যাই হোক, একবারের
ঈদের কথা খুব মনে পড়ে। তখন আমার বয়স দশ কি এগারো হবে। সেহরী খেয়ে হাঁসফাস করছি।
আবুধাবীর উষ্ণ মরু অঞ্চলে দীর্ঘ দিবস রোজা রাখার জন্য খাবারের চেয়েও পানি খাওয়া
জরুরী ছিল, আর এই পানি খেতেই আমার যত সমস্যা, পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ধীরেসুস্থে ফজর
পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় রাতের টহল পুলিশের উচ্ছ্বাসধ্বনি শুনতে পেলাম, ‘সালাতুল
ঈদ, হাইয়া; ঈদের নামাজের জন্য এসো’। বেশির ভাগ মানুষ ঈদের নামাজ পেলোনা কারণ
অনেকেই ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে, ঈদের ঘোষনা শুনতেই পায়নি। মহিলারা বিরাট ঝামেলায় পড়ে গিয়েছেন
কারণ কারো কিছু রান্না করা নেই, মেহমান এলে খেতে দেবেন কি? লোকজন যেহেতু অফিসে
যাবার প্ল্যান নিয়ে শুতে গেছে, উঠে শুনছে ঈদ, কেউ ঠিক করতে পারছেনা কোথায় যাবে কি
করবে। ঘটনা হোল, আমরা সবাই উনত্রিশে রোজার সেহরী খেয়েছি। তার মানে ঈদ হয়ে গেল আটাশ
রোজায়! অথচ ঈদের চাঁদ আকাশে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! পরে গবেষনা করে জানা গেল সরকারের
লোকজন রোজা একদিন কম রাখতে হবার জন্য প্রায় বছরই চাঁদ দেখা যাবার একদিন পর চাঁদ
দেখার ঘোষনা দিত যে কারণে আমি আবুধাবীতে এর আগে ত্রিশ রোজা তেমন দেখেছি বলে মনে
করতে পারিনা। সে বছর আল্লাহ ওদের সাথে একটু মজা করলেন। ওরা ভাবল রোজা ত্রিশ দিনের
হবে তাই নিয়মমাফিক একদিন পর রোজা শুরু হবার ঘোষনা দিল। কিন্তু সে বছর আদতেই রোজা
ছিল উনত্রিশটা। আর চাঁদটাও দেখা গেল শেষ রাতে, ফলে টহল পুলিশরা আনন্দ উচ্ছ্বাসে
রোজা ক’টা পেরোল গুনতে ভুলে গেল। পরে সরকারকে নাকে খত দিয়ে সব স্বীকার করতে হোল।
জনগণকে জানাতে হোল আরেকটি করে রোজা পূরণ করে দিতে। এর পর থেকে উনত্রিশ রোজা তেমন
পেয়েছি বলে মনে পড়েনা!
পক্ষান্তরে
ক্যানাডায় এসে গত পাঁচ বছরে উনত্রিশ রোজা পেয়েছি বলে মনে পড়েনা, এবারই প্রথম পেতে
যাচ্ছি। বহু বছর পর এই ক্যাল্গারীতে এসে আবার সেই ছোটবেলার ঈদের স্বাদ পাচ্ছি।
কয়েকটি বন্ধু পরিবার মিলে আমাদের একটি পরিবার আছে এখানে। আমরা সব কাজ একসাথে করি,
দুঃখ কষ্ট আনন্দ একসাথে ভাগাভাগি করে নেই। রামাদান শুরু হবার দু’দিন আগে বাসা
পরিবর্তন করলাম। তখন সবাই মিলে আমাদের বাসায় বাটিতে বাটিতে খাবার দিয়ে গেলেন, সেই
খাবার চলল প্রায় দশ দিন। রামাদান শুরু হবার পর প্রায় প্রতি রাতে সবাই মিলে তারাবী
পড়তে মসজিদে যাওয়া, একজনের অসুবিধা থাকলে আরেকজন তাকে তুলে নেয়া এবং নামিয়ে দেয়া,
প্রতি শুক্রবার এবং শেষ দশদিন বেজোড় রাতগুলোতে সবাই মিলে রাত জেগে নামাজ পড়া,
আলোচনা করা, প্রতি শনিবার বিকেলে সবাই মিলে কুর’আন পড়া, আড়াইশো লোকের ইফতার পার্টির
আয়োজন করা, অতঃপর নিজেরা একদিন একত্রে ইফতার করা যেখানে লোকসংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ জন,
ইফতারে কিংবা রাত জাগায় সবাই মিলে অল্প অল্প রান্না করে আনা যেন কেউ ক্লান্ত না হয়
বা কারো নামাজ পড়তে কষ্ট না হয়, সবাই সবাইকে ছোট্ট ছোট্ট উপহার দেয়া কিন্তু কেউ
নিজের জন্য কিছু না কিনে দেশে আত্মীয়স্বজন দরিদ্রদের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেয়া - এই ছিল আমাদের রামাদান। ঈদের দিন আমরা সবাই একত্রে
নামাজে যাব যেখানে সারা বিশ্বের আরো লক্ষ মুসল্লী একত্রিত হবে, বান্ধবীর ভাষায়, ‘মনে
হয় যেন হজ্জ্বের মৌসুম, প্রতিটি দরজা দিয়ে মানুষ প্রবেশ করছে ঈদগাহে, কেবল মানুষ
আর মানুষ, সাদা কালো লাল হলুদ রংবেরঙ্গের মানুষ, কত ধাঁচের কত রঙের বাহারী পোশাক
তাদের! কিন্তু প্রত্যেকের মুখে একই প্রশংসা,
‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু
আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। রাতে আমরা প্রায় একশ জন একত্রিত হব,
প্রত্যেকের দায়িত্ব একটি করে রান্নার আয়োজন, মূল উদ্দেশ্য সবাই মিলে অল্প খাওয়া আর
অনেক গল্প করা।
আল্লাহ বলেছেন সৎকর্মে
পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করতে, আমার এই বান্ধবীদের দেখলে মনে হয় এরা সবাই দৌড়
প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। কিন্তু ব্যাপারটা এমন যে তারা একা দৌড়াচ্ছেন না, কেউ কাউকে
ফেলেও যাচ্ছেন না, একজন পড়ে গেলে সবাই মিলে তাকে উঠিয়ে নিয়ে সম্মিলিতভাবে
দৌড়াচ্ছেন। আমি এই প্রতিযোগিতায় দুর্বল প্রতিযোগী। কিন্তু তাদের সাহচর্যে আশা জাগে
হয়ত কিয়ামতের কঠিন ময়দানেও আমরা একত্রে উত্থিত হব, সেখানে তারা যে ছায়া পাবেন তার
অল্প একটু ভাগ হয়ত আমিও পেতে পারি! এই পরিবারটির জন্য আমার প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করে কি শেষ করতে পারব?