Sunday, February 17, 2013

আমি আত্মহত্যা করব

‘জামিল, তুমি যদি আমাকে বিয়ে না কর তাহলে আমি আত্মহত্যা করব’।

খাতা চেক করতে গিয়ে এই একান্ত বার্তাটি চোখে পড়ে যাওয়ায় অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলাম। স্পষ্টতই বার্তাটি আমার জন্য লেখা নয়, আমার দৃষ্টির জন্যও নয়, খাতার মধ্যে এলো কিভাবে তাও বোধগম্য নয়কিন্তু প্রাথমিকভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবার পর যখন বার্তার বিষয়বস্তু আমার মাথায় উদিত হোল তখন বুঝতে পারলাম এমন একটি বিষয় জানার পরে চুপচাপ খাতা চেক করে ছাত্রীকে ফিরিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষক হিসেবে না হোক, মানুষ হিসেবে আমাকে কিছু করতেই হবে।

খাতা দেখা শেষে ছাত্রীকে ডেকে পাঠালাম। সময় নির্বাচন করতে হচ্ছিল এমনভাবে যেন সে সময় আর কেউ রুমে উপস্থিত না থাকে যেহেতু এটি তার একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। আমার ছাত্রী হলেও বয়সে সে আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়, কিন্তু আমার সকল ছাত্রছাত্রীর প্রতি আমার আচরন মাতৃসুলভতাই তাদের আদর করতে যেমন কুন্ঠিত হইনা তেমনি বকা দিতেও পিছপা হইনা। সে রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ওকে নিয়ে ছুটলাম, ‘তোমরা জীবনটাকে কি মনে কর বল তো? জীবনটা কি এত সস্তা যে ইচ্ছে হোল আর ছুঁড়ে ফেলে দিলে? তোমার বাবামা কত স্বপ্ন নিয়ে তোমাকে এত বছর ধরে পেলেপুষে মানুষ করেছেন, কত আশা নিয়ে এমন ব্যায়বহুল একটি প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠিয়েছেন। তাদের কথা ভাবলেনা? তোমার ভাইবোনের কি হবে তাও না? একটা ছেলেই কি তবে তোমার জীবনের সব হয়ে গেল? পৃথিবীটা কত বড়! অথচ তুমি এমন একজনের জন্য জীবনটাকে তুচ্ছ মনে করছ যে তোমাকে চায়ই না! এই চিঠি যদি আমার হাতে না পড়ে তোমার বাবামার হাতে পড়ত তাহলে তাদের কি অবস্থা হত ভেবে দেখেছ?’
আমার কথার তোড়ে ঝড়ে পড়া পাখীর মত কোনক্রমে ভেসে থাকার চেষ্টায় ছিল সে। এবার বলল, ‘ম্যাডাম, সরি, আসলে আমার জানা ছিলোনা চিঠিটা খাতার ভেতর ছিল। আসলে ওটা কিছু না’।

এবার মেজাজটা সত্যিই খারাপ হোল। আমি বলি কি আর আমাকে বলে কি? বললাম, ‘ওটা কিছু না মানে? তুমি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছ ওটা কিছু না?’
সে আমাকে জানাল, ‘আসলে ম্যাডাম, সে আমার শিক্ষক ছিল। আমি যখন জানতে পারি বিয়ের কয়েকমাসের মাথায় ওর স্ত্রী মারা যায় তাই সে সারাক্ষণ বিষন্ন থাকে, আমার মাঝে প্রচন্ড সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। সহানুভূতি থেকে যে কিভাবে আমি ওকে ভালবেসে ফেললাম তা নিজেও বুঝিনি। ওকে যখন বললাম আমি ওকে বিয়ে করতে চাই, চাই ওর জীবনের বিষন্নতাগুলো সুখের রঙের আড়ালে ঢেকে দিতে, তখন সে শুধু বলল, ‘আমার সাহস হয়না। একবার স্বপ্নভঙ্গের পর আবার ঘর সাজাতে ভয় হয়’। আমি তখন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম ম্যাডাম। আমি ওকে চাপ দেয়ার জন্য এই চিঠি লিখেছিলাম’।

আমি বললাম, ‘তুমি যদি একান্তই তাকে বিয়ে করতে চাও তাহলে তোমার বাবামায়ের সাথে কথা বল, তাদের মাধ্যমে যা করার কর। আর এই সমস্ত বাজে চিন্তা থেকে দূরে থাকো। ঠিক আছে?’
সে বলল, ‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ম্যাডাম, আমি আর ঐ ধরণের চিন্তা করবনা’।

 
ধরে নেই ওর নাম স্বাতী। আমি আই আই ইউ সি তে যোগ দেই ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের উদ্বোধনী শিক্ষকদের একজন হিসেবে। তখন ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের অনার্সের একটাই ব্যাচ। এই উদ্বোধনী ব্যাচটি ছিল আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং মেধাবী ব্যাচগুলোর একটি। এদের বাবামা এদের যেকোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করাতে পারতেন কিন্তু শুধুমাত্র মেয়েদের আলাদা ক্যাম্পাস হবার কারণে আই আই ইউ সি তে পড়তে পাঠান। স্বাতী যেমন লেখাপড়ায় ভাল ছিল, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিতর্ক, বক্তৃতা, আবৃত্তি, স্মার্টনেস, কনফিডেন্স কোনদিকেই পারদর্শীতার অভাব ছিলোনা। দেখতেও ছিল চমৎকার। এই ঘটনার তিনমাস পর একদিন আই আই ইউ সি র মূল ক্যাম্পাসের গেটে ওর সাথে দেখা। সে বলল, ‘ম্যাডাম, প্লিজ একটু এদিকে আসুন’। ওর সাথে গিয়ে দেখলাম একপাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝারী গোছের, শ্যামলা। সে বলল, ‘ইনিই জামিল ম্যাডাম, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম। কিছুদিন হোল আমাদের বিয়ে হয়েছে’। তাদের অভিনন্দন জানালাম, জামিলের মুখের হাসিটাই জানান দিচ্ছিল স্বাতীর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ভাবছিলাম, সবাই যদি এমন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়ে করত কত ভালই না হত!

 
এর দু’তিনমাস পর দেখা গেল স্বাতী ইউনিভার্সিটি আসছেনা। ওর বান্ধবীরা কেউ কিছু জানেনা। ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ার ব্যাপারে গাফলতি করলে আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। লেখাপড়াই তো ছাত্রজীবনের পেশা। তাহলে কি এমন জরুরী কাজ থাকতে পারে যার জন্য ওরা লেখাপড়া করতে পারবেনা? আর বিয়ের পর মেয়েরা লেখাপড়ায় ঢিল দিলে একেবারে অসহ্য লাগে। আরে বাবা! তোমার স্বামী কি বিয়ে করে চাকরীবাকরী ছেড়ে দিয়েছে? তাহলে তুমি কেন লেখাপড়া বিসর্জন দিয়ে বসে থাকবে? তাহলে তো একসময় তার মনে হবে, ‘দেখে শুনে তবে কি মূর্খ বিয়ে করলাম?’ এক সপ্তাহ হয়ে গেল ওর কোন খোঁজ নেই।

এ সময় খবর পেলাম আমাদের প্রেসিডেন্সির এক ছাত্র মোহাম্মাদুল্লাহ সপরিবারে অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হয়েছে, ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। সাথে সাথে হাফিজ সাহেব আর আমি ছুটলাম হাসপাতালে। বেচারাদের কেউ অক্ষত নেই। মোহাম্মাদুল্লাহ কোলে ছিল তাই আহত হয়েছে বেশি, নাক জুড়ে সেলাই আর হাতে পায়ে প্লাস্টার। ওদের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম আমাদের দেশে কেন মানুষ অ্যাক্সিডেন্ট করলে ট্রাক জ্বালায়। ওদের দেখে প্যাসেজে এসে দাঁড়িয়েছি, দম নেয়ার চেষ্টা করছি, এই করুণ দৃশ্য কিছুতেই হজম হচ্ছেনা। হঠাৎ দেখি জামিল কোথা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। আমি কিছু বলার আগেই বললেন, ‘ম্যাডাম, স্বাতী খুব অসুস্থ। গত সাতদিন ধরে সে এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। অথচ বার বার বলছে ম্যাডাম কি মনে করবেন, ওনাকে একটা খবর দাও। এখন আমি কি ওকে দেখব না খবর দিতে যাব বলেন? আপনি যদি ওকে একটু সাহস দিতেন খুব ভাল হত’।

সাথে সাথে সব রাগ ভুলে গেলাম। হাফিজ সাহেব কখনো মহিলা রোগী দেখতে যান না। মহিলাদের দেখতে কোন পুরুষ ভিজিটর গেলে তারা রিল্যাক্স করতে পারেন না, ফলে তাদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামে ব্যাঘাত হয়, তাই। ওনাকে জামিলের সাথে কথা বলতে দিয়ে স্বাতীর রুমে গেলাম। ওকে তখন রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে। ওর মা জানালেন, গত সাতদিন ধরে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ডাক্তাররা ওর রক্তে এক ধরনের ডিসঅর্ডার লক্ষ্য করেছেন যা পৃথিবীতে অত্যন্ত রেয়ার। তখন পর্যন্ত এমন রোগীর সংখ্যা সারা পৃথিবীতে মাত্র দু’শ জন। এর আপাতত কোন চিকিৎসা নেই। যতটুকু সামলে চলা যায়। ওকে বললাম, ‘বেশি চিন্তা কোরনা, ডাক্তাররা যেভাবে বলেন সেভাবে চল। যদি শরীর ভাল লাগে তাহলে ইউনিভার্সিটি এসো, নইলে যতটুকু সম্ভব আমরা তোমার পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে চেষ্টা করব’।

সাতদিন পর স্বাতী আবার ইউনিভার্সিটি আসতে শুরু করল। কিন্তু দিন পনেরো আসার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল। এভাবেই চলতে লাগল কয়েক মাস যাবত। সুস্থ থাকলে আসে, নইলে অনুপস্থিত থাকে। পরে আবিষ্কার করলাম জামিল আমাদের পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ফলে স্বাতী না এলে ওর স্বামীর কাছ থেকে খবর নিতে পারতাম।

কিছুদিন পর আমাদের এক সহকর্মী হুসনা আপা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে দেখার জন্য ডিপার্টমেন্টে আমার একমাত্র মহিলা সহকর্মী সালমা আপাসহ মেডিকাল কলেজে গেলাম। হুসনা আপাকে দেখে মন খারাপ করে আমরা বেরিয়ে আসছি, এমন সময় খবর পেলাম স্বাতীকেও মেডিকাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছেদু’জনে গেলাম ওকে দেখতে। সে মৃদু হেসে সালাম দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু হাসিটাই বলে দিল ওর কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে। ওর মা জানালেন সে এখন সার্বক্ষণিক এই অবস্থাতেই আছে, আগে যেমন একটু খারাপ একটু ভাল হত তেমন আর হচ্ছেনা। বিছানা থেকে উঠতেই ওর খুব কষ্ট হয়, কোন কিছুই নিজে নিজে করতে পারেনা। দিনের বেলা ওর মা স্বাতীকে দেখাশোনা করেন। জামিল কাজ শেষে ওর সাথে থাকে। কিন্তু ডাক্তাররা কোন আশার বানী শোনাতে পারছেন না। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। একটা উনিশ বিশ বছর বয়সী মেয়ে, এই বয়সে ওর হেসেখেলে বেড়ানোর কথা, অথচ সে হাসপাতালের সেই নিরানন্দ রুমটাতে শুয়ে তড়পাচ্ছে। কিছুই করার নেই আমাদের, এমনকি সান্তনা দেয়ার ভাষাও নেই।

এর পর থেকে মাঝে মাঝে ছুটির পর সময় পেলে সালমা আপা আর আমি ওকে দেখতে যেতাম। একবার সালমা আপা ওর রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আমি আর আসবনা। যতবার আসি ওর মুখখানা দেখে আমার আর ঘুম হয়না। কিছুই তো করতে পারছিনা আমরা ওর জন্য। এসে কি হবে?’

আমি আর একবারই গিয়েছিলাম, একা। মানুষের শরীরের একটা পর্যায়ে তার আর ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য একটা হাসি দেয়ারও শক্তি অবশিষ্ট থাকেনা। স্বাতী তখন সে অবস্থায়। ভাবছিলাম আমি কি করতে পারি ওর জন্য? কিছুই না। একটা পর্যায় আসে যখন আর কথাবার্তা দিয়েও কারো ভার লাঘব করা যায়না।

তার কিছুদিন পর। অনার্সের পরীক্ষা চলছিল। আমার সাথে ডিউটিতে আছেন নতুন শিক্ষক ইফতেখারউদ্দীন। ডিপার্টমেন্টে নতুন হলেও হাফিজ সাহেবের জুনিয়র হিসেবে জানাশোনা ছিল আগেই। ইফতেখার বললেন, ‘আপা, আপনি কি স্বাতীর খবর কিছু জানেন?’
আমি বললাম, ‘না ভাই, পরীক্ষার প্রশ্ন প্রস্তুতি সব মিলিয়ে আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আপনি কিছু জানেন?’

বললেন, ‘জামিল আমাদের বন্ধুশ্রেনীর। তাই ওদের সাথে মাঝেমধ্যেই যোগাযোগ হত। কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম, গতরাতে স্বাতীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ওরা ওকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হয়। কিন্তু বেচারী পথেই মারা যায়’।
জানতাম এমনটাই হবার কথা ছিল হয়ত। মনের একটা দিক বলছিল, ‘যাক, অন্তত এর মাধ্যমে সে কষ্ট থেকে মুক্তি পেল’। কিন্তু মনের আরেকটা দিক বলছিল, ‘আহারে! এক সময় সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আজ যখন সে বাঁচতে চায় তখন তার সময় ফুরিয়ে গেল! যখন সে সুস্থ ছিল তখন সে জীবনকে তুচ্ছ ভেবেছিল। যখন সে জীবনের মূল্য বুঝতে পারল তখন তার যাবার সময় হয়ে গিয়েছে। কত বকা দিয়েছি ওকে, কিন্তু আমরা নিজেরাই কি জীবনের সর্বোচ্চ হক্ক আদায় করি, একে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাই?’



তারপর বহুবছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু স্মৃতিটা যায়নি। মাঝে মাঝে প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্য দুঃখ হয়। ভাল মেমোরীর একটা সমস্যা হোল, ভালটা যেমন ভোলা যায়না তেমনি কষ্টগুলোও ম্লান হয়না। ক্যানাডা আসার আগে জামিলের সাথে দেখা হয়েছিলতিনি আর বিয়ে করেননি। পর পর দু’বার একই দুর্ভাগ্য যার জীবনে হানা দিয়ে যার তার জন্য সাহসের পাখায় ভর করে উড়াল দেয়া কঠিন বটে! স্বপ্ন দেখি একদিন ওরা দু’জন পরস্পরের হাত ধরে জান্নাতের উদ্যানে হেঁটে বেড়াবে, সেখানেই হোক সকল অপ্রাপ্তির পরিপূর্ণ তৃপ্তি, সেটাই তো চিরস্থায়ী!

No comments:

Post a Comment