Wednesday, March 27, 2013

ভালোবাসার স্বভাব, ভালোবাসার অভাব

১/

 কাজ থেকে ফিরছিলাম। ট্রেন স্টেশন থেকে বেরোবার পথে বেশিরভাগ মানুষ ডানদিকে চলে গেল, বামদিকে আমার সামনে কেবল এক মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই। আমি সাধারনত খুব দ্রুত হাঁটি, এই মহিলা বুঝলাম আমার চেয়েও দ্রুত হাঁটছেন, কারণ পেছন থেকে কেবল তাঁর ঋজু দেহখানা দেখতে পাচ্ছি, চেহারা দেখছিনা। দু’জনেই বাঁয়ে মোড় ঘুরলাম। দেখি মহিলার হাঁটার গতি আরো বেড়ে গেল। রাস্তার পাশে একখানা লাল গাড়ী, স্টিয়ারিং উইলে এক বৃদ্ধ দাদামশায় উৎসুক ভঙ্গিতে বসে আছেন, মুখের হাতের চামড়ায় কুঁচকানো দেখে বোঝা যাচ্ছে ভালোই বয়স হয়েছে। মহিলা দ্রুত হেঁটে গাড়িতে ওঠার পর খেয়াল করলাম তিনি হলেন দাদামশায়ের স্ত্রী, মাথার সব চুলই শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে, আজন্ম স্নো ক্রীমে লালিত মুখখানাতেও ভাঁজ পড়েছে ভালই। দাদীমা গিয়ে বসতেই দাদামশায় একগাল হাসি দিয়ে গাড়ীতে স্টার্ট দিলেন, দাদীর মুখ থেকে সারাদিনের ক্লান্তির সব চিহ্ন উবে গেল। তাঁদের এই চৌম্বকীয় ভালোবাসার দৃশ্যের সাক্ষীটির মনটা পরম মমতায় ভরে উঠল। আজকের যুগের দেহসর্বস্ব ভালোবাসার ভিড়ে এমন নিখাদ ভালোবাসার গভীরতা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ কি প্রতিদিন মেলে?  

২/
কেউ ভাবেনি বিয়েটা টিকবে। মেয়েটি নিজেও না। স্বামী প্রবাসী, বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে কিন্তু স্ত্রীকে নিতে পারছেনা। মেয়েটি অত্যন্ত মেধাবী, যতদিনে স্বামীর তাকে নেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হোল ততদিনে সে লেখাপড়ার মধ্যাবস্থায়, পড়াশোনা শেষ না করে সে কিছুতেই যাবেনা। স্বামী বলতে শুরু করল সে আবার বিয়ে করবে, মেয়েটি বলল, ‘তাহলে আমি আর গিয়ে কি করব?’ স্বামী ছুটিতে দেশে এসেছে, স্ত্রী যাবেনা। আত্মীয়স্বজন ভাবছে এই বিয়ে কিছুতেই টিকবেনা। এমন এক অবস্থায় ওরা দু’জনেই এলো আমার কাছে। মেয়েটিকে বললাম সবকিছু ছেড়ে চলে যাও।

সে হতবাক হয়ে বলল, ‘আপনি একজন শিক্ষক হয়ে কি করে এমন একটি কথা বলতে পারলেন?’
বললাম, ‘শোন, শিক্ষক বলেই এ’কথা বলতে পারলাম। তোমার মেধা আছে। এই মেধা কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা। আমি জানি একদিন তোমার লেখাপড়া ডিগ্রী ভবিষ্যত সব হবে কিন্তু সেদিন এই সম্পর্কের জন্য তোমার আফসোস হবে, ‘যদি আমি চেষ্টা করতাম, হয়ত আমার সংসারটা টিকত!’

সে বলল, ‘কিন্তু সে তো বলছে সে আবার বিয়ে করবে, তাহলে ওর সাথে গিয়ে আমার লাভ কি?’
বললাম, ‘রাগের মাথায় মানুষ অনেক কথাই বলে। তুমি পাশে নেই তাই তোমাকে ভয় দেখিয়ে সাথে নিতে চায়। এগুলো ভালোবাসাপ্রসূত অভিমান, বদনিয়ত নয়’।

সে আমার কথা বিশ্বাস করল। আমি আত্মীয় নই, স্বজন নই, নই কিছুই। কিন্তু সে আমার কথার ওপর ভরসা করে এত সাধের লেখাপড়া অসম্পূর্ন রেখে চলে গেল প্রবাসে, স্বামীর সাথে থাকার জন্য।

ক’দিন আগে সে জানালো সে দেশের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তি পেয়েছে। ফেসবুক প্রোফাইলে ওর ফুটফুটে সন্তান দু’টির মুখচ্ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছে আজ সে সব পেয়েছে- স্বামী, সন্তান, শিক্ষার সুযোগ, সাফল্য, সুখ। সামান্য একটু ধৈর্য্য, সামান্য একটু অপেক্ষা, অনেক অনেক বিশ্বাস- এটাই ওর সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু আমরা অনেকেই এই ধৈর্য্যটুকু রাখতে পারিনা, যা চাই তার জন্য অপেক্ষা করতে রাজী থাকিনা, ভাবতে পারিনা যে অনেকসময় ভালোটুকু পাওয়া যায় খারাপের পরেই- এ’টুকু সময় স্থির থাকতে পারলে হয়ত আমরা অনেক কিছুই অর্জন করতে পারতাম যা অনেকে আজীবন সাধনা করেও অর্জন করতে পারেনা।

 ৩/
সেই চেনা পরিচিত রোগগুলো আবার ফিরে আসছিলভোরে অ্যালার্ম বাজবে বলে অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্কুলে যখন বীজগণিত করতাম, কোন অংক না মিললে ঘুমের ভেতরেও মগজ অংক কষতে থাকত। ঘুমের মধ্যে সব অংক ঠিক ঠিক মিলে যেত, অনেক সময় ঘুম থেকে উঠে সেভাবে অংক করলে সত্যিই মিলে যেত! এখন ঘুমের মধ্যে কেবল কোম্পানীর ফাইলপত্র ঘাটতে থাকি, ঘুম শেষ হয়ে যায় কিন্তু কিছুতেই সব কাজ গুছানো শেষ হয়না।

 
প্রথম যেদিন কাজে গেলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার ডেভ বলল, ‘তোমাকে মাটিতে অবতরণ করার আগেই দৌড় শুরু করতে হবে বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু আমরা খুব বেকায়দায় পড়ে গেছি, তোমার সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন’।
সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এখানে আমাদের জাতিসংঘের মত সব দেশের প্রতিনিধিই আছে।  সবাই তোমাকে সাহায্য করবে’।

তবু অনেক অনেকদিন পর কাজ শুরু করেছি, নতুন জায়গা- শরীরের ওপর, মনের ওপর চাপ যাচ্ছিল। তাই রোগগুলো প্রভাব বিস্তার করছিল বেশ।

 
প্রথমদিনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিলো ক্যানাডার জর্ডান, হং কং- এর নেলসন আর পাকিস্তানের ফ্র্যান্সেসকা। লাজুক স্বভাবের ভারতীয় জেকব থাকে আশেপাশেই, প্রয়োজন হলেই এগিয়ে আসে, তারপর আবার ঢুকে পড়ে নিজের গর্তে। ক’দিনের মধ্যেই ভাব জমে গেল ভারতের স্বর্না, ঘানার জেরাল্ড, চীনের সানি, ক্যানাডার ডনার সাথে। অন্যরা থাকে আশেপাশেই, সুযোগ এলেই এগিয়ে আসে।

আজ সকালে গ্রুপলিডার লিন বলল, ‘আমরা কিছুদিনের মধ্যেই তোমাকে একজন সহযোগী দিতে যাচ্ছি। সে পর্যন্ত একটু কষ্ট করে চালিয়ে যাও’।

কিন্তু বেশিক্ষণ চালাতে হোলনা। কিছুক্ষণ পরই জেরাল্ড, নেলসন আর ফ্র্যান্সেসকা মিলে আমার বাকী কাজগুলো ভাগ করে নিয়ে বলল, ‘আজ তুমি বিশ্রাম নাও, কাজ আমরা করছি’। আস্তে আস্তে রোগমুক্ত হয়ে যাচ্ছি নিজের অজান্তেই!

এই বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের রূপ দেখে ভাবি, যে ফুলটিকে বাঁচাব বলে আমরা একদিন রক্ত ঝরিয়েছিলাম সে ফুলটিকে আজ আমরা নিজেরাই রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন করে ফেলছি। পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে এসে একটি ভিনদেশে আমরা একত্রিত হতে পারি, অথচ নিজের দেশে নিজের মাটিতে আমরা ভাই ভাই এক হতে পারিনা! হা কপাল!

Sunday, March 3, 2013

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে একটি উপহার চাই

আমার কন্যা ঝালমুড়ি খাবে বলে বায়না করছিল। ঝালমুড়ি বানিয়ে এনে দেখি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকলাম। বলল, ‘পরে খাব’। এখন আমি ওর পাশে বসে কম্পিউটারে খুটখাট আওয়াজ তুলে কাজ করছি, ওর কোন খবরই নেই। মায়ের পাশে শুয়ে আছে এটাই যেন মহাশান্তি!

 
কিছুদিন যাবত আমার মেয়ে আমার জামাকাপড় পরা শুরু করেছে। যখন ইচ্ছে হয় তখন সে আমার জামাকাপড় থেকে যেটা পছন্দ নিয়ে পরে। আবার কিছু খুব পছন্দ হলে নিয়ে নেয়। কি যে ভাল লাগে তখন! আর মাত্র ক’দিন পর আমার মেয়ের বয়স তেরো হবে। তেরো বছর আগে স্বাধীনতা দিবসের পরদিন সে নিজেও স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছুল। ও আমার বন্ধনমুক্ত হবার সাথে সাথে ডাক্তার নাহিদ আপা আমার সামনে ধরে বললেন, ‘দেখ, তোমার মেয়ে হয়েছে!’ ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, ‘এ কি! জন্মালো আমার ভেতর থেকে, অথচ চেহারা সুরত এমনকি দেহের প্রতিটি ভাঁজ পর্যন্ত হাফিজ সাহেবের! অন্যায়, মহা অন্যায়!’ জন্মের সময় ওর দৈর্ঘ্য আমার কনুই থেকে হাতের সমানও ছিলোনা, কোলে নিতে ভয় পেতাম, মনে হত এত নরম, আঙ্গুল ভেঙ্গে যাবে হয়ত, কিংবা হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাবে। আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিলোনা কিন্তু কন্যা ছিল স্বাস্থ্যবতী। ওর ছিল চরম ক্ষুধা, একবার খেয়েই আবার ক্ষিদে লেগে যেত। নিজের অক্ষমতায় তখন চোখ ফেটে কান্না আসত। ননদিনীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কি ওর দুধ মা হবে?’ সাড়ে চার মাস থেকে বাধ্য হয়ে অল্প অল্প ডিম, কলা ইত্যাদি খাবার দিতে শুরু করলাম।

 ওর দু’মাস বয়সে যখন কাজে ফিরে যেতে হোল তখন একবার ভাবলাম চাকরী ছেড়ে দেই, যখন দেখলাম সম্ভব নয় তখন ঠিক করলাম ওকে সাথে নিয়ে যাব। শিক্ষকতার সুবিধা হোল ফাঁকে ফ্রি পিরিয়ড থাকে। তখন গিয়ে ওকে গোসল করিয়ে খাইয়ে আসতে পারতাম। বাকী সময় সে নিজে নিজে খেলত, সাথে থাকত পিয়ন রুবি, সাজেদা, সালেহা, মোমেনা আপা কিংবা দারোয়ান ভাই। ফ্রি পিরিয়ডে মেয়ের পেছনে সময় দেয়ার ফলে যখন বাসায় ফিরতাম তখন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খাতা জমে যেত দুই তিন প্যাকেট, রাদিয়ার জামাকাপড়ের ব্যাগ দু’টো, আমার ব্যাগ আর রাদিয়া মিলে ছয় সাতটা প্যাকেট। বাসায় তখন সবাই ভাতঘুমে অচেতন। প্রতিদিন ওদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দরজা খোলাতে আমার খুব খারাপ লাগত। কেউ ঘুমোলে এত মায়া লাগে, মনে হয় কারো ঘুম ভাঙ্গানো অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। তবে কেউ জেগে ওঠা পর্যন্ত ঐ দশ পনেরো মিনিট এতগুলো প্যাকেট নিয়ে দরজার বাইরে অপেক্ষা করার পর মনে হত হাত দু’টো খসে পড়ে যাবে। যে দরজা খুলে দিত তাকে চুমো দিতে ইচ্ছে করত। কখনো কখনো আব্বা মসজিদে যাবার পথে আমাকে দেখে আধাপথ থেকে ফিরে আসতেন। রাদিয়াকে কোলে নিয়ে তিনতলায় উঠে চাবি দিয়ে দরজা খুলে আমাকে বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে আবার রওয়ানা হতেন। তখন আব্বাকে মনে হত যেন আকাশ থেকে নেমে আসা ফেরেস্তা।

এই কঠিন দিনও একসময় কেটে গেল। স্কুল ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম, খাতা টানাটানি বন্ধ হোল। আমার মেয়ে হাফিজ সাহেবের মতই হৃষ্টপুষ্ট আকার ধারণ করল। হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন হুট করে হাঁটতে শুরু করল। দেড় বছর বয়সেই নিজের হাতে ভাত খেতে শিখে গেল, দু’বছর বয়সে কাপড় পরা। তিন বছর বয়স হতে না হতেই সে মাতৃরূপে আবির্ভূত হোল। আমি খেতে বসলে চামচ দিয়ে তরকারী বেড়ে দেয়, খেলনা দিয়ে খেলা শেষ করে নিজেই তুলে রাখে, মাথা ব্যাথা করলে চুপচাপ পাশে বসে থাকে যদি কিছু প্রয়োজন হয়। এত লক্ষ্মী ছিল বলেই আমরা ওর দু’বছর বয়সে ওকে নিয়ে মটরসাইকেলে চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ ঘুরে আসার সাহস করতে পেরেছিলাম। একদিন বিছানা গুছানোর পর ও বিছানায় বসে খেলছিল, আমি ঘর পরিস্কার করছিলাম। কাজ শেষে ওকে বললাম, ‘চাদরটা টেনে ঠিক করে দাও। তারপর চল নীচতলায় দাদুর বাসায় যাই’। সে বলল, ‘আম্মু, বেহেস্তে গেলে কি বিছানা গুছাতে হবে?’ বললাম, ‘না মা, ওখানে সব অটোমেটিক হবে, আমাদের কোন কাজ করতে হবেনা’। সে বলল, ‘তাহলে আব্বুকে বলনা আমরা মটরসাইকেলে করে বেহেস্তে চলে যাই! তাহলে তোমার কোন কষ্ট করতে হবেনা, আমারও অগোছালো করলে আর গুছাতে হবেনা’। তিন বছরের কন্যার কথা শুনে তো আমি থ!

 ওর ছ’বছরের সময় রিহামের অস্তিত্ব টের পেলাম। ছোট ভাইটার আগমনের আগেই আমার কন্যা দায়িত্বশীল বড়বোনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হোল। রিহাম আমার ভেতর বেশি নড়াচড়া করলে বলত, ‘বেবি, তুমি এত নড়াচড়া কর কেন? আম্মুর কষ্ট হয় তো!’ সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরলে হাত পা জ্বালা করত। অস্থির হয়ে যেতাম, কিন্তু বুঝতে পারতাম না কি করলে ভাল লাগবে। আমার ঐ অত্তটুকুন মেয়ে একদিন আমার হাতে পায়ে লোশান লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখ আম্মু, এখন তোমার আরাম লাগবে’। সত্যিই আরাম পেলাম। তারপর থেকে আমার মেয়ে বাসায় ফিরেই আমার সেবায় লেগে যেত। সেই কন্যা এখন মায়ের মতই আমাকে খাবার সময় খেতে মনে করিয়ে দেয়, কাজে ডুবে থাকলে নামাজের জন্য বকা দেয়, ব্যাস্ত থাকলে রিহামকে নিজের সাথে ব্যাস্ত রাখে। মেয়ে যত বড় হচ্ছে ততই আনন্দের সাথে সাথে কষ্টের মাত্রাটাও বাড়ছে।

 যে মূহূর্তে আমার মেয়ে জন্ম নিলো সে মূহূর্ত থেকেই একটা ভাবনা আমার ভেতর কখনো জাগ্রত কখনো ঘুমন্ত অবস্থায় বড় হচ্ছে। আমার মেয়েটিকে আমি এত কষ্ট করে বড় করে একদিন কারো হাতে তুলে দেব। হয়ত সে আমার মেয়েকে আমার মত ভালোবাসবে না, যত্ন করবে না কিংবা মূল্যায়ন করবেনা। এটি এমন এক ক্ষেত্র যেখানে ওর লেখাপড়া, যোগ্যতা বা অন্য কোন মাপকাঠিই ওর সম্মান নিশ্চিত করতে পারবেনা যদি না তারা ওকে ভালবেসে আপন করে নেয়। আমার এত আদরের মেয়েকে কেউ কষ্ট দেবে তা ভাবতেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। অনেকেই সাহস দেন, ‘কি যে বলেন আপা, ও কত লক্ষ্মী মেয়ে! দেখবেন ওকে ওর স্বামী খুব আদর করবে’। কিন্তু একটা মেয়ের কি কেবল একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়? একটা মেয়ের তো বিয়ে হয় পুরো পরিবারটার সাথেই। একজন মানুষ কি এতগুলো মানুষকে সন্তুষ্ট করার ক্ষমতা রাখে? সবাই যদি সহনশীল এবং সহানুভূতিশীল না হয় তাহলে স্বামী ভাল হলেও কি কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এমন অনেক ভাবনাই তাড়িত করে আমাকে।

তবুও মেয়ে যত বড় হচ্ছে, মনে হয় যেন ওকে নিয়ে আমার পরিশ্রম আর স্বপ্ন ততই পূর্ণতার কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে। ও যখন আমার জামা পরে তখন এর মধ্য দিয়ে আমি এই পূর্ণতার প্রতিবিম্ব অবলোকন করেই হয়ত আনন্দে উদ্বেল হই। ভাবছিলাম একজন সরকারপ্রধান, বিশেষ করে যিনি নিজে একজন মা, যিনি তাঁর সকল নাগরিকের প্রতি সমভাবে মাতৃসুলভ, তিনি এই দেশের কল্যাণ এবং উন্নয়নশীল কর্মকান্ডে কতটা আবেগাপ্লুত হবার কথা! কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার জন্মভূমিতে যে অগণিত মা সন্তানহারা হয়েছেন, অকালে বিনষ্ট হয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় জীবন এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? তেরো বছর বয়সের কন্যাকে নিয়ে আমার কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা! তাহলে যে সন্তানদের মায়েরা এতগুলো বছর ধরে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে না জানি কত স্বপ্ন বুনেছিলেন, কত আশার প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন তাদের কেমন লাগছে? যে পুলিশ ভাইটি মারা গেলেন তিনি যেমন এই বাংলা মায়ের সন্তান যে ছেলেটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ভালোবাসায় উদ্বেল হয়ে প্রতিবাদমুখর হতে গিয়ে মারা পড়ল সেও তো এই বাংলা মায়ের সন্তান। তাহলে ওরা কেন পরস্পরকে মারছে? কেন ভাবছেনা ওরা তো আমারই দেশবাসী, আমার ভাই, পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব?!

মনুষ্যত্বের মৃত্যু মানুষের মৃত্যুর চাইতে অনেক বেশি ভয়ানক, পীড়াদায়ক।  আদর্শের মৃত্যু তার চেয়েও বেশি হৃদয়বিদারক। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মাঝে যে চেতনা কাজ করেছে তা ছিল যেকোন মূল্যে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতার পর শেখ সাহেব সরকারপ্রধান ছিলেন, তিনি তালিকার পর তালিকা করার পরেও কেন রাজাকারের শাস্তির ব্যাবস্থা করেননি? কারণ স্বাধীনতার পর অধিকাংশ রাজাকারদের স্থানীয় জনগণই মেরে ফেলে। পাতি রাজাকারদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার পরিবর্তে তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় ঐক্য এবং সংহতিকে সমুন্নত করতে। তাঁর এই সিদ্ধান্তের ফলে পরবর্তী চল্লিশ বছর আমরা একটি এক ও অভিন্ন জাতি হিসেবে মিলেমিশে থেকেছি।

তবে আজ চল্লিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার কেন জেগে উঠল? কারণ আজ তাঁর কন্যার পরিস্থিতির কাছে তাঁর আদর্শ পরাজিত হয়েছে। তিনি তাঁর দলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায় অত্যাচার অনাচার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ্য হয়ে দমন নীতি এবং বাকস্বাধীনতা রহিত করার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর দলের লোকজন জানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের মাঝে কত তীক্ষরূপে বিদ্যমান। এর ধুয়া তুলে তারা একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারেন, অপরদিকে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে মানুষকে মূল প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা থেকে দূরে রাখতে পারেন। নইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে সবার আগে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর কন্যাকে রাজাকার বেয়াইয়ের ছেলের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিতেন, উদাহরণ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সবার আগে বেয়াইয়ের বিচার শুরু করতেন, তিনি নিজেই স্বীকার করতেন দেশের সমস্ত রাজাকার কেবল তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের সদস্য হতে পারেনা এবং কয়েকজন বুড়োকে ফাঁসি দিলেই বাংলাদেশের ঘাড়ে যে কোটি টাকার ঋণ, আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি কিংবা দেশের উন্নয়নে যে বার বার বাঁধা আসছে তার কোনটাই সমাধান হবেনা । কিন্তু দেশপ্রেমের ধ্বজাধারীরা দেশের আইন শৃংখলাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আদালত অমান্য করে, আল্লাহ রাসূল এবং ইসলামকে হেয় করে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে বসল। তাদের সামাল দিতে পুলিশ বাহিনীকে নিয়োগ দিতে গিয়ে দেশে গণহত্যা শুরু হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত তিনি কিছুতেই এই পরিস্থিতি চাইতে পারেন না। কারণ তিনি তো শুধু নিজের দুই সন্তানের মা নন, এই মূহূর্তে তিনি পুরো জাতির মায়ের দায়িত্বে সমাসীন!

তাই ভাবি, আমরা কেন বুঝতে পারছিনা এদিকে আমরা মারামারি করে মরছি আর ওদিকে এমন কেউ ফায়দা লুটে যাচ্ছে যারা এই দেশটাকে ভালই বাসেনা? কেন আমরা এক হয়ে দেশটার জন্য কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ হচ্ছিনা? কেন আমরা আমাদের ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজনের সাথে এমন বিষাক্ত আচরন করছি? কেন অকালে ঝরে যাচ্ছে এমন সব তাজা প্রাণ যাদের একাত্তরে জন্মই হয়নি, যারা এই দেশটাকে ভালোবাসতে শিখেছে কেবল, প্রশ্ন করতে শেখেনি?

ছোটবেলা থেকে বিদেশে বিদেশে কেটেছে। তন্মধ্যে ইন্ডিয়া ছিলাম বেশ কয়েক বছর। দেশের রাজনীতির ব্যাপারে কিছু জানা ছিলোনা, কিন্তু ছোটবেলা থেকে বাবা চাচা দাদার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে দেশটাকে ভালবাসতাম প্রচন্ডভাবে। সাথে ছিলো আমার বামপন্থী পরিবারের আদর্শ- আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনী, তারপরে ইংরেজী শিক্ষার গোড়াপত্তন। তাই দেশ থেকে বই আসত ভুরি ভুরি- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধের বই, মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক বই- পড়তে পড়তে মনে হত আমিও স্টেনগান নিয়ে যুদ্ধ করছি শত্রুপক্ষের সাথে, কচুরীপানার নীচে লুকিয়ে গাদাবন্দুক উঁচিয়ে রেখেছি শত্রুর দিকে তাক করে! সেই আমাকে একদিন আমার ভারতীয় প্রতিবেশি, বান্ধবী অর্চনা এসে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘জানো, আমরা তোমাদের ফারাক্কায় পানি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমরাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, তাই এটা আমাদের অধিকার!’ হঠাৎ আমার চেহারার দিকে নজর পড়ায় সে ভয় পেয়ে গেল, ‘সরি, তুমি প্লিজ আমার ওপর রাগ কোরনা। এগুলো আমাদের ক্লাসে শেখানো হয়েছে। আমি ভেবেছি তুমিও জেনে খুশি হবে!’

আমি দেশকে ভালোবাসি, তাই দেশের এই অবস্থা সহ্য করতে পারিনা যেখানে এক ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয় আরেক ভাইয়ের হাত, যেখানে নিত্য ঝরে পড়ে মুকুলিত প্রাণ, যেখানে কেবল শ্বাপদের হুঙ্কার আর পশুত্বের জয়জয়কার, যে দৃশ্য দেখে দূর হতে হায়ানারা হাসে। আমি চাই একদিন আমার সন্তানরা দেশে ফিরে যাবে। সেখানে থাকবে মনুষ্যত্বের জয়জয়কার, আমরা সবাই এক হব দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য মালয়শিয়া কিংবা সংযুক্ত আরব আমীরাতের মত, আমাদের আদর্শ হবে সমুন্নত এবং আমাদের বিশ্বাস হবে অপরাজিত। একটি দরদী নেতৃত্বই আমাদের সন্তানদের জন্য এমন একটি জন্মভূমি উপহার দিতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেবেন কি এমন একটি জন্মভূমি আমাদের?