Saturday, October 2, 2010

আমি ‘লেডী’ নই

টাইটানিক ছবিটা আমার ভাইয়েরা আমাকে অনেক সাধ্য সাধনা করে দেখিয়েছিল, অনেক ভাগে বিভক্ত করে। একবার প্রথম ভাগ, একবার শেষভাগ, আরেকবার মধ্যভাগ। আমার রুচিতেই মনে হয় কিছু একটা সমস্যা আছে। আমার কোনভাগই ভালো লাগলোনা! এজন্যই মনে হয় আমার এক ননদ একবার আমাকে বলেছিল, “ভাবী, আপনি তো দেখি সব ফ্লপ ছবি পছন্দ করেন যেগুলো কেউ দেখেওনা!” আমি মনে হয় আসলেই একটু অদ্ভুত! অনেক ছবির শেষ একমিনিট দেখেও আমি অনুপ্রাণিত হই আবার অনেক ছবির পুরোটা দেখেও আমার সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু মনে হয়না।

এই টাইটানিক ছবিতে একটা অংশ ছিল যেখানে একটা বাচ্চামেয়েকে তার মা শেখাচ্ছিল কি করে একজন ‘লেডী’র মত আচরণ করতে হয়। পোশাক থেকে শুরু করে কথাবার্তা আচরণে একটা নিখুঁত মেকীভাব সৃষ্টি করতে পারাটাই হোল ‘লেডী’ হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কেন যেন এই এক জায়গায় এসে নায়িকার অনুভূতিগুলোর বঃহিপ্রকাশ আমার সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেল। মানলাম, অনেকসময় সামাজিক প্রয়োজনে আমাদের অনেক ইচ্ছা অনিচ্ছা পছন্দ অপছন্দ বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু তার একটা মাত্রা আছে। একটা মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাই করবে যা মানুষ তার কাছে আশা করবে, একটি মূহূর্তের জন্যও সে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবেনা, মনের মত হাসতে পারবেনা, কাঁদতে পারবেনা- এটা কি একটা জীবন হতে পারে?

নাটকে সিনেমায় বইয়ের পাতায় যেসব আদর্শ মেয়েদের ছবি উঠে আসে তারা সারাক্ষণ প্রজাপতির মত নেচে গেয়ে হাসিমুখে সেবা দিয়ে যায়। তাদের কোন দুঃখ তারা কাউকে বুঝতে দেয়না, রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করেনা, শতকথায় রা করেনা। আমি কখনো তাদের মত হতে চাইনি। হওয়া সম্ভব বা উচিত আমার কখনো মনে হয়নি। একটা মানুষ যেমন অন্যের সেবা করবে ঠিক সেভাবে সেবা পাবার অধিকারও তার থাকতে হবে। কখনো সে ক্লান্ত হবে, কখনো তার মন খারাপ হবে, কখনো সে রাগ করবে, চেঁচামেচি করবে। আমরা যদি স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেই “nobody is perfect’ তবে তাকে কেন নিখুঁত হতে হবে? মেয়ে বলে সে মনখারাপ করতে পারবেনা? মন খারাপ করার দোষে তাকে ‘আঁধারমুখো’ বা ‘বদমেজাজী’ না বলে কেউ কি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে পারেনা, “মন খারাপ কোরনা, সব ঠিক হয়ে যাবে”? সবসময় রাগ চেপে রেখে নিজেই কষ্ট পেতে হবে কেন? কখনো কখনো কি সে রাগ প্রকাশ করলে তাকে ‘মাথাগরম’ বা ‘বদরাগী’ খেতাব না দিয়ে ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলা যায়না, “ঠিক আছে বাপু, তোমার চা বানানোর দরকার নেই, আমিই বানিয়ে নিচ্ছি!”? কেন তার প্রতি অন্যায় করা হলে সে বলতে পারবেনা, “তোমরা আমার প্রতি অন্যায় করছ”? কেন সে কোন ব্যাপারে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে না? যার ওপর সবার অধিকার আছে তার কি কারো ওপর কোন অধিকার নেই?

খুব সাধারন সব ব্যাপারে মেয়েদের খুঁত ধরা হয়। যেমন আমি ছোটবেলা থেকেই খাবার নিয়ে খুব ঝামেলা করি। রান্না করা মাংস থেকে রগ বেছে, চর্বি আলাদা করে ফেলে দেই। মাছের কাঁটা ভীষণ ভয় পাই, ততক্ষণ বাছি যতক্ষণ না নিশ্চিত হই যে আর একটিও কাঁটা নেই। সব্জীও খাই বেছে। তাই আমার খেতে সময় লাগে অনেক। আর এই নিয়ে কত কথা! “মেয়েদের খেতে এত সময় লাগলে হয়? তুমি এত আস্তে খাও বলেই তো তুমি ঠিকমত খেতে পারোনা, বাচ্চা ঘুম থেকে উঠে যায়। মহিলারা কি করে এত আস্তে আস্তে খায়?” কেন? একজন পুরুষ যদি বাসায় একটা কাজও না করে খাবার টেবিলে গল্প করে করে একঘন্টা ধরে বিপুল পরিমাণে খাওয়াটা দোষ না হয় তাহলে একজন মহিলা সারাদিন রান্নাবাড়া করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ বাচ্চা সামলে তাকে জন্তু জানোয়ারের মত হাপুস হুপুস খেতে হবে কেন? কেন সে স্বস্তিমত খাওয়ার সময়টুকুও নিজের জন্য ব্যয় করতে পারবেনা? বহু কথা শুনলাম জীবনে কিন্তু কারণটা কেউ বুঝিয়ে বলতে পারলোনা। বিয়ে হলেই মেয়েদের কাছে আশা করা হয় যে তারা চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ফেলবে অথচ একজন পুরুষ শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে গেলেও তার জন্য তাই রান্না করা চাই যা সে নিজের বাড়ীতে খায়। সন্তানসম্ভবা হলে যখন মেয়েদের বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তার অনেক কারণ থাকে। কিন্তু আমার খুব মজা লাগে এই ভেবে যে মেয়েটা যতদিন কাজ করার উপযোগী ছিল ততদিন তাকে শ্বশুরবাড়ীতে রাখা হোল, আর যখন তাকে দেখাশোনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল তখন তাকে মায়ের বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হোল! বলি বাচ্চাটা কাদের নামে পরিচিত হবে? দাদার না নানার?

ছোটবেলায় কবিতা পড়েছিলাম “হাসতে মানা”। পড়ে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে গেছিলাম। অথচ এই ঘটনা যে আমার জীবনে ঘটবে তা কখনো ভাবিনি। বিদেশে বড় হওয়াতে আমাদের কখনো মেপে হাসার অভ্যাস করতে হয়নি। দেশে ফেরার পর একবার এক মামা এসেছিলেন বাসায়। মা ওনার সাথে কথা বলতে বলতে আমি নাস্তা এনে দিচ্ছিলাম। সব আনা হলে মা ইশারা করে বল্ল টিস্যু পেপার দিতে। মামা বলে উঠলেন, “না না, এত খাবার আমি এমনিতেই খেতে পারবনা, আর কিছু আনার প্রয়োজন নেই”। হঠাৎ মামার কথায় হাসি সামলাতে পারলাম না। মা চোখ রাঙ্গিয়ে উঠলে হাসি আরো বেড়ে গেল। মামা মা’কে জিজ্ঞেস করলেন, “ওর কি হয়েছে?” যেন মেয়েদের হাসি নিষেধ! মা আমাকে ভেতরে যেতে বলে মামাকে বুঝ দিল, “না, ওর একটু মাথা খারাপ আছে, ও এমনিতেই হাসে”।

আর কান্না? ও জিনিস আমার দ্বারা হয়না। এটাও একটা দোষ! আমার মনে হয় কান্নাটা একপ্রকার দুর্বলতা। আমি আমার দুর্বলতা শুধু একজনের কাছেই প্রকাশ করি। বাকীদের এ’ব্যপারে জানার কোন প্রয়োজন বা অধিকার আছে বলে আমি মনে করিনা। তাই মানুষের সামনে কাঁদাটা আমার জন্য প্রায় অসম্ভব একটা ব্যপার। শুধু একদিন কেঁদেছিলাম তাও ধরে বেঁধে কাঁদালে যা হয়! যখন ক্যানাডা চলে আসছি আমার মহিলা সহকর্মী এবং ছাত্রীরা আমার জন্য আলাদা করে বিদায়ী অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার আট বছরের ইউনিভার্সিটি শিক্ষকতা জীবনে যাদের পড়িয়েছি- অনার্স, মাস্টার্স, এমবিএ, ডিপ্লোমা, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীরা, আমার যেসব ছাত্রী আমার সহকর্মী হয়ে গিয়েছে প্রায় সব ব্যাচ থেকে যারা খবর পেয়েছে সবাই এসেছিল। এই আট বছরের স্মৃতিচারনা করলেন সব ছাত্রী, শিক্ষক, সহকর্মী- আট বছর যার সাথে সবচেয়ে বেশী সময় কাটিয়েছি সেই সালমা আপার উদ্যোগে, তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায়। তারপর যখন ছাত্রীরা কান্না শুরু করল, অনেকে রাগ করল “ম্যাডাম কেন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন?” না পারি উঠে যেতে না পারি বসে থাকতে! এ’ছাড়া আমি বিয়ের দিন পর্যন্ত কাঁদিনি। ছোটভাই শাওনের ওপর রাগ খুব কাজ দিয়েছিল তখন। ছেলেরা কেন মেয়েদের হলের ভেতরে আসার চেষ্টা করছে, ও কি করছে এসব নিয়ে বকাবকি করতে করতে কেটে গিয়েছে দেড়ঘন্টা-দু’ঘন্টা যা আমাকে বিয়েবাড়ীতে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু পরে এই নিয়ে কত কথা! বৌ তো খুশী হয়ে নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ী চলে গেল। একটু কাঁদলোও না! মনে হোল বলি, “বাসা থেকে আসার আগে আপনাদের সবাইকে আমার সাথে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল”। কিন্তু ভদ্রতা একটা বিরাট সমস্যা। অনেক কথাই বলা যায়না। আর মানুষ যখন এই ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করে তখন যে কি ইচ্ছে করে তা আর নাইবা বললাম।

যে মেয়েরা খুব বেড়াতে পছন্দ করে তাদের জন্য টাইটেল হোল “ঠ্যাংলম্বা”। আমার সবসময় বেড়ানোর খুব শখ ছিল। তাই ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিয়ের আগে প্রিয় বেড়ানোর জায়গা ছিল বান্দরবান। ওখানে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, চিম্বুক পাহাড়ের ওপর একটা কাঁঠালচাঁপার গাছ ছিল যে গাছের ওপর উঠলে রুমা থেকে সাতকানিয়া পর্যন্ত দেখা যেত। গাছটা পাহাড়ের একপ্রান্তে প্রায় ঝুলে আছে তাই দৃষ্টিসীমা ছিল অবারিত। চিম্বুক গেলেই আমি ঐ গাছের ওপর উঠে বসে থাকতাম। আর আমার খালাত ভাই, যে আমার জন্মের বহু আগে থেকেই বাংলাদেশে এলে মা’র সাথে সাথে থাকে, অনবরত চেঁচাতে থাকত, “এই, মেয়েরা গাছে ওঠেনা, নাম নাম!” সমস্যা কি বুঝলাম না! কিন্তু আমিও কম ট্যারা না। আমি যতক্ষণ পাহাড়ের ওপর থাকতাম ততক্ষণ ঐ গাছের ওপরেই থাকতাম। মজার ঘটনা হোল, বাবা একবার আমার একটা ছবি তুললো ঐ গাছের মগডালে বসা। বান্দরবান থেকে এসে অনেক ছবির সাথে ঐ ছবিটাও নিয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রেসিডেন্সী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সহকর্মীদের দেখাতে। ওখান থেকে ছবিটা কিভাবে যেন ‘মিসিং’ হয়ে যায়। আমার বিয়ের পর ঐ ছবিটা পেলাম আমার শ্বশুরবাড়ীর অ্যালবামে! আম্মা এই ছবি দেখে বধু নির্বাচন করেছেন! সাহসী শ্বাশুড়ী বটেন!

মেয়েদের চিন্তা চেতনা ভাবনা হতে হবে পানির মত তরল আর না হলেই সে হয়ে যাবে “পেঁচী” বা “পাগল”। আমার এক ননদ একবার অস্থির হয়ে আমাকে বলেছিল, “ভাবী, আমি আপনাকে বুঝিনা। কখনো মনে হয় আপনি তুলার মত নরম আর কখনো মনে হয় আপনি লোহার চেয়েও শক্ত!” এটা কোন কঠিন সমস্যা নয়। আমি মানুষের কষ্টের ব্যপারে তুলার মত নরম আর নিজের কষ্টের ব্যপারে লোহার চেয়েও শক্ত, নিজের অধিকারের ব্যপারে আমি তুলার চেয়েও নরম আর অন্যের অধিকারের ব্যপারে আমি লোহার চেয়েও শক্ত। আমি মহান বলে নয়। আমার অধিকারের ব্যপারে আমাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবেনা তাই এতে ছাড় দেয়া যায়। কিন্তু আমি অন্যের প্রতি অন্যায় হতে দেখেও যদি চুপ থাকি তাহলে আমি কিরকম মানুষ হলাম? আর এ’নিয়ে চেঁচামেচি করি দেখে কত মানুষ যে আমাকে অপছন্দ করে তার সীমাসংখ্যা নেই।

অনেক ব্যাপারে আমাদের দিয়ে এমন কাজ করানো হয় যার কোন যুক্তি নেই। আমি যে দোকান থেকে সোনার জিনিস কিনতাম তাদের কাছে একবার চেন কিনতে গেলাম আমার ননদের মেয়ে আর আমার মেয়ের জন্য। ওরা দু’রকম চেন দেখালেন- একটা চিকন, মনে হয় এখনি ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে আরেকটা মোটা, মজবুত। বললাম, দ্বিতীয়টা থেকে দু’টো দিতে। উনি একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, “ভাবী কি তিনটা চেন নিচ্ছেন নাকি?” আমি ততোধিক আশ্চর্য হয়ে বললাম, “না তো ভাই! দু’টাই তো নেব- আমার মেয়ের একটা আর ননদের মেয়ের একটা!” উনি বললেন, “সবাই তো নিজের জন্য মোটা নেয় আর দেয়ার জন্য চিকন নেয়, তাই আপনাকে দু’রকম দেখালাম!” আমি থ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। রাসূল (সা) বলেছেন বাসায় কাজের লোককেও তাই খেতে পরতে দিতে যা আমরা নিজের জন্য পছন্দ করি। সেটা সাধ্যে না কুলালে অন্তত দুরত্বটা কাছাকাছি রাখা উচিত। কিন্তু নিজের জন্য ভালোটা নিয়ে অন্যকে খারাপটা দিলে দেয়ার দরকার কি? কর্তার পয়সা বাঁচাতে গিয়ে এই সাধারন ইনসাফের ব্যাপারটাই আমরা অনেক সময় মনে রাখিনা! সোনার জিনিসই দিতে হবে কথা নেই, তবে সামর্থ্যের মধ্যে ভালো জিনিসটা অন্যের জন্য নির্বাচন করাটা তো স্বাভাবিক মানবতার দাবী!

আমার ছেলেকে যে মেয়েটা দেখাশোনা করত ওর নাম ছিল রোজিনা। ওরা আট বোন। বাপের সামর্থ্য বলতে কিছুই ছিলনা। তাই বড়লোকের ছেলে পেয়ে মেয়ে ভালো থাকবে ভেবে উনি রোজিনার বিয়ে দিলেন এক পাগলের সাথে। ঐ ঘরে একটা ছেলে হবার পর ও আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে ছেলেকে বড়বোনের কাছে রেখে সুদূর যশোর থেকে চট্টগ্রাম চলে এলো। বাপের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য ছোট আরো দু’বোনকে সে নিজের কাছে নিয়ে এলো। লেখাপড়া জানতনা বলে গার্মেন্টসে চাকরী পাচ্ছিলনা। চারটা বাসায় কাজ করে সে নিজে চলত, বোনদের পেট চালাত। বোনেরা যৎসামান্য লেখাপড়া পুঁজি করে তখন মাত্র গার্মেন্টসে ঢুকেছে। আমার কাছে যখন সে আসে তখন আমি ছেলের জন্য ম্যাটার্নিটি লীভে। আমার বাসাটা ছিল তার পঞ্চম ছুটা বাসা। আমি ওকে বললাম, “তুমি কি লেখাপড়া শিখলে ভালো চাকরী পাবে?” সে বল্ল, “হ্যাঁ”। তখন আমি তাকে বললাম যখন সে ফ্রি থাকে তখন আমার কাছে পড়তে আসতে। একসময় খেয়াল করলাম আমার ছেলে তাকে খুব পছন্দ করছে। ভাবলাম আমি যখন আবার কাজে ফিরে যাব তখন তো বাচ্চা রাখার জন্য কাউকে লাগবে। তখন বললাম, “এতগুলো বাসা না করে তুমি আমার বাচ্চাকে দেখাশোনা কর। আমি তোমাকে বেতন পুষিয়ে দেব, থাকাখাওয়ার পয়সা বেঁচে যাবে, লেখাপড়াও শিখতে পারবে”। তখন সে রাজী হয়ে গেল। আমার খারাপ লাগত যে নিজের ছেলেকে বোনের কাছে ফেলে এসে সে আমার ছেলেকে নিয়ে থাকে। তাই রোজিনাকে আমি সবসময় চেষ্টা করতাম সবচেয়ে ভালো কিছু দিতে যেহেতু আমার সবচেয়ে ভালো জিনিসটা আমি ওর কাছে রাখি। অথচ এটাকে সবাই পাগলামী মনে করত। বলত, কাজের লোকজনকে এত লাই দিতে নেই।

আমি এ’কথায় কান দিতাম না এটাও আমার দোষ। একবার রোজিনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওর মা বোনদের জন্য শাড়ি কিনতে। ওরা যে তিনবোন চট্টগ্রামে ছিল আর সবচেয়ে ছোট যে বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করত তাদের কাপড় আমি দিয়েছি। ওর মা আর বাকী চারবোনের জন্য বাজেট ছিল এই তিনবোনের। তাই ওকে ওয়্যারহাউজে নিয়ে গেলাম অল্প দামে যাতে ভালো কাপড় পাওয়া যায়। দোকানী জানেন আমি শাড়ী পরিনা। তাই শাড়ী কেনা হবে এই খুশীতে উনি শুধু দামী দামী শাড়ী বের করছেন। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বললাম, “ভাই, শাড়ী আমি কিনবনা উনি কিনবেন। আপনি আরেকটু কম দামে শাড়ী দেখান”। দোকানী বললেন, “উনি কি আপনার আই আই ইউ সি’র কলিগ?” তখন বুঝলাম ঘটনা কি। রোজিনাকে আমি যে বোরকা বানিয়ে দিয়েছি তার দাম ছিল আমার বোরকার চাইতে বেশী আর সে আপার সাথে বাইরে যাচ্ছে এই খুশীতে সেই চটকদার বোরকা পরে এসেছে। তাই দোকানী ধরে নিয়েছেন আজকে হেভী বাজেটে কাপড় কেনা হবে! বহুকষ্টে দোকানীর বিরস চেহারা উপেক্ষা করে বাজেটের মধ্যে শাড়ী কিনে বের হয়ে রোজিনাকে যে বকা দিলাম বুঝতেই পারছেন!

বাংলা সাহিত্যে প্রায়ই পড়তাম, “মেয়েমানুষ ছেলে ঠ্যাঙ্গাবে, পরের বদনাম করবে- তার আবার লেখাপড়ার কি দরকার?” এটা যে সত্যি সত্যি কেউ অনসরণ করতে পারে তা কখনো ভাবিনি। আমি যখন কোন বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যাই তখন আমার ঘরবাড়ীর অবস্থা থাকেনা, কোনক্রমে বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকলে আর নিজের খাবারের চিন্তাও মাথায় থাকেনা। তাই আমার বিয়ের পর পর হয়ত আমাকে অনুপ্রানিত করার জন্য আম্মা আমাকে এক আত্মীয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলতেন তিনি কি সুন্দর করে ঘরবাড়ী, সংসার, সন্তানদের ঝকঝকে তকতকে করে রাখেন। আমি নিজেই বলব আমি ভালো গৃহিনী নই। সুতরাং, আমার ‘ইম্প্রেসড’ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু উনি সাথে সাথে এ’ও বলতেন ভদ্রমহিলা গাঁটের পয়সা খরচ চট্টগ্রামের বাইরে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন করে আম্মাকে উপদেশ দিতেন বৌকে যেন মাথায় তোলা না হয়, সবসময় পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখা হয়! অথচ উনি আমাকে কখনো দেখেননি, আমার সাথে কথাও হয়নি! তাঁর কথা শুনে আমার মাথায় শুধু এ’টাই কাজ করত, যে মহিলার মন এত অপরিষ্কার তাঁর ঘর পরিষ্কার রেখে কি লাভ? যে অন্যের ঘরে সম্প্রীতি আর বিশ্বাসের বীজ জেগে উঠতে না উঠতেই আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সে নিজের জন্য কি করে সুখের স্বপ্ন দেখতে পারে? এসব দেখে আমি দোয়া করতাম আমি কারো সাথে সজ্ঞানে এরকম আচরণ করার আগে যেন আল্লাহ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যান।

যাই হোক। সবদিক বিবেচনায় শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এলাম যে আমি ‘লেডী’ বিবেচিত হওয়ার উপযুক্ত নই। তাই আমার জীবনের নিম্নোক্ত ঘটনা ছিল আমার কাছে অন্যতম আশ্চর্য এক ঘটনা। ‘৯২ সালে আমি যখন ঢাকা থেকে দিল্লী যাচ্ছি আমার বাবামার সাথে মিলিত হবার জন্য তখন আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। প্লেনে আইলের অন্যপাড়ে এক ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় হোল। উনি শ্রী লংকান মুসলিম। ঢাকা এসেছিলেন গার্মেন্টস সংক্রান্ত কাজে। ওনার মেয়ে আমার সমবয়সী। ওনার পাশে বসা ভদ্রলোক দিল্লীর মুসলিম পরিবারের ছেলে, ঢাকা শেরাটনে বারে কাজ করেন, বিয়ে করতে দেশে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় ভদ্রলোকের প্রতি বিতৃষ্ণায় মন ভরে গেল। কিন্তু প্রথম ভদ্রলোকের সাথে নানান বিষয়ে কথা হোল পুরো রাস্তা। আমাদের দু’দেশের এজুকেশন সিস্টেম, দু’দেশের মেয়েদের বেড়ে ওঠা, আমাদের চোখে দু’দেশের জনগোষ্ঠী আরো অনেক কিছু। বিমানবন্দরে নামার কিছু আগে খুব ‘টার্বুলেন্স’ শুরু হোল। বিমান কাঁপতে শুরু করল হুলস্থুল আর শব্দের জন্য শোনা মুশকিল হয়ে পড়ল। উনি কি যেন বললেন, আমিও হেসে মাথা নাড়ালাম, “ঠিক, ঠিক”। ভাবলাম উনি নিশ্চয়ই ‘টার্বুলেন্স’ বিষয়ক কোন কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর অবস্থা স্বাভাবিক হলে উনি বললেন, “তুমি কি শুনেছ আমি কি বলেছি?” বললাম, “হ্যাঁ, শুনবনা কেন?” তখন আমি নামার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাস্ত। আমার একটাই ব্যাগ কিন্তু বইপত্রের কারণে অনেক ভারী। কিভাবে নেব বুঝে পাচ্ছিনা। উনি বললেন, “তুমি শোননি”। আমি হাল্কাভাবে বললাম, “বলেন আপনি কি বলেছেন?” উনি বললেন, “আমি বলেছি যে ছেলে তোমাকে বিয়ে করবে সে খুব সুখী হবে”। আমি যদি ফর্সা হতাম আমার গাল তখন আগুনের মত লাল হয়ে যেত। কিন্তু উনি বাবা, বুঝতে পারলেন। ওনার সফরসঙ্গীর দিকে ফিরে বললেন, “এখানে একজন লেডী আছে, চল ওর ব্যাগটা আমরা চেকিন পর্যন্ত এগিয়ে দেই”।

1 comment:

  1. সত্যিই হাফিজ ভাইয়া বেশ সুখী মানুষ :)
    চরম সুখী মানুষ! :D

    আল্লাহই জানে আমার কপালে কি আছে..... :'(
    sigh..........

    ReplyDelete