কয়েকদিন আগে আমার বান্ধবী তিথি ফোন করে বল্ল কেয়া আপার বাসায় প্রতি রামাদানের মত এবারেও দশম রামাদানের রাত্রিতে ক্যল্গেরীর ধর্মপ্রান মহিলাদের জন্য সালাতুত তাসবীহর আয়োজন হচ্ছে, ও যাচ্ছে, আমি যাব কি’না। আমি বললাম, “আমার বাচ্চা ছোট, আমি মনে হয় পারবনা”।
তার দু’তিনদিন পর আরেক বান্ধবী তানজীন ফোন করে বল্ল আসমা আপার সাথে কেয়া ভাবীর বাসায় যাবে রামাদানের ত্রিশটি রাত্রির মধ্যে অন্তত এক রাত্রির ইবাদাতের আশায়। বললাম, “ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি মনে হয় পারবনা”।
পরশু বিকেলে হঠাৎ আমিনা আপা ফোন করে বললেন, “এই বিদেশের মাটিতে রামাদান উপলক্ষ্যে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটি রাত ইবাদাত করতে যাচ্ছি, আপনিও চলে আসেন”। আমার সেই ক্লাসিক এক্সকিউজ ঝাড়লাম। কিন্তু এবার আর কাজ হোলনা। কারণ ওনার বাচ্চা আরো ছোট। তদুপরি উনি মস্ত সাহসের পরিচয় দিয়ে আমার মত অপদার্থ ব্যক্তিকে একটা গুরু দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।
আমার মিস্টারের রাতে কাজ। উনি দিয়ে আসতে পারবেন কিন্তু ফজরের সময় নিয়ে আসতে পারবেন না। আমিনা আপা তারও ব্যবস্থা করলেন। আসমা আপা নামিয়ে দিয়ে যাবেন। এবার তো আর পালানোর উপায় নেই।
রাত ন’টায় ইফতার। দশটায় হাজির হলাম কেয়া আপার বাসায়। গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড। সম্পূর্ণ বেসমেন্ট জুড়ে কার্পেটের ওপর চাদর পেতে নামাজের ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য আলাদা রুমে বিছানা পেতে খেলনা, কম্বল সব রাখা। বেসমেন্টের রান্নাঘরে চা পানি নাস্তার ব্যবস্থা। সবাই মিলে চল্লিশ জন! মহিলারা অনেকেই দিনে চাকরী করে এসেছেন। অনেকে বাসায় মেহমান খাইয়ে এসেছেন। তারপরও তাদের উৎসাহের কোন ঘাটতি নেই। একেকজন হরেকরকম মিষ্টি পিঠা ভাত তরকারী আর পানীয় এত বেশী এনেছে যে সারারাত খেয়েও শেষ হোলনা।
রাত সাড়ে দশটার ভেতর সবাই এশার নামাজ সেরে ফেলল। সাড়ে দশটায় এডমন্টনে ডাক্তার নাজমা আপাকে ফোন করা হোল। ফোন স্পীকারে দিয়ে আমরা তাঁর মুখে কুর’আন থেকে রামাদান বিষয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা শুনলাম। রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ রামাদানের জন্য যে প্রস্তুতি নিতেন, একে সফল করার জন্য যে আকুতি নিয়ে তাঁরা ইবাদাত করতেন তার সাথে আমাদের রোজা রাখার তুলনা করে লজ্জা পাব না হাসব বুঝে পেলাম না। আমাদের রামাদানের প্রস্তুতি হোল ইফতারে কে কত পদ রান্না করে টেবিল ভরিয়ে ফেলবে তার পরিকল্পনা, সারাদিন বাজারে বাজারে ঘুরে নামাজ খুইয়ে ঈদের ব্যপারে কম্পিটিশন দেয়া যে কে কত বাহারী আর দামী জামাজুতা কিনতে পারে, তারপর বাসায় এসে কাজের লোকের সাথে চেঁচামেচি করা কেন এখনো ইফতার রেডী হয়নি, দাওয়াত খেয়ে এবং খাইয়ে নামাজ ঠিকমত পড়তে না পারা, কুর’আনের সাথে নিঃসম্পর্ক রোজা রাখা নতুবা কোনরকমে কিছু না বুঝে আরবীতে গড়গড় করে খতম দেয়া। রাসূল (সা) ইফতার আর সেহরী দু’বেলা সাধারণ খাবার খেয়ে স্বাভাবিক সকল কাজকর্ম করে রোজা রাখতেন। আর আমরা সামান্য কয়েক ঘন্টা না খেয়ে হাভাতের মত অর্ধরাত্রির মধ্যে তিনবেলা নানানরকম তৈলাক্ত আর ভারী খাবার গাপুস গুপুস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হায়রে! মানুষ একফোঁটাও পানি না খেয়ে দশদিন আর কোনপ্রকার খাবার না খেয়ে ত্রিশ দিন বেঁচে থাকে। আর আমরা মাত্র কয়েক ঘন্টা না খেয়ে নড়তে পারিনা, কাজ করতে পারিনা, আর খেতে বসলে থামতে পারিনা! ফরজ নামাজ পড়তেই আমাদের কষ্ট হয়ে যায়, বাজারে বাজারে ঘুরে লেটেস্ট মডেলের জামাজুতার খোঁজে আমাদের সেই নামাজও মিস হয়ে যায়, মহিলারা রান্না করতে করতে কবে যে নামাজের ওয়াক্ত চলে গেল খেয়াল করার সুযোগই পাননা, আর কাজের লোকের সাথে দুর্ব্যবহার করতে করতে তাঁদের রোজা আদৌ হয় কি’না তার খোঁজ কে রাখে? এত কাজের পর বুঝে বুঝে কুর’আন পড়ে, কুর’আনের মর্মার্থ অনুধাবন করে তাকে নিজের জীবনে অ্যাপ্লাই করার সময় করা তো একেবারেই অসম্ভব! অফিসে যাব লেট করে, ফিরে আসব তাড়াতাড়ি, কাজ করব না পারতে – আমি যে রোজা!
বড়রা তো তবুও ঠেকায় পড়ে রোজা রাখেন, কিন্তু বাচ্চাদের আমরা এত ভালোবাসি যে তারা আধাদিন না খেয়ে থাকবে এটা আমরা সহ্যই করতে পারিনা হোক না সেটা ফরজ ইবাদাত। বাচ্চাদের আরেকটু বেশী খাওয়ানোর চেষ্টায় আমরা অহরহই আফ্রিকার বাচ্চাদের উদাহরণ দেই যে ওরা বছরের পর বছর খেতে পায়না। মজার ব্যপার হোল, কথাগুলো বলতে বলতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা ভেবেও দেখিনা যে বছরের পর বছর খেতে না পেয়েও বাচ্চাগুলো দিব্যি বেঁচে আছে সুতরাং আমার সন্তানকে আমি ফরজ ইবাদাত শিক্ষা দেয়ার জন্য এক মাস আধাদিন ভালো খাইয়ে, আধাদিন অভুক্ত রাখলে সে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম কেননা কার্যত রোজা রাখলে শরীর সুস্থ থাকে। আমাদের এই আদিখ্যেতার কারণে আমাদের বাচ্চারা আজ ধর্ম থেকেও ধর্মহীন হয়ে বড় হচ্ছে! আরেকটা মজার জিনিস হোল আমাদের সব ভালোবাসা আস্তে আস্তে কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার বাচ্চারা তো কোন ছাড়, আমরা নিজের বাচ্চা ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসতে পারিনা যেন! আমার একটা বাচ্চার ঈদের জামাজুতার বাজেট থেকে যে পাশের বস্তির সবগুলো বাচ্চার জন্য জামাজুতা কেনা যায় সেটা আমাদের মনেই আসেনা। সুতরাং, আমাদের ভালোবাসা আমাদের সন্তানদের অমানুষ বানাচ্ছে যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। এই সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই বড় হলে বাবামাকেও দেখবেনা কারণ তারা শুধু খেতে আর পেতে শিখেছে, খাওয়াতে বা দিতে তো তাদের শেখানো হয়নি!
কুর’আনের আলোচনা শেষ হলে আমরা সবাই আমিনা আপার নেতৃত্বে তারাবী নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। ছোটবেলায় আবুধাবীতে স্কুলে পড়তাম যখন, ছুটির আগে স্কুলের অডিটরিয়ামে জামাতে জুহরের নামাজ হত। এই সময়টা আমার এত ভালো লাগত, এত পবিত্র মনে হত! এতগুলো মানুষ একত্রে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে আল্লাহর রহমতের আশায়। আল্লাহ কি তাদের ফেরাতে পারেন? বাংলাদেশে ফেরার পর আমার বিদেশী মুসলিম বান্ধবীদের সাথে কয়েকবার ছাড়া খুব একটা জামাতে নামাজ পড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্যল্গেরীতে সর্বত্র মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা থাকায় এখানে ঈদ, জুমা বা প্রাত্যহিক নামাজ পড়া মহিলাদের জন্য সহজ। এখানে এসেই আমি প্রথম ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পাই। অথচ রাসূল (সা) বলতেন বিশেষ করে ঈদের জামাতে যেন এমনকি অসুস্থ মহিলারা পর্যন্ত সামিল হন খুতবা শোনার জন্য এবং মুনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য। দুঃখ হয় যে ৮০% মুসলিম জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য যে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে দোকানে বা রাস্তার ওপর রেখে নিজে নামাজ পড়তে যায় অথচ মহিলাদের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়না যেন নামাজ শুধু পুরুষদের জন্যই ফরজ! আমার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমরা যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন প্রায়ই পথে নামাজের সময় হলে আমরা জামাত শেষ হয়ে গেলে কোন মসজিদে নেমে নামাজ পড়ে নিতাম। তাই আমি যখন চট্টগ্রাম অঁলিয়স ফ্রঁসেজ-এ ক্লাস করছিলাম, প্রথমদিন মাগরিবের জামাত শেষে পাশের খালি মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে। নামাজের মধ্যে থাকা অবস্থায়ই শুনতে পেলাম দুই ব্যক্তি প্রচন্ড তর্ক করছে। তর্কের বিষয় আমি। একজন বলছে, “মহিলা কেন মসজিদে নামাজ পড়বে?” আরেকজন বলছে, “পুরুষদের তো নামাজ শেষ, সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে তাতে তো কারো কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তাছাড়া আমি মক্কা শরীফে দেখেছি পুরুষ নারী একত্রে নামাজ পড়ছে”। অন্যজন বল্ল, “মক্কা শরীফে কি হয় না হয় আমার কোন আগ্রহ নেই। দরকার হলে সে নামাজ পড়বেনা, কিন্তু মসজিদে আমি কোন মহিলাকে নামাজ পড়তে দেবনা”। সত্যি সত্যি পরদিন গিয়ে দেখলাম মসজিদের দরজায় ইয়া বড় একটা তালা ঝুলানো! পরে অঁলিয়স ফ্রঁসেজের পাশে একটা হাসপাতালের ইবাদাতখানায় গিয়ে নামাজ পড়তাম। একটা মুসলিম দেশে আমার মত মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য এক চিলতে মাটি হয়না। অথচ আমি যখন ক্যানাডায় চাকরীতে প্রথমদিন গিয়েই বললাম নামাজের জায়গা চাই, আমার বস দুটো বিশাল বিশাল মিটিং রুম দেখিয়ে দিয়ে বল্ল, “এর যেটাতে তোমার ইচ্ছা তুমি নামাজ পড়তে পার”!
তারাবীর পর সালাতুত তাসবীহ। সম্পূর্ণ রুম আল্লাহর প্রশংসায় মৃদু গুঞ্জরনে ভরে উঠলো। এতগুলো মহিলা একটি রাতের জন্য স্বামীসন্তান ভুলে কেবল আল্লাহর গুনগানে মেতে উঠলো! কিছুক্ষণের জন্য মনে হোল আমরা আরশের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছি। নামাজ শেষ হলে অদ্ভুত একটা ভালো লাগার সমাপ্তি ঘটলো। অনেকে কাঁদতে শুরু করলেন।
এরপর আমার দায়িত্ব শুরু হোল। বহুদিন পর বকবকালাম। বক্তব্যের বিষয় ছিল যাকাত। এটি ফরজ ইবাদাত হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করিনা। যাকাতের মাসয়ালাগুলো আমরা অনেকেই সঠিকভাবে জানিনা। কিন্তু আগত আপাদের জানার আগ্রহ আমাকে অভিভূত করল। প্রশ্নের তোড়ে শেষপর্যন্ত আমিনা আপা আর আমি মিলে সামাল দিতে হোল! একজন প্রশ্ন করলেন, “মহিলাদের গোল্ডের যাকাত কে দেবে?” বললাম, “আইনত স্বামী স্ত্রীর যার যার যাকাতের দায়িত্ব তার নিজের। স্বামী যদি দিয়ে দেন তাতে কোন দোষ নেই। নতুবা স্ত্রীকে তার হাতখরচ থেকে টাকা জমিয়ে যাকাত আদায় করতে হবে”। একজন বললেন, “কিন্তু আপা, একজন কাজের লোকও তার কাজের বিনিময়ে বেতন পায়। অথচ বিয়ের কাবিনে স্পষ্ট লেখা থাকার পরও আমাদের স্বামীরা আমাদের খাবার, শাড়ি, গহনা সব দিলেও হাতখরচ তো দেয়না! আমি টাকা পাব কোথায়?” মুশকিলের প্রশ্ন! আমরা তো ইসলামের যেটা সুবিধা হয় সেটা মানি আর যেটা অসুবিধা লাগে সেটা না জানার চেষ্টা করি। তাহলে তো এসব ঝামেলা থাকবেই। কেয়া আপা বললেন, “আপা, আমি আপনাকে নেক্সট লেখার বিষয় ঠিক করে দিচ্ছি- ভরনপোষণ”। দুঃখে হাসলাম কিছুক্ষণ সবাই মিলে।
তারপর তাহাজ্জুদের নামাজ। নামাজের পর সবাই মিলে দোয়া। রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ, জীবিত মৃত সুস্থ অসুস্থ বাবামা সন্তান আত্মীয় স্বজন দেশ বিদেশ দুনিয়া আখেরাত কিছুই বাদ গেলনা। অধিকাংশ মহিলারাই কাঁদলেন। সবারই কিছু না কিছু দুঃখ কষ্ট আছে যা তারা আল্লাহকে জানালেন, সমাধানের জন্য সাবমিট করলেন। আমার ওপর শয়তানের আসর খুব বেশী। তাই আমি কাঁদতেও পারলামনা, বলার মত কিছু মনেও করতে পারলামনা। খেতে বসে আসমা আপাকে বললাম, “আপনি তো কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিলেন, আমার জন্য কিছু দোয়া করেছিলেন তো? আমি নিজে তো কিছুই করতে পারলামনা”। উনি কিছু বলার আগেই তানজীন বল্ল, “শুনেন, আপনার কেস হোল অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর”। তার মানে কি এই যে আমি এত গুনাহ করেছি যে … আল্লাহই ভালো জানেন।
এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব। হাতে সময় ছিল কম তাই সবাই টেবিলের পাশে ভিড় জমিয়েছেন। আমাদের মত কম স্বাস্থ্যবতীরা সেই ভিড় ঠেলে কিছুতেই টেবিলের কাছে পৌঁছতে পারছিনা। তখন আসমা আপা বললেন, “কেয়ামত তো বহুদূর। খাবার টেবিলেই আমরা এতক্ষণ যাদের সাথে সময় কাটালাম তাদের চিনতে পারছিনা। সুতরাং আল্লাহ যে বলেছেন কেয়ামতের দিন বাবা মা স্বামী স্ত্রী সন্তান কেউ কাউকে চিনবেনা, ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করতে থাকবে, উনি অবশ্যই ঠিক বলেছেন”। চিন্তা করলাম কত সহজেই উনি একটা কঠিন সত্যকে ব্যাখ্যা করে দিলেন!
খাওয়া শেষে যাদের বাসা কাছে তাদের অধিকাংশ বাসায় চলে গেলেন। আমরা যারা দূরে থাকি তারা ফজরের নামাজের জন্য বেসমেন্টে রওয়ানা দিলাম। গিয়ে দেশি কেয়া আপার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে ঐশী চাদর কম্বল ভাঁজ করে গোছগাছ করতে শুরু করেছে। এই ছোট্ট মেয়েটা আমাদের আসা থেকে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা মায়ের সাথে সাথে সব বাচ্চাদের দেখাশোনা, পানি আনা, খাবার দিতে সাহায্য করা, নামাজ পড়া সব কিছুতেই অংশগ্রহন করেছে। এই বিদেশের মাটিতে ওর মত কেয়ারিং, কন্সিডারেট, সামাজিক আর বিশেষ করে ইসলামিক ছেলেমেয়ে খুব কম দেখে যায়। এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য আপনা আপনিই অনেক দোয়া এলো মন থেকে।
রাত্রি জাগা এই কয়েকজন ইবাদাতকারিনীকে একটু মজা দেয়ার জন্য একটা গল্প বললাম যেটা অনুষ্ঠানের কথা শোনার পর থেকেই মনে আসছিল। আমি যখন আই আই ইউ সি তে কাজ করতাম তখন একবার আমাদের সম্পূর্ণ ইউনিভার্সিটির একটা তিনদিনব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছিল কক্সবাজারে। পুরুষদের আলাদা ব্যবস্থা আর মহিলাদের আলাদা। এই ক্যাম্পের একটা অংশ ছিল ‘কিয়ামুল লাইল’। রাসূল (সা) প্রায়ই রাত্রির কিয়দংশ বা কখনো কখনো সারারাত জেগে ইবাদাত করতেন। এই রাত জেগে ইবাদাতকে আরবীতে বলা হয় ‘কিয়ামুল লাইল’। এটি ছিল আমাদের ক্যাম্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ। রাতের অন্ধকারে কিছু ইবাদাত, কিছু গল্পসল্প, চা খাওয়া, ফজরের পর কুর’আন পড়তে পড়তে একপাশে সমুদ্র আর আরেকপাশে পাহাড়ের ওপর সূর্য ওঠার দৃশ্য - মনে হত এই পৃথিবীর বাইরের কিছু মূহূর্ত। পরে আমাদের ফাজিল বান্ধবী ফাহমিদা এর নাম দিয়েছিল ‘কেয়ামতের লাইল’ যদিও সে’ই সবচেয়ে পছন্দ করেছিল এই পর্ব! ‘কিয়ামূল লাইলে’ চা খাওয়ানোর জন্য সে ইলেকট্রিক কেটেল বহন করে নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে। এই কাহিনী শুনে আমিনা আপা থেকে শুরু করে সবাই হেসেই খুন! ফাহমিদার জন্য খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও আজ উপস্থিত থাকতে পারলে অভিভূত হয়ে বলত, “আপা, চলেন আবার কেয়ামতের লাইল করি!”
ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে এলাম। একটা অসম্ভব সুন্দর রাত শেষ হয়ে গেল।
তার দু’তিনদিন পর আরেক বান্ধবী তানজীন ফোন করে বল্ল আসমা আপার সাথে কেয়া ভাবীর বাসায় যাবে রামাদানের ত্রিশটি রাত্রির মধ্যে অন্তত এক রাত্রির ইবাদাতের আশায়। বললাম, “ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি মনে হয় পারবনা”।
পরশু বিকেলে হঠাৎ আমিনা আপা ফোন করে বললেন, “এই বিদেশের মাটিতে রামাদান উপলক্ষ্যে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটি রাত ইবাদাত করতে যাচ্ছি, আপনিও চলে আসেন”। আমার সেই ক্লাসিক এক্সকিউজ ঝাড়লাম। কিন্তু এবার আর কাজ হোলনা। কারণ ওনার বাচ্চা আরো ছোট। তদুপরি উনি মস্ত সাহসের পরিচয় দিয়ে আমার মত অপদার্থ ব্যক্তিকে একটা গুরু দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।
আমার মিস্টারের রাতে কাজ। উনি দিয়ে আসতে পারবেন কিন্তু ফজরের সময় নিয়ে আসতে পারবেন না। আমিনা আপা তারও ব্যবস্থা করলেন। আসমা আপা নামিয়ে দিয়ে যাবেন। এবার তো আর পালানোর উপায় নেই।
রাত ন’টায় ইফতার। দশটায় হাজির হলাম কেয়া আপার বাসায়। গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড। সম্পূর্ণ বেসমেন্ট জুড়ে কার্পেটের ওপর চাদর পেতে নামাজের ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য আলাদা রুমে বিছানা পেতে খেলনা, কম্বল সব রাখা। বেসমেন্টের রান্নাঘরে চা পানি নাস্তার ব্যবস্থা। সবাই মিলে চল্লিশ জন! মহিলারা অনেকেই দিনে চাকরী করে এসেছেন। অনেকে বাসায় মেহমান খাইয়ে এসেছেন। তারপরও তাদের উৎসাহের কোন ঘাটতি নেই। একেকজন হরেকরকম মিষ্টি পিঠা ভাত তরকারী আর পানীয় এত বেশী এনেছে যে সারারাত খেয়েও শেষ হোলনা।
রাত সাড়ে দশটার ভেতর সবাই এশার নামাজ সেরে ফেলল। সাড়ে দশটায় এডমন্টনে ডাক্তার নাজমা আপাকে ফোন করা হোল। ফোন স্পীকারে দিয়ে আমরা তাঁর মুখে কুর’আন থেকে রামাদান বিষয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা শুনলাম। রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ রামাদানের জন্য যে প্রস্তুতি নিতেন, একে সফল করার জন্য যে আকুতি নিয়ে তাঁরা ইবাদাত করতেন তার সাথে আমাদের রোজা রাখার তুলনা করে লজ্জা পাব না হাসব বুঝে পেলাম না। আমাদের রামাদানের প্রস্তুতি হোল ইফতারে কে কত পদ রান্না করে টেবিল ভরিয়ে ফেলবে তার পরিকল্পনা, সারাদিন বাজারে বাজারে ঘুরে নামাজ খুইয়ে ঈদের ব্যপারে কম্পিটিশন দেয়া যে কে কত বাহারী আর দামী জামাজুতা কিনতে পারে, তারপর বাসায় এসে কাজের লোকের সাথে চেঁচামেচি করা কেন এখনো ইফতার রেডী হয়নি, দাওয়াত খেয়ে এবং খাইয়ে নামাজ ঠিকমত পড়তে না পারা, কুর’আনের সাথে নিঃসম্পর্ক রোজা রাখা নতুবা কোনরকমে কিছু না বুঝে আরবীতে গড়গড় করে খতম দেয়া। রাসূল (সা) ইফতার আর সেহরী দু’বেলা সাধারণ খাবার খেয়ে স্বাভাবিক সকল কাজকর্ম করে রোজা রাখতেন। আর আমরা সামান্য কয়েক ঘন্টা না খেয়ে হাভাতের মত অর্ধরাত্রির মধ্যে তিনবেলা নানানরকম তৈলাক্ত আর ভারী খাবার গাপুস গুপুস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হায়রে! মানুষ একফোঁটাও পানি না খেয়ে দশদিন আর কোনপ্রকার খাবার না খেয়ে ত্রিশ দিন বেঁচে থাকে। আর আমরা মাত্র কয়েক ঘন্টা না খেয়ে নড়তে পারিনা, কাজ করতে পারিনা, আর খেতে বসলে থামতে পারিনা! ফরজ নামাজ পড়তেই আমাদের কষ্ট হয়ে যায়, বাজারে বাজারে ঘুরে লেটেস্ট মডেলের জামাজুতার খোঁজে আমাদের সেই নামাজও মিস হয়ে যায়, মহিলারা রান্না করতে করতে কবে যে নামাজের ওয়াক্ত চলে গেল খেয়াল করার সুযোগই পাননা, আর কাজের লোকের সাথে দুর্ব্যবহার করতে করতে তাঁদের রোজা আদৌ হয় কি’না তার খোঁজ কে রাখে? এত কাজের পর বুঝে বুঝে কুর’আন পড়ে, কুর’আনের মর্মার্থ অনুধাবন করে তাকে নিজের জীবনে অ্যাপ্লাই করার সময় করা তো একেবারেই অসম্ভব! অফিসে যাব লেট করে, ফিরে আসব তাড়াতাড়ি, কাজ করব না পারতে – আমি যে রোজা!
বড়রা তো তবুও ঠেকায় পড়ে রোজা রাখেন, কিন্তু বাচ্চাদের আমরা এত ভালোবাসি যে তারা আধাদিন না খেয়ে থাকবে এটা আমরা সহ্যই করতে পারিনা হোক না সেটা ফরজ ইবাদাত। বাচ্চাদের আরেকটু বেশী খাওয়ানোর চেষ্টায় আমরা অহরহই আফ্রিকার বাচ্চাদের উদাহরণ দেই যে ওরা বছরের পর বছর খেতে পায়না। মজার ব্যপার হোল, কথাগুলো বলতে বলতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা ভেবেও দেখিনা যে বছরের পর বছর খেতে না পেয়েও বাচ্চাগুলো দিব্যি বেঁচে আছে সুতরাং আমার সন্তানকে আমি ফরজ ইবাদাত শিক্ষা দেয়ার জন্য এক মাস আধাদিন ভালো খাইয়ে, আধাদিন অভুক্ত রাখলে সে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম কেননা কার্যত রোজা রাখলে শরীর সুস্থ থাকে। আমাদের এই আদিখ্যেতার কারণে আমাদের বাচ্চারা আজ ধর্ম থেকেও ধর্মহীন হয়ে বড় হচ্ছে! আরেকটা মজার জিনিস হোল আমাদের সব ভালোবাসা আস্তে আস্তে কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার বাচ্চারা তো কোন ছাড়, আমরা নিজের বাচ্চা ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসতে পারিনা যেন! আমার একটা বাচ্চার ঈদের জামাজুতার বাজেট থেকে যে পাশের বস্তির সবগুলো বাচ্চার জন্য জামাজুতা কেনা যায় সেটা আমাদের মনেই আসেনা। সুতরাং, আমাদের ভালোবাসা আমাদের সন্তানদের অমানুষ বানাচ্ছে যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। এই সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই বড় হলে বাবামাকেও দেখবেনা কারণ তারা শুধু খেতে আর পেতে শিখেছে, খাওয়াতে বা দিতে তো তাদের শেখানো হয়নি!
কুর’আনের আলোচনা শেষ হলে আমরা সবাই আমিনা আপার নেতৃত্বে তারাবী নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। ছোটবেলায় আবুধাবীতে স্কুলে পড়তাম যখন, ছুটির আগে স্কুলের অডিটরিয়ামে জামাতে জুহরের নামাজ হত। এই সময়টা আমার এত ভালো লাগত, এত পবিত্র মনে হত! এতগুলো মানুষ একত্রে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে আল্লাহর রহমতের আশায়। আল্লাহ কি তাদের ফেরাতে পারেন? বাংলাদেশে ফেরার পর আমার বিদেশী মুসলিম বান্ধবীদের সাথে কয়েকবার ছাড়া খুব একটা জামাতে নামাজ পড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্যল্গেরীতে সর্বত্র মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা থাকায় এখানে ঈদ, জুমা বা প্রাত্যহিক নামাজ পড়া মহিলাদের জন্য সহজ। এখানে এসেই আমি প্রথম ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পাই। অথচ রাসূল (সা) বলতেন বিশেষ করে ঈদের জামাতে যেন এমনকি অসুস্থ মহিলারা পর্যন্ত সামিল হন খুতবা শোনার জন্য এবং মুনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য। দুঃখ হয় যে ৮০% মুসলিম জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য যে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে দোকানে বা রাস্তার ওপর রেখে নিজে নামাজ পড়তে যায় অথচ মহিলাদের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়না যেন নামাজ শুধু পুরুষদের জন্যই ফরজ! আমার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমরা যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন প্রায়ই পথে নামাজের সময় হলে আমরা জামাত শেষ হয়ে গেলে কোন মসজিদে নেমে নামাজ পড়ে নিতাম। তাই আমি যখন চট্টগ্রাম অঁলিয়স ফ্রঁসেজ-এ ক্লাস করছিলাম, প্রথমদিন মাগরিবের জামাত শেষে পাশের খালি মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে। নামাজের মধ্যে থাকা অবস্থায়ই শুনতে পেলাম দুই ব্যক্তি প্রচন্ড তর্ক করছে। তর্কের বিষয় আমি। একজন বলছে, “মহিলা কেন মসজিদে নামাজ পড়বে?” আরেকজন বলছে, “পুরুষদের তো নামাজ শেষ, সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে তাতে তো কারো কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তাছাড়া আমি মক্কা শরীফে দেখেছি পুরুষ নারী একত্রে নামাজ পড়ছে”। অন্যজন বল্ল, “মক্কা শরীফে কি হয় না হয় আমার কোন আগ্রহ নেই। দরকার হলে সে নামাজ পড়বেনা, কিন্তু মসজিদে আমি কোন মহিলাকে নামাজ পড়তে দেবনা”। সত্যি সত্যি পরদিন গিয়ে দেখলাম মসজিদের দরজায় ইয়া বড় একটা তালা ঝুলানো! পরে অঁলিয়স ফ্রঁসেজের পাশে একটা হাসপাতালের ইবাদাতখানায় গিয়ে নামাজ পড়তাম। একটা মুসলিম দেশে আমার মত মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য এক চিলতে মাটি হয়না। অথচ আমি যখন ক্যানাডায় চাকরীতে প্রথমদিন গিয়েই বললাম নামাজের জায়গা চাই, আমার বস দুটো বিশাল বিশাল মিটিং রুম দেখিয়ে দিয়ে বল্ল, “এর যেটাতে তোমার ইচ্ছা তুমি নামাজ পড়তে পার”!
তারাবীর পর সালাতুত তাসবীহ। সম্পূর্ণ রুম আল্লাহর প্রশংসায় মৃদু গুঞ্জরনে ভরে উঠলো। এতগুলো মহিলা একটি রাতের জন্য স্বামীসন্তান ভুলে কেবল আল্লাহর গুনগানে মেতে উঠলো! কিছুক্ষণের জন্য মনে হোল আমরা আরশের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছি। নামাজ শেষ হলে অদ্ভুত একটা ভালো লাগার সমাপ্তি ঘটলো। অনেকে কাঁদতে শুরু করলেন।
এরপর আমার দায়িত্ব শুরু হোল। বহুদিন পর বকবকালাম। বক্তব্যের বিষয় ছিল যাকাত। এটি ফরজ ইবাদাত হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করিনা। যাকাতের মাসয়ালাগুলো আমরা অনেকেই সঠিকভাবে জানিনা। কিন্তু আগত আপাদের জানার আগ্রহ আমাকে অভিভূত করল। প্রশ্নের তোড়ে শেষপর্যন্ত আমিনা আপা আর আমি মিলে সামাল দিতে হোল! একজন প্রশ্ন করলেন, “মহিলাদের গোল্ডের যাকাত কে দেবে?” বললাম, “আইনত স্বামী স্ত্রীর যার যার যাকাতের দায়িত্ব তার নিজের। স্বামী যদি দিয়ে দেন তাতে কোন দোষ নেই। নতুবা স্ত্রীকে তার হাতখরচ থেকে টাকা জমিয়ে যাকাত আদায় করতে হবে”। একজন বললেন, “কিন্তু আপা, একজন কাজের লোকও তার কাজের বিনিময়ে বেতন পায়। অথচ বিয়ের কাবিনে স্পষ্ট লেখা থাকার পরও আমাদের স্বামীরা আমাদের খাবার, শাড়ি, গহনা সব দিলেও হাতখরচ তো দেয়না! আমি টাকা পাব কোথায়?” মুশকিলের প্রশ্ন! আমরা তো ইসলামের যেটা সুবিধা হয় সেটা মানি আর যেটা অসুবিধা লাগে সেটা না জানার চেষ্টা করি। তাহলে তো এসব ঝামেলা থাকবেই। কেয়া আপা বললেন, “আপা, আমি আপনাকে নেক্সট লেখার বিষয় ঠিক করে দিচ্ছি- ভরনপোষণ”। দুঃখে হাসলাম কিছুক্ষণ সবাই মিলে।
তারপর তাহাজ্জুদের নামাজ। নামাজের পর সবাই মিলে দোয়া। রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ, জীবিত মৃত সুস্থ অসুস্থ বাবামা সন্তান আত্মীয় স্বজন দেশ বিদেশ দুনিয়া আখেরাত কিছুই বাদ গেলনা। অধিকাংশ মহিলারাই কাঁদলেন। সবারই কিছু না কিছু দুঃখ কষ্ট আছে যা তারা আল্লাহকে জানালেন, সমাধানের জন্য সাবমিট করলেন। আমার ওপর শয়তানের আসর খুব বেশী। তাই আমি কাঁদতেও পারলামনা, বলার মত কিছু মনেও করতে পারলামনা। খেতে বসে আসমা আপাকে বললাম, “আপনি তো কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিলেন, আমার জন্য কিছু দোয়া করেছিলেন তো? আমি নিজে তো কিছুই করতে পারলামনা”। উনি কিছু বলার আগেই তানজীন বল্ল, “শুনেন, আপনার কেস হোল অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর”। তার মানে কি এই যে আমি এত গুনাহ করেছি যে … আল্লাহই ভালো জানেন।
এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব। হাতে সময় ছিল কম তাই সবাই টেবিলের পাশে ভিড় জমিয়েছেন। আমাদের মত কম স্বাস্থ্যবতীরা সেই ভিড় ঠেলে কিছুতেই টেবিলের কাছে পৌঁছতে পারছিনা। তখন আসমা আপা বললেন, “কেয়ামত তো বহুদূর। খাবার টেবিলেই আমরা এতক্ষণ যাদের সাথে সময় কাটালাম তাদের চিনতে পারছিনা। সুতরাং আল্লাহ যে বলেছেন কেয়ামতের দিন বাবা মা স্বামী স্ত্রী সন্তান কেউ কাউকে চিনবেনা, ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করতে থাকবে, উনি অবশ্যই ঠিক বলেছেন”। চিন্তা করলাম কত সহজেই উনি একটা কঠিন সত্যকে ব্যাখ্যা করে দিলেন!
খাওয়া শেষে যাদের বাসা কাছে তাদের অধিকাংশ বাসায় চলে গেলেন। আমরা যারা দূরে থাকি তারা ফজরের নামাজের জন্য বেসমেন্টে রওয়ানা দিলাম। গিয়ে দেশি কেয়া আপার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে ঐশী চাদর কম্বল ভাঁজ করে গোছগাছ করতে শুরু করেছে। এই ছোট্ট মেয়েটা আমাদের আসা থেকে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা মায়ের সাথে সাথে সব বাচ্চাদের দেখাশোনা, পানি আনা, খাবার দিতে সাহায্য করা, নামাজ পড়া সব কিছুতেই অংশগ্রহন করেছে। এই বিদেশের মাটিতে ওর মত কেয়ারিং, কন্সিডারেট, সামাজিক আর বিশেষ করে ইসলামিক ছেলেমেয়ে খুব কম দেখে যায়। এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য আপনা আপনিই অনেক দোয়া এলো মন থেকে।
রাত্রি জাগা এই কয়েকজন ইবাদাতকারিনীকে একটু মজা দেয়ার জন্য একটা গল্প বললাম যেটা অনুষ্ঠানের কথা শোনার পর থেকেই মনে আসছিল। আমি যখন আই আই ইউ সি তে কাজ করতাম তখন একবার আমাদের সম্পূর্ণ ইউনিভার্সিটির একটা তিনদিনব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছিল কক্সবাজারে। পুরুষদের আলাদা ব্যবস্থা আর মহিলাদের আলাদা। এই ক্যাম্পের একটা অংশ ছিল ‘কিয়ামুল লাইল’। রাসূল (সা) প্রায়ই রাত্রির কিয়দংশ বা কখনো কখনো সারারাত জেগে ইবাদাত করতেন। এই রাত জেগে ইবাদাতকে আরবীতে বলা হয় ‘কিয়ামুল লাইল’। এটি ছিল আমাদের ক্যাম্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ। রাতের অন্ধকারে কিছু ইবাদাত, কিছু গল্পসল্প, চা খাওয়া, ফজরের পর কুর’আন পড়তে পড়তে একপাশে সমুদ্র আর আরেকপাশে পাহাড়ের ওপর সূর্য ওঠার দৃশ্য - মনে হত এই পৃথিবীর বাইরের কিছু মূহূর্ত। পরে আমাদের ফাজিল বান্ধবী ফাহমিদা এর নাম দিয়েছিল ‘কেয়ামতের লাইল’ যদিও সে’ই সবচেয়ে পছন্দ করেছিল এই পর্ব! ‘কিয়ামূল লাইলে’ চা খাওয়ানোর জন্য সে ইলেকট্রিক কেটেল বহন করে নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে। এই কাহিনী শুনে আমিনা আপা থেকে শুরু করে সবাই হেসেই খুন! ফাহমিদার জন্য খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও আজ উপস্থিত থাকতে পারলে অভিভূত হয়ে বলত, “আপা, চলেন আবার কেয়ামতের লাইল করি!”
ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে এলাম। একটা অসম্ভব সুন্দর রাত শেষ হয়ে গেল।