আমি যখন CRTP(Corporate Readiness Training Program)তে ভর্তি হলাম, কোর্সের চাইতেও যে জিনিসটা ভালো লাগল তা হোল পৃথিবীব্যাপী নানা দেশ থেকে আগত বিভিন্ন লোকজনের সাথে মেশার, তাদের দেশ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ। কোর্সের বিভিন্ন প্রজেক্ট আর আমার নিজের আগ্রহের কারণে কিছুদিনের মধ্যে আমার সবার সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে চোখে পড়ার মত ত্রয়ী ছিলো পল, হাসান আর ইগর।পলের বাড়ী নাইজেরিয়া, বড় হয়েছে লন্ডনে। হাসানের বাড়ী তুরষ্কে, বৌকে লেখাপড়া করানোর জন্য ক্যানাডা এসেছে। ইগর দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলা থেকে এসেছে, ওর দেশের political corruption থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হোল ওরা তিনজনই তালগাছ, তিনজনই সারাক্ষন হাসে আর হাসায়, তিনজনই ভীষন ভদ্র। কিভাবে যেন এদের তিনজনের সাথেই আমার ওঠাবসা হত বেশী।
পল আমাকে নাগাল পেত ট্রেনে, যাবার পথেই। ট্রেন থেকে নামার সময় সে কিছু না বলে আমার ভারী বইয়ের ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দিত। বাড়ী ফেরার পথে আবার একই কান্ড। কেউ হাসলে বা কিছু বললে বলত, ‘she’s my sister’. হাসান প্রতিদিন ক্লাসের সবাইকে wafer খাওয়াত। সে আমাদের এত wafer খাইয়েছে যে এখন আমাদের সবার কাছে wafer আর হাসান সমার্থক। আমাদের ক্লাসে দক্ষিণ আমেরিকার যত নারী ছিল, তারা যেমন অশালীন ছিল (আমার মতে নয়, ক্যানাডীয়রাও তাদের হজম করতে পারতনা), পুরুষরা ছিল ঠিক তেমনি ভদ্র। আর ইগর এত ভদ্র ছিল যে সে বসা অবস্থায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে সে কল্পনাও করতে পারতনা।
পলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ফিস জমা দেয়ার জন্য অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে। এই লাইন যে কি দুর্বিসহ ধীরগতিতে অগ্রসর হয় আর আমরা যে কতবার বিরক্ত হয়ে কাজ না করিয়েই ফিরে এসেছি বলার মত না। সেদিন ছিল ডেডলাইন, কাজ হতেই হবে। আমরা যতক্ষণে লাইনের সামনে পৌঁছলাম, তখন ওরা আর একজনকে নেবে (লাঞ্চের সময় হলে আর কেউ তাদের পায়ে ধরেও রাখতে পারবে না)। পল বল্ল, ‘তুমি যাও’। আমার কাজ হয়ে গেলে সে গিয়ে তাদের খুব অনুনয় বিনয় করতে লাগল, কিন্তু ওরা কিছুতেই ওর টাকা নেবেনা। শেষে আমি বললাম, ‘ভাই, সে আমাকে সুযোগ দিতে গিয়ে আগে যায়নি। ওর ভদ্রতার মূল্যায়ন করে অন্তত বেচারার কাজটা করে দাও’। ওর বদান্যতার কথা শুনে মহিলার মনে দয়ার উদ্রেক হোল। সে ফি জমা নিয়ে নিল।
আমাদের যখন ক্লাস শুরু হোল, তখনো হাসান ভর্তি পায়নি। এক্সপ্তাহ পর একজন চলে যাওয়াতে হাসান আসার সুযোগ পেল। সে আসার তিনদিন পরও আমার তার সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। এ সময় আমি নিয়ম মেনে চলার জন্য পুরষ্কার পেলাম ক্যন্টিন থেকে ফ্রি চা খাওয়ার জন্য টিকেট। আমি যেহেতু চা খাইনা, ভাবলাম এটা কাকে দেয়া যায়? তখন মনে হোল হাসান আমাদের ক্লাসে সবার শেষে এসেছে। সুতরাং একটা উপহার পেলে সে নিশ্চয় খুশী হবে। ব্যাস, দিয়ে দিলাম টিকেট। সে অবাক হয়ে বল্ল, ‘তুমি আমাকে টিকেট দিলে কেন?’ মাথায় দুষ্টুমী চাপল, বললাম, ‘তুমি আমার সাথে কথা বলনা তাই!’। তারপর তার সাথে অনেক কথা হোল। জানলাম, সে মুসলিম হলেও ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী চলেনা। তাই আমরা রোজা রাখতাম আর সে রাখতনা। কিন্তু যতদিন রামাদান ছিল, সে কোনদিন আমাদের সামনে খায়নি।
ইগর কথা বলত কম। কিন্তু প্রথমদিনই তাকে আমার চোখে পড়ে। কারণ আমরা যখন ক্যাম্পাসের guided tour নিচ্ছিলাম, এক মহিলা আমাদের tour guide কে সকাতরে কি যেন জিজ্ঞেস করছিলেন। কিন্তু উনি কি ভাষায় কথা বলছেন বা কি বলছেন, আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।গাইড মেয়েটা অল্পবয়ষ্ক। সে ব্যাপারটা কিভাবে কি করবে বুঝতে না পেরে চলে যাচ্ছিল। আমার মহিলার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছিল, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। ততক্ষণে পেছন থেকে আরেক গ্রুপ এসে পড়েছে। ওখান থেকে ইগর ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে সমাধান করে দিল। মহিলা খুশী হয়ে চলে গেলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকে ধন্যবাদ জানালাম কিন্তু সে এমন একটা ভাব করল যে সে জানাই না কে মহিলাকে সাহায্য করেছে।
একদিন শরীর খারাপ লাগছিল দেখে লাঞ্চের সময় ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছিলাম। ওরা তিনজন বাইরে ছিল। বিল্ডিং থেকে সবে নেমেছি, পল ফোন করে বল, ‘তুমি কোথায়?’ বললাম, ‘বাসায় যাচ্ছি’। সে বল্ল, ‘একটু অফিসে আস, খুব জরুরী দরকার’। এভাবে বললে আর কি করা? গেলাম অফিসে। গিয়ে দেখি ওরা কেউ নাই। শরীরের পাশাপাশি এবার মেজাজটাও বিগড়ে গেল। থাকব না চলে যাব ভাবছি এমন সময় দেখি পল এল। এসেই বলে, ‘তোমার ব্যাগের ভেতর তো সব থাকে, টেপ আর কাঁচি আছে কিনা দেখত?’ আমি বললাম, ‘কাঁচি দিতে পারব কিন্তু টেপ শেষ’। হাসান আর ইগর দেখি এক কোণায় চোরের মত দাঁড়িয়ে আছে। বল্ল, ‘টেপ লাগবেই’। আমি বললাম, ‘অফিসে বললেই দেবে’। ওরা টেপ আর কাঁচি নিয়ে চলে গেল। পল আমার ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা দিল। ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই, শরীরও ভাল লাগছিলনা, তাই চুপচাপ বাইরে চল্লাম।
রাস্তায় পৌঁছে দেখি হাসান জ্যাকেটের ভিতরে লুকানো হাতটা এতক্ষণে বের করল, হাতে একটা কবুতর! কবুতরটার একটা পা ভাঙ্গা। দুজনে মিলে টেপ কেটে কেটে তার পায়ে দিতে লাগল প্লাস্টারের মত করে। হাসান আমাকে বোঝাতে লাগল, ‘বেচারা হাঁটতে না পারলে হয় না খেয়ে মরে যাবে নয় কোন বিড়ালের পেটে যাবে। ওর পা’টা প্লস্টার করে দিলে আস্তে আস্তে সেরে যাবে। আপাতত সে চলে ফিরে নিজের খাবারটা সংগ্রহ করে নিতে পারবে’। আমরা সবাই রাস্তার ওপর দাঁড়ানো। Animal rights department খবর পেলে সবগুলোকে জেলে ভরবে। কিন্তু ওরা ওদের কাজ করেই চলেছে দ্রুতগতিতে।
আমি একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। তখন ব্রিজ ছিলনা, ছিল ফেরী। বড় বড় ট্রাক নামছে। একটা ছুঁচো দৌড় দিতে গিয়ে ট্রাকের চাকার নীচে পড়তে যাচ্ছিল। এক লোক পা দিয়ে তাকে তুলে নিল। আমার মন তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হতে না হতেই সে ছুঁচোটাকে সেই একই ট্রাকের পেছনের চাকার নীচে ছুঁড়ে মারল। তারপর ঐখানে দাঁড়ানো মানুষ নামের প্রানীগুলো হাসতে হাসতে চলে গেল। একটা প্রাণ যা তারা সৃষ্টি করেনি, তা তারা অনায়াসে, অমানুষিকভাবে ধ্বংস করে কিভাবে হাসতে পারে ভাবতেই শিউরে উঠেছিলাম। তখন আমরা মাত্র বাংলাদেশে থাকার সংকল্প নিয়ে দেশে ফিরেছি। তাই হয়ত এই অমানবিক আচরণে আশ্চর্য হয়েছি। তারপর ত কতকিছু দেখলাম। বুঝলাম, মানুষের প্রাণ নিতেই যে দেশে মানুষের হাত কাঁপেনা, সে দেশে একটা ছুঁচোর প্রাণের আর কিইবা মূল্য?
আমি মানুষের সামনে কাঁদতে পারিনা। নাহলে সেদিন এই তিনজন মানুষের হাসিঠাট্টার আড়ালে যে সত্যিকার মানুষগুলো লুকিয়ে আছে এতে অভিভূত হয়ে আমি কাঁদতাম। আমার মন কৃতজ্ঞতায় উথলে উঠলো যে এই মানুষগুলো আমার বন্ধু, আনন্দে আপ্লুত হলাম যে আমি এই দৃশ্যের একটা ছোট্ট অংশের অংশীদার।একটু পরে অপারেশন শেষ করে ওরে কবুতরটাকে একটা নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিল। আমার আপত্তি সত্ত্বেও স্টেশনে এসে আমাকে ব্যাগসহ ট্রেনে তুলে দিয়ে আবার হাসতে হাসতে চলে গেল। কেউ জানতেও পারলোনা এই আধঘন্টায় তারা কত মহান একটা কাজ করে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ অথচ অনন্যসাধারণ তিনটা লোক – পৃথিবীর তিনপ্রান্ত থেকে এসেও যারা একত্রিত হয়েছে মনবতার ছায়াতলে।
আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে চোখে পড়ার মত ত্রয়ী ছিলো পল, হাসান আর ইগর।পলের বাড়ী নাইজেরিয়া, বড় হয়েছে লন্ডনে। হাসানের বাড়ী তুরষ্কে, বৌকে লেখাপড়া করানোর জন্য ক্যানাডা এসেছে। ইগর দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলা থেকে এসেছে, ওর দেশের political corruption থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হোল ওরা তিনজনই তালগাছ, তিনজনই সারাক্ষন হাসে আর হাসায়, তিনজনই ভীষন ভদ্র। কিভাবে যেন এদের তিনজনের সাথেই আমার ওঠাবসা হত বেশী।
পল আমাকে নাগাল পেত ট্রেনে, যাবার পথেই। ট্রেন থেকে নামার সময় সে কিছু না বলে আমার ভারী বইয়ের ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দিত। বাড়ী ফেরার পথে আবার একই কান্ড। কেউ হাসলে বা কিছু বললে বলত, ‘she’s my sister’. হাসান প্রতিদিন ক্লাসের সবাইকে wafer খাওয়াত। সে আমাদের এত wafer খাইয়েছে যে এখন আমাদের সবার কাছে wafer আর হাসান সমার্থক। আমাদের ক্লাসে দক্ষিণ আমেরিকার যত নারী ছিল, তারা যেমন অশালীন ছিল (আমার মতে নয়, ক্যানাডীয়রাও তাদের হজম করতে পারতনা), পুরুষরা ছিল ঠিক তেমনি ভদ্র। আর ইগর এত ভদ্র ছিল যে সে বসা অবস্থায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে সে কল্পনাও করতে পারতনা।
পলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ফিস জমা দেয়ার জন্য অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে। এই লাইন যে কি দুর্বিসহ ধীরগতিতে অগ্রসর হয় আর আমরা যে কতবার বিরক্ত হয়ে কাজ না করিয়েই ফিরে এসেছি বলার মত না। সেদিন ছিল ডেডলাইন, কাজ হতেই হবে। আমরা যতক্ষণে লাইনের সামনে পৌঁছলাম, তখন ওরা আর একজনকে নেবে (লাঞ্চের সময় হলে আর কেউ তাদের পায়ে ধরেও রাখতে পারবে না)। পল বল্ল, ‘তুমি যাও’। আমার কাজ হয়ে গেলে সে গিয়ে তাদের খুব অনুনয় বিনয় করতে লাগল, কিন্তু ওরা কিছুতেই ওর টাকা নেবেনা। শেষে আমি বললাম, ‘ভাই, সে আমাকে সুযোগ দিতে গিয়ে আগে যায়নি। ওর ভদ্রতার মূল্যায়ন করে অন্তত বেচারার কাজটা করে দাও’। ওর বদান্যতার কথা শুনে মহিলার মনে দয়ার উদ্রেক হোল। সে ফি জমা নিয়ে নিল।
আমাদের যখন ক্লাস শুরু হোল, তখনো হাসান ভর্তি পায়নি। এক্সপ্তাহ পর একজন চলে যাওয়াতে হাসান আসার সুযোগ পেল। সে আসার তিনদিন পরও আমার তার সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। এ সময় আমি নিয়ম মেনে চলার জন্য পুরষ্কার পেলাম ক্যন্টিন থেকে ফ্রি চা খাওয়ার জন্য টিকেট। আমি যেহেতু চা খাইনা, ভাবলাম এটা কাকে দেয়া যায়? তখন মনে হোল হাসান আমাদের ক্লাসে সবার শেষে এসেছে। সুতরাং একটা উপহার পেলে সে নিশ্চয় খুশী হবে। ব্যাস, দিয়ে দিলাম টিকেট। সে অবাক হয়ে বল্ল, ‘তুমি আমাকে টিকেট দিলে কেন?’ মাথায় দুষ্টুমী চাপল, বললাম, ‘তুমি আমার সাথে কথা বলনা তাই!’। তারপর তার সাথে অনেক কথা হোল। জানলাম, সে মুসলিম হলেও ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী চলেনা। তাই আমরা রোজা রাখতাম আর সে রাখতনা। কিন্তু যতদিন রামাদান ছিল, সে কোনদিন আমাদের সামনে খায়নি।
ইগর কথা বলত কম। কিন্তু প্রথমদিনই তাকে আমার চোখে পড়ে। কারণ আমরা যখন ক্যাম্পাসের guided tour নিচ্ছিলাম, এক মহিলা আমাদের tour guide কে সকাতরে কি যেন জিজ্ঞেস করছিলেন। কিন্তু উনি কি ভাষায় কথা বলছেন বা কি বলছেন, আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।গাইড মেয়েটা অল্পবয়ষ্ক। সে ব্যাপারটা কিভাবে কি করবে বুঝতে না পেরে চলে যাচ্ছিল। আমার মহিলার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছিল, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। ততক্ষণে পেছন থেকে আরেক গ্রুপ এসে পড়েছে। ওখান থেকে ইগর ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলে সমাধান করে দিল। মহিলা খুশী হয়ে চলে গেলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকে ধন্যবাদ জানালাম কিন্তু সে এমন একটা ভাব করল যে সে জানাই না কে মহিলাকে সাহায্য করেছে।
একদিন শরীর খারাপ লাগছিল দেখে লাঞ্চের সময় ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছিলাম। ওরা তিনজন বাইরে ছিল। বিল্ডিং থেকে সবে নেমেছি, পল ফোন করে বল, ‘তুমি কোথায়?’ বললাম, ‘বাসায় যাচ্ছি’। সে বল্ল, ‘একটু অফিসে আস, খুব জরুরী দরকার’। এভাবে বললে আর কি করা? গেলাম অফিসে। গিয়ে দেখি ওরা কেউ নাই। শরীরের পাশাপাশি এবার মেজাজটাও বিগড়ে গেল। থাকব না চলে যাব ভাবছি এমন সময় দেখি পল এল। এসেই বলে, ‘তোমার ব্যাগের ভেতর তো সব থাকে, টেপ আর কাঁচি আছে কিনা দেখত?’ আমি বললাম, ‘কাঁচি দিতে পারব কিন্তু টেপ শেষ’। হাসান আর ইগর দেখি এক কোণায় চোরের মত দাঁড়িয়ে আছে। বল্ল, ‘টেপ লাগবেই’। আমি বললাম, ‘অফিসে বললেই দেবে’। ওরা টেপ আর কাঁচি নিয়ে চলে গেল। পল আমার ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা দিল। ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই, শরীরও ভাল লাগছিলনা, তাই চুপচাপ বাইরে চল্লাম।
রাস্তায় পৌঁছে দেখি হাসান জ্যাকেটের ভিতরে লুকানো হাতটা এতক্ষণে বের করল, হাতে একটা কবুতর! কবুতরটার একটা পা ভাঙ্গা। দুজনে মিলে টেপ কেটে কেটে তার পায়ে দিতে লাগল প্লাস্টারের মত করে। হাসান আমাকে বোঝাতে লাগল, ‘বেচারা হাঁটতে না পারলে হয় না খেয়ে মরে যাবে নয় কোন বিড়ালের পেটে যাবে। ওর পা’টা প্লস্টার করে দিলে আস্তে আস্তে সেরে যাবে। আপাতত সে চলে ফিরে নিজের খাবারটা সংগ্রহ করে নিতে পারবে’। আমরা সবাই রাস্তার ওপর দাঁড়ানো। Animal rights department খবর পেলে সবগুলোকে জেলে ভরবে। কিন্তু ওরা ওদের কাজ করেই চলেছে দ্রুতগতিতে।
আমি একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। তখন ব্রিজ ছিলনা, ছিল ফেরী। বড় বড় ট্রাক নামছে। একটা ছুঁচো দৌড় দিতে গিয়ে ট্রাকের চাকার নীচে পড়তে যাচ্ছিল। এক লোক পা দিয়ে তাকে তুলে নিল। আমার মন তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হতে না হতেই সে ছুঁচোটাকে সেই একই ট্রাকের পেছনের চাকার নীচে ছুঁড়ে মারল। তারপর ঐখানে দাঁড়ানো মানুষ নামের প্রানীগুলো হাসতে হাসতে চলে গেল। একটা প্রাণ যা তারা সৃষ্টি করেনি, তা তারা অনায়াসে, অমানুষিকভাবে ধ্বংস করে কিভাবে হাসতে পারে ভাবতেই শিউরে উঠেছিলাম। তখন আমরা মাত্র বাংলাদেশে থাকার সংকল্প নিয়ে দেশে ফিরেছি। তাই হয়ত এই অমানবিক আচরণে আশ্চর্য হয়েছি। তারপর ত কতকিছু দেখলাম। বুঝলাম, মানুষের প্রাণ নিতেই যে দেশে মানুষের হাত কাঁপেনা, সে দেশে একটা ছুঁচোর প্রাণের আর কিইবা মূল্য?
আমি মানুষের সামনে কাঁদতে পারিনা। নাহলে সেদিন এই তিনজন মানুষের হাসিঠাট্টার আড়ালে যে সত্যিকার মানুষগুলো লুকিয়ে আছে এতে অভিভূত হয়ে আমি কাঁদতাম। আমার মন কৃতজ্ঞতায় উথলে উঠলো যে এই মানুষগুলো আমার বন্ধু, আনন্দে আপ্লুত হলাম যে আমি এই দৃশ্যের একটা ছোট্ট অংশের অংশীদার।একটু পরে অপারেশন শেষ করে ওরে কবুতরটাকে একটা নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিল। আমার আপত্তি সত্ত্বেও স্টেশনে এসে আমাকে ব্যাগসহ ট্রেনে তুলে দিয়ে আবার হাসতে হাসতে চলে গেল। কেউ জানতেও পারলোনা এই আধঘন্টায় তারা কত মহান একটা কাজ করে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ অথচ অনন্যসাধারণ তিনটা লোক – পৃথিবীর তিনপ্রান্ত থেকে এসেও যারা একত্রিত হয়েছে মনবতার ছায়াতলে।
ফেইসবুকেই লেখাটা পড়েছি। অসাধারন অনুপ্রেরনাদায়ক একটা লিখা ম্যাডাম। আপনি প্লীজ বেশী বেশী লিখবেন।
ReplyDelete