বাবামা শখ করে ওর নাম রেখেছিলেন সপ্তর্ষি। নামটা অনায়াসেই স্বাতী কিংবা রোহিণী হতে পারত। কিন্তু তাদের একমাত্র সন্তানটির জন্য কোন একক নক্ষত্র নয়, পরিপূর্ণ একটি নক্ষত্রমন্ডলের নামই তাদের সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছিল। সে ছিল নক্ষত্রের মতই উজ্জ্বল এবং মেধাবী। প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছাত্রী হিসেবে সে ছিল আমার ছাত্রী। ওর বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীতে, মা শিক্ষক। ওর বাবামা মিস্টার এবং মিসেস জামালুদ্দীন আই আই ইউ সিতে এমবিএ পড়তেন, সে হিসেবে তারাও আমাদের ছাত্র। তবে ওর মায়ের সাথে আমার পরিচয় প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে। তাঁর ইন্টারভিউ নেয়ার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কারণ তিনি তাঁর অ্যামেরিকা সফরের সবচেয়ে স্মরনীয় ঘটনার বৃত্তান্ত দিয়েছিলেন এভাবে, ‘একদিন আমি এক বৃদ্ধার সাথে পার্কে হাঁটছিলাম। প্রচন্ড গরম ছিল। সবদিকে উলঙ্গ অর্ধ উলঙ্গ মানুষের ভিড়। বৃদ্ধা আমাকে বললেন, তুমি জামা না খুললেও অন্তত প্যান্টটা খুলে ফেল। আমি তাঁকে বোঝাতে পারলাম না যে আমরা মুসলিম, তাই মাথায় কাপড় দেই বা না দেই, সালোয়ার খুলে হাঁটতে পারবনা!’
তিনি যখন প্রেসিডেন্সিতে যোগ দেন তখন আমি স্কুল ছেড়ে আই আই ইউ সিতে যোগ দিয়েছি। কিন্তু হাফিজ সাহেব তখনো প্রেসিডেন্সিতে ছিলেন, আমার মেয়ে থাকত স্কুলে এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে আসা যাওয়া হত প্রচুর। প্রেসিডেন্সির প্যাসেজে, বন্ধুদের আড্ডায়, বিভিন্ন মিটিংয়ে, ক্লাসে কিংবা লাঞ্চরুমে প্রায়ই দেখা হয়ে যেত হাসিখুশি এই শিক্ষিকার সাথে। কখনো আলাপ হত তাঁর মেয়ের নাম নিয়ে, আর কখনো তিনি সরলমনে বিস্ময় প্রকাশ করতেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত রাদিয়া আপনার থেকেই জন্মেছে?’ হাসতাম। কন্যা আমার পুরোটাই বাপের ডুপ্লিকেট, তাই অনেককেই আশ্বস্ত করতে হত, ‘জ্বী, রাদিয়ার জন্মের সময় আমি পরিপূর্ণ হুঁশজ্ঞানে ছিলাম, আমি নিশ্চিত জানি ওকে আমার ভেতর থেকেই বের করা হয়েছে’!
কয়েকবছর মা মেয়ে প্রেসিডেন্সিতে কাটানোর পর সে বছর সপ্তর্ষীর বাবার পাবনা ট্রান্সফার হয়ে গেল। পুরোন বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে বলে সপ্তর্ষীর মন খারাপ। কিন্তু ওর মা মহাখুশি! কারণ পাবনা তাঁর বাপের বাড়ী। আনন্দটা ডাবল ছিল কারণ ওর খালা আসছিল অ্যামেরিকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে। বেশ ক’বছর পর দু’বোনের দেখা হবে। ওরা ওর খালাকে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে পিক আপ করে যমুনা ব্রিজ পাড়ি দিয়ে সোজা পাবনা চলে যাবে। পাবনায় গিয়ে ঈদ। আনন্দের জোয়ার বটে!
সেবার তাঁর ক্লাসের বাচ্চাদের সাথে শেষ ক্লাস পার্টির জন্য সপ্তর্ষীর মা সবার সতর্কতাবানী উপেক্ষা করে কাঁচের ডিনার সেট নিয়ে এলেন। বললেন, ‘আমার বাচ্চারা পেপার প্লেটে খাবে, এটা কি করে হয়?’ ওর বাবাও এলেন বিশ পঁচিশটা বাচ্চাকে ঠিকভাবে খাওয়াতে তাঁর মিসেসকে সাহায্য করতে।
যিনি অন্যের সন্তানকে এতটা আদরস্নেহ দিতে পারেন, তিনি নিজের সন্তানের ব্যাপারে কতটা আন্তরিক হবেন তা তো বুঝাই যায়। যেদিন উনি শেষ কাজে আসবেন সেদিন তড়িঘড়ি আই আই ইউ সির ক্লাস শেষ করে লাঞ্চরুমে পৌঁছে দেখি ততক্ষণে অনেকেই জড়ো হয়ে গিয়েছে। সবাই একসাথে খেতে বসলাম। সেদিনের মেনু সাদাভাত, গরুর মাংস আর ডাল। আমাদের স্কুলের রাঁধুনী সাজেদার রান্না অসাধারন হলেও সামান্য ঝাল হত। সপ্তর্ষির ঝাল লাগবে দেখে ওর মা মাংস ডালে ডুবিয়ে ভাতে মেখে ঝোল ছাড়িয়ে সাদাভাত দিয়ে খাওয়াচ্ছেন। সপ্তর্ষি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। দেখে ভাবছিলাম, আমি মনে হয় আমার সন্তানকে ভালোই বাসিনা। আমার তিনবছর বয়সী মেয়ে দু’মাস বয়স থেকেই আমার সাথে স্কুলে আসে, স্কুলেই খাওয়া দাওয়া গোসল ঘুম। সে দেড় বছর বয়স থেকেই নিজের হাতে খায়। দু’বছর থেকে নিজে নিজে কাপড় পরে। আমি আই আই ইউ সি আর প্রেসিডেন্সির মধ্যে আসাযাওয়া করে ওকে দেখে যাই বটে কিন্তু সে দিব্যি ক্লাসে যায়, টিফিন খায় আর ক্লাস শেষে দারোয়ান ভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্টের দায়িত্ব পালন করে। দু’বছর বয়স থেকেই সে সম্পূর্ন স্বাবলম্বী! ওকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাটা কি বাবামা হিসেবে আমাদের দিক থেকে আদরের অভাব? ভেবে পাইনা।
চলে গেল সপ্তর্ষী আর ওর মা মহানন্দে, স্কুল ছেড়ে।
কয়েকদিন পর। সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে আমাদের জুনিয়র সেকশনের সিনিয়র টিচার ডেইজি আপা ফোন করলেন। জুনিয়র সেকশনের একজন শিক্ষক দিবা টিচারকে কে যেন বিকেলে ফোন করেছিল। একটা অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে তিনজন মারা গেছে। সেখানে যে মোবাইল পাওয়া গেছে তাতে লাস্ট কল দেখাচ্ছে ওর নাম্বারে। সে বেচারী অতটুকুতেই ভীষণ ভড়কে গেছে। যত আত্মীয়স্বজন আছে সবার খবর নেয়া শেষ। কিন্তু বুঝতে পারছেনা কার মোবাইলে ওর নাম্বার পাওয়া গেছিল। আমরা ডেইজি আপাকে বললাম, ‘ওকে শান্ত হতে বলেন, আমরা খোঁজখবর করে দেখছি’। হাফিজ সাহেব আর আমি দু’জন দুই মোবাইলে বিভিন্ন দিকে ফোন করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর টিভিতে আটটার সংবাদের শিরোনাম শুনে ফোন করা বন্ধ করলাম।
যমুনা ব্রিজে প্রাইভেট কারের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষে মিস্টার এবং মিসেস জামালুদ্দীন এবং সদ্য অ্যামেরিকাফেরত বোনটি সাথে সাথেই মারা যায়। আমরা ধরে নেই সপ্তর্ষী বেঁচে গেছে।
পরে ওর নানা নানীকে ফোন করে জানা যায় সে গুরুতর আহত হলেও সাথে সাথে মারা যায়নি, ঐ অবস্থাতেই বেঁচে ছিল আরো চার ঘন্টা। চিৎকার করছিল, ‘আমার আম্মুকে ডাক, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’। চারঘন্টা পর সে নিজেও আম্মুর পথ ধরে চলে গেছিল প্রচন্ড অভিমানে।
ক্যানাডা চলে আসার আগে বান্ধবী জলসার সাথে দেখা করতে গেলাম। ইন্টারে একসাথে পড়েছি আমরা। কিন্তু আসল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ইন্টারের পরে। আমার বিয়ের কয়েকবছর পর কিভাবে যেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর একদিন আচমকা কলকাতা এয়ারপোর্টে আমার বাবামার সাথে জলসার দেখা। ওরা কেউ কাউকে কোনদিন দেখেনি, পাশাপাশি বসে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা কিন্তু কেউ কাউকে চেনেনা। কিভাবে যে কথা শুরু হয়েছিল জানিনা, কথায় আমি কেন বা কোথা থেকে এলাম তাও জানিনা, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীকে আবার খুঁজে পেলাম। ওর বাসায় গিয়ে বহুবছর পর আবার ওর মায়ের সাথে দেখা হোল, ওর জমজদের দেখাশোনার সহযোগিতার জন্য আন্টি ওর বাসাতেই ছিলেন তখন। পৃথিবীতে যে অল্প ক’জন মানুষ আমাকে অন্ধভাবে পছন্দ করতেন, বিশ্বাস করতেন, তাদের একজন তিনি, আজও জানিনা কেন। এত বছর পর আবার আমাকে দেখে আন্টি ভীষণ খুশি হলেন। সেই ক্ষণিকের দেখার পর আবারও বিদায়ের পালা।
জলসার বাসা থেকে বের হয়ে হাফিজ সাহেব বললেন, ‘চল, ওদের বাসার পেছনে যাই’।
বললাম, ‘পেছনে কি? রাস্তা তো সামনে’।
উনি বললেন, ‘চল, একটি পরিবারের সাথে দেখা করে আসি’।
জলসার স্বামী সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। ওদের বাসার পেছনেই সেনাবাহিনীর গোরস্থান। গিয়ে দেখলাম এখনেই শুয়ে আছে আমাদের সেই নক্ষত্রসম ছাত্রী এবং ওর পরিবার। ওদের জন্য দু’আ করতে গিয়ে বার বার চোখের সামনে ভাসতে লাগল, একজন মা তাঁর সন্তানের ঝাল লাগবে বলে মাংস ডালে ডুবিয়ে ভাতে মাখিয়ে ঝোল ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ তাঁর সন্তানটি যখন গুরুতর আহত হয়ে কাতরাচ্ছে তখন তিনি তাকে কোন সাহায্যই করতে পারছেন না! কত অসহায় আমাদের ভালোবাসা!
এই পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। কেউ স্থায়ী নয়। এমনকি আমার সন্তানের জন্য আমার বেঁচে থাকা অপরিহার্য নয়। এটাই চরম সত্য। সেক্ষেত্রে আমার সন্তানকে আমি আমার মুখাপেক্ষি করে রাখলে তা বেশি ভালবাসার পরিচায়ক, নাকি তাকে এমনভাবে গড়ে তোলাই প্রকৃত ভালোবাসা যেন সে সর্বাবস্থায় স্বাবলম্বী হয়ে চলতে পারে? আমার দুই সন্তানকে আত্মনির্ভরশীল করে বড় করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে যে খটকা লাগত, ‘আমি কি তবে আমার সন্তানদের যথেষ্ট ভালোবাসিনা?’, তা হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, এটা আমার সন্তানদের প্রতি আমার স্নেহের অভাব নয় বরং তাদের প্রতি আমার উপহার। একজন মা হিসেবে আমি তাদের শারিরীকভাবে আদর করার মাধ্যমে যতটা মমতা প্রকাশ করতে পারি, তার চেয়ে তাদের মাঝে নৈতিকতা এবং মনোবল গড়ে দিতে পারলেই মাতৃত্বের দাবী পূরণ করতে পারি। তার বিপদের মূহূর্তে আমি পাশে থাকতে পারবনা হয়ত, কিন্তু আমার শিক্ষা তাকে প্রেরণা জোগাবে।
But at my back I always hear
Time's winged chariot hurrying near; (To His Coy Mistress, Andrew Marvell)
ঘড়ির প্রতিটি টিক টিক আমায় জানান দিচ্ছে, ‘সময় ফুরিয়ে এলো, তুমি কি যাবার জন্য প্রস্তুত?’ আমি কি আসলেই প্রস্তুত?
No comments:
Post a Comment