ছিলনা। আমাদের বাসা রেলস্টেশন থেকে দুই মিনিটের হাঁটাপথ। তাই মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতেও যাওয়া আসাতে খুব একটা কষ্ট হতনা। ডাউনটাউনের সব বিল্ডিং কাঁচের টানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত। তাই বাইরে যখন মাইনাস ৪০ তখন লোকজন টানেলে +১৫ ডিগ্রীতে চলাফেরা করতে পারে যে কারণে এই টানেলগুলোর নামই প্লাস ফিফটিন। কিন্তু দেখা গেল কাজ করে এসে, ঘর গুছিয়ে, রান্না করে বাচ্চাদের কিছুতেই সময় দিতে পারছিনা। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম দেড়মাস পূর্ণ হয়ে গেলে আর চাকরীর নামও নেবনা।

আমাদের পাঁচটা ছ’টার মধ্যে খেয়ে ফেলার অভ্যাস। দেখা গেল পাঁচটায় এসে ছ’টার ভেতর রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে সব গুছিয়ে দশটার মধ্যে শুতে গিয়ে কিছুতেই আর কুলিয়ে উঠতে পারিনা। আমার বাচ্চাদের কখনো বাইরের খাবার, ফাস্টফুড বা প্যাকেটজাত খাবারের অভ্যাস করাইনি। তাই টেনশানটা ছিল বেশী। এ’সময় হাবিবা প্রতি সপ্তাহে নিজে থেকেই দু’তিনবার করে খাবার পাঠাতে শুরু করল। একদিন শরীর খারাপ ছিল। সাধারণত আমি আর কিছু না হোক ভাত রান্না করে যেতাম যেন সাড়ে তিনটায় আমার মেয়ে যখন আসে তখন অন্তত ডিম ভেজে হলেও যেন খেয়ে নিতে পারে। সেদিন ভাতও রান্না করা হয়নি। অফিসে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিনা। চারটা বাজতেই ছুটলাম রেল স্টেশনের দিকে। মনে মনে ভাবছি আমার ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে নিশ্চয়ই শুকনো মুখে বসে আছে। যাব, রান্না করব, তারপর ওরা খাবে, কত দেরী হয়ে যাবে! আমার মেয়েটা আবার ক্ষিদে সহ্য করতে পারেনা। এত কষ্ট লাগছিল আমার বাচ্চাদের জন্য যে নিজেকে অপদার্থ মা হিসেবে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। সেদিন বরফ পড়ে রেললাইন স্লিপারী হয়ে গিয়েছে, সব চলছে ধীরগতিতে আর আমার হার্টবিট বেড়ে চলেছে প্রতি সেকেন্ডে। স্টেশনে যখন নেমেছি তখনই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি বাসায় উড়ে চলে যাই। স্টেশনের ওপরতলায় উঠতেই শুনি কেউ ডাকছে, “রেহনুমা!” তাকিয়ে দেখি সামির, আমাদের ক্লাসের আলজিরিয়ান ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার। সে স্টেশন পরিবর্তন করতে নেমেছে। পথে আমাকে দেখে খবর নিতে ডাক দিল। সামিরকে আমি খুব পছন্দ করতাম তার শান্ত স্বভাব আর ইসলামপ্রীতির জন্য। কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিল এই দেখাটা আরেকদিন হলে ভালো হত। অনেকটা অভদ্রভাবেই ওর সাথে বাক্যালাপ সংক্ষিপ্ত করে বাসার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম সামিরকে একদিন দাওয়াত খাইয়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করে নেব।

বাসার দরজায় এসে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখের চামড়া টেনশানে চড়চড় করছে। নামাজ আগে পড়ব না ভাত আগে বসাব? চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি আমার ছেলেমেয়ে কিচেনের ডাইনিং টেবিলে বসে মহা উৎসাহে কথাবার্তা বলছে। ভীষণ অপরাধবোধ হোল যে বেচারারা নিশ্চয়ই উল্লসিত যে মা এসেছে, এবার রান্না হবে, খাওয়া দাওয়া হবে! তাকিয়ে দেখি ওরা অলরেডী খাচ্ছে। হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম হাফিজ সাহেবকে আল্লাহ রহমত করুন। আমি বাসায় থাকলে উনি প্রায়ই রান্না করেন কিন্তু না থাকলে কেন যে করেন না আল্লাহ জানেন! শেষপর্যন্ত আল্লাহ ওনাকে হেদায়েত করেছেন। রাদিয়াকে বললাম, “কি খাচ্ছ আম্মু?” ও মহা আনন্দে বল্ল, “বিরিয়ানী”। হাফিজ সাহেব তো বিরিয়ানী রান্না করতে পারেন না! “তোমরা বিরিয়ানী পেলে কোথায়?” “হাবিবা আন্টি পাঠিয়েছে”, বলেই আবার খাওয়া দাওয়ায় মনোনিবেশ করল দুই ভাইবোন।

কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো। আল্লাহ তোমাকে ধন্যবাদ এই পাকিস্তানীদের জন্য!

1 comment:

  1. কাকতলীয় ব্যাপার!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!! মাত্র গত পরশু এই ধরনের একটা ঘটনায় পাকিস্তানীদের উপর আমার রাগ/বিরক্তি চেইঞ্জ হয়ে গিয়েছে; আর আজকেই আপনার এই পোষ্ট!!!!!!! লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো ম্যাডাম।

    ReplyDelete