Sunday, November 17, 2013

বিদেশে বাংলাদেশী ঈদ



ঈদের আগে তিনদিনের লং উইকএন্ড পড়লেও ঈদের দিনটা পড়ল ঠিক লং উইকএন্ডের পরদিন। অফিসে যখন ঈদের ছুটি নিতে গেলাম, বান্ধবী কাম টিম লিড জেইন বলল, 'তিনদিন ছুটির পর আবার ছুটি নিতে চাও? তুমি একদিন কাজ না করলে একদিনের বেতন পাবেনা তা জানো তো?' আমি বললাম, 'তাতে কি? ঈদের নামাজ পড়া, বাচ্চাদের সময় দেয়া, বন্ধুদের অপ্যায়ন করা একদিনের বেতনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ'।  নিয়ে নিলাম ছুটি। কিন্তু বন্ধুদের অনেকেই ছুটি পেলেন না।
দুর্ভাগ্য, অসুস্থতাবশত লং উইকএন্ড শুরু হবার আগের দিন বিকেল থেকে পুরো চার দিনই ছিলাম শয্যাশায়ী। ঈদের আগের দিন অল্প সময়ের জন্য উঠে দাঁড়ালাম, টলতে টলতে গেলাম গ্যারেজে, অল্প কিছু রান্না করে রাখলাম পরের দিনের জন্য আর হাফিজ সাহেবের চমচম বানানো পর্যবেক্ষণ করলাম। এখানে রান্নাঘরের চুলাগুলো মূলত ইলেকট্রিক হিটার। বেশি পরিমাণে রান্না সহজে এবং স্বল্প সময়ে করার জন্য গ্যারেজে দু'টি গ্যাসের চুলা এবং কিছু বৃহদাকার হাঁড়ি রয়েছে।  ঈদের দিন বাসায় দু'টো গরু কাটা হবে, চৌদ্দ পরিবারের ভাগ। এতগুলো মানুষ কাজ করবে, তাঁদের খাওয়ানোর তাগিদেই শয্যাত্যাগ করা। এখানে সাধারনত সবাই দেশেই কোরবানী দেন। আমরা কিছু লোকজন বেশ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হলেও এখানে অন্তত একটি ভাগ কোরবানী দেই যেন আমাদের সন্তানরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং এই কাজগুলো করতে অভ্যস্ত হয়।

ঈদের দিন নামাজে যাবার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেখলাম দর্বলতাহেতু চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা। অবস্থা দেখে হাফিজ সাহেব বললেন, 'তুমি তো কখনো ঈদের নামাজ মিস করনা, কিন্তু এবার মনে হয় তোমার বাসায় থাকা উচিত'। ওঁরা ঈদের জামাত থেকে সরাসরি ফার্মে চলে যাবেন, এই অবস্থায় আমার পক্ষে এতক্ষণ বসে থাকা সম্ভব নয়, তাই ওনার কাছে হার মানলাম। উনিও সদাপ্রতিবাদী স্ত্রী কিভাবে এত বাধ্য, অনুগত হয়ে গেল ভেবে আনন্দসহকারে ঈদের নামাজে যাত্রা করলেন। বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে যায়নি। কিন্তু ওদের সবকিছু কেন যেন আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আমি যেতে না পারায় ওরাও গেলনা। আমরা তিনজন নিরানন্দ দূর করতে আরো এক চোট ঘুম দিলাম।
এগারোটায় উঠে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ফার্মে গরু জবাই করে, বড় বড় টুকরো করে নিয়ে এসে, গ্যারেজে রান্নার উপযুক্ত সাইজ করে কেটে, অতঃপর ভাগ করা হবে। এই উপলক্ষ্যে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় দু'জন ভাই এসে একটি কাঠের টেবিল বানিয়েছেন যেন সবাই মিলে একসাথে মাংস কাটতে পারেন। প্রথম গরু এলো দুপুর একটায়। প্রথম দল প্রথম গরু নিয়ে কাটতে বসে গেলেন। পৌনে এক ঘন্টা পর দ্বিতীয় দল এসে উপস্থিত। এবার শুরু হোল পুরোদমে গরু কাটা, বাচ্চাদের ছুটোছুটি, 'এটা দাও, ওটা দাও' শোরগোল। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এক বালতি মাংস এনে বললেন ভাইরা ফ্রেশ মাংস খেতে চেয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমরা ক'টি পরিবার মিলে ফার্ম থেকে একটি গরু জবাই করে এনে আমাদের বাসায় কেটে ভাগ করে নেই। তখন এক ঘন্টার ভেতর তাঁদের ফ্রেশ মাংস রান্না করে খাইয়েছিলাম, সবাই খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন এবং বাসায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ভাল গৃহিনী নই, কিন্তু হাফিজ সাহেব একজন উত্তম সহকারী, তাই সম্ভব হয়েছিল। এবার শরীর অসুস্থ বলে আগে রান্না করে রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হোলনা। গ্যারেজে মাংস কাটা হচ্ছে, তাই গ্যাসের চুলা বাসায় এনে হাফিজ সাহেব আর আমি মিলে দেড় ঘন্টায় দশ কেজি মাংস, বিরাট এক হাঁড়ি সাদাভাত আর বড় পাতিলে ডাল রান্না করলাম। রাদিয়া সালাদ বানালো। এই দিয়ে বিশ পঁচিশজন ক্ষুধার্ত মানুষ খেয়ে ওঠার পর দেখা গেল সামান্য ডাল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু কম পড়েনি এতেই রক্ষা। ভাইদের মধ্যে যারা কাজের কারণে আসতে পারেননি তাঁদের কারো কারো স্ত্রী এলেন। সন্ধ্যা সাতটায় তাঁরা মাংস ভাগ করে, সমস্ত দা ছুরি ধুয়েমুছে, টেবিল সাবান দিয়ে ধুয়ে, গ্যারেজ ধুয়ে, ময়লা গার্বেজে ফেলে অদ্ভুত সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে রেখে গেলেন।
বাচ্চারা বিকালে চলে গিয়েছিল ফারজানা আপার বাসায়- ওনার মেয়ে সারিকা রাদিয়ার বান্ধবী, আর ছেলে সামীর রিহামের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা সবাইকে বিদায় দিয়ে, মাংস গুছিয়ে, পরিচ্ছন্ন হয়ে ফারজানা আপার বাসায় গেলাম। গত কয়েকমাস আপার বাবামা ক্যাল্গেরীতে ছিলেন, আমাদের সব প্রোগ্রামে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে আমরা এডমন্টন গেছি, পিকনিক করেছি, বাসায় দাওয়াত করেছি, সারারাত জেগে বসে গল্প করেছি, তারাবীর নামাজ পড়েছি- ওরা চলে যাবেন তিনদিন পর। সব বন্ধুদেরই খুব মন খারাপ, সবাই দেখা করতে গিয়েছেন- ব্যাস্ততার কারণে আমরা গেলাম সবার শেষে। খালাম্মা খালুর সাথে গল্প করলাম, ফারজানা আপার নানান রান্না খেলাম। বাচ্চারা কিছুতেই বাসায় যাবেনা, ফারজানা আপাও বললেন, 'ওরা থাকুক আরো কিছুক্ষন, বাচ্চারাও মজা পাচ্ছে, ঈদের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে'। তখন ওদের রেখেই আমরা ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় মাংস দিতে গেলাম, বেচারা বিশিষ্ট কর্মঠ ব্যাক্তি, কিন্তু সেদিন ছুটি না পাওয়ায় কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তারপর একছুটে দু'তিনটা বাসা ঘুরে এলাম যেগুলো না গেলেই নয়। এর মধ্যে নাহিদ আপার বাসায় আমার এক ছাত্রীর সাথে দেখা, গত ঈদে ওদের বাসায় যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। ওর মা বৃহস্পতিবার দাওয়াত দিলেন। প্রচন্ড ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পরদিন আবার কাজে যেতে হবে। তাই বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এলাম।
দিনের শুরুটা তাড়াতাড়ি করতে পছন্দ করি। ইদানিং শীত এগিয়ে আসায় সূর্য ওঠে আমি অফিসে যাবার দু'ঘন্টা পর। ক'দিন পর ফজর নামাজ পড়া শুরু করতে হবে অফিসে। তবু সকালটা আমার খুব প্রিয় সময়- কাজের দিন কাজ করার জন্য আর ছুটির দিন ঘুমোনোর জন্য। বাকি সপ্তাহটা গেল এই ধরাবাঁধা রুটিনে। তবে সব সপ্তাহ যদি এমন তিনটি কর্মদিবস সম্বলিত হত তাহলে কি মজাই না হত!
বৃহস্পতিবার কাজ থেকে ফিরে গেলাম আমার প্রিয় ছাত্রী ফারিয়ার বাসায়। ওখানে আমাদের সমবয়স্কা এক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ প্রসঙ্গে আরেকজন বয়োঃজ্যেষ্ঠা মেহমান নামাজের গুরুত্বের কথা স্মরন করিয়ে দিলেন। তো ভদ্রমহিলা দেখি রেগে আগুন, যাবার সময় ভুল ইংরেজীতে তাঁকে কিছু শুনিয়ে দিয়ে গেলেন। রাগ করার হেতু বুঝতে পারলাম, অনেকেই ভাল কথা শুনতে পছন্দ করেন না এবং নিজের দুর্বলতা স্বীকার করার পরিবর্তে নিজের ইচ্ছাপ্রসূত কাজটিকেই সঠিক প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর থাকেন, কিন্তু রাগ হলে মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে হবে কেন সেটা বোধগম্য হোলনা। পরে বয়োঃজ্যেষ্ঠা বোনটির সাথে আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনি এবং তাঁর স্বামী মূলত ধর্ম সম্পর্কে তেমন জানতেন না বা এখনো শিখছেন, শিখছেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাছে। ক্যানাডায় ব্যাক্তিস্বাধীনতার এই বিশেষ উপকারী দিকটি আমার খুব ভাল লাগছে। ইদানিং প্রচুর ছেলেমেয়ে দেখছি যাদের বাবামায়েরা ইসলাম সম্পর্কে নিজেরাই জানেন না, সন্তানদের শেখাবেন কি? কিন্তু ছেলেমেয়েরা নিজেরা লেখাপড়া করে পুরোদমে ইসলাম পালন করছে, বাবামা সাথে থাকলে ভাল, না থাকলেও তাঁদের সন্তানদের বাঁধা দেয়ার অধিকার নেই। অনেক বাবামাই অবশ্য বোঝেন না তাঁরা এমন সন্তান পেয়ে কতটা ভাগ্যবান।
গত বছর পর্যন্ত আমরা ঈদে বান্ধবীরা সবাই মিলে ঘুরতে বেরোতাম। দেখা যেত কোন বাসায় আরাম করে বসা বা খাওয়া যেতনা, কোন কোন বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যেতনা, অধিকাংশ সময় কাটত পথে পথে। দিন শেষে প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফেরা। তাই এ'বছর থেকে ঠিক হোল আমরা সবাই এক বাসায় মিলিত হব, রান্না সবাই এক আইটেম করে করবে। কারো চাপ পড়বেনা, সবাই আরাম করে খাওয়া এবং কথা বলা যাবে। ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠান আমার বাসায় হয়। বান্ধবী তানজিন বলল, 'তোমার ওপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে যাচ্ছে, এবারের অনুষ্ঠান তাহলে আমার বাসায় করা হোক'। কিন্তু হিসেব করে দেখা গেল মেহমানের সংখ্যা আনুমানিক দেড়শ, তানজিনের বাসা বড় হলেও নীচতলা ভাড়া দেয়া, স্থান সংকুলান করা মুস্কিল হয়ে যাবে, তাই অনুষ্ঠান আবার ঘুরেফিরে আমাদের বাসায় চলে এলো। ক'দিন আগে এডমন্টনে নাজমা আপাদের সাথে সুন্দর সময় কাটিয়ে এসেছি। তাঁদেরসহ এডমন্টনের তিনটি পরিবারকেও দাওয়াত করা হোল। ঈদ যেহেতু মঙ্গলবার, অনেকের অফিস, অনেকের পরদিন কাজ, তাই ঈদ পুনর্মিলনীর ব্যাবস্থা হোল শনিবার। এতে এডন্টনবাসীদেরও আসতে সুবিধা হবে। কিন্তু শনিবার নাজমা আপার ছেলে জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এডন্টনবাসীদের আসা ক্যান্সেল হয়ে গেল। হতাশ হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে হোল।
পুরো সপ্তাহ কাজ শেষে সপ্তাহান্তে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শুক্রবার পর্যন্ত কাজ করে শনিবারের ভেতর বাসার সব কাজ সামাল দেয়া মুস্কিল। তদুপরি আমি অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে না উঠতেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ায় দুর্বলতার কারণে অল্প কাজ করি আর তারপর অনেকক্ষণ বসে হাঁপাই। তাই সবাই হাত লাগালেন। রাদিয়া পুরো ঘরের কার্পেট ভ্যাকুয়াম করল তিনদিন ধরে। আমি সব রুম গুছালাম, বাথরুম পরিষ্কার করলাম।  হাফিজ সাহেব রান্নাঘরের জিনিসপত্র ধোয়াপালা করে দিলেন যেন আমি রান্নাঘর গুছিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু প্রথম থেকেই নিউ ইয়র্ক যাত্রা, তারপর অসুস্থতা সব মিলে বেশ কিছু কাজ বাকি পড়ে গিয়েছিল যেগুলো গুছিয়ে উঠতে পারার কোন সম্ভাবনা দেখ যাচ্ছিল না। সকাল এগারোটার দিকে মোহাম্মদ ফোন করে বলল, 'আপু, তোমার তো বাসায় বিরাট আয়োজন। কোন হেল্প লাগবে?' আমি বললাম, 'লাগবে মানে?! চলে আয়, আমার সামনের আর পেছনের উঠোন পাতা পড়ে ভর্তি হয়ে রয়েছে, এগুলো তুলে দিলে ভীষণ উপকার হবে'। আমাদের বাসাটার সামনে পেছনে প্রচুর গাছ দিয়ে ঘেরা। পুরো গরমকাল আমরা এগুলোর ছায়া, বিভিন্ন রঙের ফুল পাতার মায়া, পাতার ফাঁকে বয়ে যাওয়া ঝিরঝির বাতাস, গাছে গাছে পাখীদের কলকাকলী আর কাঠবেড়ালীদের খেলা উপভোগ করেছি। কিন্তু এখন শীতের আগমনী বার্তায় তাদের পাতা ঝরা দেখে কেবল এই আয়াতটিই মনে পড়ে যায়ঃ 'তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। এরপর আল্লাহ তাকে খড়-কুটায় পরিণত করে দেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশ রয়েছে' (সুরা যুমারঃ আয়াত ২১)।
মোহাম্মদ আসার সময় ওর শ্বশুর আর বৌকেও নিয়ে এলো। ওরা শ্বশুরজামাই মিলে পাতা পরিষ্কার করল। রাদিয়া আর ওর মামী মিলে শেলফে বই গুছিয়ে রাখল, নামাজের জায়গা পরিষ্কার করল, সব বিছানায় চাদর পরিবর্তন করল। ওদের দুপুরের খাওয়া শেষ হতে না হতেই মোনালিসা আপা এলেন। উনি রাদিয়া আর ওর মামীকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে 'ঈদ মুবারাক' পোস্টার বানাবে, বেলুন দিয়ে ঘর সাজাবে, তারপর এসে আমাকে কাপড় ভাঁজ করতে সাহায্য করলেন। বেশ কিছু দিন অসুস্থ থাকায় মেশিনে কাপড় ধোয়া হলেও ভাঁজ করা হয়ে ওঠেনি, তাই স্তুপ জমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সবাই বাসায় চলে গেল জামাকাপড় বদলে সেজেগুজে আসতে। ততক্ষণে আবার আসমা আপা আর তানজিন এসে হাজির। আসমা আপা বললেন, 'আপনার রান্নাঘরের দায়িত্ব সম্পূর্ন আমার, আপনি রেডি হতে যান'। কিন্তু সবার ঘর গুছিয়ে বাকি ছিল কেবল আমার রুম। একজন অসুস্থ বোন আসার কথা, তাঁর জন্য ঘরটা গুছিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল যেন তিনি খারাপ লাগলে শুতে পারেন। তানজিন যেমন কথাবার্তায় ধীরস্থির তেমনি কাজ করে বিদ্যুতগতিতে। দুই মিনিটের ভেতর আমার ঘর গুছানো শেষ।
আমার ব্যাপারে তানজিনের বহুদিনের নালিশ আমি নাকি যত বড় অনুষ্ঠান হয় তত সাধারন জামাকাপড় পরি, আমার মেয়েও আন্টির সাথে সুর মেলায়। গত ঈদে তানজিন ওর জমকালো এক শাড়ি নিয়ে এসেছিল আমাকে পরাবে বলে। বিয়ের দিন শাড়ি পরিনি আর আমি পরব শাড়ি! কিন্তু বারোজন বান্ধবী মিলে চেপে ধরে সেই শাড়ি পরিয়েই ছাড়ল আমাকে। তারপর আবার ছবি তুলে রাখল যেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেখাতে পারে আন্টি জীবনে একদিন শাড়ি পরেছিল। এবার তাই নিউ ইয়র্কে খালা শাশুড়ির দেয়া সালোয়ার কামিজ আগেই বের করে রেখেছিলাম। রাদিয়া আবার আন্টিকে দেখিয়ে নিশ্চিত করল যে এটা পরলে আন্টির কোন আপত্তি নেই।
কিছুক্ষণ পর মেহমান আসতে শুরু করল। এর ফাঁকে জেসমিন আপা আর স্বপ্না আপাকে পাঠানো হোল ফারজানা আপাকে নিয়ে আসতে- ওনার বাবামা সেদিনই বাংলাদেশ রওয়ানা করেছেন, বাসায় একা থাকলে মন খারাপ হবে, আমাদের সাথে থাকলে অন্তত কিছু সময় তিনি কষ্ট ভুলে থাকতে পারবেন। মোনালিসা আপা বাচ্চাদের অনুষ্ঠান শুরু করলেন। বাচ্চারা আবৃত্তি করল, গান গাইল। এর মধ্যে আসমা আপা কয়েকজন বোনকে নিয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলেন। ভাইরা নীচের তলায় নামাজ পড়ছিলেন, তারপর খেতে বসবেন, তাই ওদের টেবিল আগে বাড়া হোল। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই মোনালিসা আপা বললেন, 'আপনি ঈদুল আজহার ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলেন'। বান্ধবীদের কল্পনায় সম্ভবত আমি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ছোটবোন। তাৎক্ষনিক কি যে বলেছি জানিনা। পরে মোনাজাত করলেন আসমা আপা। এরপর এক টেবিলে মায়েরা বাচ্চাদের খাওয়াতে শুরু করলেন, বাবারা আলাদা টেবিল থেকে খাবার নিতে লাগলেন- ফলে দেড়শ মানুষ হলেও কোনদিকে কোনপ্রকার ঝামেলা অনুভূত হোলনা।
 
সবার খাওয়াদাওয়া শেষ, মেহমানরা অধিকাংশ চলে গিয়েছেন, যাবার সময় অধিকাংশ মেহমানকে বক্সে করে খাবার দেয়া হয়েছে যার দায়িত্ব ছিল তানিয়া আপা, জেসমিন আপা আর তানজিনের। তারপর শুরু হোল আসল মজা। ভাইদের ওপরতলায় আসা নিষেধ, আছি কেবল বান্ধবীরা, সুতরাং শুরু হোল বাঁধভাঙ্গা দুষ্টুমী। তানজিনের সংকল্প হোল, 'আমি রেহনুমার জন্য কিছু বাকি রাখতে চাইনা'। সে বেচারী এসে পোলাও আর সাদাভাত রান্না করেছে, এবার লেগে গেল ধোয়াপালায়। ওর দেখাদেখি যোগ দিলেন নাহিদ আপা। অন্যরা সবাই হাততালি দিচ্ছেন, 'দেখি কে বেশি উপযুক্ত বুয়া!' জেসমিন আপা বিশিষ্ট ফাঁকিবাজ, ওর গলাটাই শোনা যাচ্ছে বেশি। এই নিয়ে আবার আমরা হাসাহাসি করছি। দুই এক্সপার্ট মিলে অল্প সময়ে সব কাজ শেষ। এবার গল্পের আসর বসল ডাইনিং রুমে। ওখানে আরেক চোট হাসাহাসি, দুষ্টুমী, ফাঁকে ফাঁকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়েও আলাপ হোল। আসর ভাঙ্গল রাত সাড়ে বারোটায়।
খেলতে, আনন্দ করতে ক্লান্ত বাচ্চারা যেন বিছানায় আছড়ে পড়ল। ওদের আর কোন সাড়াশব্দ নেই। হাফিজ সাহেবও বেহুঁশ। এই সুযোগে ধীরে সুস্থে ঘর পরিষ্কার করে রাত তিনটায় এসে নামাজ পড়লাম, সাড়ে ছ'টায় ফজরের নামাজের অ্যালার্ম দিলাম এবং এত অসুস্থতা সত্ত্বেও এমন সুন্দর একটি ঈদ উপহার দেয়ার জন্য আমার প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

No comments:

Post a Comment