দু’বছর আগে খবর পাই এখানে একজন বাংলাদেশী বোন ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’টি
ছোট ছোট সন্তান রেখে তিনি হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় রয়েছেন। তার স্বামী হাসপাতাল আর
বাসার মাঝে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, সুতরাং ব্যায় থাকলেও আয়
বন্ধ। বলাবাহুল্য অধিকাংশ অভিবাসীর মত তাদের এখানে কোন আত্মীয়স্বজন নেই। অসহায়
পরিবারটির খবর ছড়িয়ে দিতেই বান্ধবীরা সহযোগিতায় সরব হয়ে ওঠেন, অবশ্যই নীরবে। গত
তিন চার দিন আগে দুই বান্ধবীকে নিয়ে তাকে দেখতে যাই, এই আমাদের প্রথম সাক্ষাত।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি চিন্তিত হয়ে বলতে শুরু করেন, ‘যদি সুস্থ হয়ে
যাই তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, আর যদি মরে যাই...’। কথাটা আর আগে বাড়তে দিতে ইচ্ছে
হোলনা। এসব বিষয়ে আমার একটু সমস্যা আছে। আমি নেগেটিভিটি একেবারেই সহ্য করতে
পারিনা। তার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘মরে গেলে কি হবে আপা? কিছুই হবেনা!
কিছুদিন সবাই কান্নাকাটি করবে, তারপর একসময় সবাই সব ভুলে যাবে, পৃথিবী আবার
স্বাভাবিক নিয়মে চলতে থাকবে। আপনার স্বামী আবার বিয়ে করবেন, সন্তানরা বড় হবে, আপনি
শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবেন। আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এ’কথাটা সত্য। আদম (আ) এর
পর আজ অবধি পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ এসেছেন এবং চলে গেছেন। তাদের অনেকের যোগ্যতা,
ক্ষমতা, ধনসম্পদ ছিল আকাশচুম্বী। কই, তারা আজ কোথায়? আপনার ক্যান্সার তাই আপনি
ভাবছেন আপনি মারা যেতে পারেন, কিন্তু এটা তো একটা এক্সকিউজ মাত্র। আমার তো কিছু
হয়নি, কিন্তু আপনি কাল শুনতে পারেন আমি মারা গেছি! মৃত্যু সময়মত যেকোন একটা রূপ
নিয়ে চলে আসবে। যা অবশ্যম্ভাবী তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে কি কোন লাভ আছে? বরং যেটুকু
সময় আছে তা কাজে লাগানোই যৌক্তিক। আপনি তাঁকেই রোগ নিরাময়ের জন্য অনুরোধ করুন যিনি
এই রোগ দিয়েছেন। ভেবে দেখুন আপনি যেভাবে আশা করেন তিনি আপনার কথা শুনবেন সেভাবে আপনি
তাঁর কথা শোনেন কিনা। পাশাপাশি স্বামী সন্তানকে সময় দিন। যেটুকু সময় হাতে আছে তাকে
পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হোন যেন আপনি চলে গেলেও আপনার সাফল্যের সাক্ষর
রয়ে যায়। এটা কেমন হয়?’
ভেবেছিলাম বান্ধবীরা আমার কথায় মর্মাহত হবেন, বকাও দিতে পারেন। কিন্তু সকলেই
সায় দিলেন, অসুস্থ বোনটিও।
২।
দু’দিন আগে, দুপুরবেলা সাদিয়া (মুকিম) ফোন করে বলল, ‘আপু, আমি খুব বিপদে
পড়েছি। আপনি তাড়াতাড়ি স্কাইপে আসেন’। ওদের ওখানে তখন রাত, তাই বুঝলাম ব্যাপারটা
সিরিয়াস। নইলে সে না ঘুমিয়ে স্কাইপে কি করছে?
স্কাইপে রিং দিতেই সাদিয়া জানাল ওদের ওখানে একজন মুসলিম বাংলাদেশী মহিলা
মারা গিয়েছেন। যারা সচরাচর মৃতের লাশ গোসল দিয়ে থাকেন তারা সবাই আউট অফ টাউন। সাদিয়ারা
মোটামুটি ইসলামের চর্চা করে বিধায় মৃতের পরিবারের সবাই মিলে ওকে অনুরোধ করেছেন এই
দায়িত্ব নেয়ার জন্য। সাদিয়া বলল, ‘আপু, আমি তো এই কাজ জীবনে কোনদিন করিনি, কিভাবে
করতে হয় তাও জানা নেই, আবার সঠিকভাবে করতে না পারলে আল্লাহর কাছে দায়ী থাকব। এখানে
আমার কাছে কোন বইপত্র বা সহায়ক কিছু নেই যা দেখে আমি শিখে নিতে পারি কাজটি কিভাবে
করতে হয়। বাংলাদেশে এখন অনেক রাত, সুতরাং এখন ফোন করে যে কাউকে জিজ্ঞেস করব সে
উপায় নেই। সকালে আমার কাজ, দুপুরে তাকে গোসল দিতে যেতে হবে। সুতরাং, আমাকে রাতেই
জেনে নিতে হবে কিভাবে কি করতে হয়। আপনি কি আমাকে এই ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে
পারেন?’
বেচারীকে বেশ প্যানিকড মনে হোল। বললাম, ‘আমি পড়েছি কিভাবে কি করতে হয় তবে করিনি কোনদিন। তবুও করার
সময় হাতে একটা গাইডলাইন থাকলে সবকিছু নিয়মমাফিকভাবে করাটা সহজ হয়। আচ্ছা, আমাকে
একটু সময় দাও, দেখি কি করতে পারি’।
বাংলাদেশে তখন গভীর রাত, তবু খানিকটা আশা নিয়ে ইয়াহুতে গেলাম, না কেউ নেই।
ঢুকলাম ফেসবুকে, দেখলাম তখনই আমার এক ছাত্রী ফারাহ একটা স্ট্যাটাস দিল। আমার এই
ছাত্রীকে আমি দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে পড়িয়েছি। ইসলামী পরিবারে জন্ম না হলেও সে কিভাবে
নিজের চেষ্টায় ইসলাম শিখেছে এবং পালন করেছে এই বিবর্তন চোখের সামনে দেখেছি।
সুশিক্ষিত মাত্রেই স্বশিক্ষিত। তাই ওকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। বললাম,
‘ফারাহ, তাড়াতাড়ি আমাকে মৃতের গোসলের মাস’আলাগুলো পাঠাও’। ঠিক দুই মিনিটের ভেতর ও
আমাকে দু’টি লিঙ্ক দিল যেখানে ইন্সট্রাকশনগুলো পরিস্কারভাবে দেয়া আছে। ততক্ষণে
আমিও একটি চমৎকার লিঙ্ক খুঁজে পেয়েছি যেখানে মৃত্যুসংক্রান্ত সকল প্রক্রিয়ার
ব্যাপারে স্টেপ বায় স্টেপ নির্দেশনা দেয়া আছে।
ফারাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাদিয়াকে কল দিলাম। লিঙ্কগুলো দেয়ার পর ও বলল,
‘আপু, আমরা তো এখানে ইটালিয়ান বলি, ইংরেজীর চর্চা হয়ই না বলতে গেলে। আমার তো
ডিকশনারী নিয়ে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে!’ ইংরেজী পড়ার ফায়দাটা আবার হাতে কলমে টের
পেলাম। ওকে লিঙ্ক দু’টো বঙ্গানুবাদ করে শোনালাম, ও ঝটপট সব লিখে নিল। অনেক
জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হবে, সব জোগাড়যন্ত্র করতে লেগে গেল। বিকেলে কম্পিউটারে
বসে দেখি ও তখনো স্কাইপে। ওদের ওখানে তখন গভীর রাত। কল দিয়ে জানলাম আরোহী (রায়হান
প্রিয়ন্তি)র বোন আফরোজা (হাসান)ও বেশ কিছু তথ্য জানিয়েছে, মুকিম ভাই নিজেও কিছু
লিঙ্ক বের করেছেন, সাদিয়া বেচারী জ্ঞানের ভারে জর্জরিত।
গতকাল ওর অভিজ্ঞতা জানার জন্য যোগাযোগ করলাম। ও বলল, পরশু সে রাত দু’টো
পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, সকালে উঠে আবার চাকরীতে গেছে। কাজ থেকে ফিরেই যেতে হয়েছে
লাশের গোসল দিতে। এর ফাঁকেও সে দেশে কয়েকটা ফোন করে জেনে নিয়েছে ওর প্রস্তুতি সঠিক
আছে কিনা। প্রথমে খানিকটা আশঙ্কা থাকলেও মৃতের মহিলা আত্মীয়স্বজন এবং আরো দু’জন
মহিলার সহযোগিতায় প্রতিটি কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়। গোসল দিয়ে, কাফন পরিয়ে ওরা
যখন লাশ কফিনে পুরে দিল ততক্ষণে ওর মনে হচ্ছিল উনি বুঝি কত পরিচিত, অথচ কালই তার
সাথে ওর প্রথম দেখা! সাদিয়া বলল, ‘আপু, এই অভিজ্ঞতা আমাকে জীবন সম্পর্কে নতুন করে
ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে, আমি এখন সবকিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি’।
শুধু সাদিয়াই নয়, ওর মাধ্যমে এই পরোক্ষ অভিজ্ঞতা আমার মাঝেও ভাবনাগুলোকে
নাড়া দিয়েছে অন্যভাবে। জীবন নিয়ে পাগল আমরা আসলে মৃত্যুর কাছে কত অসহায়! অথচ
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও এর জন্য আমরা কতটা অপ্রস্তুত ভাবতেই অবাক লাগে! সামান্য
টাকাপয়সা আয় করার জন্য আমরা বিশ থেকে ত্রিশ বছর পড়াশোনা করি; মানুষকে ইম্প্রেস
করার জন্য আমরা কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক আশাক থেকে মানসিকতায় পর্যন্ত আমূল
পরিবর্তন নিয়ে আসি; কত লক্ষ কোটি টাকা খরচ
করে পৃথিবীতে বেহেস্তসদৃশ বাড়ী বানাই, বোরাকসদৃশ গাড়ী কিনি! অথচ যাকে ইম্প্রেস করা
সবচেয়ে জরুরী, যার কাছ থেকে এসেছি এবং যার কাছে ফিরে যেতে হবে, তাঁকে খুশি করার
জন্য কি করা প্রয়োজন তা জানার জন্য আমরা কতটুকু সময় ব্যায় করি? প্রতিদিন ক’টি কাজ
আমরা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি? তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমরা কতটুকু
প্রস্তুত? মানুষ মারা যাবেই এটা নিশ্চিত। অথচ আমরা জানিই না কিভাবে তাকে গোসল করাতে
হবে, কিভাবে কাফন পরাতে হবে, মৃতদেহের সাথে কেমন আচরন করতে হবে! সর্বজ্ঞানী আমাদের
সাধারন জ্ঞানের কি ভয়াবহ অভাব!
আমি ভাবছিলাম মৃত ভদ্রমহিলার কথা। সাদিয়া বলছিল, ‘এই শরীরটি তাকে শৈশব থেকে
কৈশোর, কৈশোর থেকে তারুণ্য, তারুণ্য থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত বয়ে
নিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ এই শরীরটি আরেকজনের হাতের ওপর দিয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে, আরেকজনের
কাঁধের ওপর দিয়ে কবরে পৌঁছবে’। একসময় এই দু’টি হাত নেড়ে নেড়ে তিনি কত কথা বলেছেন, এই দু’টি হাত
দিয়ে আঁচল টেনে দিয়েছেন লজ্জারাঙ্গা মুখের ওপর, এই দু’টি হাতের ওপর দিয়ে বেড়ে
উঠেছে তার সন্তান সংসার, কিন্তু আজ এই নিথর হাত দু’টি দিয়ে তিনি নিজের শরীরের ওপর
চাদর টেনে দিয়ে লজ্জা ঢাকতে পারছেন না যদি না কেউ ঢেকে দেয়! এই শরীর একদিন কত ভার
বহন করেছে- স্কুলব্যাগ, শাড়ি গহনা, সন্তান, রোগশোক- অথচ আজ একটি মাছির ভার তার শরীরে
পাহাড়ের মত অনুভূত হচ্ছে তবু কেউ তার প্রতি দয়ার্দ্র না হলে তিনি ‘উহ’ শব্দটি
পর্যন্ত করে ব্যাথার বঃহিপ্রকাশ করতে পারছেন না। এই হৃদয় দিয়ে তিনি কতজনকে কত
ভালবেসেছেন, কত ভালোবাসা বিলিয়েছেন চারপাশে- অথচ আজ তার বাবামা, ভাইবোন, স্বামী,
সন্তান কেউ তার সঙ্গী হতে নারাজ! এই দিন সবার আসবে, আপনার আমার সবার।
তবু কেন যেন আমাদের মাথায় এই সহজ কথাটা ঢোকেনা। আমাদের মাথায় ক্ষীণভাবে
একটা আওয়াজ বলতে থাকে, ‘মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, সুতরাং সবাই মারা যাবে, কিন্তু আমি না,
আমি না, আমি না...’।
তাই দিন যায়, কিন্তু আমাদের কোন প্রস্তুতি নেয়া হয়না। হিসেব করা হয়না আমি
কাল যা ছিলাম আজ কি তার চেয়ে এক পা এগোতে পেরেছি, পেরেছি কি চিন্তাক্লিষ্ট কারো
মুখে হাসি ফোটাতে, স্বার্থপরতা থেকে একটি ধাপ উত্তরন করতে পেরেছি কি, আজ কি কেউ
আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে, আমি আজ যা করলাম তার জন্য জবাবদিহিতায় কি আমার আটকে যাবার
সম্ভাবনা আছে, থাকলে আমি এই ব্যাপারে কি পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারি, আমি কিভাবে
নিজের আগামীকালকে আমার আজ থেকে উন্নততর করতে পারি?
আজ থেকে বিশ বছর পর আমার কত টাকা চাই, ক’টা বাড়ী চাই, ক’খানা গাড়ী চাই, বৌ
কেমন হওয়া চাই, সন্তান কয়জন হওয়া চাই সব পরিকল্পনা আমার মাথায় স্পষ্ট খেলে যায়;
দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই সুটবুট পরে বৌবাচ্চা নিয়ে সোফায় বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে
কেক খাচ্ছি আর টিভি দেখছি।
এই চিত্রটা দিনে ক’বার আমাকে নাড়া দেয়?- আজরাইল (আ)এর প্রতিনিধিবর্গ আমার
সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আমার রূহ আমার শরীরের কোণায় ঘুপচিতে আত্মগোপন করার জন্য
ছুটোছুটি করছে, আমার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে, ওরা আমার রূহকে টেনে টেনে বের করছেন আর মনে
হচ্ছে আমার শরীর যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমার
চারপাশে এত মানুষজন অথচ কি আশ্চর্য কেউ আমাকে সাহায্য করছেনা কেন, ওরা কি দেখছেনা আমার
কি কষ্ট হচ্ছে? ঐ যা, আমার রূহটা তো ওরা নিয়েই গেল! এ কি? আমি এই মানুষগুলোকে এত
ভালোবাসি অথচ এরা আমার সব সোনাগহনা, টাকাপয়সা এমনকি আমার পরনের কাপড়টা পর্যন্ত
খুলে নিয়ে যাচ্ছে! আচ্ছা বাবা, নিবি নে, তোদের কি একটু মায়াদয়া নেই? অন্তত একটু
কৃতজ্ঞতাবোধ কি থাকতে নেই? তোদের মাথা থেকে একটা চুল খসে আমার গায়ে পড়লেও মনে
হচ্ছে আমার শরীরের ওপর বুঝি পুরো বিছানাটাই তুলে দিলি অথচ তোরা আমাকে উল্টেপাল্টে
ঘসেঘসে গোসল করাচ্ছিস! ক্ষতবিক্ষত এই শরীরটাকে এবার তো শান্তি দে! যাক, শেষপর্যন্ত
আবার খাটে শুলাম। এ কি? ফোমের বিছানায় শুয়ে আমার ঘুম হতনা আর এই কাদামাটিতে তোরা
আমাকে শুইয়ে দিচ্ছিস কি মনে করে? আরে আরে! আমার গায়ের ওপর মাটি ফেলছিস কেন? নাহ,
আমার চিৎকার কেউ শুনলনা, আমাকে এই অন্ধকার কবরে রেখে, গায়ের ওপর এক মন মাটি চাপা
দিয়ে সবাই চলে গেল। কি ভয়াবহ দু’জন ফেরেস্তা এসে উপস্থিত! মুনকির নাকির না? ওরা কি
প্রশ্ন করবে আমি জানি, কিন্তু আমি কি উত্তর দিতে প্রস্তুত?
No comments:
Post a Comment