১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম সাইক্লোনগুলোর একটি। আমরা আবুধাবী থেকে এসেছি তখন দেড়বছরের কাছাকাছি। আবুধাবীতে তিনবছরেও একবার বৃষ্টি দেখতাম না। সেখান থেকে এসে জীবনের এই প্রথম সাইক্লোন দেখা আমার জন্য ছিলো এক স্মরনীয় অ্ভিজ্ঞতা। তবে আরো নানাবিধ কারণে এই ঝড়ের স্মৃতি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের চট্টগ্রামের বাড়ীটি ১৯৪৮ সালে তৈরী। সামনে একসারি ঘর, মধ্যে মূল বাড়ী, পেছনে আরেক সারি ঘর। বৃটিশ আমলের বাড়ীগুলোর মত ডিজাইন, রাস্তা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত সরলরেখায় দেখা যায়। দেশে এসে একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে বাসোপযোগী করে তোলা হয়। সামনের ঘর ভেঙ্গে কম্পিউটার সেন্টার এবং ভাড়া দেয়ার জন্য গোডাউন করা হয়। বাথ্রুম এবং রান্নাঘর পেছনের ঘর থেকে মূল বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। পেছনের ঘর পরে কখনো ভেঙ্গে ঠিক করার জন্য পেন্ডিং রাখা হয়। সামনের ঘর আর মূলবাড়ীর মধ্যখানে গোলাপবাগানসহ চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল, বড়ই, পেয়ারা, নারকেল, সুপারী আরো নানান গাছপালা, লতাপাতা লাগালো বাবা আর মা, বাবার দাদীর হাতে লাগানো বাগানকে সম্বৃদ্ধ করার জন্য। মধ্যে ওয়াসার সাথে রাগারাগি করে বাবা মূলবাড়ী আর পেছনের ঘরগুলোর মাঝখানে টিউবওয়েল বসালো। কিন্তু সেই টিউবওয়েল ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়ার আগেই বাবাকে দেশ ছেড়ে আবার পাড়ি জমাতে হোল আমেরিকায়।
যেদিন ঝড় হোল সেদিন ঝড়ের আগের কিছু মনে পড়েনা। যেহেতু আগে কখনো সাইক্লোন দেখিনি, আমার কোন ধারণা ছিলোনা আমাদের বাসার লোকজন ওয়েদার বুলেটিন কি দেখছে, কি বুঝছে বা বাইরে কি হতে চলেছে। আমরা তিন ভাইবোন স্বাভাবিকভাবেই গল্পসল্প করছি। সন্ধ্যার পর পর ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে শোঁ শোঁ শব্দ শুরু হোল। মা বল্ল ডইং রুম আর ডাইনিং রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে দিতে। ডইং রুম ছিল অর্ধেকটাই কাঁচের, তাছাড়া পুরাতন বাড়ীর কারুকাজ করা বারান্দার কারুকাজের ওপর টিনের ঝকঝকে পাত দিয়ে ঢেকে ড্রয়িং রুম করা। কাঁচ ভেঙ্গে ছিটতে পারে বা টিন খুলে পড়তে পারে এই ভয়েই মা দরজা বন্ধ করে দিতে বল্ল। কিন্তু ড্রয়িং রুমে গিয়ে আমি যেন মোহগ্রস্তের মত আটকে গেলাম। ইয়া বড় বড় টিনের পাতগুলো, যেগুলো আলগে ধরে লাগাতে কয়েকজন শক্তিশালী লোকের ঘাম ছুটে গেছে, সেগুলোর নাটবোল্ট বাতাসে পটপট করে খুলে যাচ্ছে! বহু কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লাইট বন্ধ করলাম। সাথে সাথে চোখ ছুটে গেল জানালার বাইরে। আমি শুধু দেখলাম আকাশটা লাল। সেই লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখতে পেলাম সামনের চারতলা বিল্ডিং-এর সামনের পাঁচতলা সমান নারকেল গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় একবার ধনুকের মত নুয়ে মাটি স্পর্শ করছে, আবার বাতাসের গতিবেগ কমে যেতেই সাঁই করে তীরের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য কতক্ষন দেখে ছিলাম জানিনা। মাথার ওপর পটপট টিন খোলার শব্দ শুনেও চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। হঠাৎ মা’র ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার দেরী দেখে মা ছোট ভাই দুটোকে বেডরুমে বসিয়ে দেখতে এসেছে আমি উড়ে গেলাম কি’না। মাদের সেফটি সেন্স খুব ভালো হয়। একবার ঢাকায় শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। তখন মা আমাদের দুইভাইবোনকে নিয়ে বাথরুমের সামনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে দেখলাম ঐ একজায়গায় ছাড়া ঘরের আর কোথাও কাঁচভাঙ্গার জন্য পা রাখার জায়গা নেই। আমাদের চট্টগ্রাম বাসার বেডরুমগুলো ছিল বাউন্ডারী ওয়ালের একগজের ভেতর। তাই মা বুঝে নিয়েছে বাচ্চাদের রাখার জন্য ওটাই ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা যদিও নিরাপত্তা আল্লাহর হাতে।
ড্রইয়িরুম থেকে বেডরুমে যেতে যেতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বেডরুমে পৌঁছতেই বাউন্ডারীর ও’পাশের বাড়ীর পুরুষমহিলার আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। বিকট শব্দে ওদের ঘরের টিনের চাল কাপড়ের মত ছিঁড়ে যাচ্ছে। ওদের যে আমাদের বাসায় ডেকে আনব তাও এই তুফানের মধ্যে সম্ভব না। আমরা অসহায়ের মত শুনতে লাগলাম ওদের চিৎকার। ওদের পাশের বাসা তখন পর্যন্ত নিরাপদ ছিল। কিন্তু এই দুই পরিবারের মধ্যে আজন্ম শত্রুতা। ওরা কি এদের ঠাঁই দেবে? কিছুক্ষণ পর ওদের গলার শব্দ অনসরণ করে বুঝতে পারলাম এই ঝড়ের রাতে তারা শত্রুতা ভুলে গিয়ে অসহায় প্রতিবেশীকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই দেখি কানফাটানো শব্দে বাতাস বেচারা চালের শেষ শক্তিটুকুও শুষে নিয়ে তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
একটু পরে বাতাসের গতি আরো বেড়ে গেল। আমাদের পুরোঘর পাকা হলেও চিলেকোঠায় টিন দেয়া ছিল। এবার শুনলাম ঐ টিন ফরফর করতে শুরু করেছে। বেচারা টিন চিলেকোঠাকে আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাতাস তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। চিলেকোঠা ছিল রান্নাঘরের একপাশে আর রান্নাঘর থেকে ডাইনিং রুমের দরজা মা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি দু’একবার ডাইনিং রুমে গিয়ে ছালা বিছিয়ে রান্নাঘর থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোত স্তিমিত করার চেষ্টা করলাম। দীর্ঘসময় যুদ্ধ করতে করতে বেচারা টিন একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে উড়েই গেল। আমিও পানি বন্ধ করার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বাড়ীর ফ্লোরে নদীর সৃষ্টিরহস্য পর্যবেক্ষণ করে লাগলাম।
ভোরের দিকে বাতাস কমে এলো।মনে হোল সদর দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। মা ভাইয়াকে পাঠালো দেখার জন্য। একটু পরে দেখি ছোটমামা এসে হাজির। বেশ কিছুদিন থেকেই নাকি সাইক্লোনের ওয়ার্নিং দেয়া হচ্ছিল কিন্তু কিছুই হচ্ছিলনা। তাই অধিকাংশ মানুষ এই ওয়ার্নিংকে পাত্তা দেয়নি। মামাও তাই ঝড়ের আগে আমাদের বাসায় না এসে দোকানেই রয়ে গিয়েছিল। দোকানের চাল উড়ে গিয়ে ভিজতে ভিজতে বেচারা কোনক্রমে উড়ে যাওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল। পরে বাতাসের বেগ বাড়তে দেখে দোকান থেকে বের হতেই একটুর জন্য উড়ে আসা টিনে দোফালা হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল। তখন ভেবে দেখল দোকান থেকে আমাদের বাসা পর্যন্ত আসতে গেলে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা। এতদুর আসার চেয়ে দোকানের কাছাকাছি এক বাসার সিঁড়িতে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। বাতাস কমে যাওয়ায় সাহস করে আমাদের বাসা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।
রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্য। সকালে উঠে দেখি বাইরে সব চুপচাপ যদিও মৃদু বাতাস বইছে তখনো। ডাইনিং রুমের নদী ততক্ষণে আমাদের রুম পর্যন্ত গড়িয়েছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি একটা টিন তিনদিক খুলে ঝুলে আছে, আরেকটা তখনো দুদিকে লাগানো। ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই বাতাসের প্রচন্ডতা সত্যিকার অর্থে টের পেলাম। গোলাপবাগান মনে হোল বিরানভূমি যেখানে কখনো কিছু ছিলোনা। বেলুম্বু আর অড়বড়ই গাছের ডালে কোন পাতা বা ফল নেই, সব গাছের নীচে। কাঁঠালগাছ একটা ভেঙ্গে গেছে আর একটা কোনরকমে প্রাণে বেঁচে গেছে। বাবার দাদীর লাগানো আমগাছটা পাতা পড়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে কিন্তু ডালপালা ভাঙ্গেনি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হোল নয়টা সুপারীগাছ আর ছয়টা নারকেল গাছের দেখি মাথা কোথায় উড়ে চলে গিয়েছে, দুমড়ানো মোচড়ানো কান্ডটা কিভাবে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যেভাবে ম্যচের কাঠি বা টুথপিক ভাঙ্গি, কোন বিশাল হাত যেন গাছগুলোকে ঠিক সেভাবে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে ফেলেছে! আর পেছনের ঘরগুলোতে দেখি বাতাসে পুরনো জীর্ণ দেয়াল ভেঙ্গে গিয়েছে জায়গায় জায়গায় আর এক জায়গায় ভেঙ্গে পড়েই গেছে!
সেদিন খবর এলো উপকুলীয় অঞ্চলে প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছে। দু’একজায়গায় ছাড়া আর কোথাও ইলেকট্রিসিটি পানি টেলিফোন কিছুই নেই। আমাদের বাড়ী শহরের মধ্যখানে। কিন্তু বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত সমুদ্রের পানি এসে পড়েছিল আর কোথাও কোথাও বিল্ডিং-এর ছাদ পর্যন্ত পানি উঠেছিল। গ্রামের বাড়ীতে কি অবস্থা দেখার জন্য মা সাথে সাথে ছোটমামা আর ভাইয়াকে বাড়ী পাঠিয়ে দিল। সেদিন পর্যন্ত আমাদের ট্যাংকের পানিতে চলল। তারপর দিন থেকে শুরু করলাম টিউবওয়েল থেকে ভেতরের বাথরুমে, রান্নাঘরে পানি টানা। দুতিনদিন পর যখন আবার লোকজন প্রকৃতিস্থ হয়ে কাজে যেতে শুরু করল তখন মা সবার আগে ছাদে টিন লাগাতে লোক নিয়োগ করল। নইলে প্রতিবারের বৃষ্টিতেই ঘর ভেসে যায়।
গ্রাম থেকে ফিরে ভাইয়া আর মামা যে বিবরণ দিল তাতে মনে হোল আমাদের কষ্ট কোন কষ্টই না। আজকাল অনেক বাড়ীর ছেলেমেয়েরা বিদেশে চাকরী করতে যাওয়ায় প্রবাসের টাকায় ইটের বাড়ীঘর হচ্ছে। এ’ছাড়া গ্রামাঞ্চলে পাহাড় কাছে হওয়ায় মাটির ঘরই তৈরী হয় বেশী। সাইক্লোনে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢলে গলে ভেঙ্গে পড়েছে অধিকাংশ মাটির ঘর। টিনের ঘর এতদঞ্চলে খুব একটা প্রচলিত নয় কিন্তু টিনের ছাদ উড়ে গিয়েছে অধিকাংশ ঘরের আর সেই টিনে কাটা পড়ে মারা পড়েছে অনেকেই। অনেকের বাড়ীর ওপর গাছ পড়ে বাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকজন সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছে এই ঝড়ে। অনেকের লাশ কোমর পর্যন্ত গেড়ে গেছে কাদায়। মৃতদেহ এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরা এখনই কথা বলবে। এই লাশ কি করে তোলা হবে কেউ বুঝতে পারছেনা। বাতাসে মহিলাদের শাড়ি উড়ে গেছে। যতক্ষণ ঝড় ছিল ততক্ষণ তারা বাঁচার তাগিদে গাছপালা আঁকড়ে ছিলেন। কিন্তু অন্ধকার কেটে যেতেই অনেকে লজ্জা ঢাকার জন্য গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নেমে লুকিয়ে আছেন। খাবারের অভাব তো আছেই, রান্না করার কোন উপায় নেই।
আমাদের সাপ্তাহিক বাজার করা হয়েছিল তুফানের আগের দিন। মা বিশাল ফ্রিজারসম্পন্ন ফ্রিজটা আমাদের আবুধাবী বাসা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। এতে একটা আস্ত গরুর সমুদয় মাংস রাখা যেত। এই ফ্রিজার সম্পূর্ণ খালি করে মা মাছ মাংস যা পেল সব বিশাল বিশাল হাঁড়িতে চুলায় বসিয়ে দিল। রান্না করে হাঁড়িসহ পাঠিয়ে দেবে গ্রামে। আমি গেলাম আমাদের আলমারীতে ঘাটাঘাটি করে তিন ভাইবোনের কাপড় থেকে না রাখলেই নয় এমন সব কাপড় বেছে বস্তাভর্তি করতে।
কাপড় প্রায় গুছিয়ে এনেছি, এ’সময় মা এসে বল্ল স্যার এসেছেন। জীবনে অংক ছাড়া আর কিছুর জন্য শিক্ষক রাখতে হয়নি। সাতটা বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েও আমি দু’একবার ছাড়া অংকে কোনদিন পাশ করতে পারিনি। সেই স্যার। এমনিতে ঘরবাড়ীর এই অবস্থা, ব্যস্ততা আর পানি টানতে টানতে অবস্থা কাহিল, তার ওপর আমি অংক সহ্য করতে পারিনা- স্যারের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আমার চেহারাটা খুব বিচ্ছিরী। কখনোই কোন অনুভূতি লুকাতে সে আমাকে সাহায্য করেনা। স্যার আমাকে দেখেই বললেন, “শোন আজ তোমাকে পড়াতে আসিনি, ছাত্রী বেঁচে আছে না আমার চাকরীটা গেছে দেখতে এসেছি!” তখন আমার বেশ ভালো লাগল। ওনাকে আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। ওনাদের কি অবস্থা ছিল জিজ্ঞেস করলাম। স্যারের বাড়ী হালিশহর। একতলা বাড়ী সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেলে ওঁদের সম্পূর্ণ পরিবার এই বৃষ্টিতে ভিজে ছাদে আশ্রয় নেয়। সারারাত ওঁরা ছাদ থেকে উঠে থাকা রডের সাথে নিজেদের বেঁধে রেখে বাতাসে উড়ে যাওয়া থেকে আত্মরক্ষা করেন। বেচারার কাহিনী শুনে মনে হয় আল্লাহ আমাদের ঐ সময় বেহেস্তে রেখেছিলেন। এইচ এস সি পরীক্ষা পিছাবে কি’না খবর নিতে মনে করিয়ে দিয়ে স্যার তাঁর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের খবর নিতে রওয়ানা হয়ে যান।
তার পরদিন থেকে প্রতিবেশীরা টিউবওয়েলের পানি নেয়ার জন্য আমাদের বাসায় ভিড় জমাতে শুরু করেন। আমাদের পেছনের দরজা প্রায় ফুলটাইম খুলে দেয়া হয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য এলাকার লোকজন খবর পেয়ে সর্বোচ্চ আট কিলোমিটার দূর থেকে পর্যন্ত পানি নিতে আসে। বাবার টিউবওয়েল, যা থেকে বাবা বেচারা একগ্লাস পানিও তোলেনি, বাবাকে বালতি বালতি সাওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
তুফানের প্রায় একসপ্তাহ পর প্রিয় বান্ধবী শিখা আসে। দু’জনে কলেজে যাই আমাদের আসন্ন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কি হবে জানতে। সাইক্লোনের পর এই প্রথম আমার রাস্তায় বের হওয়া। চারপাশে পুরাতন বিল্ডিংগুলো দেখে মনে হোল এগুলোকে কেউ বিশাল সব বুরুশ দিয়ে পরিষ্কার করেছে! কোন বিল্ডিং –এর দরজা নেই, কোন বিল্ডিং-এর জানালা। বিরাট বিরাট সাইনবোর্ডগুলো মনে হচ্ছে কেউ বাতিল চিঠির মত মুচড়ে ফেলেছে! কিছু কোনক্রমে ঝুলে আছে বিল্ডিং-এর গায়ে আর কিছু খুলে পড়েছে রাস্তায়। কলেজে যেতে যেতে দেখি অসংখ্য গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকগুলো তখনো সরানো সম্ভব হয়নি। কলেজে পৌঁছে দেখি আলোচনার মূখ্য বিষয় সাইক্লোন এবং এ’কারণে এইচ এস সি পরীক্ষা পেছানো আর বিদেশে ইরাক কুয়েত যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়া। কিন্তু আমার মনে হোল কি হবে পরীক্ষা দিয়ে বা আমেরিকা ইরাক কি করল জেনে যেখানে এক মূহূর্তের জন্য জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই? আমার হাতে আছে তো কেবল এই মূহূর্তটুকুই! এই মূহূর্তটা আমি কি কাজে লাগালাম তা ছাড়া আর কোন কিছু চিন্তাভাবনা করে কোন লাভ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সব বান্ধবীদের খবরাখবর নিয়ে বাসায় রওয়ানা হলাম, বাসায় অনেক কাজ।
বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি আলমারী খুললাম, কলেজ ড্রেস বদলে বাসার জামা পরতে হবে। আলমারী খুলে তো আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়! আলমারী সম্পূর্ণ ফাঁকা! কিচ্ছু নেই! মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা বল্ল গতবার গ্রামে যে কাপড় পাঠানো হয়েছে তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। তাই আজকে আবার আলমারী খালি করে সব পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে পরে বানিয়ে দেবে। আমি বললাম এতে আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু আপাতত আমি কি পরব? মা খুঁজেপেতে বাবার দুটো খাদি পাঞ্জাবী আর মা’র ইউরোপ সফরের দু’টো ট্রাউজার বের করে দিল। বল্ল, “আপাতত এই দিয়ে চালাও”। কি আর করা? আমার মায়ের এখন তিন ছেলে হোল!
এর প্রায় একসপ্তাহ পর পানি নিতে নিতে টিউবওয়েলের ফিল্টার ফেটে কাদা উঠতে শুরু করল। লোক ডাকা হোল, ওরা বল্ল নতুন করে টিউবওয়েল খুঁড়তে হবে। এই টিউবওয়েলে আর পানি উঠবে না। তখনো পানি বা ইলেকট্রিসিটি আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। লোকজন শেষপর্যন্ত সেই কাদাই নিয়ে গেল, কাদা বসে গেলে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করে পান করবে। পানির কি মূল্য আমি সে ক’দিনে বুঝতে পারলাম।
তার এক্সপ্তাহ পর একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না যে আল্লাহ মানুষের দোয়া তাৎক্ষণিক কবুল করেন। জুহর নামাজ পড়ছি। বাইরে লোকজনের কোলাহল শুনছি যেটা তখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক। এক লোক এসেছেন এই কাদাপানি নিয়ে যেতে। কাদা বসে গেলে ওপর থেকে পানি তুলে তার অসুস্থ বাবামাকে খাওয়াবেন যেহেতু অন্য পানিতে রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা। নামাজের মধ্যেই শুনতে পেলাম উনি দুঃখ করছেন, এখন আর কাদাও উঠছেনা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাইরে উনি দোয়া করছেন আর ভেতরে আমি, কেউ কাউকে দেখছিনা কিন্তু দু’জনে একই কথা বলছি, “হে আল্লাহ, তুমি আমাদের রিজিক তুলে নিয়োনা! এই কল বিকল হয়ে যেতে পারে কিন্তু তোমার সীমাহীন রহমতে এই ভাঙ্গা কল থেকেই পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি ওঠা সম্ভব। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের পানির উৎস বন্ধ করে দিয়োনা”। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই শুনি ওরা আবার পানি তোলার চেষ্টা করছেন আর ঐ ভদ্রলোক উচ্ছসিত হয়ে বলছেন, “এরকম পরিষ্কার পানি তো আমরা যখন টিউবওয়েল ভালো ছিল তখনো পাইনি!” আমার মত মানুষের কথা আল্লাহ শোনার কথা না। তাই আমি নিশ্চিত ঐ ভদ্রলোকের কারণেই আল্লাহ ঐ ভাঙ্গা টিউবওয়েল দিয়েই স্বচ্ছ পানির স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। ওয়াসার পানি ফিরে আসা পর্যন্ত ঐ পানি অব্যাহত ছিল। তারপর আর কোনদিন ঐ টিউবওয়েল দিয়ে একফোঁটা পানিও ওঠেনি। কিন্তু ওর মর্চেপড়া মাথাটা আমি যতবার দেখি, আমি পুণর্বার বিশ্বাস করি- আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন, কিন্তু তারপরও তিনি আমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, ক্ষমাশীল এবং তিনি আমাদের দোয়া কবুল করার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন, যদি আমরা শুধু চাইতে জানি।
আমাদের চট্টগ্রামের বাড়ীটি ১৯৪৮ সালে তৈরী। সামনে একসারি ঘর, মধ্যে মূল বাড়ী, পেছনে আরেক সারি ঘর। বৃটিশ আমলের বাড়ীগুলোর মত ডিজাইন, রাস্তা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত সরলরেখায় দেখা যায়। দেশে এসে একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে বাসোপযোগী করে তোলা হয়। সামনের ঘর ভেঙ্গে কম্পিউটার সেন্টার এবং ভাড়া দেয়ার জন্য গোডাউন করা হয়। বাথ্রুম এবং রান্নাঘর পেছনের ঘর থেকে মূল বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। পেছনের ঘর পরে কখনো ভেঙ্গে ঠিক করার জন্য পেন্ডিং রাখা হয়। সামনের ঘর আর মূলবাড়ীর মধ্যখানে গোলাপবাগানসহ চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল, বড়ই, পেয়ারা, নারকেল, সুপারী আরো নানান গাছপালা, লতাপাতা লাগালো বাবা আর মা, বাবার দাদীর হাতে লাগানো বাগানকে সম্বৃদ্ধ করার জন্য। মধ্যে ওয়াসার সাথে রাগারাগি করে বাবা মূলবাড়ী আর পেছনের ঘরগুলোর মাঝখানে টিউবওয়েল বসালো। কিন্তু সেই টিউবওয়েল ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়ার আগেই বাবাকে দেশ ছেড়ে আবার পাড়ি জমাতে হোল আমেরিকায়।
যেদিন ঝড় হোল সেদিন ঝড়ের আগের কিছু মনে পড়েনা। যেহেতু আগে কখনো সাইক্লোন দেখিনি, আমার কোন ধারণা ছিলোনা আমাদের বাসার লোকজন ওয়েদার বুলেটিন কি দেখছে, কি বুঝছে বা বাইরে কি হতে চলেছে। আমরা তিন ভাইবোন স্বাভাবিকভাবেই গল্পসল্প করছি। সন্ধ্যার পর পর ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে শোঁ শোঁ শব্দ শুরু হোল। মা বল্ল ডইং রুম আর ডাইনিং রুমের মধ্যে দরজা বন্ধ করে দিতে। ডইং রুম ছিল অর্ধেকটাই কাঁচের, তাছাড়া পুরাতন বাড়ীর কারুকাজ করা বারান্দার কারুকাজের ওপর টিনের ঝকঝকে পাত দিয়ে ঢেকে ড্রয়িং রুম করা। কাঁচ ভেঙ্গে ছিটতে পারে বা টিন খুলে পড়তে পারে এই ভয়েই মা দরজা বন্ধ করে দিতে বল্ল। কিন্তু ড্রয়িং রুমে গিয়ে আমি যেন মোহগ্রস্তের মত আটকে গেলাম। ইয়া বড় বড় টিনের পাতগুলো, যেগুলো আলগে ধরে লাগাতে কয়েকজন শক্তিশালী লোকের ঘাম ছুটে গেছে, সেগুলোর নাটবোল্ট বাতাসে পটপট করে খুলে যাচ্ছে! বহু কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লাইট বন্ধ করলাম। সাথে সাথে চোখ ছুটে গেল জানালার বাইরে। আমি শুধু দেখলাম আকাশটা লাল। সেই লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখতে পেলাম সামনের চারতলা বিল্ডিং-এর সামনের পাঁচতলা সমান নারকেল গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় একবার ধনুকের মত নুয়ে মাটি স্পর্শ করছে, আবার বাতাসের গতিবেগ কমে যেতেই সাঁই করে তীরের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য কতক্ষন দেখে ছিলাম জানিনা। মাথার ওপর পটপট টিন খোলার শব্দ শুনেও চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। হঠাৎ মা’র ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার দেরী দেখে মা ছোট ভাই দুটোকে বেডরুমে বসিয়ে দেখতে এসেছে আমি উড়ে গেলাম কি’না। মাদের সেফটি সেন্স খুব ভালো হয়। একবার ঢাকায় শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। তখন মা আমাদের দুইভাইবোনকে নিয়ে বাথরুমের সামনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে দেখলাম ঐ একজায়গায় ছাড়া ঘরের আর কোথাও কাঁচভাঙ্গার জন্য পা রাখার জায়গা নেই। আমাদের চট্টগ্রাম বাসার বেডরুমগুলো ছিল বাউন্ডারী ওয়ালের একগজের ভেতর। তাই মা বুঝে নিয়েছে বাচ্চাদের রাখার জন্য ওটাই ঘরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা যদিও নিরাপত্তা আল্লাহর হাতে।
ড্রইয়িরুম থেকে বেডরুমে যেতে যেতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বেডরুমে পৌঁছতেই বাউন্ডারীর ও’পাশের বাড়ীর পুরুষমহিলার আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। বিকট শব্দে ওদের ঘরের টিনের চাল কাপড়ের মত ছিঁড়ে যাচ্ছে। ওদের যে আমাদের বাসায় ডেকে আনব তাও এই তুফানের মধ্যে সম্ভব না। আমরা অসহায়ের মত শুনতে লাগলাম ওদের চিৎকার। ওদের পাশের বাসা তখন পর্যন্ত নিরাপদ ছিল। কিন্তু এই দুই পরিবারের মধ্যে আজন্ম শত্রুতা। ওরা কি এদের ঠাঁই দেবে? কিছুক্ষণ পর ওদের গলার শব্দ অনসরণ করে বুঝতে পারলাম এই ঝড়ের রাতে তারা শত্রুতা ভুলে গিয়ে অসহায় প্রতিবেশীকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই দেখি কানফাটানো শব্দে বাতাস বেচারা চালের শেষ শক্তিটুকুও শুষে নিয়ে তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
একটু পরে বাতাসের গতি আরো বেড়ে গেল। আমাদের পুরোঘর পাকা হলেও চিলেকোঠায় টিন দেয়া ছিল। এবার শুনলাম ঐ টিন ফরফর করতে শুরু করেছে। বেচারা টিন চিলেকোঠাকে আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাতাস তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। চিলেকোঠা ছিল রান্নাঘরের একপাশে আর রান্নাঘর থেকে ডাইনিং রুমের দরজা মা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি দু’একবার ডাইনিং রুমে গিয়ে ছালা বিছিয়ে রান্নাঘর থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোত স্তিমিত করার চেষ্টা করলাম। দীর্ঘসময় যুদ্ধ করতে করতে বেচারা টিন একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে উড়েই গেল। আমিও পানি বন্ধ করার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বাড়ীর ফ্লোরে নদীর সৃষ্টিরহস্য পর্যবেক্ষণ করে লাগলাম।
ভোরের দিকে বাতাস কমে এলো।মনে হোল সদর দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। মা ভাইয়াকে পাঠালো দেখার জন্য। একটু পরে দেখি ছোটমামা এসে হাজির। বেশ কিছুদিন থেকেই নাকি সাইক্লোনের ওয়ার্নিং দেয়া হচ্ছিল কিন্তু কিছুই হচ্ছিলনা। তাই অধিকাংশ মানুষ এই ওয়ার্নিংকে পাত্তা দেয়নি। মামাও তাই ঝড়ের আগে আমাদের বাসায় না এসে দোকানেই রয়ে গিয়েছিল। দোকানের চাল উড়ে গিয়ে ভিজতে ভিজতে বেচারা কোনক্রমে উড়ে যাওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল। পরে বাতাসের বেগ বাড়তে দেখে দোকান থেকে বের হতেই একটুর জন্য উড়ে আসা টিনে দোফালা হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল। তখন ভেবে দেখল দোকান থেকে আমাদের বাসা পর্যন্ত আসতে গেলে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা। এতদুর আসার চেয়ে দোকানের কাছাকাছি এক বাসার সিঁড়িতে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। বাতাস কমে যাওয়ায় সাহস করে আমাদের বাসা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।
রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্য। সকালে উঠে দেখি বাইরে সব চুপচাপ যদিও মৃদু বাতাস বইছে তখনো। ডাইনিং রুমের নদী ততক্ষণে আমাদের রুম পর্যন্ত গড়িয়েছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি একটা টিন তিনদিক খুলে ঝুলে আছে, আরেকটা তখনো দুদিকে লাগানো। ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই বাতাসের প্রচন্ডতা সত্যিকার অর্থে টের পেলাম। গোলাপবাগান মনে হোল বিরানভূমি যেখানে কখনো কিছু ছিলোনা। বেলুম্বু আর অড়বড়ই গাছের ডালে কোন পাতা বা ফল নেই, সব গাছের নীচে। কাঁঠালগাছ একটা ভেঙ্গে গেছে আর একটা কোনরকমে প্রাণে বেঁচে গেছে। বাবার দাদীর লাগানো আমগাছটা পাতা পড়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে কিন্তু ডালপালা ভাঙ্গেনি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হোল নয়টা সুপারীগাছ আর ছয়টা নারকেল গাছের দেখি মাথা কোথায় উড়ে চলে গিয়েছে, দুমড়ানো মোচড়ানো কান্ডটা কিভাবে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যেভাবে ম্যচের কাঠি বা টুথপিক ভাঙ্গি, কোন বিশাল হাত যেন গাছগুলোকে ঠিক সেভাবে মাঝ বরাবর ভেঙ্গে ফেলেছে! আর পেছনের ঘরগুলোতে দেখি বাতাসে পুরনো জীর্ণ দেয়াল ভেঙ্গে গিয়েছে জায়গায় জায়গায় আর এক জায়গায় ভেঙ্গে পড়েই গেছে!
সেদিন খবর এলো উপকুলীয় অঞ্চলে প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছে। দু’একজায়গায় ছাড়া আর কোথাও ইলেকট্রিসিটি পানি টেলিফোন কিছুই নেই। আমাদের বাড়ী শহরের মধ্যখানে। কিন্তু বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত সমুদ্রের পানি এসে পড়েছিল আর কোথাও কোথাও বিল্ডিং-এর ছাদ পর্যন্ত পানি উঠেছিল। গ্রামের বাড়ীতে কি অবস্থা দেখার জন্য মা সাথে সাথে ছোটমামা আর ভাইয়াকে বাড়ী পাঠিয়ে দিল। সেদিন পর্যন্ত আমাদের ট্যাংকের পানিতে চলল। তারপর দিন থেকে শুরু করলাম টিউবওয়েল থেকে ভেতরের বাথরুমে, রান্নাঘরে পানি টানা। দুতিনদিন পর যখন আবার লোকজন প্রকৃতিস্থ হয়ে কাজে যেতে শুরু করল তখন মা সবার আগে ছাদে টিন লাগাতে লোক নিয়োগ করল। নইলে প্রতিবারের বৃষ্টিতেই ঘর ভেসে যায়।
গ্রাম থেকে ফিরে ভাইয়া আর মামা যে বিবরণ দিল তাতে মনে হোল আমাদের কষ্ট কোন কষ্টই না। আজকাল অনেক বাড়ীর ছেলেমেয়েরা বিদেশে চাকরী করতে যাওয়ায় প্রবাসের টাকায় ইটের বাড়ীঘর হচ্ছে। এ’ছাড়া গ্রামাঞ্চলে পাহাড় কাছে হওয়ায় মাটির ঘরই তৈরী হয় বেশী। সাইক্লোনে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢলে গলে ভেঙ্গে পড়েছে অধিকাংশ মাটির ঘর। টিনের ঘর এতদঞ্চলে খুব একটা প্রচলিত নয় কিন্তু টিনের ছাদ উড়ে গিয়েছে অধিকাংশ ঘরের আর সেই টিনে কাটা পড়ে মারা পড়েছে অনেকেই। অনেকের বাড়ীর ওপর গাছ পড়ে বাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোকজন সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছে এই ঝড়ে। অনেকের লাশ কোমর পর্যন্ত গেড়ে গেছে কাদায়। মৃতদেহ এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরা এখনই কথা বলবে। এই লাশ কি করে তোলা হবে কেউ বুঝতে পারছেনা। বাতাসে মহিলাদের শাড়ি উড়ে গেছে। যতক্ষণ ঝড় ছিল ততক্ষণ তারা বাঁচার তাগিদে গাছপালা আঁকড়ে ছিলেন। কিন্তু অন্ধকার কেটে যেতেই অনেকে লজ্জা ঢাকার জন্য গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নেমে লুকিয়ে আছেন। খাবারের অভাব তো আছেই, রান্না করার কোন উপায় নেই।
আমাদের সাপ্তাহিক বাজার করা হয়েছিল তুফানের আগের দিন। মা বিশাল ফ্রিজারসম্পন্ন ফ্রিজটা আমাদের আবুধাবী বাসা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। এতে একটা আস্ত গরুর সমুদয় মাংস রাখা যেত। এই ফ্রিজার সম্পূর্ণ খালি করে মা মাছ মাংস যা পেল সব বিশাল বিশাল হাঁড়িতে চুলায় বসিয়ে দিল। রান্না করে হাঁড়িসহ পাঠিয়ে দেবে গ্রামে। আমি গেলাম আমাদের আলমারীতে ঘাটাঘাটি করে তিন ভাইবোনের কাপড় থেকে না রাখলেই নয় এমন সব কাপড় বেছে বস্তাভর্তি করতে।
কাপড় প্রায় গুছিয়ে এনেছি, এ’সময় মা এসে বল্ল স্যার এসেছেন। জীবনে অংক ছাড়া আর কিছুর জন্য শিক্ষক রাখতে হয়নি। সাতটা বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েও আমি দু’একবার ছাড়া অংকে কোনদিন পাশ করতে পারিনি। সেই স্যার। এমনিতে ঘরবাড়ীর এই অবস্থা, ব্যস্ততা আর পানি টানতে টানতে অবস্থা কাহিল, তার ওপর আমি অংক সহ্য করতে পারিনা- স্যারের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আমার চেহারাটা খুব বিচ্ছিরী। কখনোই কোন অনুভূতি লুকাতে সে আমাকে সাহায্য করেনা। স্যার আমাকে দেখেই বললেন, “শোন আজ তোমাকে পড়াতে আসিনি, ছাত্রী বেঁচে আছে না আমার চাকরীটা গেছে দেখতে এসেছি!” তখন আমার বেশ ভালো লাগল। ওনাকে আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। ওনাদের কি অবস্থা ছিল জিজ্ঞেস করলাম। স্যারের বাড়ী হালিশহর। একতলা বাড়ী সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেলে ওঁদের সম্পূর্ণ পরিবার এই বৃষ্টিতে ভিজে ছাদে আশ্রয় নেয়। সারারাত ওঁরা ছাদ থেকে উঠে থাকা রডের সাথে নিজেদের বেঁধে রেখে বাতাসে উড়ে যাওয়া থেকে আত্মরক্ষা করেন। বেচারার কাহিনী শুনে মনে হয় আল্লাহ আমাদের ঐ সময় বেহেস্তে রেখেছিলেন। এইচ এস সি পরীক্ষা পিছাবে কি’না খবর নিতে মনে করিয়ে দিয়ে স্যার তাঁর অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের খবর নিতে রওয়ানা হয়ে যান।
তার পরদিন থেকে প্রতিবেশীরা টিউবওয়েলের পানি নেয়ার জন্য আমাদের বাসায় ভিড় জমাতে শুরু করেন। আমাদের পেছনের দরজা প্রায় ফুলটাইম খুলে দেয়া হয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য এলাকার লোকজন খবর পেয়ে সর্বোচ্চ আট কিলোমিটার দূর থেকে পর্যন্ত পানি নিতে আসে। বাবার টিউবওয়েল, যা থেকে বাবা বেচারা একগ্লাস পানিও তোলেনি, বাবাকে বালতি বালতি সাওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
তুফানের প্রায় একসপ্তাহ পর প্রিয় বান্ধবী শিখা আসে। দু’জনে কলেজে যাই আমাদের আসন্ন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কি হবে জানতে। সাইক্লোনের পর এই প্রথম আমার রাস্তায় বের হওয়া। চারপাশে পুরাতন বিল্ডিংগুলো দেখে মনে হোল এগুলোকে কেউ বিশাল সব বুরুশ দিয়ে পরিষ্কার করেছে! কোন বিল্ডিং –এর দরজা নেই, কোন বিল্ডিং-এর জানালা। বিরাট বিরাট সাইনবোর্ডগুলো মনে হচ্ছে কেউ বাতিল চিঠির মত মুচড়ে ফেলেছে! কিছু কোনক্রমে ঝুলে আছে বিল্ডিং-এর গায়ে আর কিছু খুলে পড়েছে রাস্তায়। কলেজে যেতে যেতে দেখি অসংখ্য গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকগুলো তখনো সরানো সম্ভব হয়নি। কলেজে পৌঁছে দেখি আলোচনার মূখ্য বিষয় সাইক্লোন এবং এ’কারণে এইচ এস সি পরীক্ষা পেছানো আর বিদেশে ইরাক কুয়েত যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে পড়া। কিন্তু আমার মনে হোল কি হবে পরীক্ষা দিয়ে বা আমেরিকা ইরাক কি করল জেনে যেখানে এক মূহূর্তের জন্য জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই? আমার হাতে আছে তো কেবল এই মূহূর্তটুকুই! এই মূহূর্তটা আমি কি কাজে লাগালাম তা ছাড়া আর কোন কিছু চিন্তাভাবনা করে কোন লাভ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সব বান্ধবীদের খবরাখবর নিয়ে বাসায় রওয়ানা হলাম, বাসায় অনেক কাজ।
বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি আলমারী খুললাম, কলেজ ড্রেস বদলে বাসার জামা পরতে হবে। আলমারী খুলে তো আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়! আলমারী সম্পূর্ণ ফাঁকা! কিচ্ছু নেই! মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা বল্ল গতবার গ্রামে যে কাপড় পাঠানো হয়েছে তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। তাই আজকে আবার আলমারী খালি করে সব পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাকে পরে বানিয়ে দেবে। আমি বললাম এতে আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু আপাতত আমি কি পরব? মা খুঁজেপেতে বাবার দুটো খাদি পাঞ্জাবী আর মা’র ইউরোপ সফরের দু’টো ট্রাউজার বের করে দিল। বল্ল, “আপাতত এই দিয়ে চালাও”। কি আর করা? আমার মায়ের এখন তিন ছেলে হোল!
এর প্রায় একসপ্তাহ পর পানি নিতে নিতে টিউবওয়েলের ফিল্টার ফেটে কাদা উঠতে শুরু করল। লোক ডাকা হোল, ওরা বল্ল নতুন করে টিউবওয়েল খুঁড়তে হবে। এই টিউবওয়েলে আর পানি উঠবে না। তখনো পানি বা ইলেকট্রিসিটি আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। লোকজন শেষপর্যন্ত সেই কাদাই নিয়ে গেল, কাদা বসে গেলে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করে পান করবে। পানির কি মূল্য আমি সে ক’দিনে বুঝতে পারলাম।
তার এক্সপ্তাহ পর একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না যে আল্লাহ মানুষের দোয়া তাৎক্ষণিক কবুল করেন। জুহর নামাজ পড়ছি। বাইরে লোকজনের কোলাহল শুনছি যেটা তখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক। এক লোক এসেছেন এই কাদাপানি নিয়ে যেতে। কাদা বসে গেলে ওপর থেকে পানি তুলে তার অসুস্থ বাবামাকে খাওয়াবেন যেহেতু অন্য পানিতে রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা। নামাজের মধ্যেই শুনতে পেলাম উনি দুঃখ করছেন, এখন আর কাদাও উঠছেনা। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাইরে উনি দোয়া করছেন আর ভেতরে আমি, কেউ কাউকে দেখছিনা কিন্তু দু’জনে একই কথা বলছি, “হে আল্লাহ, তুমি আমাদের রিজিক তুলে নিয়োনা! এই কল বিকল হয়ে যেতে পারে কিন্তু তোমার সীমাহীন রহমতে এই ভাঙ্গা কল থেকেই পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি ওঠা সম্ভব। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের পানির উৎস বন্ধ করে দিয়োনা”। নামাজ শেষ হওয়ার আগেই শুনি ওরা আবার পানি তোলার চেষ্টা করছেন আর ঐ ভদ্রলোক উচ্ছসিত হয়ে বলছেন, “এরকম পরিষ্কার পানি তো আমরা যখন টিউবওয়েল ভালো ছিল তখনো পাইনি!” আমার মত মানুষের কথা আল্লাহ শোনার কথা না। তাই আমি নিশ্চিত ঐ ভদ্রলোকের কারণেই আল্লাহ ঐ ভাঙ্গা টিউবওয়েল দিয়েই স্বচ্ছ পানির স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। ওয়াসার পানি ফিরে আসা পর্যন্ত ঐ পানি অব্যাহত ছিল। তারপর আর কোনদিন ঐ টিউবওয়েল দিয়ে একফোঁটা পানিও ওঠেনি। কিন্তু ওর মর্চেপড়া মাথাটা আমি যতবার দেখি, আমি পুণর্বার বিশ্বাস করি- আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন, কিন্তু তারপরও তিনি আমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, ক্ষমাশীল এবং তিনি আমাদের দোয়া কবুল করার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন, যদি আমরা শুধু চাইতে জানি।
No comments:
Post a Comment