কোথাও পড়েছিলাম, When you love someone, you give them what they want. এখানে they শব্দটি মূখ্য এবং you শব্দটি গৌণ। অর্থাৎ যাকে ভালোবাসেন তার ইচ্ছেটাই মূখ্য।
আমরা আমাদের আশেপাশে সাধারণত দু’প্রকার ভালোবাসা দেখতে পাই। একপ্রকার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, ততটুকু, যতটুকু মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব। আরেকপ্রকার ভালোবাসায় স্বার্থের মিশ্রণ সুস্পষ্ট। প্রথমপ্রকার ভালোবাসায় ব্যাক্তি প্রিয়জনের জন্য তাই চায় যা প্রিয়জন চায় যদিও এতে করে সে প্রিয় ব্যাক্তিটির সংসর্গবঞ্চিত হয়। আর দ্বিতীয়প্রকার ভালোবাসায় সে প্রিয়জনকে ধরে রাখার জন্য তাকে কষ্ট দিতেও পিছপা হয়না।
আজকাল দ্বিতীয় প্রকার ভালোবাসার দৌড়াত্ম্য দেখে ভয় হয় যদি এ’বিষয়ে কিছু বলি, মানুষ মনে করবে আমি পাষানহৃদয়, ভালোবাসা কাকে বলে তার আমি কি জানি! আজ My Sister’s Keeper ছবিটি দেখে সাহস পেলাম যে আরো কিছু মানুষ আমার মত করে ভাবে।
বহুদিন অপেক্ষা করে ছিলাম ছবিটি দেখার জন্য। কাহিনী খুবই সাধারণ। এক ভদ্রমহিলা যখন জানতে পারলেন যে তার বড় মেয়েটির লিউকেমিয়া তখন তিনি আরেকটি সন্তান নিলেন যাতে করে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে তার শরীর থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে বড় সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তেরো বছর বয়সে উপনীত হয়ে ছোট মেয়েটি এক বিখ্যাত উকিলের সাথে কথা বলে কেস করে দিল যাতে তার শরীর থেকে আর কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেয়ার ওপর আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা সংগ্রহ করা যায়। বড় মেয়েকে দেখাশোনার জন্য কাজ ছেড়ে দেয়ার আগে মা নিজেও উকিল ছিলেন। তিনিও লড়াই না করে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নন। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না যে মেয়ে বড়বোনকে এত ভালোবাসে সে হঠাৎ এভাবে বেঁকে বসল কেন। কোর্টে কেসের শুনানীর এক পর্যায়ে ছোট মেয়েটির জবানবন্দী নেয়ার সময় দুই বোনের মধ্যবর্তী ভাইটি ফাঁস করে দেয় যে বড় মেয়েটি জানে তার রোগের কোন চিকিৎসা নেই, সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত অথচ মা চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। বড়বোন তখন ছোটটিকে বোঝালো সে এই “life of pain” থেকে বাঁচতে চায়, সে মৃত্যুর মাধ্যমে এই কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি চায়। তখন দুইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে মায়ের সাথে কথা বলে মাকে বোঝানোর চেয়ে এইভাবেই তার চিকিৎসা বন্ধ করে তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করা যায়। শেষপর্যন্ত মা নিজেও বুঝতে পারেন মেয়েটি কি কষ্টে আছে এবং এই মূহূর্তে তার জন্য জীবনের চেয়ে মৃত্যুই সহজ। মেয়েটি মারা যায় কিন্তু তার পরিবার তাকে মনে রাখে সবসময়।
মৃত্যু একটি স্বাভাবিকতা। জন্মের সাথে সাথে মৃত্যু আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যে পরিণত হয়। জীবনের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা পরবর্তী পর্যায়ে চলে যাই। সক্রেটিস বিষপানের সময় তাঁর শিষ্যদের কাঁদতে দেখে বলেন, “Death may be the greatest of all human blessings.” মৃত্যুকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে একটিমাত্র ক্ষেত্রে আপত্তি থাকতে পারে; যদি আমরা মনে করি যে এটি সকল কিছুর সমাপ্তি।
পরিচিত মহলে বেশ কয়েকটি কেস দেখে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম যে বৃদ্ধ বাবামাকে মেশিন দিয়ে মাসের পর মাস vegetable state-এ রেখে দিয়ে তাদের নামমাত্র বাঁচিয়ে রাখা অন্যায়। তাঁরা তাঁদের আয়ু পূর্ণ করেছেন এবং যখন তাদের চলে যাবার সময় হবে তখন যেকোন এক উসিলায় মৃত্যু তাদের সামনে উপস্থিত হবে। সে সময় চিকিৎসার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু কোন চিকিৎসা নেই বলে মেশিন দিয়ে শুধু তাদের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁদের প্রতি জুলুম। আমি নিজেকে দিয়ে চিন্তা করি। আমার বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা যেদিন থেকে কাজ করবেনা সেদিন থেকে আমার বেঁচে থাকার কোন উদ্দেশ্য থাকবেনা। সেক্ষেত্রে আমার শরীরটকে যদি মেশিন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে আমার সন্তানেরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে মা আছেন বা আমরা টাকা পয়সার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মাকে বাঁচিয়ে রেখেছি- সেটা কি হাস্যকর হবেনা? কি জানি, আমি এতে পরিতৃপ্ত হবার মত কিছু দেখিনা। শরীরটা আমার হতে পারে কিন্তু আমি সেই শরীরের চেয়ে নিজেকে আরেকটু বেশী কিছু মনে করি। সেই বেশী কিছুর অস্তিত্ব যদি না থাকে তবে শুধু খোলটা জিইয়ে রাখা বোকামী নয় কি?
যাকে ভালোবাসি তাকে ধরে রাখার চেয়েও ছেড়ে দেয়া অনেক সময় অনেক বড় ভালোবাসার দাবী। এটা বুঝতে পারলে হয়ত আমরা বাবামাকে মেশিন দিয়ে জিইয়ে না রেখে তাদের জীবদ্দশায় তাদের সাথে সময় কাটানোর বা তাদের খুশী রাখার ওপরেই বেশী গুরুত্ব দিতাম।
একদম নির্মম সত্য কথা :)
ReplyDelete