এই কঠিন দিনও একসময় কেটে গেল। স্কুল
ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম, খাতা টানাটানি বন্ধ হোল। আমার মেয়ে হাফিজ সাহেবের
মতই হৃষ্টপুষ্ট আকার ধারণ করল। হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন হুট করে হাঁটতে শুরু করল।
দেড় বছর বয়সেই নিজের হাতে ভাত খেতে শিখে গেল, দু’বছর বয়সে কাপড় পরা। তিন বছর বয়স
হতে না হতেই সে মাতৃরূপে আবির্ভূত হোল। আমি খেতে বসলে চামচ দিয়ে তরকারী বেড়ে দেয়,
খেলনা দিয়ে খেলা শেষ করে নিজেই তুলে রাখে, মাথা ব্যাথা করলে চুপচাপ পাশে বসে থাকে
যদি কিছু প্রয়োজন হয়। এত লক্ষ্মী ছিল বলেই আমরা ওর দু’বছর বয়সে ওকে নিয়ে
মটরসাইকেলে চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল, চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ ঘুরে আসার সাহস করতে
পেরেছিলাম। একদিন বিছানা গুছানোর পর ও বিছানায় বসে খেলছিল, আমি ঘর পরিস্কার
করছিলাম। কাজ শেষে ওকে বললাম, ‘চাদরটা টেনে ঠিক করে দাও। তারপর চল নীচতলায় দাদুর
বাসায় যাই’। সে বলল, ‘আম্মু, বেহেস্তে গেলে কি বিছানা গুছাতে হবে?’ বললাম, ‘না মা,
ওখানে সব অটোমেটিক হবে, আমাদের কোন কাজ করতে হবেনা’। সে বলল, ‘তাহলে আব্বুকে বলনা
আমরা মটরসাইকেলে করে বেহেস্তে চলে যাই! তাহলে তোমার কোন কষ্ট করতে হবেনা, আমারও
অগোছালো করলে আর গুছাতে হবেনা’। তিন বছরের কন্যার কথা শুনে তো আমি থ!
তবুও মেয়ে যত বড় হচ্ছে, মনে হয় যেন ওকে
নিয়ে আমার পরিশ্রম আর স্বপ্ন ততই পূর্ণতার কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে। ও যখন আমার জামা
পরে তখন এর মধ্য দিয়ে আমি এই পূর্ণতার প্রতিবিম্ব অবলোকন করেই হয়ত আনন্দে উদ্বেল
হই। ভাবছিলাম একজন সরকারপ্রধান, বিশেষ করে যিনি নিজে একজন মা, যিনি তাঁর সকল
নাগরিকের প্রতি সমভাবে মাতৃসুলভ, তিনি এই দেশের কল্যাণ এবং উন্নয়নশীল কর্মকান্ডে
কতটা আবেগাপ্লুত হবার কথা! কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার জন্মভূমিতে যে অগণিত মা
সন্তানহারা হয়েছেন, অকালে বিনষ্ট হয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় জীবন এটাকে কিভাবে
ব্যাখ্যা করা যায়? তেরো বছর বয়সের কন্যাকে নিয়ে আমার কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন, কত
পরিকল্পনা! তাহলে যে সন্তানদের মায়েরা এতগুলো বছর ধরে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে না
জানি কত স্বপ্ন বুনেছিলেন, কত আশার প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন তাদের কেমন লাগছে? যে
পুলিশ ভাইটি মারা গেলেন তিনি যেমন এই বাংলা মায়ের সন্তান যে ছেলেটি আল্লাহ এবং
তাঁর রাসূলের ভালোবাসায় উদ্বেল হয়ে প্রতিবাদমুখর হতে গিয়ে মারা পড়ল সেও তো এই
বাংলা মায়ের সন্তান। তাহলে ওরা কেন পরস্পরকে মারছে? কেন ভাবছেনা ওরা তো আমারই
দেশবাসী, আমার ভাই, পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব?!
মনুষ্যত্বের মৃত্যু মানুষের মৃত্যুর
চাইতে অনেক বেশি ভয়ানক, পীড়াদায়ক। আদর্শের
মৃত্যু তার চেয়েও বেশি হৃদয়বিদারক। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মাঝে যে চেতনা কাজ
করেছে তা ছিল যেকোন মূল্যে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতার পর শেখ সাহেব
সরকারপ্রধান ছিলেন, তিনি তালিকার পর তালিকা করার পরেও কেন রাজাকারের শাস্তির
ব্যাবস্থা করেননি? কারণ স্বাধীনতার পর অধিকাংশ রাজাকারদের স্থানীয় জনগণই মেরে
ফেলে। পাতি রাজাকারদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার পরিবর্তে তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় ঐক্য এবং
সংহতিকে সমুন্নত করতে। তাঁর এই সিদ্ধান্তের ফলে পরবর্তী চল্লিশ বছর আমরা একটি এক ও
অভিন্ন জাতি হিসেবে মিলেমিশে থেকেছি।
তবে আজ চল্লিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা আবার কেন জেগে উঠল? কারণ আজ তাঁর কন্যার পরিস্থিতির কাছে তাঁর আদর্শ পরাজিত
হয়েছে। তিনি তাঁর দলীয় নেতাকর্মীদের অন্যায় অত্যাচার অনাচার নিয়ন্ত্রণ করতে
ব্যার্থ্য হয়ে দমন নীতি এবং বাকস্বাধীনতা রহিত করার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর
দলের লোকজন জানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের মাঝে কত তীক্ষরূপে বিদ্যমান। এর ধুয়া
তুলে তারা একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারেন, অপরদিকে দেশকে
গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে মানুষকে মূল প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা থেকে দূরে রাখতে
পারেন। নইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে সবার আগে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর
কন্যাকে রাজাকার বেয়াইয়ের ছেলের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিতেন, উদাহরণ স্থাপন
করার উদ্দেশ্যে সবার আগে বেয়াইয়ের বিচার শুরু করতেন, তিনি নিজেই স্বীকার করতেন
দেশের সমস্ত রাজাকার কেবল তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের সদস্য হতে পারেনা এবং
কয়েকজন বুড়োকে ফাঁসি দিলেই বাংলাদেশের ঘাড়ে যে কোটি টাকার ঋণ, আইন শৃংখলা
পরিস্থিতির অবনতি কিংবা দেশের উন্নয়নে যে বার বার বাঁধা আসছে তার কোনটাই সমাধান
হবেনা । কিন্তু দেশপ্রেমের ধ্বজাধারীরা দেশের আইন শৃংখলাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আদালত
অমান্য করে, আল্লাহ রাসূল এবং ইসলামকে হেয় করে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষনা করে বসল। তাদের সামাল দিতে পুলিশ বাহিনীকে নিয়োগ দিতে গিয়ে দেশে
গণহত্যা শুরু হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত তিনি কিছুতেই এই পরিস্থিতি চাইতে পারেন না।
কারণ তিনি তো শুধু নিজের দুই সন্তানের মা নন, এই মূহূর্তে তিনি পুরো জাতির মায়ের
দায়িত্বে সমাসীন!
তাই ভাবি, আমরা কেন
বুঝতে পারছিনা এদিকে আমরা মারামারি করে মরছি আর ওদিকে এমন কেউ ফায়দা লুটে যাচ্ছে
যারা এই দেশটাকে ভালই বাসেনা? কেন আমরা এক হয়ে দেশটার জন্য কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ হচ্ছিনা?
কেন আমরা আমাদের ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজনের সাথে এমন বিষাক্ত আচরন করছি? কেন অকালে
ঝরে যাচ্ছে এমন সব তাজা প্রাণ যাদের একাত্তরে জন্মই হয়নি, যারা এই দেশটাকে
ভালোবাসতে শিখেছে কেবল, প্রশ্ন করতে শেখেনি?
ছোটবেলা থেকে বিদেশে
বিদেশে কেটেছে। তন্মধ্যে ইন্ডিয়া ছিলাম বেশ কয়েক বছর। দেশের রাজনীতির ব্যাপারে
কিছু জানা ছিলোনা, কিন্তু ছোটবেলা থেকে বাবা চাচা দাদার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে
শুনতে দেশটাকে ভালবাসতাম প্রচন্ডভাবে। সাথে ছিলো আমার বামপন্থী পরিবারের আদর্শ-
আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনী, তারপরে ইংরেজী শিক্ষার গোড়াপত্তন। তাই দেশ থেকে বই
আসত ভুরি ভুরি- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধের বই,
মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক বই- পড়তে পড়তে মনে হত আমিও স্টেনগান নিয়ে যুদ্ধ করছি শত্রুপক্ষের
সাথে, কচুরীপানার নীচে লুকিয়ে গাদাবন্দুক উঁচিয়ে রেখেছি শত্রুর দিকে তাক করে! সেই
আমাকে একদিন আমার ভারতীয় প্রতিবেশি, বান্ধবী অর্চনা এসে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘জানো,
আমরা তোমাদের ফারাক্কায় পানি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমরাই তো বাংলাদেশ স্বাধীন
করেছি, তাই এটা আমাদের অধিকার!’ হঠাৎ আমার চেহারার দিকে নজর পড়ায় সে ভয় পেয়ে গেল, ‘সরি,
তুমি প্লিজ আমার ওপর রাগ কোরনা। এগুলো আমাদের ক্লাসে শেখানো হয়েছে। আমি ভেবেছি
তুমিও জেনে খুশি হবে!’
আমি দেশকে ভালোবাসি,
তাই দেশের এই অবস্থা সহ্য করতে পারিনা যেখানে এক ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয় আরেক
ভাইয়ের হাত, যেখানে নিত্য ঝরে পড়ে মুকুলিত প্রাণ, যেখানে কেবল শ্বাপদের হুঙ্কার আর
পশুত্বের জয়জয়কার, যে দৃশ্য দেখে দূর হতে হায়ানারা হাসে। আমি চাই একদিন আমার
সন্তানরা দেশে ফিরে যাবে। সেখানে থাকবে মনুষ্যত্বের জয়জয়কার, আমরা সবাই এক হব
দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য মালয়শিয়া কিংবা সংযুক্ত আরব আমীরাতের মত, আমাদের আদর্শ হবে
সমুন্নত এবং আমাদের বিশ্বাস হবে অপরাজিত। একটি দরদী নেতৃত্বই আমাদের সন্তানদের
জন্য এমন একটি জন্মভূমি উপহার দিতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেবেন কি এমন একটি
জন্মভূমি আমাদের?
Apu tumi onek liberal,onek generous. onake amar kokhonoi matrishomo mone hoina.
ReplyDelete