১. অহসন
ভাবছেন ভুল লিখেছি? নাহ, আমাদের ক্লাসের আহসান বানানে এত কাঁচা ছিল যে ক্লাস ফাইভের পরীক্ষার খাতায় নিজের নাম সে এভাবেই লিখেছিল। তারপর থেকে শাস্তিস্বরূপ সমাজ টিচার বলে দেন সবাই যেন ওকে ‘অহসন’ ডাকে। আমি নিজে লেখাপড়ায় আহামরি কিছু না হলেও যারা জ্ঞানপিপাসু তাদের সবসময় শ্রদ্ধা করতাম। তাই লাকী তিথি মিনহাজের মত মেধাবীদের ভীড়ে ওকে খুব একটা গণ্য করা হতনা।
একদিন আমার ছোটভাই আহমদ বাসায় এসে জানালো ক্লাসে ওর এক বান্ধবী হয়েছে। ক্লাস ওয়ানের সে বান্ধবী আবার ওকে সপরিবারে দাওয়াত করেছে! সে কান্নাকাটি করে বাবামাকে রাজী করিয়ে ফেল্ল ওদের বাসায় যাবে। মেয়েটি ছিল খুব সুন্দরী। তাই ক’দিন আমরা ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করলাম। পরে একদিন ঐ আংকেল ফোন করে দাওয়াত দিলেন।
ওদের বাসায় গিয়ে দেখি আহমদের সুন্দরী বান্ধবী হোল আহসানের ছোটবোন! ওদের বাসায় যেতেই সে আহমদকে নিয়ে ওর রুমে খেলতে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ গোঁ ধরে বড়দের মধ্যে বসে রইলাম। শেষে আংকেল বললেন, “তুমি বড়দের মধ্যে বসে কি করছ? আহসান, ওকে নিয়ে যাও। তোমরা একসাথে খেল”। মেজাজটা বিগড়ে গেল। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার ভাই বা তার বান্ধবীর কোন দেখা নেই। অগত্যা আহসানই শেষ ভরসা।
যেহেতু ক্লাসে আমাদের খুব একটা কথাবার্তা হতনা, দু’জনেই ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। তাই কথা বার্তা না বলে সে ওর বিভিন্ন খেলনা আমাকে দেখাতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে দেখি কোন খেলনাই আমি পুরোপুরি চিনতে পারছিনা! সবই মনে হোল এক খেলনার এক পার্টের সাথে আরেক খেলনার আরেক পার্ট নিখুঁতভাবে জোড়া দেয়া অথচ এগুলো দিব্যি ব্যাটারী দিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে! আমি আগ্রহী হয়ে উঠলে আহসানও বেশ সাবলীল হয়ে উঠলো। সে বল্ল বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করা ওর নেশা। সে খুটখাট করে টুকটাক মেরামত শুরু করেছিল দু’বছর আগে। এখন টিভি থেকে ট্রানজিস্টার সব ঠিক করতে পারে। একই প্রযুক্তি খেলনার ওপর প্রয়োগ করলে কি হয় দেখার জন্যই সে খেলনাগুলো নিয়ে এই পরীক্ষা চালিয়েছে!
সেদিন বুঝলাম, কাউকে বাইরে দেখে বোঝার উপায় নেই তার মধ্যে কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ওর বাবামা ওর মেধাকে চিহ্নিত করে তাকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কিন্তু সে মেধা আবিষ্কার করার কথা ছিল আমাদের শিক্ষকদের- কেননা শিক্ষকদের দায়িত্ব কেবল পড়ানো নয়, ছাত্রছাত্রীদের সুপ্ত মেধাকে চিহ্নিত করে তাকে বিকশিত করার চেষ্টা করাও। হায়! ক’জন শিক্ষক এই দায়িত্ব পালন করেন?
পুনশ্চঃ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আহসান টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। যেহেতু ওটাই ওর ক্ষেত্র ছিল, নিশ্চয়ই সে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল।
২. ক্লাস পালানো
জীবনে একবার ক্লাস পালিয়েছিলাম! তখন আমরা ক্লাস সিক্সে পড়ি। আবুধাবী সরকারের নির্দেশে সব স্কুলে দু’টো পেপার এক্সট্রা পড়ানো হত। আরবী আর কুর’আন মিলে এক পেপার, ইউ.এ.ই. সোশ্যাল স্টাডিজ আরেক পেপার। আরবী পড়াতেন এক ঈজিপ্সিয়ান শিক্ষক। কেউ পড়া না পারলে তিনি তাদের মাথায় চাঁটি মারতেন। তবে শুধু ছেলেদের। দুঃখজনক ঘটনা হোল, আগের বছর ‘ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় ‘আরবী মেয়ে’ সাজার পর থেকে উনি কেন যেন আমাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করলেন। লাভ হোল এই যে একমাত্র আমার বেলায় উনি মেয়ে হলেও পড়া না পারলে চাঁটি মারার ভয় দেখাতেন!
সেদিন পড়া ছিল ‘সূরা আলাক’ মুখস্ত করা। কিছুতেই প্রথম সাত আয়াতের পর মনে রাখতে পারিনা! ক্লাসের ছেলেদের সাথে কথা বলে কিছুটা সান্তনা পেলাম যে শুধু আমি না, আর কেউ পুরোটা মুখস্ত পারেনা। আরবী ক্লাসের আগের পিরিয়ডে জানা গেল লাকী পুরোটা মুখস্ত করে এসেছে। ও ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, সবকিছুতে পার্ফেক্ট। খুব মেজাজ খারাপ হোল। কে বলেছে ওকে এত ভালো হতে? ছেলেরা ওকে থ্রেট দিল ও যদি বলে ও পুরোটা শিখে এসেছে, ওকে মেরেই ফেলবে! কিন্তু মনে শান্তি পেলাম না।
কুর’আন ক্লাসের আগে আগে আমি আর তিথি গেলাম ওজু করতে। আমাদের স্কুলের নিজস্ব প্রেমিস ছিলোনা। একটা আরবী স্কুলে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ঐ প্রেমিসে বিকেলে আমরা ক্লাস করতাম। স্কুলের দু’টো ভাগ ছিল, আমাদের ক্লাস চলত একভাগে। দু’ভাগের মধ্যখানে ছিল ওজু করার জায়গা। ওখানে কোন ক্লাসরুম ছিলোনা। মেয়েদের ওজু করার জায়গাটা একটু বাগান দিয়ে ঘেরা। ওজু করতে করতে তিথি আর আমি আলাপ করতে শুরু করলাম আজকে ক্লাসে কি হতে পারে। কথা বলতে বলতে আমরা এর এমন ভয়াবহ এক চিত্র কল্পনা করে বসলাম যে শেষমেশ আর ক্লাসে ফিরে যেতে সাহসে কুলালনা। সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাস পালাবো। কিচ্ছু করার দরকার নেই। আরবী স্যার ছিলেন একজনই। উনি আমাদের ক্লাসে থাকলে আর কেউ এখানে ওজু করতে আসবেনা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, অন্ধকার। তাছাড়া জায়গাটা বাগান দিয়ে ঘেরা। সুতরাং, এখানে বসে থাকলে আমাদের কেউ দেখতে পাবেনা। তবুও এই অন্যায় কোনদিন করিনি, ভীষণ ভয় লাগতে শুরু করল। ধুকপুক করতে করতে মনে হোল হৃৎপিন্ডটা ফেটেই যাবে। দু’জনে কথা বলতে বলতে সময় মনে হয় শেষই হয়না! যখন মনে হোল বুকটা মনে হয় ব্যাথা করতে করতে মরেই যাব, শেষপর্যন্ত ঘন্টা বাজল! খুব দেখেশুনে স্যার নিরাপদে অন্য ক্লাসে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়ার পর আমরা চোরের মত ক্লাসে ঢুকলাম।
আমাদের দেখে ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। জেনে খুব মর্মাহত হলাম যে সেদিন স্যার ‘সূরা আলাক’ ধরেননি, শুধু গল্প করে চলে গিয়েছেন!
পুনশ্চঃ আমাদের পড়াশোনায় নিবেদিতপ্রাণ বান্ধবী লাকী এখন ডাক্তার। তিথি আর আমি এখনো একসাথে আছি ক্যাল্গেরীতে! এখনো ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি, কিন্তু নির্ভয়ে। ঐ দিনের কথা মনে হলে ভীষণ হাসি পায়!
৩. বন্ধুত্ব
ক্লাস সিক্সে বিজ্ঞান ক্লাসে একটা প্রজেক্ট ছিল পিনহোল ক্যামেরা। এতে একটা ক্যামেরা বানাতে হয় যার ভেতর দিয়ে দেখলে মোমবাতি উলটো দেখা যায়। যেদিন টিচারকে দেখাতে হবে আমরা সবাই খুব সাবধানে নিজের নিজের ক্যামেরা সামলে রাখলাম যেহেতু এগুলো এত ঠুনকো জিনিস দিয়ে বানানো ছিল যে যেকোন মূহূর্তে অসাবধানতাবশত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পঞ্চম পিরিয়ডে টিফিনের পর আহসান আর আশিক দুই বন্ধু একে অপরের ক্যামেরা নিয়ে বসল মন্তব্য করার জন্য। ঘটনাটা কি করে ঘটল আমরা কেউ লক্ষ্য করিনি। আশিককে চিৎকার করতে শুনে ক্লাসের পেছনে তাকিয়ে দেখি কিভাবে যেন ওর ক্যামেরাটা একটু চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে আর আহসান মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে আছে। সবাই আশিককে বোঝানোর চেষ্টা করল আহসান নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ওর ক্যামেরাটা নষ্ট করেনি, কিন্তু সে ক্ষেপে গিয়ে আহসানের ক্যামেরাটা পায়ের নীচে ফেলে মাড়িয়ে দুমড়ে মুচড়ে ওটার দফারফা করে দিল। তারপরও ওর মাথা ঠান্ডা হোলনা। টিচার যেকোনসময় আসবেন বলেও ওকে আমরা ক্লাসে আটকে রাখতে পারলাম না; সে মাঠে গিয়ে ঐ দুমড়ানো ক্যামেরাটাকে মাঠের এ’মাথা থেকে ও’মাথা লাথি দিয়ে নিয়ে যেতে থাকল। রুবী টিচার শব্দ শুনে ক্লাস ফোর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন লাভ হোলনা। বিজ্ঞান টিচার, মিসেস বজলুর রহমান, আবার স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেদিন উনি মিটিংযে আটকে পড়ায় ক্লাসে আসতে দেরী হচ্ছিল।
শেষপর্যন্ত হয়ত মাড়ানোর মত আর কিছু অবশিষ্ট ছিলোনা বলেই সে ক্লাসে ফিরে এলো। কিন্তু এসে মাত্র সে আহসানের টেবিলটা তুলে মেয়েদের সীটের পাশে বসিয়ে দিয়ে গেল, “যা, তুই মেয়েদের সাথে বস”, তারপর ওর আগের জায়গায় থুথু ছিটালো। শেষমেশ আর করার কিছু না পেয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল।
ভীষণ মেজাজ খারাপ হোল আমাদের মেয়েদের। ছেলেগুলো এরকম অভদ্র কেন?
সেদিন ক্লাস শেষে স্কুলবাসে বসে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমার জানালার বাইরেই একটা দৃশ্য দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল! আশিক আর আহসান একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে! আহসান বলছে, “ভুল হয়ে গেছে দোস্ত, মাফ করে দে ভাই”। আর আশিক ওকে জড়িয়ে ধরে বলছে, “আমার মাথার ঠিক ছিলোনা ভাই, তুই সব ভুলে যা, আমাকে মাফ করে দে”।
সেদিন ঠিক করলাম ছেলেরা হয়ত আসলে অত খারাপ না কারণ আমি হলফ করে বলতে পারি ৯০% মেয়ে, সে তাদের হৃদয় যত বড়ই হোকনা কেন, এ’রকম একটা ঘটনার পর পরস্পরের সাথে স্বাভাবিক হতে পারতনা, অন্তত এই রেকর্ড সময়ে তো নয়ই!
আমি এখনো কারো সাথে মনখারাপ হলে এই ঘটনা মনে করে নিজেকে প্রশস্ত করার চেষ্টা করি। আহা! সেই নিষ্পাপ মনটা যদি আমরা আজীবন ধরে রাখতে পারতাম!
৪. দ্য আগলী ডাকলিং
বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল থেকে আদৌ এসএসসি দেয়া যাবে কি’না ব্যাপারটা যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বাবা আমাকে একটা ও’লেভেল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য নিয়ে গেল। এই স্কুলে ছেলেমেয়েদের সেকশন আলাদা এবং অংকের জন্য একজন বৃদ্ধ শিক্ষক ছাড়া কোন পুরুষ শিক্ষক মেয়েদের পড়ান না। লৈখিক পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা। আমি যখন ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি তখনো শ্রীলঙ্কা থেকে ইংরেজীর শিক্ষক এসে পৌঁছননি তাই আমার ক্ষেত্রে ভাইভার জন্য ছেলেদের সেকশনের শিক্ষককে নিয়ে আসা হোল। ওনাকে দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। উনি ইংরেজ! বাংলাদেশ স্কুলে সবসময় শিক্ষকরা বলে এসেছেন আমি ইংরেজীতে ভালো না। আর এই ভদ্রলোক আমার কি অবস্থা করবেন?
যা থাকে কপালে বলে বসে পড়লাম। উনি আমাকে একটা গল্প পড়তে দিলেন, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘দ্য আগলী ডাকলিং’। আমি পড়তে পড়তে বিমুগ্ধ হয়ে ভুলেই গেছিলাম যে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি! মনে হচ্ছিল এটা যেন আমারই গল্প! স্যারের ডাকে পৃথিবীতে ফিরে এলাম। উনি আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ভাইভা শেষে আমার ইংরেজীর প্রশংসা করলেন (!),আমাকে কিছু ইসলামী উপদেশ দিলেন, তারপর আমাকে ছেড়ে দিলেন। ঐ পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করলাম। বহু পরে বুঝেছি কেন আমাকে বাংলা স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন আমি ইংরেজীতে কাঁচা কিন্তু ইংরেজী স্কুলে আমি ইংরেজীতে হাইয়েস্ট পেতাম। আমি ইংরেজী শিখেছি সেভাবে যেভাবে একজন রিক্সাওয়ালা ভাই বাংলা শিখেছেন। তিনি বাংলা বলার সময় কোন ভুল করেননা কিন্তু তাঁকে যদি ব্যাকরণ জিজ্ঞেস করা হয় উনি আকাশ থেকে পড়বেন, “ঐটা আবার কি জিনিস?”
সে যা হোক, এই শিক্ষকের সাথে যদিও আমার ঐ একবারের পর আর দেখা হয়নি, আমার জীবনে ওনার যে কি অবদান তা উনিও কোনদিন জানবেন না। ‘দ্য আগলী ডাকলিং’ গল্পটি এবং আমার ব্যাপারে তাঁর অ্যাসেসমেন্ট প্রথম আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল যে সবাই আমাকে যেমন অপদার্থ বলে বা আমি সুন্দর নই বলে আজেবাজে কমেন্ট করে এগুলো কোন মূখ্য বিষয় নয়! আমাকেই খুঁজে নিতে হবে আমি কি পারি এবং ধৈর্য্য আর ডিটারমিনেশনের সাথে এগিয়ে যেতে হবে।
পরবর্তীতে দেখলাম শুধু আমিই নই, ছাত্রী শিক্ষক সবাই ওনার ব্যাপারে কৌতুহলী ছিল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল তিনি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম। কিন্তু তিনি যখন ইসলামকে গ্রহণ করেছেন তখন পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছেন। স্কুলের মাঠের ওপাড়েই ছিলো ওনার বাসা। একদিন উনি ক্লাসে থাকাকালীন ছাত্রীদের ওনার বাসা দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। দেখলাম উনি ঠিক রাসূল (সা)এর আদর্শ অনুযায়ী মাটিতে শুতেন এবং ঘরে নূন্যতম পরিমাণ জিনিস ছিল যা একজন জন্মগত বৃটিশের জন্য অস্বাভাবিক। অংক স্যারের কাছে শুনেছি তিনি হাত দিয়ে খেতেন, চাকুরীর সময়টুকু ছাড়া রাসূল (সা)এর মত করে জামাকাপড় পরতেন। দেখেছি তিনি মানুষের সাথে সদ্ব্যাবহার করতেন, ভালো উপদেশ দিতেন। তাঁকে দেখেই আমার প্রথম ইসলাম সম্পর্কে নিজে নিজে লেখাপড়া করে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আজকের আমি।
হয়ত শিক্ষক হবার আগ্রহটাও তাঁকে দেখেই কেননা একজন মানুষের দশ মিনিটের সংস্পর্শ যদি কারো জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে, তবে আপত্তির কি আছে?
৫. পাগল
আমরা যখন ক্লাস এইটে, একদিন বাংলা স্যার এসে জিজ্ঞেস করলেন আমরা জীবনে কে কি হতে চাই। সবাই যে যার ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশ করতে লাগল।
ক্লাসের এক ছেলে কিছুতেই বলবে না। অনেকক্ষণ পর ওর ভাই (দু’ভাই একই ক্লাসে পড়ত) বলে দিল, “স্যার, ও ট্রাকড্রাইভার হতে চায়!” আসলে আগেরদিন বাবার কাছে পড়াশোনায় গাফলতির জন্য বকা খাওয়ার একপর্যায়ে সে জেদ করে এ’কথা বলেছিল। কিন্তু বেঈমান ছোটভাই সব ফাঁস করে দিল!
মেয়েদের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে যখন আমার পালা এলো, বললাম, “আমি এতকিছু হতে চাই যে আমি নিজেই ঠিক করতে পারিনা আমি আসলে কি হতে চাই! তবে আপাতত মানসিক রোগীদের ওপর একটা লেখা পড়ে ভাবছি মানসিক ডাক্তার হব। ওদের কষ্টের কথা এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে আমার মনে হয় ওদের একজনকেও সাহায্য করতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যাবে”। স্যারকে মনে হোল এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে উনি একটু কনফিউজড! অন্যমনষ্ক হয়ে উনি আমার পাশে বসা শিরিনকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি হতে চাও?” ও ছিল ভীষণ দুষ্ট। ও বল্ল, “স্যার, আমি পাগল হতে চাই!” স্যার চমকে উঠে বললেন, “বল কি? কেন?” ও বল্ল, “স্যার, আমার প্রিয় বান্ধবীর জন্য। নাহলে ও রোগী পাবে কোথায়?!”
পুনশ্চঃ সে’বছর শিরিন সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিল। নাহ, সিরিয়াস কিছু না। ‘ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় সে এত বাস্তবভাবে পাগলের অভিনয় করেছিল যে প্রথম পুরস্কার ওর জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ফলাফল ঘোষনার আগেই!
৬. হুদা টিচার
মিসেস হুদা ছিলেন কেজির টিচার। আমি আবুধাবীর বাংলাদেশী স্কুলে ভর্তি হয়েছি ক্লাস ফাইভে। তাই ওনার ক্লাস কখনো পাইনি। তবে দূর থেকে ওনাকে আমরা সবাই খুব পছন্দ করতাম। মার্জিত রুচি, পরিশীলিত আচরণ, তীক্ষ্ণ মেধা আর শৈল্পিক ব্যাক্তিত্ব- সব মিলে উনি ছিলেন এক আদর্শ নারী।
চার বছর বয়স থেকেই বাবামা, দাদাদাদু আমাকে প্রচুর বই কিনে দিয়ে পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে দেয়। পাঁচবছর থেকে লেখালেখির শুরু। কিন্তু বই আর লেখালেখি আমাকে আস্তে আস্তে অসামাজিক করে তোলে। মানুষের সাথে কথা বলার চাইতে আমি এক কোণে একখানা বই নিয়ে বসে থাকা হাজারগুনে পছন্দ করতাম। আর কারো সামনে বক্তৃতা, বিতর্ক বা আবৃত্তি করতে বললে মনে হত যেন আমাকে কোরবানী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! ক্লাস ফাইভে উঠে বাবা আমাকে এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করতে লাগল। আমি যতই বই আর লেখালেখি নিয়ে মেতে থাকতে চাই, বাবা আমাকে ততই ঠেলে। আমি নিরুপায় হয়ে সবার সামনে গিয়ে ঘামতে থাকি, মাটির দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কি বলে আসি আমি নিজেই শুনতে পাইনা। এভাবেই চলতে লাগল বছরের পর বছর।
সেভেনে আমি অন্য স্কুলে ছিলাম। এইটে যখন জানা গেল বাংলাদেশ স্কুল থেকে এসএসসি দেয়া যাবে আমি আবার আমার আগের স্কুলে ফিরে এলাম। সেবার হুদা টিচার ছিলেন আমাদের বক্তৃতার বিচারকদের একজন। প্রতিযোগিতা শেষে উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি একটু অবাক হলাম যেহেতু ওনার সাথে আমাদের কোন সংস্পর্শ ছিলোনা। টিচারের কাছে গেলে উনি বললেন আমার বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট দেখবেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে উনি হতবাক হয়ে বললেন, “তাইত বলি, যে মেয়ে রেগুলার ম্যাগাজিনে লেখে সে বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট লিখতে পারেনা কেন? তোমার লেখা তো চমৎকার, তাহলে তোমার সমস্যা কি? তুমি কেন কনফিডেন্টলি বক্তৃতা দিতে পারোনা?” আমি চুপ করে রইলাম। উনি বুঝে নিলেন আমার সমস্যা কি। পরে আমাকে বলে দিলেন আমি যেন প্রতিদিন টিফিন টাইমে ওনার সাথে বসি।
উনি আমাকে সাতদিন বক্তৃতা আর আবৃত্তির বেসিক্স শেখালেন তার সাথে প্রতিদিন প্র্যাক্টিস। সাতদিন পর উনি বললেন, “এবার তুমি নিজে নিজে এগোতে পারবে। আমি তোমার পরবর্তী পারফর্মেন্সগুলোর দিকে নজর রাখব”।
প্রতিযোগিতা আর অনুষ্ঠানের কথা বাদ দিলাম। পরবর্তীতে ওনার এই শিক্ষা যে আমার কত কাজে লাগবে তা হয়ত উনিও কোনদিন ধারণা করতে পারেননি। কিন্তু আমার শিক্ষকতা জীবনে প্রতিটি দিন প্রতিটি মূহূর্ত আমি ওনার বদান্যতার কথা স্মরণ করেছি।
পুনশ্চঃ আমাদের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের একটা ছবি আছে যেখানে দেখতে পাচ্ছি আমি বক্তৃতা দিচ্ছি আর হুদা টিচার গালে হাত ঠেকিয়ে একমনে শুনছেন, চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। খুব জানতে ইচ্ছা করে উনি আমাকে নিয়ে যে কষ্ট করলেন এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমার পার্ফরমেন্সে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি’না!
৭. আংকেল
ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার আগেরদিন বাংলা ক্লাসে রহিম স্যারের পরিবর্তে আনিস স্যারকে দেখে সবাই হকচকিয়ে গেলাম। স্যার বুঝতে পেরে জানালেন যে রহিম স্যার অসুস্থ বলে উনি ক্লাস নিতে এসেছেন। যেহেতু সব পড়া হয়ে গিয়েছে উনি বাংলা বই নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আনিস স্যার ইংরেজীর শিক্ষক হলেও বাংলা সাহিত্যে ওনার ভালো দখল ছিল। তাই উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একদম ভেতর থেকে প্রশ্ন করছিলেন। আমাদের ক্লাসে ছেলেরা যে শুধু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিলো তাই নয়, তাদের লেখাপড়া ছাড়া আর কোন বিষয়ে আগ্রহের অভাব ছিলোনা। তাই দেখা গেল মেয়েরা পটপট উত্তর দিয়ে যাচ্ছে অথচ ওরা হাতও তুলতে পারছেনা।
কিছুক্ষণ পর স্যার প্রশ্ন করলেন, “’কপোতাক্ষ নদ’ কে লিখেছেন?” শেষপর্যন্ত একটা সহজ প্রশ্ন পেয়ে ক্লাসের এক ছেলে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, মেয়েরা যাতে উত্তর দিতে না পারে সেজন্য সে খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেল্ল, “আমি পারি স্যার! আংকেল মুধুসূদন দত্ত!”
পুনশ্চঃ সেদিন হাসির তোড়ে ভেসে গেছিল আমাদের ক্লাস। স্যার কোনরকমে হাসি চেপে ক্লাস ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছিলেন প্রাণ খুলে হাসার জন্য। দুর্ভাগ্য আমার! ছেলেটা আমাদের বাসেই যেত। তাই ওকে যতবার দেখছিলাম ‘আংকেলের’ কথা মনে করে কিছুতেই হাসি বন্ধ করতে পারছিলাম না। রাতে যে পেটব্যাথা করছিল, মাগো, সে কথা মনে করতেই ভয় লাগে!
৮. রাশেদ
সেদিন খেলার মাঠে রাশেদকে না পেয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছিল। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা ক্লাস সেভেন এইট থেকেই খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভাইদের সাথে বড় হওয়ার কারণেই কি’না জানিনা আমি খুব একটা ভদ্রটাইপ মেয়ে হতে পারিনি কখনো। ক্লাস টেনে উঠে ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা ছাড়া আর গত্যান্তর রইলোনা আমার। সেদিন দেখি কেউ নেই। এদিক সেদিক ঘুরে টিফিন শেষের ঘন্টা বাজতে ক্লাসে ফিরে এলাম। দেখি আমাদের ক্লাসের সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছে রাশেদকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তো হতবাক! ঘটনা কি? ওদের ক্লাসের এক ছাত্রী ওকে কি বলে যেন ক্ষেপিয়েছে আর সেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের ব্লেড দিয়ে কব্জী থেকে কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলেছে!
ভারী আশ্চর্য লাগল। ওরা চার ভাইবোন পড়ত আমাদের স্কুলে। সবাই ছোটখাট, ধবধবে ফর্সা আর সুন্দর। কিন্তু আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত ওর ছোট তিনবোনকে। ওরা প্রতিদিন স্কুলে জায়নামাজ নিয়ে আসত। সময় হলেই নিজেরা নামাজ পড়ত, বড় ভাইকে ডেকে নামাজ পড়াত, হোক ক্লাস বা পরীক্ষা। ওরা যেমন লেখাপড়ায় অগ্রগামী ছিল তেমনি খেলাধূলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কিন্তু কোন বাজে কাজে বা উলটাপালটা কথায় তাদের দেখতাম না। ওদের ভাই একটা মেয়ের কথায় এমন করতে পারে ভাবতেই অবাক লাগল!
দু’দিন পর রাশেদ আবার স্কুলে আসতে শুরু করল। ফুলশার্ট পরে। টিচাররা বলে দিয়েছিলেন কেউ যেন ওকে কিছু না বলে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা তো আর আমার জন্য প্রযোজ্য নয়! আচ্ছামত ঝাড়লাম ওকে।
কয়েকদিন পর হঠাৎ বায়োলজি স্যার এসে বললেন জবা ফুলের ডিসেকশন করাবেন। যেহেতু সেদিন রুটিনে বায়োলজি ক্লাস ছিলোনা আমরা কেউ বায়োলজি কিট নিয়ে যাইনি।স্যার বললেন, একটা ব্লেড পাওয়া গেলেও আমরা একে একে সবাই প্র্যাক্টিকালটা করতে পারতাম। সবাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমি বললাম, “স্যার, আমি দেখি ক্লাস নাইনে কারো কাছে আছে কি’না”। গিয়ে সোজা রাশেদকে ধরলাম, “ব্লেড দাও”।
ও বল্ল, “কেন আপু?”
“আমাদের ফুল ডিসেকশন করার জন্য লাগবে”।
“আজকে তো ব্লেড আনিনি আপু”।
“অসম্ভব, আর কারো কাছে না থাকলেও তোমার কাছে অবশ্যই থাকবে”।
বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে বল্ল, “বিশ্বাস করেন আপু, আমি এখন ভালো হয়ে গিয়েছি। সত্যিই আমার কাছে ব্লেড নাই!”
কি আর করা? হাসতে হাসতে চলে এলাম। সেদিন হাত দিয়েই ব্লেডের কাজ চালাতে হয়েছিল ঐ জবাফুলগুলোর ওপর। আবুধাবীতে জবাফুল সবসময় মিলতোনা তাই যখন পাওয়া যেত তখনই বায়োলজি ক্লাসের আয়োজন করতে হত।
ক্লাস টেনের শেষে আমাদের শিক্ষকরা জানালেন আমাদের কোন ফেয়ারওয়েল দেয়া হবেনা। আমাদের পরীক্ষার ব্যাবস্থা হয়েছিল আবুধাবীস্থ বাংলাদেশ এম্বাসীতে। নতুন স্কুলের কন্সট্রাকশনের কাজ শুরু হয়েছে তাই স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে এই স্কুলের এসএসসি পরিক্ষার্থী প্রথম ব্যাচের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের জন্য ফান্ড ছিলোনা।
তা রাশেদ এই কথা কিছুতেই মেনে নিতে রাজী হোলনা, “আমি আপুদের কিছুতেই ফেয়ারওয়েল ছাড়া স্কুল ছেড়ে চলে যেতে দেবনা!” বেচারা সবার কাছ থেকে টাকাপয়সা সংগ্রহ করে, স্কুলের মাঠে টেবিল চেয়ার বিছিয়ে, উপহার কিনে, মানপত্রসহ সবার জন্য ব্যাক্তিগতভাবে কার্ড বানিয়ে আমাদের বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করল! ওর এই মায়া চিরিদিন মনে থাকবে।
পুনশ্চঃ আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে সে একবার বাসায় এসেছিল আমার বইখাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর আর কোনদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ওকে আর ওর অসাধারণ বোনদের আমার সবসময় মনে পড়ে।