১/
ফোন ধরে বুঝতে
পারলাম প্রস্তুতি এত ভাল হয়েছে যে আমার মস্তিষ্ক কিছুতেই আরবী থেকে ইংরেজী মোডে
ট্রান্সফার হতে রাজী নয়। কিছুতেই মুখে ‘হ্যালো’ আসেনা! শেষমেশ কথা বলার চেষ্টা করতে
গিয়ে বেরোল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’!
ঐদিক থেকে আওয়াজ
এলো, ‘ফোন ধরে আসসালামু আলাইকুম বললেই যথেষ্ট, বিসমিল্লাহ বলার দরকার হয়না!’
ভাগ্য ভাল ফোনটা
বাবা করেছিল!
২/
বিজ্ঞান ছিল আমার
প্রিয় বিষয়। সেভেনে যে শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াতেন তিনি প্রতিদিন প্রত্যেক ছাত্রকে আগের
দিনের পড়ার আদ্যোপান্ত প্রশ্ন করতেন, প্রায় সবাই কোথাও না কোথাও আটকে যেত, ক্লাস
শেষে দেখা যেত ক্লাসে প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকেও প্রতিদিন কুপোকাত করতে
পারতাম আলহামদুলিল্লাহ, তাই একটা সুপ্ত অহংকার হয়ত মনের কোণে কোথাও জন্ম নিচ্ছিল। একদিন
আগাছাটা পরিস্কার হয়ে গেল খুব সহজেই।
ক্লাস নাইনে ব্যাঙের
চ্যাপ্টারে এক লাইনের প্রশ্নের দুই লাইনের উত্তরে তিন রকম বানান দিয়ে ব্যাঙ শব্দটি
লেখার পর বিজ্ঞান শিক্ষিকা জিজ্ঞেস করলেন ঘটনা কি? বললাম, ‘সবই তো সঠিক বানান, তাই
সবগুলোই ব্যাবহার করেছি’।
হাসি চেপে প্রসঙ্গ
পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ফ্যাগোসাইটোসিস বলতে কি বুঝায়
বল’।
ব্যাঙ যে প্রক্রিয়ায়
ব্যাঙাচি হতে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে রূপান্তরিত হবার সময় তার লেজটি খসিয়ে ফেলে তাকে
ফ্যাগোসাইটোসিস বলে। খুব সুন্দর করে বর্ণনা দিলাম, তারপর বললাম, ‘একেই বলে ফ্যাসোগাইটোসিস!’
আর সাথে সাথে পুরো
ক্লাসে হাসির বন্যা বয়ে গেল, সেই বন্যায় আগাছার বীজখানাও ভেসে চলে গেল!
৩/
দশম শ্রেণীতে আমাদের বাংলার শিক্ষক অত্যন্ত মজা করে সাহিত্য পড়াতেন। যেমন
নাটক পড়ালে একেকজনকে একেক চরিত্রে অভিনয় করতে দিতেন। ‘কাবুলীওয়ালা’ নাটকে আমি
ছিলাম মিনির বাবা। সে সূত্রে তিনি আমাকে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গান গাইতে বাধ্য
করলেন। তখন আমার স্ত্রী চরিত্রে অভিনয়রত বান্ধবী রওশন আরা খুব হাসল।
তারপর যখন ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাস পড়ার পালা এলো তখন আমাদের একেকজনকে একেকটি
অংশ পড়ে শোনাতে দেয়া হত। একদিন আমার অংশে ছিল
আধুনিক ডাক্তারের আধুনিকমনষ্ক কথাবার্তা, খুব ঠাট নিয়ে পড়লাম। রওশন আরার ভাগে পড়ল
বাঁশগাড়ির ডায়ালগ। দরিদ্র ব্যাক্তির জায়গাজমি সুদের দায়ে বেদখল হয়ে যাচ্ছে, সে আকুল
আবেদন জানাচ্ছে, ‘হুজুর, দয়া করেন। কনে যাব আমি এতগুলান বাচ্চাকাচ্চা নে?’
‘এতগুলান বাচ্চাকাচ্চা’ বলেই রওশন আরা লজ্জায় ইয়া বড় জিভ বের করে দিল, যেন
বাচ্চাগুলো সত্যি সত্যিই ওর! ওর লজ্জা দেখে ক্লাসের সবার তখন সে কি
হাসি!
৪/
প্রেসিডেন্সি স্কুলে আমি
পড়াতাম ক্রিয়েটিভ রাইটিং। যদিও খাতা চেক করতে করতে অবস্থা কাহিল হয়ে যেত, এই
বিষয়টি পড়াতে আমার খুব ভাল লাগত। এর মাধ্যমে আমি বাচ্চাদের কোমল মনের জানালায় উঁকি
দেয়ার সুযোগ পেতাম, অনেকের লেখায় আগামীর সাহিত্যিকের ঝলক দেখতে পেতাম, আবার কেউ
কেউ এত মজার সব ঘটনা লিখত যে না পড়লে বিশ্বাস করা যেতনা বাচ্চারা এত মজা করে লিখতে
পারে।
একবার ক্লাস ওয়ানে লিখতে
দিলাম ‘আমার মা’। এই বিষয়ে লিখতে দিলে ছোট বড় সবাই লিখতে লিখতে পাতার পর পাতা ভরাট
করে ফেলে। খাতা চেক করতে করতে খানিকটা ক্লান্তই লাগছিল, কারণ সবার লেখার ধরন
মোটামুটি একই ধাঁচের। কিছুক্ষণ পর একটা খাতা পেলাম। শুরুতেই লেখা, ‘আমার মা
অত্যন্ত বদরাগী, সুযোগ পেলেই আমাকে ধরে মারে, মাঝে মাঝে আমার বাবাকেও মারে’!
ভাগ্য ভাল ওর মাকে চিনতাম, তাই মেয়েটির সাহিত্য প্রতিভার প্রশংসা
না করে পারলাম না!
৫/
প্রেসিডেন্সিতে একবার ছুটির
দিনে আমরা কয়েকজন অফিসে বসে গল্প করছিলাম, সময় যাচ্ছিল ঢিমেতালে।
এক ভদ্রলোক দুই মহিলাকে
নিয়ে এলেন তাদের বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে। যথারীতি তাদের পরীক্ষা নেয়া হোল।
একটা বাচ্চা কেজিতে এবং আরেকটা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি পেল। কিন্তু ভদ্রলোক বার বার
অনুরোধ করতে রইলেন যেন হয় উভয়কে কেজিতে, নয় উভয়কে ক্লাস ওয়ানে দেয়া হয়। আমরা তাকে
বোঝানোর চেষ্টা করলাম একজনের জন্য অপরজনকে প্রমোশন দেয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি
একজনের জন্য অন্যজনকে বঞ্চিত করাও অন্যায়। উনি কিছুতেই শুনবেন না। তখন আমরা ভাবলাম
দুই মহিলার সাথে আলাপ করে দেখি তাদের বোঝাতে পারি কিনা। কিন্তু দুই বাচ্চাকে দুই
ক্লাসে দেয়ার কথা বলতেই দুই মহিলার মাঝে হুলস্থুল বেঁধে গেল। যেহেতু এদের একজন
মুসলিম এবং অপরজন হিন্দু, আমরা ধরে নিলাম বোরকাপরা মহিলা ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং
অপরজন হয়ত প্রতিবেশি। কিন্তু এদের মধ্যে এত প্রতিযোগিতার কারণ বুঝতে পারলাম না।
স্বাভাবিকভাবেই
এক্ষেত্রে একজন বাকপটু লোক প্রয়োজন যে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দৃশ্যপটে অবতীর্ণ হলেন হাফিজ সাহেব। ভদ্রলোকের সাথে কিছুক্ষণ
আলাপসালাপ করার পর হাফিজ সাহেব বললেন, ‘সন্তানদের ব্যাপারে অনেকসময় মহিলারা একটু
প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকেন। তখন তারা সন্তানদের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে চান
না। এক্ষেত্রে সম্ভবত বাচ্চাদের বাবারা সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। আপনি তো
আছেনই, অন্যজনের স্বামীকে খবর দিন যেন তিনি একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন’।
এই কথায় ভদ্রলোক এদিক
ওদিক তাকিয়ে বললেন, ‘ভাই, আপনারা এত ঝামেলা করছেন কেন? বাচ্চাদের মা আলাদা বলে কি
ওদের বাবা একজন হতে পারেনা?’!
ঘটনার আকস্মিকতায়
বিস্মিত হতভম্ব হয়ে আমরা উভয়কে কেজিতে ভর্তি করে নিলাম।
No comments:
Post a Comment