রোজিনা আমাকে নিয়ে সবসময় হাসাহাসি করত। সে দিনে দু’বার ঘর ঝাড়ু দিত, আমি দিতাম তিনবার। আমি মাটিতে ঘুমাতে ভালোবাসি। তাই আমার ঘরে কেউ স্যান্ডেল পরে ঢুকতনা। তারপরও একটা বালুকণা থাকলে সেটা আমার পায়েই লাগত। সে দু’বার বিছানা ঝাড়ার পর আমি নিজে ঝাড়তাম আরো দু’বার। তারপরও একটা বালু গায়ে লাগলে বিছানায় ঘুমাতে পারতাম না যতক্ষণ না বালিটা খুঁজে বের করে ফেলে আসতে পারতাম। এত আদরযত্নে থাকার পর আমার ঘুম হতনা। হায় আল্লাহ! যে ঘরে নীচে মাটি, ওপরে মাটি, মাটির বিছানা পাতা, সে ঘরে থাকব কি করে?
আমার একটা রিসার্চ আর্টিকেলের প্রিন্ট করার জন্য পিয়ন শাহীনকে ব্যস্ত না রেখে নিজেই কাগজের ফীড দিচ্ছিলাম। দুপুরে যখন সবাই খেতে বসলাম দেখি হাত জ্বলে ছিঁড়ে যাচ্ছে অথচ তরকারী ঝাল হয়নি। শেষপর্যন্ত হাতের জ্বলুনী সহ্য করতে না পেরে আলোতে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম হাতে কি হয়েছে। দেখি পুরা হাত জুড়ে সুক্ষ্ণ সব কাটা। কাগজে হাত কেটে ফালাফালা হয়ে গেছে! কি আশ্চর্য বাজে চামড়া! অথচ শাহীন প্রতিদিন হাজার হাজার পেজ প্রিন্ট আর ফটোকপি নেয়, ওর কিছু হয়না। কবরের কঠিন মাটিতে যখন আমাকে শুইয়ে দিয়ে সবাই চলে আসবে, চারদিক থেকে কৌতুহলী পোকামাকড়ের দল পরীক্ষা করতে আসবে এখানে কে এলো, সেদিন কি লাভ হবে আমার এই চামড়া দিয়ে যা আমাকে কাগজের থেকে পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনা?
একবার আমাদের চট্টগ্রাম বাসায় গ্রাম থেকে এক মামাতো বোন বেড়াতে এলো। সে আমার অন্তত পাঁচ ছ’বছরের ছোট। মা তরকারী গরম করে করে দিচ্ছে আর আমরা বাটি টেবিলে এনে রাখছি। ওর হাতে তরকারীর বাটি দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “তুমি বস, আমাকে দাও”। ও বল্ল, “আপু, তুমি নিতে পারবেনা, গরম”। আমি বললাম, “তুমি যখন খালি হাতে ধরেছ আর কত গরম হবে? দাও, আমাকে দাও”। ওর হাত থেকে বাটি নিয়ে কোনরকমে দু’পা হেঁটে টেবিলে রেখে দৌড় দিয়ে ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে হাতে পানি ঢালতে ঢালতেই দেখি দু’হাতের আঙ্গুলে এত্ত বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে! মনে হচ্ছে যেন আরো কয়েকখানা আঙ্গুল গজিয়েছে আমার! সেদিন খাওয়া দাওয়া লাটে উঠলো। ফোস্কা আর জ্বলুনীতে প্রাণ যায়। ভাবলাম আমার বোন আমার ছোট হয়েও আমার চেয়ে কত শক্তিশালী। এই বাটি চুলা থেকে খালিহাতে এনে ওর কিছু হোলনা, আর আমার কি’না দু’হাতের দশ আঙ্গুলে দশটা ফোস্কা পড়ে গেল! এই আমি দোজখে গেলে কি করে থাকব?
ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে ছাত্রীদের স্টাডি ট্যূরে ছাত্রীদের দু’ভাগ করে আমি এক গ্রুপ আর চৌধুরী গোলাম মাওলা ভাই এক গ্রুপ নিয়ে দু’দিকে ছড়িয়ে পড়লাম। আমি যখন ফ্যাক্টরী পরিদর্শন শেষে বৃষ্টিতে ভিজে ছাত্রীদের নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় পনেরো মিনিট তখনো মাওলা ভাইয়ের গ্রুপের দেখা নেই। মোবাইলে কলের পর কল দিচ্ছি কেউ ধরছেনা। প্রায় আধঘন্টা পর যখন সবাই ফিরে এলো দেখি কেউ কোন কথা বলেনা, কোন কথার উত্তর দেয়না, সবার চোখমুখ ফোলাফোলা। এদের কি হয়েছে বুঝতে না পেরে আমরা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে শুরু করলাম। বাকী তিনদিনেও কেউ বল্লনা ওরা কোথায় গিয়েছিল, কি হয়েছিল। চট্টগ্রাম ফেরার পথে বাসে সবাই স্টাডি ট্যূরের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। তখন এক ছাত্রী বল্ল সেদিন কি হয়েছিল। সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর যেখানে ৩০০০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় পাথর গলানো হয় সেখানে আমার গ্রুপ দূর থেকেই গরমে দাঁড়াতে না পেরে খুব দ্রুত চলে গিয়েছিল তার পরের জায়গায়। কিন্তু মাওলা ভাইয়ের গ্রুপ ওখানে যায় সবার শেষে। তখন বাইরে বৃষ্টি, তাই ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। কাছাকাছি থেকে এই আগুন দেখে মাওলা ভাই বলতে শুরু করেন, “আল্লাহ সৃষ্টির মাত্র একভাগ আগুন দিয়েছেন তাবৎ পৃথিবীতে, বাকী সবটা আছে দোজখে। এই একভাগ আগুনের কত লক্ষতম ভাগ দিয়ে এই পাথর গলে বালি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই মাটির শরীর কি করে দোজখের আগুন সইবে?” এই কথায় মাওলা ভাইসহ ছাত্রীরা সবাই কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের সময়ের হিসেব হারিয়ে যায়। আগুনের দাউদাউ শব্দে মোবাইলের রিং কেউ শোনেনি। হায়! আমরা নিজেদের কত শক্তিশালী মনে করি! তাৎক্ষণিক আনন্দ উপভোগ আর ইন্দ্রিয়সুখ কত সহজেই না দোজখের এই দাউদাউ আগুনকে আমাদের কাছে ম্লান করে দেয়! আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে মাওলা ভাইয়ের মত অনুভূতিসম্পন্ন হওয়ার তৌফিক দেন!
আমার একটা রিসার্চ আর্টিকেলের প্রিন্ট করার জন্য পিয়ন শাহীনকে ব্যস্ত না রেখে নিজেই কাগজের ফীড দিচ্ছিলাম। দুপুরে যখন সবাই খেতে বসলাম দেখি হাত জ্বলে ছিঁড়ে যাচ্ছে অথচ তরকারী ঝাল হয়নি। শেষপর্যন্ত হাতের জ্বলুনী সহ্য করতে না পেরে আলোতে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম হাতে কি হয়েছে। দেখি পুরা হাত জুড়ে সুক্ষ্ণ সব কাটা। কাগজে হাত কেটে ফালাফালা হয়ে গেছে! কি আশ্চর্য বাজে চামড়া! অথচ শাহীন প্রতিদিন হাজার হাজার পেজ প্রিন্ট আর ফটোকপি নেয়, ওর কিছু হয়না। কবরের কঠিন মাটিতে যখন আমাকে শুইয়ে দিয়ে সবাই চলে আসবে, চারদিক থেকে কৌতুহলী পোকামাকড়ের দল পরীক্ষা করতে আসবে এখানে কে এলো, সেদিন কি লাভ হবে আমার এই চামড়া দিয়ে যা আমাকে কাগজের থেকে পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনা?
একবার আমাদের চট্টগ্রাম বাসায় গ্রাম থেকে এক মামাতো বোন বেড়াতে এলো। সে আমার অন্তত পাঁচ ছ’বছরের ছোট। মা তরকারী গরম করে করে দিচ্ছে আর আমরা বাটি টেবিলে এনে রাখছি। ওর হাতে তরকারীর বাটি দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “তুমি বস, আমাকে দাও”। ও বল্ল, “আপু, তুমি নিতে পারবেনা, গরম”। আমি বললাম, “তুমি যখন খালি হাতে ধরেছ আর কত গরম হবে? দাও, আমাকে দাও”। ওর হাত থেকে বাটি নিয়ে কোনরকমে দু’পা হেঁটে টেবিলে রেখে দৌড় দিয়ে ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে হাতে পানি ঢালতে ঢালতেই দেখি দু’হাতের আঙ্গুলে এত্ত বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে! মনে হচ্ছে যেন আরো কয়েকখানা আঙ্গুল গজিয়েছে আমার! সেদিন খাওয়া দাওয়া লাটে উঠলো। ফোস্কা আর জ্বলুনীতে প্রাণ যায়। ভাবলাম আমার বোন আমার ছোট হয়েও আমার চেয়ে কত শক্তিশালী। এই বাটি চুলা থেকে খালিহাতে এনে ওর কিছু হোলনা, আর আমার কি’না দু’হাতের দশ আঙ্গুলে দশটা ফোস্কা পড়ে গেল! এই আমি দোজখে গেলে কি করে থাকব?
ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে ছাত্রীদের স্টাডি ট্যূরে ছাত্রীদের দু’ভাগ করে আমি এক গ্রুপ আর চৌধুরী গোলাম মাওলা ভাই এক গ্রুপ নিয়ে দু’দিকে ছড়িয়ে পড়লাম। আমি যখন ফ্যাক্টরী পরিদর্শন শেষে বৃষ্টিতে ভিজে ছাত্রীদের নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় পনেরো মিনিট তখনো মাওলা ভাইয়ের গ্রুপের দেখা নেই। মোবাইলে কলের পর কল দিচ্ছি কেউ ধরছেনা। প্রায় আধঘন্টা পর যখন সবাই ফিরে এলো দেখি কেউ কোন কথা বলেনা, কোন কথার উত্তর দেয়না, সবার চোখমুখ ফোলাফোলা। এদের কি হয়েছে বুঝতে না পেরে আমরা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে শুরু করলাম। বাকী তিনদিনেও কেউ বল্লনা ওরা কোথায় গিয়েছিল, কি হয়েছিল। চট্টগ্রাম ফেরার পথে বাসে সবাই স্টাডি ট্যূরের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। তখন এক ছাত্রী বল্ল সেদিন কি হয়েছিল। সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর যেখানে ৩০০০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় পাথর গলানো হয় সেখানে আমার গ্রুপ দূর থেকেই গরমে দাঁড়াতে না পেরে খুব দ্রুত চলে গিয়েছিল তার পরের জায়গায়। কিন্তু মাওলা ভাইয়ের গ্রুপ ওখানে যায় সবার শেষে। তখন বাইরে বৃষ্টি, তাই ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। কাছাকাছি থেকে এই আগুন দেখে মাওলা ভাই বলতে শুরু করেন, “আল্লাহ সৃষ্টির মাত্র একভাগ আগুন দিয়েছেন তাবৎ পৃথিবীতে, বাকী সবটা আছে দোজখে। এই একভাগ আগুনের কত লক্ষতম ভাগ দিয়ে এই পাথর গলে বালি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই মাটির শরীর কি করে দোজখের আগুন সইবে?” এই কথায় মাওলা ভাইসহ ছাত্রীরা সবাই কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের সময়ের হিসেব হারিয়ে যায়। আগুনের দাউদাউ শব্দে মোবাইলের রিং কেউ শোনেনি। হায়! আমরা নিজেদের কত শক্তিশালী মনে করি! তাৎক্ষণিক আনন্দ উপভোগ আর ইন্দ্রিয়সুখ কত সহজেই না দোজখের এই দাউদাউ আগুনকে আমাদের কাছে ম্লান করে দেয়! আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে মাওলা ভাইয়ের মত অনুভূতিসম্পন্ন হওয়ার তৌফিক দেন!
:(
ReplyDelete