‘তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ, আমি খবর নিয়ে জেনেছি তুমি বিবাহিতা নও’।
সে কিছু বলেনা, শীতল দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে, ‘চল, মাঠে গিয়ে বসি’।
আমার হৃদয়বীনায়
ঝঙ্কার ওঠে, যেন মাঠে নয় স্বর্গের উদ্যানে ওর সাথে অনন্তকাল যাপন করার জন্য রওয়ানা
হয়েছি আমি!
আমরা মাঠে গিয়ে
ঘাসের ওপর মুখোমুখি হয়ে বসি। আহ! কি রোমান্টিক! আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে যায় আমার।
চোখ মেলে দেখি
সাদিয়ার দু’পাশে ওর দুই বান্ধবী ওর গা ঘেঁষে বসে আছে। হৃদয়ের তানপুরাটায় ছেদ পড়ে।
‘ওরা এখানে কি
করছে?’
‘আমাকে যা বলার ওদের
সামনেই বলতে হবে’, দৃঢ়ভাবে বলে সাদিয়া।
আমিও দমে যাবার
পাত্র নই, বিপদে ডরেনা বীর।
বললাম, ‘তুমি আমাকে
মিথ্যা বললে কেন?’
‘তুমি কি জানোনা
কেন?’
চুপ করে থাকি।
‘তুমি আসলে কি চাও,
বল তো?’
‘তোমাকে ভালোবাসতে
চাই’।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? প্রেম
করতে চাই’।
‘তারপর?’
‘তারপর... যদি
ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর সব ঠিকঠাক থাকে হয়ত আমাদের বিয়ে হবে’।
‘নয়ত?’
‘নয়ত এই স্মৃতিটাই
আমাদের জন্য বেদনামধুর হয়ে থাকবে’।
‘আমি এই শর্তে রাজী
নই। কারণ এতে প্রাপ্তি আছে দায়বদ্ধতা নেই। তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তাহলে
তোমার বাবামাকে নিয়ে এসো, আমার বাবামা রাজী হলে শুধু চার বছর কেন সারাজীবন আমি
তোমার সাথে থাকব। এর বাইরে
একটি মূহূর্তও আমি তোমার সাথে কাটাতে নারাজ’।
‘কিন্তু এখন আমি
বিয়ে করব কি করে?! সবে তো মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, এখন কি বাবামা বিয়ে দেবেন?
আমার কি কোন ইনকাম আছে? আমি তোমায় রাখব কোথায়, খাওয়াব কি?’
‘তাহলে তুমিই বল,
আমি যদি তোমাকে প্রস্তাব দিতাম আমি তোমার কোন দায়িত্ব নেবনা কিন্তু তোমার সাহচর্য
উপভোগ করব, এই শর্তে তুমি কি আমরা সাথে থাকতে রাজী হতে?’
চিন্তায় পড়ে গেলাম।
‘হ্যাঁ’ও বলতে পারিনা, ‘না’ও বলতে পারিনা।
‘তুমি আমাকে কেন
পছন্দ কর?’
যাক, বাঁচা গেল।
সহজতর প্রসঙ্গে আলাপ করতে পেরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম।
‘তুমি লম্বা, ফর্সা,
সুন্দরী, তোমার চোখ দু’টো অদ্ভুত সুন্দর...’
‘তার মানে আমার মেধা,
মনন, চরিত্র কোন ব্যাপার না। এখন ভেবে দেখ, তুমি যে জিনিসগুলোর কথা বললে এগুলো
কোনটাই আমার অর্জন নয়, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত উপহার, তিনি যখন ইচ্ছে ফিরিয়ে নিতে
পারেন। আমি যদি অ্যাক্সিডেন্টে পা দু’টো হারিয়ে ফেলি আমার উচ্চতা কমে যাবে, রোদে
জ্বলে আমি তামাটে হয়ে যেতে পারি, কয়েকবছরের মধ্যেই এই চামড়া ঝুলে যাবে তারপর কুঁচকে
যাবে, আর আমি যদি অন্ধ হয়ে যাই তাহলে আমার চোখ দু’টো আর কাউকে আকর্ষন করতে
পারবেনা। তার মানে তখন আর তোমার কাছে আমার কোন মূল্য থাকবেনা। তাইনা? এটাকে কি
ভালোবাসা বলা যায়?’
এ কি বিপদে পড়া গেল
ভাই! নায়িকারা তো দেখি তাদের সুন্দর বললে আহ্লাদে গদ গদ হয়ে যায়, যেন সৃষ্টিকর্তা
তাদের সামনে মডেল উপস্থাপন করে তাদের পছন্দ করতে দিয়েছিলেন, ‘বল, তুমি কেমন হতে
চাও’, তাই সুন্দরী হবার কৃতিত্ব তাদেরই! এই মেয়ে তো বড় জ্বালালো!
‘শোন, আমি এজন্যও
তোমাকে পছন্দ করি যে তুমি অন্নেক স্মার্ট’।
‘তাই? স্মার্টের
দু’টো ডেফিনেশান আছে। একটা হোল যে দেখতে শুনতে স্মার্ট। সেটা নির্ভর করে তার পোশাক
আশাক, কথাবার্তা, পসচার এবং চালচলনের ওপর। তার মানে যদি আমি ভাল জুতোজামা পরতে না
পারি, কুঁজো হয়ে যাই কিংবা কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি তাহলেও তোমার কাছে আমার
কোন মূল্য থাকবেনা!’
কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে
করছে আমার!
‘স্মার্টের আরেকটা
অর্থ হোল বুদ্ধিমান। আমি মনে করি এই বয়সটা আমার নিজেকে গড়ে তোলার সময়- এখন আমার
সবচেয়ে জরুরী কাজ লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন করা, যে বাবামা ভাইবোন আমাকে এতগুলো বছর
ছায়াবৃক্ষের মত আগলে রেখেছেন তাদের সম্মানের প্রতি সচেতন হওয়া, সমাজসেবার মাধ্যমে
সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখা, সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যেম নিজেকে বিকশিত করা। তোমার কি মনে হয় আমি যদি এই সময়টা অনর্থক পার্কে
ঘুরে, চীনাবাদাম খেয়ে ব্যায় করি সেটা স্মার্টনেসের পরিচায়ক হবে? কেন এতগুলো লক্ষ্য
বাদ দিয়ে আমরা একটি লক্ষ্যহীন সম্পর্কের পেছনে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেব, বলতে
পারো?’
যুক্তি খুঁজে
পাচ্ছিনা।
‘শোন, তুমি তো আমাকে
ভালোবাস, তাইনা?’
‘হ্যাঁ’।
‘তাই যদি হয় তাহলে আমি
কি বন্ধু হিসেবে তোমাকে কিছু কথা বলতে পারি?’
‘অবশ্যই’।
‘তুমি একজন স্মার্ট
এবং বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার সামনে আছে অপার সম্ভাবনা। তোমার বাবামা এই সম্ভাবনার
কথা ভেবে নিজেদের অনেক আশা আকাঙ্খা, কষ্ট, ত্যাগ তুচ্ছ জ্ঞান করে তোমাকে সর্বোচ্চ
বিদ্যাপিঠে পড়তে পাঠিয়েছেন। অথচ
তারা চাইলেই তোমাকে কোন গাড়ীর গ্যারেজে মেকানিক হিসেবে কিংবা কোন অফিসে পিয়নের
চাকরী দিয়ে টাকা ইনকাম করতে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন! তাহলে তাদের এই ত্যাগের কথা কি
তোমার মাথায় রাখা উচিত নয়? লেখাপড়া করে পৃথিবীটাকে জানার মাধ্যমে, নিজেকে গড়ে তুলে
আশেপাশের মানুষগুলোর কষ্টে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তুমি তোমার বাবামায়ের এই কষ্টের
মূল্যায়ন করতে পারো, একজন সফল এবং ভাল মানুষ হবার মাধ্যমে তুমি তাদের সম্মান উচ্চকিত
করতে পারো। এভাবে নিজেকে গড়ার সংকল্প নিয়ে নামলে কয়েকটা বছর কোনদিক দিয়ে কেটে যাবে
তা তুমি নিজেই টের পাবেনা। তারপর যেদিন তুমি প্রস্তুত হবে সেদিন তোমার
মিতা আপনিই তোমার সামনে এসে উপস্থিত
হবে, সে আমি হই বা অন্য কেউ’।
আমি মাথা নত করে
ভাবতে থাকি।
‘জানো, তুমি ভাবছ
আমি বিবাহিতা নই, তুমি বিবাহিত নও, তাই এই সময়টা আমরা পরস্পরের সাহচর্য উপভোগ করতে
পারি। কিন্তু একটু ভেবে দেখ, কেউ একজন পৃথিবীর কোন এক কোণে আমার জন্য অপেক্ষায় বসে
আছে। হয়ত আমাদের দেখা
হয়েছে, হয়ত হয়নি। কিন্তু আমরা একদিন পরস্পরের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হব, একে অপরকে
অনুপ্রাণিত করব নিজেকে অতিক্রম করে যেতে, বিপদের বন্ধু হব, সুখ দুঃখে একে অপরের
সাথী হব, অন্যায় হতে একে অপরকে টেনে ধরব এবং অনন্তকাল এক অপরের পাশাপাশি চলব। সেই
বন্ধুটির জন্য আমি নিজেকে সেভাবে সংরক্ষণ করতে চাই, সকল প্রলোভন হতে নিজেকে সংবরণ
করতে চাই, সমস্ত প্রেম বাঁচিয়ে রাখতে চাই যেন যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন সে আমাকে
তার সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে, তার সবটুকু আমাকে উজার করে দিয়ে ভালোবাসতে
পারে, আমার এই উপহার গ্রহণ করে কৃতার্থ হতে পারে। বল, সেই অদেখা অচেনা অজানা মানুষটির
সাথে আমার যে প্রেম তার চেয়ে রোমান্টিক আর কি হতে পারে? এই ভালোবাসাই আমি উপহার
দিতে চাই আমার স্বামীকে যেদিন তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত হবে। তুমিও কি তাই
চাওনা?’
কথাবার্তায় তুখোড়
বলে আমার একটা সুপ্ত অহংকার ছিল। কিন্তু সাদিয়ার সামনে আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। ওর
প্রতিটি কথাই তো যুক্তিযুক্ত, তাহলে আমি কোথায় আপত্তি করব? মনে মনে আমিও তো চাই
আমার নববধূর জীবনে আমিই হব প্রথম পুরুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু যাকে সে তার জীবন দিয়ে
বিশ্বাস করতে পারবে, অকুন্ঠচিত্তে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে ভালবাসতে পারবে।
কিন্ত এর জন্য যে আমাকেও তার প্রতি বিশ্বস্ত হতে হবে এটা তো মাথায় ছিলোনা! যা আমি
দিতে প্রস্তুত নই তা চাইবার অধিকার যে আমার নেই তা তো ভাবিনি!
গল্প এখানেই শেষ?
ReplyDelete