রঙ্গিন চিনির গুঁড়ো ছিটানো ডোনাটটা সন্তর্পনে হাতে তুলে নিতেই কোথা থেকে এক দঙ্গল ছেলে এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। সবার বয়স চার থেকে ছয়ের মধ্যে, সবার হাতে একই রকম ডোনাট। ওরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল, ‘এই দেখ দেখ, আন্টিও আমাদের মত একইরকম ডোনাট খাচ্ছে!’
মিষ্টি জিনিস খেতে ভালবাসি, ভালবাসি শিশুদের। খুব মজা পেলাম ওদের কথাবার্তায়। বললাম, ‘হুমম, আমি তো তোমাদের সমান, তাই তোমাদের মত ডোনাট পছন্দ করি’।
ওরা বলল, ‘বল কি! তুমি তো আমাদের চেয়ে অনেক লম্বা!’
বললাম, ‘কি করব বল? কিভাবে যেন একটু লম্বা হয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমি আসলে তোমাদেরই সমান’।
একজন এসে আমার সাথে গা ঘেঁসে দাঁড়ালো। মাপ দিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলোনা, ‘নাহ, তুমি বেশশিইইই লম্বা!’।
অন্যরা পরামর্শ দিল, ‘তুই পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়া, দেখ সমান হতে পারিস কিনা’।
সে যথাসম্ভব টান টান হয়ে পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। তারপর হতাশ হয়ে বলল, ‘তুমি কিভাবে আমাদের বয়সে এত লম্বা হলে?’
আমি বললাম, ‘আমি আসলে তোমাদের চেয়ে এই অল্প কিছুদিনের বড়, তোমরাও আর কিছুদিন পর আমার সাইজের হয়ে যাবে’।
ওরা আশান্বিত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে তুমি আমাদের মত ডোনাট খেতে পারো!’
দল বেঁধে অন্যদিকে চলে গেল ওরা। বাচ্চারা কত সহজেই না বিশ্বাস করে! এই বিশ্বাসী মনটা কালক্রমে কিছু অসতর্ক বিবেকহীন মানুষের কারণে হারিয়ে যায়। কতই না ভাল হত যদি প্রতিটা মানুষ এই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ মনটা ধরে রাখতে পারত!
ওহ! এই মজার ঘটনাটা কোথায় ঘটল সেটাই তো বলা হয়নি! তিনদিনের সফরে অ্যালবার্টার রাজধানী এডমন্টন গেছিলাম। পথের দুরত্ব ঢাকা চট্টগ্রামের সমান তবে রাস্তা ভাল হওয়ায় আড়াই তিনঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। গতবছর প্রথম এডমন্টন গেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত একেবারেই ভাল লাগেনি। যেমন বৃষ্টি ছিল তেমনি গরম। তার ওপর আমি এতটা অসুস্থ ছিলাম যে পুরো পথ গাড়ীর পেছনে শুয়ে গিয়েছি, শুয়ে এসেছি।
এ’বছর ঘরে বাইরে কাজের চাপে দিশাহারা বোধ করছিলাম। তাই আবার সব বন্ধুরা এডমন্টনে একত্রিত হচ্ছে শুনে যাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। যাবার আগের দিন ভোর থেকে মধ্যরাত পেরিয়েও কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। সকালে যাবার সময় গাড়ীতে জিনিসপত্র তুলতে তুলতে ভাবছি, ‘আহা! মাত্র তিনদিনের জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরে যাচ্ছি অথচ জামাকাপড়, জুতা, বই, খেলনা, কম্পিউটার, চার্জার, খাবার, পানীয়, গরম কাপড় সব মিলে কত্তগুলো জিনিস নিয়ে যাচ্ছি!’ তারপর মাথায় এলো একটাই ভ্রমন সম্ভব যেখানে কিছুই নিয়ে যেতে হয়না, সেই ভ্রমনটার জন্যই সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, অথচ সেই ভ্রমনের ব্যাপারেই আমরা সবচেয়ে উদাসীন!
পথটা বৈচিত্রহীন কিন্তু ভালই লাগল যদিও বরাবরের মতই রোদ ছিল আমার সঙ্গী। হোটেলে পৌঁছে দেখি আমাদের ক্যাল্গেরী বাহিনী পৌঁছতে শুরু করেছে। আমাদের রুমে গিয়ে দেখলাম সুইটটা দু’টো রুমে বিভক্ত। সামনের রুমে সোফাটা খুলে বিছানায় রূপান্তরিত করা যায়। আমার ছয় বছর বয়সী পুত্র পাঁচ মিনিটের ভেতর বিছানাটা বিছিয়ে তেরো বছর বয়সী বোনকে বলে, ‘আপু, তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত। দেখ, আমি তোমার জন্য বিছানা বানিয়েছি। এসো, শুয়ে পড়!’ মনে মনে শুকরিয়া করলাম ওদের দু’জনের এই বন্ধুত্বের জন্য। রাদিয়া রিহামকে অসম্ভব আদর করে- ওকে খাইয়ে দেয়, কাপড় পরিয়ে দেয়, দাঁত মেজে গোসল পর্যন্ত করিয়ে দেয়- কিন্তু ভাইদের আদরটা সবসময় প্রকাশ্য হয়না। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করলাম ওদের এই ভালোবাসার বন্ধন যেন চিরকাল অটুট থাকে।
দুপুরে ক্লান্তিতে তলিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে শুনলাম আমাদের ক্যাল্গেরীর সবাই এসে পৌঁছেছে। একটি পরিবার ছাড়া আমরা সবাই একই হোটেলে উঠেছি। আমরা সবাই যেহেতু উদ্বাস্তু, নাজমা আপা ক্যাল্গেরী আর সাস্কাচুয়ানের সব মেহমানদের রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছেন। সন্ধ্যায় ওনার বাসায় গিয়ে বাগানে লাউ, কুমড়া, জুকিনি, করলা, শসা, নানাবিধ শাক, বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ ইত্যাদির সম্ভার দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আর রাতে নানান খাবারের সাথে বাগানের উপকরণ দেয়া ভর্তা খেয়ে ভুরিভোজটাও জমল চমৎকার। বুঝলাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে- যিনি ডাক্তার, তিনি উত্তম বক্তা, তিনিই চাষী আবার তিনি উত্তম রাঁধুনীও বটে। এডমন্টনের আরো বোনেরা আসায় সবাই মিলে গল্পটাও জমেছিল বেশ।
হোটেলে আমাদের রুমে কফি মেশিন দেখে রিহামের খুব শখ হয়েছিল কফি খাবে, কিন্তু আমি বার বার মানা করছিলাম। পরদিন সকালে আমি অন্য রুমে বসে আছি দেখে নিরাপদ ভেবে রিহাম বোনকে পটিয়ে পাটিয়ে রাজী করল গোপনে কফি বানাতে। এক কাপ কফি বানানোকে কেন্দ্র করে ওদের আধঘন্টার কথোপকথন এত মজার ছিল যে সুযোগ হলে রেকর্ড করে রাখতাম। রিহাম রাদিয়াকে শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে পানি গরম করতে হয়, কিভাবে কফি দিতে হয়, কিভাবে দুধচিনি মেশাতে হয়, রাদিয়া হাসতে হাসতে শেষ। হাসি শুনে আমি চলে আসতে পারি ভেবে রিহাম রাদিয়াকে বকা দিলো, ‘রাদিয়াপু, হাউ পাগল ক্যান ইউ বি?’ ওদের কথা শুনে পাশের ঘরে আমিও হাসতে লাগলাম।
সম্মেলন কক্ষ নির্বাচন করা হয়েছিল একটি মসজিদে। এখানে যারা বিভিন্ন শহর থেকে এসেছেন তাদের সবার একটাই উদ্দেশ্য, সবাই মিলে আলোচনা করে একটা পন্থা নির্ধারন করা যাতে এই বিদেশে নিজেদের ঈমান রক্ষা করা যায় এবং সন্তানদের মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা যায়। সকালে নাস্তার পর্ব শেষে বাচ্চাদের জন্য ডোনাট ছিল, তখনই বাচ্চাদের সাথে আমার এই মজার মোলাকাত। তারপর অনেক আলোচনা হোল, বড়দের গান আর কৌতুক পরিবেশন হোল, বাচ্চাদের গান আর নাটক হোল, বাচ্চাদের সাথে বুড়োরাও গাইলেন, সাধারন জ্ঞানের কুইজ প্রতিযোগিতা হোল, সব পর্বের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হোল, দুপুরের খাবার হোল, রাতের খাবার দিয়ে দেয়া হোল। এডমন্টনবাসীদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। এবারের অনুষ্ঠানটাও ছিল অনেক বেশি প্রানবন্ত এবং আলোচনাগুলোও ছিল অনেক ফলপ্রসূ। তবে এক বান্ধবী একটা মূল্যবান কথা বললেন, ‘এখানে বসে আমরা কত কথা শুনি, কত কথা বলি, কিন্তু বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে মনে হয় সব মন থেকে ধুয়েমুছে পরিস্কার হয়ে যায়, কিছুই যেন আর অবশিষ্ট থাকেনা।
পরদিন সকালে বেরোলাম ফোর্ট এডমন্টন পার্ক দেখতে যেখানে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলোকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে সরিয়ে পুণঃস্থাপন করা হয়েছে। এটি উল্লেখযোগ্য দু’টো কারণে- প্রথমত, নর্থ অ্যামেরিকার ইতিহাস খুব একটা পুরাতন নয় সুতরাং এর মাধ্যমে সরকার একটি ইতিহাসের অনুভূতি সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে; দ্বিতীয়ত, পার্কের স্থাপত্যগুলো রেপ্লিকা নয়, ওরিজিনাল স্থাপত্যগুলোকেই আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পূর্বের অবস্থান থেকে গোটাই তুলে এনে পুণঃস্থাপন করা হয়েছে। এই স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটি দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলাম আবার অনেক লজ্জাও পেলাম। এই স্থাপত্যটির নাম আল রাশীদ মসজিদ। অল্প সময়ের জন্য এটি নর্থ অ্যামেরিকার প্রথম মসজিদ হয়ে উঠতে পারেনি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে কেবল দু’টি মসজিদ স্থাপিত হয়। একজন নও মুসলিমা প্রথম মসজিদ বানানোর জন্য জমি নিয়ে মেয়রের সাথে কথা বলেন। তখন এডমন্টনে মুসলিমের সংখ্যা ছিল মাত্র তেরোজন এবং এদের অধিকাংশই ছিল নও মুসলিম যারা নিজেরাও ইসলাম তেমন ভালোভাবে বুঝতেন না। কিন্তু তারা নামাজের গুরুত্ব বুঝতেন এবং নামাজের জন্য একটি নির্ধারিত স্থানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেই তারা এই মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। তারা যখন বুঝতে পারেন তাদের সবার সম্মিলিত অর্থও এই মসজিদ স্থাপনের জন্য যথেষ্ট নয় তখন তারা আরব দেশগুলোর কাছে সাহায্য চায়, আরব ক্রিশ্চানরা সহায়তা করে, এমনকি স্থানীয় জনগণও তাদের সাহায্য করে। ১৯৩৮ সালে এই মসজিদের উদ্বোধন করেন কুর’আনের বিখ্যাত অনুবাদক আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী। ১৯৯২ সালে পচাত্তর হাজার ডলার ব্যায়ে মসজিদটিকে এই পার্কে স্থানান্তর করা হয়। মসজিদটির ওপরতলায় প্রায় দেড়শ থেকে দুশো মানুষ নামাজ পড়তে পারে; নীচে লাশ ধোয়ানো, বিয়ে ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানাদি করার জায়গা আছে। একটি জিনিস দেখে অবাক হলাম, দরজায় লেখা আছে মুসলিমরা মসজিদে জুতো নিয়ে প্রবেশ করা পছন্দ করেনা। ব্যাস, যত বিধর্মীরা মসজিদ দেখতে আসছে সবাই জুতো খুলে চুপচাপ মসজিদে প্রবেশ করছে। তারা জানেনা ইসলাম কি, তাদের মুসলিমদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে মাথাব্যাথার কোন কারণ নেই, কিন্তু তারা সবাই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করল। অথচ আনুগত্যের দিক থেকে তো আমাদেরই এগিয়ে থাকার কথা ছিল। যখন মুসলিমরা আনুগত্য করত তখন তেরোজন মুসলিম দেড়শ মানুষের উপযোগী মসজিদ বানিয়েছিলেন, এখন আমাদের আনুগত্য নেই তাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে মসজিদ আছে কিন্তু নামাজ পড়ার মানুষ নেই! আমরা লক্ষ কোটি মুসলিম আজ যেন সাগরের ফেনার মত, দেখে মনে হয় প্রচুর কিন্তু আসলে ভেতরটা ফাঁপা।
এখানে এসে ক্যাল্গেরীর দুই বন্ধু পরিবার, এডমন্টনের দুই ভাই আর টরোন্টোর এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। বড় ভাই আমাদের আইস ক্রীম খাওয়ালেন। গরম ছিল ভালই, আমি নিজেরটাও খেলাম, হাফিজ সাহেবেরটাও খেলাম। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে নামাজ পড়ে ক্যাল্গেরীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
পথে একটা মজার জিনিস দেখলাম। এখানে এসে কখনো রাস্তায় জ্যাম দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম এডমন্টনগামী লেনে আদিগন্তবিস্তৃত জ্যাম। ভাগ্য ভাল আমাদের লেনটা ছিল মোটামুটি ফাঁকা! ক্যাল্গেরী থেকে এডমন্টনে যাওয়া সব বন্ধুদের মাঝে আমরাই সর্বশেষ ক্যাল্গেরী এসে পৌঁছলাম।
ব্লগার কানিজ ফাতিমা অন্টারিও থেকে এসে আমাদের বাসায় উঠেছিলেন আমরা এডমন্টন যাবার দু’দিন আগে। এসে দেখি তিনি আমাদের জন্য খিচুড়ি, ডিমভূনা আর মাছ ভাজা করে রেখেছেন। বান্ধবীরা সবাই হিংসা করতে লাগল কারণ সবাইকে এসে রান্না করে খেতে হয়েছে।
তিনদিনের আনন্দের পর আজ আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম কিন্তু সাঁতার কাটতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই আনন্দগুলোকে আবার আনমনে ঝালাই করে নিলাম।
No comments:
Post a Comment