Wednesday, December 1, 2010

সন্তানদের “মানুষ” করা


[“ভয়” প্রবন্ধটি লেখার পর থেকে অনেকেই জানিয়েছেন এর একটা সমাধানও বাতলানো দরকার ছিল। আমার দুই সন্তানের বয়স এখন দশ আর চার। যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের পিতামাতাই সমাধান দিতে পারছেন না, আমি কি করে সাহস করি? তাই আমি কেবল আমার সন্তানদের জন্য যা ভাবি, পরিচিত বন্ধুবান্ধবকে যা পরামর্শ দেই- তাই লিখলাম। হয়ত এতে কেউ কেউ অনপ্রাণিত হতে পারেন। লেখাটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। অন্যদের ভালো না লাগতেই পারে।]



বান্ধবী শিমু বলত বিয়ের পর সে ছেলের মা হতে চায় যেন সে দেখিয়ে দিতে পারে ছেলেদের কত ভালোভাবে মানুষ করা যায়। অন্যরা বলত তারা মেয়ে সন্তান চায় কারণ মেয়েরা বাবামাকে জ্বালায় না।আর আমি বলতাম আমি বিয়েই করবনা!

কিন্তু অদৃষ্টের লিখন যায় না খন্ডন। বিয়ে হোল। বাচ্চাও হোল। তখন বাচ্চা “মানুষ” করার প্রশ্নও এলো।

এক্ষেত্রে আমার তিনটা বিশেষ সুবিধা ছিল। প্রথমত, আমার অভিজ্ঞতা। ছোট ভাই দু’টি যথাক্রমে আমার ছয় এবং বারো বছরের ছোট ছিল। বিশেষ করে বিদেশে থাকায় ছোটটির প্রায় সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বারো বছর বয়স থেকেই মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া বাবা অল্প বয়সে বিয়ে করাতে বাবার বন্ধুদের ছেলেমেয়েরাও ছিল আমার অনেক অনেক ছোট। তাঁরা বিভিন্ন সময় আমার কাছে বাচ্চা রেখে যেতেন, এতে করে বিভিন্ন ধরণের শিশুদের দেখার এবং নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস হয়ে গেছিল অল্প বয়সেই। দ্বিতীয়ত, আমি সর্বভূক। ছোটবেলা থেকেই যেখানে যা পেতাম, বুঝি না বুঝি, পড়তাম। পরে এই টুকরো টুকরো তথ্যগুলো অনেক কাজে লেগে যায়। তৃতীয়ত, আমার বাবামার পাশাপাশি অন্যান্যদের বাবামাকে পর্যবেক্ষণ করে অনেক কিছু শেখার এবং বোঝার সুযোগ পেয়েছি।

আমি খুব ভালো মা নই। আদর্শ মায়েদের মত সন্তানদের খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক নিয়ে আদিখ্যেতা আমাকে দিয়ে হয়না, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ব্যাপারেও আমার বাচ্চাদের ওপর কোন জোর নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই তাদের আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছি। পড়তে শেখার সাথে সাথে হাতে অর্থসহ কুর’আন ধরিয়ে দিয়েছি।তাদের বলেছি, “তোমাদের আমাকে বা আব্বুকে বা আর কাউকে খুশী করার কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোন কাজ তোমরা কখনো কোরনা। তোমরা যদি লুকিয়ে কিছু কর আমি দেখবনা, আব্বু দেখবেনা, হয়ত কেউই দেখবেনা, কিন্তু আল্লাহ দেখবেন। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আগুনে শিক কাবাব বানাবেন। আর ওনার কথা শুনলে তোমরা যা চাও সব উনি তোমাদের দেবেন”। আমি চাইনা আমার সন্তানেরা রূপকথা শিখুক। আ্মাদের অধিকাংশেই ইসলাম সম্পর্কে ধারণা রূপকথার মতই। বিভিন্নজনের কাছে টুকটাক শোনা বা চটিবই পড়াতেই আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ফলে আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় নানানরকম ভুল ধারণা, অনেক ভুল আচরণ। আসলে যে কি করতে বলা হয়েছে, কি মানা করা হয়েছে বা কেন এ’ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। তাই আমরা নামসর্বস্ব মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠি। কুর’আনের কোন অংশ শুনলে “নিজের যুক্তি” দিয়ে বিচার করি। অথচ আমাদের মানদন্ড হওয়া উচিত কুর’আন এবং “যুক্তি” হওয়া উচিত সেই মানদন্ডের প্রেক্ষিতে। তাই আমি চাই ওরা নিজে পড়ে জেনে বুঝে “মানুষ” হোক। তাছাড়া এই বইটিতে যেভাবে আদর্শ আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা যদি কোন মানুষ অনুসরণ করে তবে সে শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাবা বা মা, বন্ধু, প্রতিবেশী, মালিক বা কর্মচারী সবই হতে পারবে। ব্যাস, আমার কাজ হয়ে গেল!

আমি যখন জানলাম তিনমাস বয়স থেকে গর্ভস্থ শিশুর হৃৎপিন্ড চালু হয়ে যায় এবং পাঁচমাস বয়স থেকে সে শুনতে পায় তখন একটা প্ল্যান করলাম। তিনমাসের সময় চুপি চুপি পড়ার পরিবর্তে জোরেজোরে কুর’আন হাদি্‌স বইপত্র পড়তে শুরু করলাম, রাগ কমিয়ে হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করতে শুরু করলাম, মানুষের সাথে আরো বেশী ভালো আচরণ করতে শুরু করলাম। পাঁচমাসের সময় আমি আমার সন্তানদের সাথে কথা বলতে শুরু করতাম, ভালো খারাপ বোঝাতাম। অনেকে এটাকে পাগলামী মনে করে। কিন্তু একটা সাধারন পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন এতে পাগলামীর কিছু নেই। ভূমিষ্ঠ হবার পর শিশু তার বাবাকে দেখে পিটপিট করে তাকায়, তার গলার স্বরে সাড়া দেয়। সে কি করে বোঝে এটা তার বাবা? কারণ সে আগে থেকেই বাবাকে চেনে!

আমি আমার সন্তানদের সাথে তাদের জন্মের সাথে সাথেই কথাবার্তা চালিয়ে যেতাম। Baby talk না, adult talk. তাদের রূপকথার গল্প না বলে বিভিন্ন নবীরাসূল এবং বড়বড় মানুষের কথা বলতাম। আমার ননদরা হাসত। একদিনের বাচ্চাকে গল্প বলে! কিন্তু আমার মেয়ে আড়াই বছর বয়সে সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে সে সব শোনে এবং বোঝে যখন ওর বাবা ওকে দুষ্টুমী করে বল্ল, “যাও, তুমি গোসল করে আস, তোমাকে কোরবানী দেব”। সে বল্ল, “আব্বু, আপনি কিছু জানেন না। শুধু ইব্রাহীম (আ) ইসমাইল(আ) কে কোরবানী করতে পারে। অন্য আব্বুরা শুধু গরুছাগল কোরবানী করতে পারে!” আমার এক বোন কর্ণেলিয়া আজ ফেসবুকে লিখেছেঃ “Jasmine was in a forbidden relationship with Aladin, Snow White lived alone with seven men, Pinocchio was a liar, Robin Hood was a thief, Tarzan walked without clothes on, a stranger kissed Sleeping Beauty and she married him, Cinderella lied and sneaked out at night to attend a party. These are the stories our families raised us with and then they complain our present generation is messed up!” আমরা আমাদের সন্তানদের যে আদর্শ দিয়ে বড় করব তাই তো তারা শিখবে!

অনেক আহ্লাদী মায়েরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলায় শাসন করতে চান না। বলেন, “ও তো এখনো ছোট, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে”। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একটা শিশুকে ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড যদি বাবামা না শেখায় তবে সে “ঠিক” হবে কি করে? একটা শিশু অন্যদের সাথে খেলনা শেয়ার করতে চাইবেনা, অন্যের ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করবে, রাত বারোটা বাজে কমলা খাবার আহ্লাদ করবে আর আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলব, “ছোটবাচ্চা, ঠিক হয়ে যাবে?- কক্ষনো নয়! আমার মেয়ের যখন দেড়বছর, সে বারবার রান্নাঘরে আগুনে হাত দিতে চাইত। এই অবস্থা দেখে আমি একদিন একহাতে বরফ নিলাম, আরেক হাতে একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে তাকে ধরার সুযোগ দিলাম। সে ম্যাচ ধরে কেঁদে ওঠার সাথে সাথে হাতে বরফ ঠেঁসে দিলাম। ফোস্কাও পড়লোনা, হাতও পুড়লোনা- বড়জোর কিছুক্ষণ জ্বালা করল। কিন্তু সে বুঝে গেল আগুন দেখতে সুন্দর কিন্তু তা ধরলে হাত পুড়ে যায়। আর কোনদিন তাকে নিয়ে আমার ভাবতে হয়নি। মাঝে মাঝে বিপদের কাছাকাছি যেতে দিয়ে শিশুকে সচেতনতা শেখানো যায়। এতে সে বৃহত্তর বিপদ থেকে রক্ষা পায়। Responsibility এমন একটা জিনিস যা আমার মনে হয় সবাইকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো উচিত।

একইভাবে এটাও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন যে আমাদের শিশুরা টিভিতে কি দেখছে। সারাদিন টিভিতে নাঙ্গা নাচ চলছে আর শিশু বাবামা’র সাথে বসে তাই দেখছে, এই শিশুর লজ্জাবোধ তো ওখানেই শহীদ হয়ে যাচ্ছে! এক ভাই রাহাত আজ লিখলঃ “Almost 70 of the Tom and Jerry cartoon shows that Tom is extensively addicted to the opposite sex. And he reacts strangely when he sees anyone of the opposite sex. Guardians are not weary of what it represents but the kids are watching this very easily with family!” শিশুকে যে ধরণের রুচি দিয়ে বড় করা হবে তাই শিশুর ভালো মনে হবে। যেমন আমরা যখন ছোট ছিলাম বাবা ভালো ছবি বেছে আমাদের দেখাত, সাথে বসে বুঝিয়ে দিত। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে Peace TV দেখে অভ্যস্ত। ক্যানাডায় Peace TV নেই বলে সে নিজেই কম্পিউটারে Peace TV বের করে দেখে।

সবচেয়ে বড় কথা আমাদের নিজেদের সংশোধন করতে হবে। আমাদের এটা বোঝা প্রয়োজন যে আমরা শিশুদের কি বলি তার চেয়েও ওরা অনুসরণ করে আমরা কি করি। প্রত্যেক শিশুই মনে করে তার পিতামাতা আদর্শ। সুতরাং, আমরা কোন অন্যায় করলে তখন তারা মনে করে, “বাহ, আব্বু যেহেতু মিথ্যা কথা বলে, আমি বললেও নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা নেই!” এটা খুব জরুরী যেন বাবামা সন্তানদের সামনে ঝগড়া না করেন বা পরস্পরের বা তাদের পরিবারের ব্যাপারে কোন বাজে মন্তব্য না করেন। কারণ একটা শিশু নিজেকে মূল্যায়ন করে তার বাবামায়ের মাধ্যমে। তার যদি নিজের বাবামা’র প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায় তবে সে নিজেও low self esteemএ ভুগতে শুরু করে। এ’ একই কারণে আমাদের এমন অন্যায় করা উচিত নয় যা আমরা চাই না আমাদের সন্তান করুক যদিও সেটা আমরা মনে করি আমার সন্তানের সুখের জন্য। যেমন, আমার আয়-রোজগার কম হবার কারণে যদি আমার সন্তান একবেলা না খেয়েও থাকে তাতে তার সামান্য ক্ষুধা ছাড়া আর কোন কষ্ট হবেনা। কিন্তু যদি আমি সুদঘুষের টাকায় আমার সন্তানকে একটি ভালো জীবন দেয়ার চেষ্টা করি তাতে তার ক্ষতি বই কোন লাভ হবেনা। সে টাকার মূল্য বুঝবেনা, শ্রমের মূল্য শিখবেনা এবং এই টাকা তাকে পৃথিবীর জৌলুসের প্রতি আকৃষ্ট করে মূল জিনিসগুলো থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, ফলে সুখ তার কাছে কখনোই ধরা দেবেনা। উপরন্তু, আল্লাহ বলেছেন যার শরীরে একবিন্দু পরিমাণ হারাম প্রবেশ করবে সে কোনদিন জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। সুতরাং, কার্যত এতে করে আমি আমার সন্তানকে কেবল দুনিয়াতেই নয় বরং আখেরাতেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব।

আমি আমার সন্তানদের সাধারন মানুষ হিসেবেই বড় করতে চাই। তারা আমার সাথে মাটিতে শুয়ে ঘুমাতে ভালোবাসে। ওরা কোনদিন ওদের বাবামাকে অতিরিক্ত দামী জামাকাপড় পরতে দেখেনি, তাই যখন ওদের জন্য হকার্স মার্কেট থেকে কাপড় কেনা হয় তখন ওদের আঁতে ঘা লাগার মত কিছু ঘটেনা। ওদের ছোটবেলা থেকে needs এবং wantsএর তফাত করতে শেখানোর চেষ্টা করেছি। “চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে” কথাটা ওরা কোনদি্ন শোনেনি। যখন ওরা কিছু চায় তখন ওদের চিন্তা করার সুযোগ দেই আসলে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা এর পরিবর্তে অন্য কিছু দিলে কেমন হয়। যেমন আমি আমার সন্তানদের শেখানোর চেষ্টা করি তারা যেন নিজেদের মেধা, গুন, ব্যবহারের মাধ্যমে সুপরিচিত হবার চেষ্টা করে। আমি আমার মেয়েকে সামান্য পয়সার লিপ্সটিক কিনে দেইনি কোনদিন, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী দাম দিয়ে মাইক্রোস্কোপ কিনে দিয়েছি। কেননা লিপ্সটিক তাকে সৌন্দর্যপ্রদর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করে তাকে লোভী পুরুষদের দৃষ্টির খোরাকে পরিণত করবে, কিন্তু মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখা আরেকটা জগত তার অন্তঃর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করবে।

আমার বাবার কাছ থেকে আমি দু’টো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি। বাবা যথাসম্ভব পরিবারকে সময় দিত এবং সবার সাথে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করত যে আমাদের কখনো মনে হয়নি এ’কথাটা বাবাকে বলা যাবেনা বা এটা লুকানো দরকার। সন্তান যখন মনে করে যে সে তার পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব পাচ্ছে তখন সে বাইরে ভালোবাসা খুঁজতে যাবার প্রয়োজন বোধ করেনা। সুতরাং, তার সুযোগসন্ধানী কারো হাতে পড়ে জীবনটা এলোমেলো করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে কম। পাশাপাশি সে যদি মনে করে বাবামায়ের সাথে সব কথা বলা যায় তাহলে সে কোন বিপদে পড়লে বা কাউকে ভালো লাগলে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে- ফলে বাবামা উত্তম পরামর্শ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে পারবেন। অন্তত একজন অভিভাবকের এই দায়িত্বটা পালন করা উচিত যাতে সন্তান পিতামাতার কাছ থেকে নিজেকে distant মনে না করে, তার মনে না হয় তার পরামর্শ করা উচিত বন্ধুদের সাথে (বন্ধুদের জ্ঞানবুদ্ধি আর বাবামায়ের অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার মধ্যে কি কোন তুলনা হয়?), সে নিজেকে চাপযুক্ত মনে না করে এবং সে বাধ্য হয়ে ন্য় খুশী হয়ে বাবামায়ের আদেশ উপদেশ শোনে। পারিবারিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। আমরা বাবার সাথে স্ক্র্যাবল, মনোপলি, ফ্রিসবি থেকে শুরু করে লুডো পর্যন্ত খেলতাম- এখনো সময় পেলে খেলি। আরেকটা ব্যাপার হোল গল্পসল্প করা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা, পছন্দ অপছন্দ আলাপ করা যাতে উভয়ে পরস্পরের মনমানসিকতা বুঝতে পারে এবং মনোমালিন্য এড়িয়ে চলতে পারে।

ছোটবেলায়, যখন পুরোপুরি সব কথা বুঝতামনা তখন বিচিত্রায় একটা জরীপ পড়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (লুকিয়ে লুকিয়ে অবশ্যই!)। এতে বলা হয়েছিল, যারা দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এখানে পড়তে আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই নানাপ্রকার প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে যেহেতু দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে তাদের মন প্রায়ই খারাপ থাকে। আমার সেই ছোট্ট মাথায় তখন এটাই এসেছিল, এত লেখাপড়া করে কি হবে যদি একটা মানুষ তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, তার চরিত্রই হারিয়ে ফেলে? একটা মানুষের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা মাস্টার্স হওয়াটাই কি জীবনের মূল লক্ষ্য? সবার আগে কি তার একজন ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করা উচিত নয়?

এখন বড় হয়েছি (মনে হয়, যদিও মনটা এখনো ছোটদের মতই রয়ে গেল এবং সেভাবেই তাকে রাখতে চাই)। এখন বুঝি মানুষের সঠিক বয়সে বিয়ে করা উচিত। এটা লেখাপড়া বা আর কোন ব্যাপারে প্রতিবন্ধক নয়। জীবনে কোন কিছুকে আর কোনকিছুর জন্য ঠেকিয়ে রেখে দেয়াটা একটা চরম বোকামী। মানুষের রয়েছে অসীম সম্ভাবনা আর প্রচন্ড চাপ নেবার ক্ষমতা যদি সে নিজের মনোবলকে উন্নীত করতে পারে। তাই মানুষ বিয়ে, সন্তান, সংসার, লেখাপড়া, চাকরী সব একসাথে চালাতে পারে যদি বাবামা সহযোগিতাপূর্ণ হন। আমাদের বাবামাদের উচিত সন্তানের পার্থিব উন্নতির পাশাপাশি তাদের পারলৌকিক জীবনে ঠেকে না যাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তাদের সময়মত বিয়ে দেয়া। আমরা বিয়ে নামক সামাজিক অনুষ্ঠানে নানারকম বিদ’আত যোগ করে একে একপ্রকার বিভিষিকায় রূপান্তরিত করে ফেলেছি। অথচ এগুলো বাদ দিলে এটা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। ধরুন আমার বিয়ে। বাবা হাফিজ সাহেবকে বল্ল, “তোমার নতুন চাকরী, এখন গোল্ড দেয়া জরুরী নয়। পরে তুমি যখন পারো তখন তুমি তোমার বৌকে ইচ্ছেমত কিনে দিয়ো”। হাফিজ সাহেব বললেন, “আমি যৌতুক নেবনা, দিলে বিয়েই করবনা”। আমি বললাম, “গায়ে হলুদ বিদ’আত, সুতরাং গায়ে হলুদ করা, বাড়ীতে বা বিয়ে বাড়ীতে লাইট লাগানো যাবেনা। বরং ঐ পরিমাণ টাকা তুমি কোন গরীব মেয়ের বিয়ে দিতে খরচ কোর। এতে হয়ত আমাদের বিয়েতে আল্লাহ বরকত দেবেন”। ব্যাস, অল্প সংখ্যক আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব খাইয়ে, এক অনুষ্ঠানে বিয়ে হয়ে গেল! হাফিজ সাহেব ওনার বাবার একমাত্র ছেলে আর আমি বাবার একমাত্র মেয়ে। দুই পরিবারেরই সামর্থ্য ছিল জাঁকজমক করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার। কিন্তু আমরা আনন্দিত যে আমরা আমাদের বাবামাকে আমাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে কোন কষ্ট ভোগ করতে দেইনি।

আবার অনেক সময় মানুষের বিয়ে করতে দেরী হয়ে যায় “প্যাকেট” খুঁজতে খুঁজতে। ছেলে কি করে, মেয়ে দেখতে ঐশ্বর্য রাইয়ের চেয়ে সুন্দরী কি’না। যেই criteria দেখে বিয়ে করা প্রয়োজন সেগুলো নিগৃহিত হয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় সমস্যা। হয় তালাক, নয় অশান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান, নইলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পরস্পরের সাথে অবস্থান করেও চারিত্রিকভাবে বিচ্যূত হয়ে পড়া। বাবামাকে নির্বাচন করতে হবে মানুষ দেখে, সন্তানকেও এ’ব্যাপারে বাবামাকে উৎসাহিত করতে হবে যে মানুষ কেমন এটাই তার মূল লক্ষ্য এবং যদি এর জন্য তাকে কিছু ছাড় দিতে হয় তাতে সে অনুৎসাহী নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমি এখন থেকেই আমার সন্তানদের জন্য দুআ করি যেন আল্লাহ তাদের জন্য সর্বোত্তম সঙ্গী মিলিয়ে দেন এবং আমাদের মনকে তাদের জন্য এমনভাবে উন্মুক্ত করে দেন যাতে আমরা তাদের নিজেদের সন্তান থেকে পৃথকভাবে না দেখি।

সবচেয়ে বড় যে অন্যায়টি আমরা নিজের সন্তানের সাথে করি তা হোল তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা। পক্ষপাতিত্ব যার বিরুদ্ধে করা হয় তার চেয়েও বেশী ক্ষতি করা হয় সে সন্তানটির যার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়। সাধারনত এহেন আচরণের পেছনে বাবা বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের একটা সুপ্ত উদ্দেশ্য থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে মা এই সন্তানটিকে ব্যাবহার করেন কারো বিরুদ্ধে- সেটা হতে পারে তাঁর স্বামী, শ্বাশুড়ী বা ছেলের বৌ। কখনো সন্তানের ভক্তি তাকে এই সন্তানের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল করে তোলে। কিন্তু সেই সন্তানটি যখন বুঝতে পারে যে সে ব্যবহৃত হবার বিনিময়ে কিছু বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারে বা কোন অন্যায় করেও scot free বেঁচে যেতে পারে, তখন সেও এই special status উপভোগ করতে শুরু করে। কিন্তু কার্যত এতে সে লেখাপড়া ফাঁকি দিতে শুরু করে, কাজের প্রতি নিস্পৃহ হয়ে পড়ে, পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে, নির্লজ্জ ও স্বার্থপর হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারের সবার বিরক্তির কারণ হিসেবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একজন পিতা বা মাতা সন্তানের এর চেয়ে বড় আর কি ক্ষতি করতে পারেন? এক্ষেত্রে পিতামাতার পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সন্তান লালন করা, সন্তানকে নিজেদের মধ্যে power playর গুটি না বানানো এবং নিজেদের মধ্যকার সমস্যা সন্তানকে বুঝতে না দেয়া অত্যন্ত জরুরী।

চারপাশে দেখছি, শিখছি, ভুল করছি আবার সংশোধন করছি। সন্তানের সাথে প্রতিটি মূহূর্তই তো আসলে এক নতুন অভিজ্ঞতা কারণ প্রতিটি শিশু আলাদা স্বভাবচরিত্র নিয়ে জন্মায়, প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ করে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হয়, তারপর তাকে কিভাবে বোঝানো যায় তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। আমার অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের দেখে এবং তাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে শেখার সুযোগ পেয়েছি অনেক, আমি কৃতজ্ঞ। চেষ্টা করছি ছেলেমেয়েদের আমার বোধ অনুযায়ী সন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। সবাই দুআ করবেন যেন সবাই সন্তানদের সর্বাগ্রে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

Thursday, November 25, 2010

ভয়

আমি সচরাচর ভয় পাইনা। তবে একবার সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। ঐ ঘটনার কথা মনে হলে আমার এখনো বুক কেঁপে ওঠে।

আমার প্রথম সন্তানের সময় পুরুষ ডাক্তারের কাছে আল্ট্রাসাউন্ড করবনা বলে শেষমূহূর্তে ঢাকা গিয়েছিলাম সবার আদেশ অনুরোধ উপেক্ষা করে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার বান্ধবী নাহিদ আপা জানালেন চট্টগ্রামে তাঁর পরিচিতা এক সনোলজিস্ট আছেন, তাঁর সাথে দেখা করতে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর নামও রেহনুমা! নিজের নামে আরেকজনকে ডাকতে কেমন লাগে সে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। তবে এবারে কিভাবে যেন আমার মিতার সাথে ভীষণ মিতালী হয়ে গেল। তাঁর যেকোন সমস্যা বা প্রয়োজনের কথা তিনি আমাকে জানাতেন, আমিও তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম আমার যেকোন সমস্যার কথা।

একদিন রেহনুমা আপার কাছে গিয়েছি এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে। কথায় কথায় বান্ধবী বল্ল, “আমার বুয়ার কিছুদিন যাবৎ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। আগে কোনদিন হয়নি তাই ভেবেছিলাম কয়েকদিন ওষুধ খেলে সেরে যাবে। কিন্তু কিছুতেই ভালো হচ্ছেনা। আপনি কি মনে করেন ওর একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখা দরকার ভেতরে কি অবস্থা?” রেহনুমা আপা বললেন, “আমি আপাতত ফ্রি আছি, যদি তাকে তাড়াতাড়ি আনতে পারেন তবে দেখে দিতে পারি”। বুয়া কাছেই ছিল। তাঁকে নিয়ে এসে পরীক্ষা করতে করতে বান্ধবী চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, আমি রেহনুমা আপার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আমাদের দু’জনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল! আমার হাতপা কাঁপতে শুরু করল। রেহনুমা আপা ডাক্তার হয়েও ভড়কে গেলেন। উনি কোনক্রমে সনোগ্রাম শেষ করে বুয়াকে রুমের বাইরে চলে যেতে বললেন। বান্ধবী আমাদের চেহারা দেখে আন্দাজ করল কিছু একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে। রেহনুমা আপা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বুয়ার স্বামী এসেছে কতদিন হোল?”
বান্ধবী বল্ল, “বুয়া তো বিধবা, ৪৫ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে তাই আর বিয়ে করেনি”।
রেহনুমা আপা এবার আমার দিকে তাকালেন। উভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষে যথাসম্ভব নরমভাবে বান্ধবীকে বললাম, “তোমার বুয়া প্রেগন্যান্ট”।
সে প্রথমে হেসে ফেল্ল। তারপর আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারল আমরা ঠাট্টা করছিনা, সে কোনক্রমে চেয়ারের হাতল ধরে ধপ করে বসে পড়লো। আমি গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত দিতেই সে উদ্ভ্রান্তের মত বলতে শুরু করল, “এই মহিলাকে আমি মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সবচেয়ে দামী জিনিস, আমার সন্তান, আমি তার হাতে দিয়ে কাজে আসি… কোনদিকে তার সুবিধা বা টাকাপয়সার কোন ঘাটতি রাখিনি… ড্রাইভার তো সারাদিন আমার সাথে থাকে… তাহলে কি সে আমার অনপস্থিতিতে…” রেহনুমা আপার চেম্বারে যদি বান্ধবীর প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয় তাহলে কি হবে ভেবে আপাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি সনোগ্রাম আমার হাতে দিন। আমি পরে ওকে বুঝিয়ে দেব। আপাতত আমাদের এখান থেকে দ্রুত সরে পড়া দরকার”। রেহনুমা আপা খুব দুঃখী মন নিয়ে রিপোর্টটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

বান্ধবীকে বাসায় যেতে দিলে কি হতে পারে ভেবে আমার ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম যতক্ষণ না তাকে কিছুটা প্রকৃতিস্থ মনে হোল। সে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলতে লাগল, “একজন বয়স্কা মহিলা… আমি তাকে মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সন্তান তার কাছে রেখে আমি কাজে আসতাম… সে কাকে ঘরে এনেছে… সে লোক যদি আমার সন্তানের কোন ক্ষতি করত… এমন মহিলার হাতে আমি কি করে আমার সন্তানকে রেখে এলাম…”।

পরে তাকে বললাম ভাইয়াকে বলতে যেন তিনি আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘরে আসেন। তারপর ওকে বাসায় দিয়ে আমি বাড়ী ফিরে গেলাম।

বান্ধবী মহিলাকে অনেক বোঝানোর পর মহিলা স্বীকার করলেন আরেক বাসায় ষোল বছর বয়সী কাজের ছেলে এই সন্তানের বাবা। ঐ বাসার লোকজনের সাথে কথা বলে সাব্যাস্ত হোল এদের বিয়ে দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হবে। বান্ধবী কাজ থেকে ছুটি নিল আরেকজন বুয়া না পাওয়া পর্যন্ত।

এটা হয়ত একরকম সমাধান হোল। কিন্তু আমি বুঝে পাইনা, একজন মানুষ কি করে এমন কাউকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটাকে পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে নারাজ?

পরেরবার রেহনুমা আপার চেম্বারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে কথা উঠলো। উনি তখন জানালেন কলেজ ইউনিভার্সিটি, এমনকি স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও এখন তাঁর চেম্বারে এসে আবিষ্কার করে যে যদিও তাদের বিয়ে হয়নি তারা কিভাবে যেন মা হয়ে গিয়েছে! কিন্তু এত বয়সী একজন এমন কাজ করতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, একবার এক মেয়ে তাঁকে বারবার বলতে লাগল, “বিশ্বাস করুন, আমি কোনকিছু করিনি। এসব কি করে হোল আমি কিছুই জানিনা”। একপর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে বলে বসলেন, “তবে কি তুমি নিজেকে মাদার মেরী প্রমাণ করতে চাও?” তখন মেয়েটির প্রেগন্যান্সি সাতমাস পেরিয়েছে। সে যদি এ দায় থেকে বাঁচার জন্য উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে মারাও যেতে পারে। তাই তিনি মেয়েটির বাবামাকে খবর দিতে বাধ্য হলেন। বাবামায়ের অগোচরে এরা যে কি কি করে বেড়ায় তা যদি বাবামা জানতেন তাহলে তাঁদের এত কষ্টের রোজগার, সন্তানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, বিত্তবৈভব সব অর্থহীন বিস্বাদ মনে হত। কি করে পারে একজন মেয়ে তার বাবামায়ের কষ্ট, অবদান, ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান সব ধুলায় লুটিয়ে এমন একটা ছেলেকে বিশ্বাস করতে যার এতটুকু মেরুদন্ড নেই যে সে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে মেয়েটিকে আপন করে নেবে? একজন বোন কি করে ভুলে যায় তার ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব যারা তাকে ভালোবাসে, আদর্শ হিসেবে দেখে? একজন ছাত্রী কি করে তার জীবনের পরম বন্ধু লেখাপড়ার হাত ছেড়ে এমন একজনের হাত ধরে যার নিজের লেখাপড়ার প্রতি, জীবনে কিছু করার প্রতি, তার দায়িত্ব নেবার প্রতি কোন আকর্ষণ নেই? দায়িত্ব নেই কিন্তু প্রাপ্তি আছে, এ’ কেমন ভালোবাসা?

পেপারে যখন পড়ি “সুন্দরী অমুক বলেছে তমুক তাকে ফুসলিয়ে সন্তানের মা বানিয়েছে কিন্তু এখন সন্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা্‌”, তখন দুঃখও লাগে, হাসিও পায়। সে যদি ধর্ষিতা হত তার জন্য সহমর্মিতা এবং বেদনা ব্যাতীত আর কিছুই অনুভব করা কঠিন হত। কিন্তু যে বলে তাকে ঠকানো হয়েছে, তার যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে যে সে বাড়ীর সকলকে ধোঁকা দিয়ে এমন এক ব্যাক্তির সাথে মিলিত হতে পারে যে সর্বসমক্ষে তার সাথে চলাফেরা করতে অনিচ্ছুক, তবে এটা কি করে সম্ভব যে সে বোঝেনা এই ধরণের একটা লোক কখনোই তার সন্তানকে স্বীকৃতি দেবেনা?

মেরী স্টোপ্সে এক আত্মীয়া কাজ করতেন। তাই বাচ্চাদের টিকা দেয়ার জন্য ওখানে নিয়ে যেতাম। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালা, এতগুলো ছোটছোট মেয়ে এখানে কি করে? ওদের তো বাচ্চাও দেখছিনা যে বাচ্চাকে টিকা দিতে এনেছে!” উনি কিচ্ছু না বলে আমাকে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বের করে দিলেন। পরে জেনেছি এই ছোটছোট মেয়েগুলো তাদের প্রেমের খেসারত দিতে এসেছে। তাদের বাবামা জানে তারা কলেজ, ইউনিভার্সিটি বা স্কুলে। কোন কোন ক্ষেত্রে মা নিজেই নিয়ে এসেছেন মেয়েকে। কারো কারো সাথে বয়ফ্রেন্ড। তারপর আবার কিছুদিন পর একই কাহিনীর পুণরাবৃত্তি।

আমি সবসময় বলতাম, “সব মেয়েরা যেমন চায় তাদের বর প্রিন্সের মত দেখতে হবে, আমি কিন্তু চাইনা। কারণ আমি নিজে দেখতে প্রিন্সেসের মত নই। কিন্তু আমি এমন লোকের সাথে থাকার কল্পনাও করতে পারিনা যে আমি আসা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা না করে এখানে সেখানে সৌখিন প্রেম করে বেড়িয়েছে। আমি চাই যে সততা সে আমার কাছে আশা করে, সে সততা যেন আমিও তার কাছে পাই”।

কিন্তু উপরোক্ত অবস্থা দেখে একদিকে মনে হয়, “হায় আল্লাহ, আমি কার কাছে মেয়ে বিয়ে দেব? আমি কি তবে আমার এত আদরযত্নে বড় করা কন্যাকে কোন লম্পটের হাতেই তুলে দিতে বাধ্য হব? কোন্ মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধু করে আনব?” আরেকদিকে মনে হয়, সমাজের অগণিত গুণী এবং কৃতী বাবামা তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েও সঠিকপথে পরিচালিত করতে পারছেন না এই সমাজে যেখানে টিভি, সিনেমা, মোবাইল, পত্রিকা মায় অ্যাডভার্টাইজমেন্টগুলো পর্যন্ত আমাদের সন্তানদের বিপথগামী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই লাম্পট্যের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সমাজে আমি আমার দু’টি সন্তানকে কি করে রক্ষা করব?

আমার ছাত্রছাত্রী, যাদের সন্তানস্নেহে লালন করার পেশা এবং নেশা আমাকে উজ্জীবিত করে, তাদেরই এক এক সময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম- যখন ইনভিজিলেশনের ফাঁকে কেন্টাকী ফ্রাইড চিকেনে ম্যাডামদের সবাইকে একসাথে দেখে ওরা বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়ে যেত, যখন আমার স্যারের বাসায় কার্ড পৌঁছতে গিয়ে অন্ধকার সিঁড়িতে ছাত্রীকে বয়ফ্রেন্ডের থেকে ছিটকে সরে যেতে দেখতাম, যখন ওয়ার সেমেট্রিতে আমার মেয়েকে ফুল দেখাতে নিয়ে গিয়ে দেখতাম কিভাবে ওরা একটা কবরস্থানকে পর্যত্ন রেহাই দিচ্ছেনা, যখন আমাদের বাইকে চড়ে বাড়ী ফেরার পথে কোন বন্ধুর ডাক শুনে পেছনে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ে যেত পেছনের রিক্সায় জড়াজড়ি করে বসা ছাত্রছাত্রীদের হতভম্ব চোখে…। যাকে সন্তানের মত ভালোবাসি তার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করে তোলে। কাকে বিশ্বাস করব আমি? আর কেনইবা তাকে অবিশ্বাস করব যাকে আমি মনে মনে নিষ্পাপ ভেবে এসেছি?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আসলেই এ’ যুগে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন!

Monday, November 22, 2010

চা


আমার বিয়ের সময় কার্ডের যেখানটায় লেখা থাকে ‘দোয়াই কাম্য’- যার অর্থ ‘তবে উপহার দিলে ভালো হয়’- সেখানে লেখা ছিল ‘অনুগ্রহপূর্বক উপহার দেবেন না’। তারপরও যারা নিয়্মভঙ্গ করেছে তাদের একজন ছিলো আমার বান্ধবী সিমিন। সে আমাকে একটা বেডসাইড ল্যাম্প দিয়ে বলেছিল, “জানিস, আমার বিয়ের সময় এক বান্ধবী এরকম একটা ল্যাম্প দিয়েছিল। আমি প্রতিদিন সব কাজ সেরে যখন ঘুমাতে যেতাম, সবশেষে ল্যাম্পটার সুইচ অফ করতাম- ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার শেষ স্মৃতি হত ঐ বান্ধবীর মুখটা। তাই আমার মনে হোল এই ল্যাম্পটা দেই, প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও তুই আমাকে মনে করবি!”


এভাবে অনেক জিনিসের সাথে অনেক স্মৃতি জুড়ে যায়। যেমন মুড়ি দেখলেই আমার নানার কথা মনে হয়। নানা যখন রিটায়ার করল তখন সময় কাটানো জন্য একটা দোকান করল। ঐ দোকান থেকে আমি টিনভর্তি করে মুড়ি মোয়া এনে খেতাম! লিখতে বসলেই বাবার কথা মনে হয় কারণ বাবাকে চিঠি লিখতে গিয়েই আমার লেখায় হাতেখড়ি, পাঁচবছর বয়সেই বাবা একটা ডায়রী দিয়ে বলেছিল, “এতে প্রত্যেকদিন তোমার মনমত কবিতা গল্প কিছু একটা লিখবে”। আর চা দেখলেই মনে পড়ে আলিম ভাইয়ের কথা।


২০০৮ সালের আগস্ট মাসে যখন সিআরটিপি কোর্সে ভর্তি হই, দেখে খুব মজা লাগে যে আমাদের বাংলাদেশীদের দেয়া হয়েছে এক ক্লাসে আর সমস্ত পাকিস্তানীদের দেয়া হয়েছে অন্য ক্লাসে! যেন ওরা জানে যে আমরা একসাথে থাকাটা বিপজ্জনক! আমাদের চাকরী খুঁজে দেয়ার দায়িত্বে ছিল সুজান। সুজানের গ্রুপে আবার আমি ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী ছিলোনা। সত্যি বলতে আমার চাইনিজ বান্ধবী জেনী আর আলজেরিয়ান বন্ধু সামির ছাড়া আর প্রায় সবাই ছিল অন্য ক্লাসের। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় সব পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের দেখা হত সুজানের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে।


একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি আর জেনী দেরী করে মিটিংয়ে পৌঁছে দেখি সব চেয়ার দখল হয়ে গিয়েছে। এক পাকিস্তানী ভাই, বয়সে আমার বড়ই হবেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি বসুন”। আমি একটু অবাক হলাম, সারাজীবন জেনে এসেছি ওদের সাথে আমাদের জন্মজন্মান্তরের শত্রুতা! একটু পরে হিসেব করে দেখা গেল একজন শর্ট। তখন জানলাম যিনি আসেননি তাঁর নাম আলিম শওকত। পরদিন তাঁর সাথে সাড়ম্বরে পরিচয় হোল, তিনি কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছেন এবং খুশী হয়ে শুধু নিজের ক্লাসের জন্যই নয়, উভয় ক্লাসের জন্য ভারী মজার মিষ্টি নিয়ে এসেছেন!


পরে দেখা গেল সুজান আমার আর আলিম ভাইয়ের জন্য একই জায়গায় চাকরীর ব্যাবস্থা করছে। যেদিন ইন্টারভিউ তার আগেরদিন আলিম ভাই এসে বললেন, “চল, জায়গাটা চিনে আসি”। আমার জন্যও ভালো হোল। একা একা ডাউন্টাউনে ঘুরে ঠিকানা বের করার ঝক্কি পোহাতে হোলনা। হাঁটতে হাঁটতে উনি মোটামুটি ওনার চৌদ্দগুষ্টির ইতিহাস বলে ফেললেন, এমনকি নামাজে গাফলতি করার কারণে বৌয়ের কাছে বকা খাওয়ার কাহিনী পর্যন্ত! বুঝলাম উনি পাঞ্জাবী হলেও খুব সরল মনের অধিকারী।


ইন্টারভিউ ওনার ছিল সকালে আর আমার বিকেলে, দু’জনেরই চাকরী হয়ে গেল দু’মাসের জন্য। এখানে এটা খুব মজার ব্যাপার। একসপ্তাহ বা একদিনের জন্যও চাকরী হয়!


যেদিন থেকে যেতে হবে, উনি যোগাযোগ করে ঠিক করলেন আমরা একসাথে হাজিরা দেব। অফিসে গিয়ে দেখলাম আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে পাশাপাশি ডেস্কে। উনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে, সেকেন্ড ইন কমান্ড রোজিটার পাশে আর আমি একেবারে বস কোরিনের দরজার সামনাসামনি। আমার ডেস্ক হোল তিনরাস্তার মোড়ে, যেই যায় ‘হাই’ বলে যায় আর আমি হাই তুলতে তুলতে ‘হাই, হাই’ করতে থাকি। আলিম ভাই বললেন, “তুমি চা খাওয়ার অভ্যাস কর”। অফিসে চা কফি সবার জন্য ফ্রি। পুদিনা, আর্ল গ্রে, হার্বাল, রেড লেবেল, ইয়েলো লেবেল কত রকম যে লেবেল! চিনিও আছে, স্যাকারিনও আছে, দুধ তো আছেই। নেই যা তা হোল অভ্যাস। চা-কফি জীবনে মজা লাগলোনা। কতগুলো গরম গরম পানিতে দুধচিনি মিলিয়ে গলা মুখ জিহ্বা পুড়িয়ে মানুষ কি মজা পায় কোনদিন বুঝলাম না। দশ এগার বছর বয়সে কালেভদ্রে ঠান্ডা করে চা খেতাম বটে কিন্তু যেদিন টের পেলাম এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি দিয়েও আমার মিষ্টি লাগছেনা সেদিন থেকে সব ছেড়ে দিয়েছি।


কিন্তু আলিম ভাই ছাড়ার পাত্র নন। উনি কিছুতেই একা চা খেতে যাবেন না। তাই ওনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য হোক বা আমার বসতে বসতে ক্লান্ত হাড়গুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য হোক, টিরুমে যাওয়াই হত। আর গেলেই উনি চা বানাতেন দুই কাপ। এতরকম দুধ চিনি চাপাতা থাকতে উনি বাসা থেকে ওনার নিজস্ব পছন্দের দুধ চিনি চাপাতা নিয়ে আসতেন। “খাও, খাও, তোমার ঘুম কেটে যাবে”, বলে বলে চা খাওয়াতেন প্রায় জোর করে। আমি মনে মনে বলতাম, “আহারে, আইআইইউসি’র শাহীন, নাজমুন কতবার টেবিলের ওপর চা রেখে গিয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে, ম্যাডাম খায় কি’না দেখি- কত চা ফেলে দেয়া হয়েছে আমার টেবিল থেকে! এখানে এসেও আবার সেই পরীক্ষা! কি আছে এই চায়ে?”


আলিম ভাই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ক্যানাডায় সবাই নিজের কাজ নিজে করে। একসময় শাহীন নাজমুন সব ফটোকপি করে এনে দিত, তখন ভেবেও দেখিনি কিভাবে কি করতে হয়। আর এখানে আমার ফটোকপি কে করে দেবে? উনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে ফটোকপি করতে হয়। আমি খুব দ্রুত কাজ করি। কিন্তু ক্যানাডিয়ানরা কাজ করে আস্তেধীরে রয়েসয়ে- কতক্ষণ গল্প করে, কতক্ষণ নেটে চ্যাট করে, নেটসার্ফিং করে- অফিসে অর্ধেক সময়ের বেশী কাজ করেনা, তাই কেউ বেশী কাজ করলে সে তাদের চক্ষুশূল হয়ে যায়। উনি আমাকে শেখালেন কিভাবে কাজ শেষ হয়ে গেলেও ধৈর্য্য ধরে বসে সময় কাটাতে হবে। আর যেটা শেখালেন সেটা হোল ‘ডিপ্লোমেসি’ যেটা আমার একেবারেই নেই।


আমার সরাসরি কথাগুলোকে উনি আবার মেজেঘসে সহনীয় করে তুলতেন। যেমন, একবার আমাদের কোম্পানীর আরেক শাখার অফিস থেকে এক মহিলা কিছু সময়ের জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে এলেন। ক্রীস্টমাসের কয়েকদিন আগে উনি খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “তা তোমরা ক্রীস্টমাসের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ?” আমি জানতাম এদের অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রায় কোন ধারণাই নেই। বললাম, “আমরা তো ক্রীস্টমাস করিনা!” মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “তোমরা কি ক্রীস্টমাস একটুও করনা?” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, “তোমরা কি ঈদ একটুও করনা?” তার আগেই আলিম ভাই বললেন, “হ্যাঁ, আমরা একটু একটু করি। রেহনুমা চল, আমাদের ক্রীস্টমাসের শপিং করতে হবে!”


আরেকদিন ট্রেন স্টেশনে যেতে যেতে দেখি এক মহিলা কুকুর কোলে নিয়ে, কুকুরের দিকে তাকিয়ে একহাতে তাকে আদর করতে করতে গাড়ী চালাচ্ছে। আহ্লাদের সীমা নেই! মানুষ চাকার নীচে পড়বে মাথাব্যাথা নেই, কুকুরের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালায়! আলিম ভাইকে দেখালাম, উনি বললেন, “কুত্তা মাত বোলনা, উয়ো তো উসকা বাচ্চা হ্যায়!” (কুকুর বোলনা, ওটা তো ওর সন্তান!)


নতুন বাবা হবার উচ্ছাস কাছে থেকে দেখেছি আলিম ভাইয়ের মধ্যে, “আজ আমার মেয়ে হেসেছে, আজ সারারাত ও কেঁদেছে আর আমি ওকে কোলে নিয়ে হেঁটেছি, ওর মা কি করে? আমিই তো আমার মেয়েকে দেখি!” নতুন মাদের কথা প্রায়ই শোনা যায়, তারা কিভাবে উচ্ছসিত, উত্তেজিত, পুলকিত হয়। বাবাদের অনুভূতিটা থাকে অনেকটা আগোচরে। তাই ওনার মেয়ে নিয়ে এই আদিখ্যেতা আমার খুব মজা লাগত।


ওনার সাথে প্রায় সকালে ট্রেনেই দেখা হয়ে যেত যেমন হত বাংলাদেশী দুই বন্ধু তানজীন আর ইফতেখার ভাইয়ের সাথে অথবা বাল্যবন্ধু তিথির সাথে। ফেরার সময় আমরা একসাথেই স্টেশনে যেতাম, সাথে নিয়ে নিতাম তিথিকে। মজার ব্যাপার হোল, তিথি আর আমি একই বিল্ডিংয়ের দুই টাওয়ারে কাজ করতাম। একবার ও আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল লাঞ্চের সময়। আলিম ভাই কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “আমি তোমার জন্য স্টেশনে যাবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করি আর তুমি আমাকে বাদ দিয়ে বান্ধবীর দাওয়াত খেতে যাও!” সিআরটিপির ইরানী বন্ধু আফশীন আর চাইনীজ বান্ধবী জেনী আমাদের কোম্পানী অ্যাল্টাগ্যাসে জয়েন করার পর থেকে চারজনে মিলে লাঞ্চ করার মজাটাই ছিল আলাদা। তাই তিথির সাথে মূলত বেরোবার পথে একত্রে যাওয়া হত। অনেক সময় ট্রেনে দু’জনে গল্প করতে করতে ভুলেই যেতাম আমার স্টপ তিথি আর আলিম ভাইয়ের দুই স্টেশন আগে। আলিম ভাই ডাক দিয়ে বলতেন, “তোমাদের দুই বান্ধবীর কি গল্প শেষ না তুমি আমাদের স্টেশনেই নামবে ঠিক করেছ?”


এখানে সরকার বেকারদের জন্য নানাপ্রকার ব্যাবস্থা রেখেছে। এই ব্যাবস্থার অধীনে আলিম ভাই কিছুদিন পর পর সরকারের কাছে টাকা বা খাবার পেতেন। একবার ৪০ ব্যাগ খাবার পেয়ে তিনি বিপদে পড়ে গেলেন, দু’জন মিলে এত খাবার শেষ করবেন কি করে? ব্যাস, পরদিন ব্যাগ ভরে আলু আর ম্যাকারনি নিয়ে এলেন আমার জন্য! কি মুস্কিল বলুন তো! অফিস থেকে বাসায় যাব দুই বস্তা খাবার নিয়ে! পরে বেচারা নিজে স্টেশন পর্যন্ত বস্তাগুলো বহন করে দিলেন। তবুও খাবারগুলো কারো কাজে লাগুক।


এভাবে কখন যে দু’মাস কেটে গেল টেরই পেলাম না। শেষদিন আমাদের গ্রুপের ঈজিপ্সিয়ান ছেলে খালিদ সবাইকে উপহার দিল, আমাকে যে কাজ শিখিয়েছিলেন সে বৃদ্ধ ওয়েন আমাদের কফি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন, আর কোরিন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরল তখন আলিম ভাই আতংকে পিছিয়ে গিয়েও রক্ষা পেলেন না। আমাকে ছেড়ে সে বিশালদেহী বয়স্কা বস যখন ওনাকে জড়িয়ে ধরল তখন ওনার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মত! আমার হাতটা নিশপিশ করছিল একটা ক্যামেরার জন্য।


তবে সেই শেষমূহূর্তে উনি ঠিক করলেন শেষ একবার অফিসে বসে চা খেতে হবে! আমি গোঙ্গাতে শুরু করলাম, “না্…”। কিন্তু কোন কাজ হলনা। তিনি খুব যত্নসহকারে চা বানালেন, বাকী চায়ের সরঞ্জামাদি অফিসে দান করে দিলেন, তারপর খুব উপভোগ করে চা পান করতে শুরু করলেন। ততদিনে আমি চায়ের ওপর তিক্তবিরক্ত। বেচারা অন্যদিকে ফিরে কথা বলার সময় কায়দা করে অর্ধেক কাপ চা বিসমিল্লাহ বলে দিলাম সিঙ্কে ঢেলে!


কিন্তু এখন যেখানেই চা দেখি, আলিম ভাইয়ের কথা মনে হয়, ওনার আন্তরিকতার কথা মনে হয়। আমি পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু চা জিনিসটা মনে হয় আসলে এত খারাপ না!

Tuesday, November 16, 2010

একজন বেহেস্তী নারী


একদিন অফিসে কাজ করছি, এমনসময় পিয়ন এসে বল্ল, “আপা, এক মহিলা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে, ভিজিটর্স রুমে বসে আছেন”। আমি হাতের কাজটা গুছিয়ে নিতে নিতে সে ফিক করে হেসে বল্ল, “আপা, মহিলা মনে হয় পাগল!”, তারপর হঠাৎ আমার ঈষৎ বিরক্ত চেহারার দিকে চোখ পড়তে সে আর কথা না বলে কেটে পড়ল।

দু’মিনিট পর ভিজিটর্স রুমের দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখি এক বিরাটাকার মহিলা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গর্ভবতী, উদ্ভ্রান্তের মত চুল, ওড়না মাটিতে গড়াচ্ছে কোন খেয়াল নেই- মহিলা কে চিনতে পারলাম না। ভেতরে ঢুকতেই সে হঠাৎ তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠা মানুষের মত আমার হাত দু’টো চেপে ধরে বল্ল, “রেহনুমা, তুই আমাকে বাঁচা!” কোন সম্ভাষন নেই, পরিচিতি নেই … চেহারাটা কাছে থেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, “রিমা না? কি রে তোর এই অবস্থা হয়েছে কি করে? কি হয়েছে তোর?” এই বান্ধবীকে আমি কোনদিন একটা চুল এদিক ওদিক হতে দেখিনি। ভীষণ রুচিশীল আর শৈল্পিক একটা মেয়ে ছিল সে। বিয়ে হয়েছিল আপন ফুপাত ভাইয়ের সাথে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সে ভালো আছে যেহেতু ফুপু নিজে ওকে চেয়ে নিয়েছিলেন। বিবাহিতা বান্ধবীদের সবার খোঁজখবর করা হত ওরা ভালো আছে কি’না, রিমার খোঁজ কোনদিন করা হয়নি। সে নিজেও সব বান্ধবীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে কেউ ভাবেনি সে কষ্টে আছে। এখন ওকে দেখে ভীষণ অপরাধবোধ হতে লাগল। তাড়াতাড়ি ওকে বসালাম। ওর জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করলাম। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর এই অবস্থা হোল কি করে।

রিমার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। সে যা বল্ল তার সারমর্ম হোল, বিয়ের পরদিন থেকেই ফুপু কেবল শ্বাশুড়ীই হয়ে গেলেন, যেই ফুপু ওকে এত আদর করতেন তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলনা। উনি উঠতে বসতে ওকে কথা শোনাতেন, জ্বালাতন করতেন, অন্য বৌকে ওর সামনে আদর করতেন আর ওদের সামনে ওকে হেয় করতেন। ও নিজেই বুঝে পেলনা ও কি অন্যায় করেছে। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হবে মনে করে ও ওর বাবামা বা আর কোন আত্মীয় পরিজনকেই এ’কথা বলতে পারলনা। বান্ধবীরা শুনলে কি মনে করবে ভেবে সে আমাদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একসময় ওর নিজের ওপরেই ঘৃনা চলে এলো, “আমি যদি এতি খারাপ হই তাহলে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?” স্বামীর কাছ থেকেও সে কোন সহযোগিতা পেলনা, পেল সহানুভূতি কিন্তু সেটা ওকে এই সার্বক্ষণিক মানসিক অত্যাচার থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখেনা। একসময় ও বুঝতে পারল ওর মধ্যে আরেকটি জীবনের অস্তিত্ব। এ’সময় মেয়েরা শারিরীক মানসিক উভয় দিক থেকে স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু অত্যাচার কমলোনা। এমতাবস্থায় সে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতে শুরু করল। হঠাৎ একদিন পেপারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে ওর মনে হোল নিজের জন্য না হোক, ওর অনাগত সন্তানের জন্য ওকে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। তাই সে এসেছে আমার কাছে।

আমি তখন নিজেই লজ্জায় মারা যাচ্ছি যে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমরা কেউ ওর একটা খবর পর্যন্ত নিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম আমি কিভাবে ওকে সাহায্য করতে পারি। ও বল্ল, “তুই যেভাবেই হোক আমার জন্য একটা চাকরীর ব্যাবস্থা কর। আমার পাগল হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে হবে। আমার যেকোন উসিলায় দিনের অন্তত কিছুটা সময় বাসার বাইরে থাকা দরকার। প্রতিদিন অন্তত কিছুক্ষণ আমি স্বাভাবিক লোকজনের সাথে মিশতে চাই, স্বাভাবিক কাকে বলে আমি ভুলেই গেছি”। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, “তুই যেটা চাচ্ছিস সেটা যে আমার জন্য কত কঠিন ব্যাপার! দু’মাস পরে বাচ্চা হবে এমন কাউকে কোন প্রতিষ্ঠানেই নিতে চাইবেনা কারণ এর সাথে আছে ম্যাটার্নিটি লীভ, বেতন আর ঈদ বোনাসের ব্যাপার”। কিন্তু ওর চেহারা দেখে সাহস হোলনা ওকে ক’মাস পর আসতে বলি, হয়ত ততদিনে সে আত্মহত্যা করেই বসবে!

ওকে বসিয়ে রেখে ভেতরে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সবার সাথে কথা বললাম। সবার আগেই উঠে আসল ম্যাটার্নিটি লীভ, বেতন আর ঈদ বোনাসের ব্যাপারটা। চাকরীর দু’মাসের ভেতর যাকে এতসব সুবিধা দিতে হবে তাকে নেয়া আদৌ যৌক্তিক কি’না। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হোল আগে পরীক্ষা নিয়ে দেখা যাক আদৌ সে চাকরীর জন্য উপযুক্ত কি’না। ওকে তিনদিন পর পরীক্ষার জন্য আসতে বললাম প্রস্তুতি নিয়ে, পরিপাটি হয়ে।

আশা মানুষের মধ্যে কি অদ্ভুত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে স্বচক্ষে দেখলাম তিনদিন পর। রিমাকে দেখে মনে হোল যেন আমাদের আগের সেই রিমা। সে পরীক্ষা দিল এমনভাবে যেন এর ওপর ওর জীবনমরণ নির্ভর করছে। লৈখিক পরীক্ষায় অসম্ভব ভালো করাতে প্রতিষ্ঠান ওকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকতে বাধ্য হোল। আমি ওকে বলে দিলাম যে এই ইন্টারভিউর ওপরেই নির্ভর করছে ওর চাকরী পাওয়া না পাওয়া- আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকব সুতরাং ওর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু ইন্টারভিউ ভালো না হলে আমি বোর্ডে থেকেও ওকে কোন সাহায্য করতে পারবনা।

সে আমাকে নিরাশ করলনা। ইন্টারভিউতে সে বল্ল, “এই চাকরীটাই হবে আমার আসল জীবন, সুতরাং আমি যে সিন্সিয়ারলি কাজ করব এ’ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমি চেষ্টা করব ম্যাটার্নিটি লীভ সংক্ষিপ্ত করতে আর আমাকে এ’সময় বেতন বা ঈদ বোনাস না দিলেও আমার কোন সমস্যা নেই”। ওর চাকরী হয়ে গেল।

রিমা এত ভালো কাজ করতে লাগল যে অল্প দিনের মধ্যেই ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ওকে অনেক স্বাভাবিক আর প্রাণবন্ত মনে হতে লাগল। দিনের একটা সময় হাসিখুশী থাকায় এবং লোকজন ওকে অ্যাপ্রিশিয়েট করায়, বাসায় যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা ওকে আগে কষ্ট দিত সেগুলো ওকে আর ওভাবে স্পর্শ করতে পারতনা। দু’মাস পর ওর একটা ফুটফুটে ছেলে হোল। সাতদিন পরই ও আবার ছেলে নিয়ে আসতে শুরু করল। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওকে মানা করা হোল, জানানো হোল ও তিনমাস থেকে চারমাস ছুটির হকদার। কিন্তু ও আমাকে ডেকে বল্ল, “তুই কি ভাবিস আমি তোদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সাতদিনের মধ্যে চলে এসেছি? আমি বাসায় থাকলে মরে যাবো রে!”

আমার প্রথম সন্তান হবার পর আমাদের প্রতিষ্ঠানে বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। খুব বেশী কিছু না, একটা রুম, রুমজোড়া বিছানা আর বাচ্চা দেখার জন্য একজন মানুষ। খেলনা আর খাবার মায়েরা নিয়ে আসবে। আমার সন্তানের জন্য এইসব ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। আমার মেয়ে বড় হয়ে যাবার পর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই লোক রাখা হয়। তারপর থেকে মহিলা কর্মীরা তাদের শিশু সন্তানদের সাথে নিয়ে আসতে পারতেন। তাহলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেরাই সন্তানদের তদারক করতে পারতেন। এতে যেটা লাভ হয় তা হোল মায়েরা তাদের কাজের ব্যাপারে আরো আন্তরিক হয়ে যান এবং বাসায় ফেরার কোন তাড়া থাকেনা। রিমা এখানে বাচ্চা রাখতে শুরু করল আর ওর কাজ কমিয়ে দেয়া হোল যেন সে যথেষ্ট বিশ্রাম পায়।

দিনে দিনে ওর সুনাম আরো বাড়তে লাগল, ওর আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো, ওর স্বামী ওকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করল। ওদিকে ওর শ্বাশুড়ী যখন দেখলেন উনি ওকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, উনি মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন সে চাকরী ছেড়ে দেয়। আমরা সবাই ওকে পরামর্শ দিলাম ও যেন ভুলেও এই কথায় কান না দেয়। এদিকে ঝামেলা করে কোন ফলাফল হবেনা বুঝতে পারে উনি ছেলেকে চাপ দিতে শুরু করলেন, “আমি বাসায় থাকতে বৌ নাতি নিয়ে চাকরীতে যাবে কেন?” সাত মাসের সময়ই রিমার ছেলে একটু একটু হাঁটতে, কথা বলতে শুরু করেছিল। ন’মাসের সময় উনি সফল হলেন। রিমা ছেলেকে শ্বাশুড়ীর কাছে রেখে আসতে বাধ্য হোল।

একদিন বাসায় ফিরে রিমা একটু অবাক হোল। ওর ছেলে এত চঞ্চল প্রাণবন্ত, ঘরময় ঘুরে বেড়ায়, বকবক করে- সে কেন চুপচাপ শুয়ে আছে? হাত পায়ের পর্যন্ত কোন নড়াচড়া নেই! সেই ছেলে আর কোনদিনই নড়াচড়া করলোনা। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, বিদেশ নিয়ে গিয়েছে কিন্তু সবাই বল্ল ওর ব্রেনের ভেতরে কোন গুরুতর আঘাতে ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। অনেক পরে সে জানতে পেরেছিল যে ওর একবছরের শিশু ওর শ্বাশুড়ীর সামনেই কাজের মেয়ের হাত থেকে লাফ দিতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে নীচে পড়ে গেছিল। উনি যদি সাথে সাথে জানাতেন হয়ত কিছু করা গেলেও যেতে পারত। কিন্তু বাচ্চার জ্বর বা দুর্বলতা জাতীয় স্বাভাবিক কোন অসুখ ভেবে প্রায় দু’মাস অপেক্ষা করার পর যখন ওরা ডাক্তারের কাছে যায় তখন বাচ্চা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।

রিমাকে চাকরী ছেড়ে দিতে হোল। হয়ত অপরাধবোধ থেকেই ওর শ্বাশুড়ী ওকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। ওকে আলাদা বাসা নিতে হোল। তার কয়েকবছর পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যান্য বৌরা শ্বাশুড়ীকে দেখাশোনা করতে অপারগতা প্রকাশ করল। ওনার ঠাঁই হোল এই রিমার বাসায়। ওর শ্বাশুড়ী আর ছেলে একই রুমে থাকত। ওনার ‘পাওয়ার প্লে’র সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে ওনার কেমন লাগত জানিনা। তবে রিমা এই দুই রোগীকে নিয়ে কি আমানুষিক পরিশ্রম করেছে আমরা দেখেছি। ছেলে ততদিনে অনেক বড় হয়েছে, রিমার মতই বড়সড় গোছের। একবার ছেলেকে খাওয়ায় খাবার গ্রাইন্ড করে পাইপ দিয়ে, আবার শ্বাশুড়ীকে খাওয়ায়। একবার ছেলেকে কোলে করে বাথ্রুমে নিয়ে যায়, আবার শ্বাশুড়ীকে আলগে বাথ্রুমে নিয়ে যায়। এভাবে কয়েকবছর যাবার পর ওর শ্বাশুড়ী গ্রামে ঈদ করার শখ করলেন। এই অসুস্থ বাচ্চা শ্বাশুড়ী সব নিয়ে সে গ্রামের বাড়ী গেল বেশ কয়েকবার বাস নৌকা পরিবর্তন করে। ঈদের পরদিন উনি কোরবানীর গরুর নেহারী খেতে চাইলেন। রান্নার মধ্যখানেই রিমা শুনলো ওর শ্বাশুড়ীর শ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি ওনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য নেহারীর ঝোল অল্প চামচে করে এনে খাওয়ালো। সে ফিরে আসার পর যখন ওর সাথে দেখা করতে গেলাম ও বারবার বলতে লাগল, “আহারে, নেহারীতে বাগাড় দেয়ার আগেই উনি মারা গেলেন। বাগাড় ছাড়া ঝোলই ওনাকে দিতে হোল”। আমি ওর দিকে হা করে চেয়ে রইলাম। যে ওকে এতটা কষ্ট দিয়েছে যে এত বিশাল শক্তপোক্ত একটা মেয়ে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গেছিল, ওর প্রথম সন্তানকে পঙ্গু করে দিয়েছে চিরতরে, তার জন্য সে দুঃখ করছে, “বাগাড় ছাড়া ঝোল ওনাকে দিতে হোল”!

ক্যানাডা আসার আগে গেছিলাম ওর সাথে দেখা করতে। ওর ছেলেটাকে খাওয়ানোর পর ও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল পরবর্তী সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে। ওদের পাঠিয়ে ছেলের রুমে গিয়ে দেখে ওর গাল বেয়ে যে লালা পড়েছে সেখানে অসংখ্য পিঁপড়া, পিঁপড়ের কামড়ে গাল লাল হয়ে ফুলে গিয়েছে কিন্তু বেচারার হাত চলেনা যে সে পিঁপড়েগুলোকে সরিয়ে দেবে, কথা বলতে পারেনা যে মাকে ডেকে বলবে। ওর কথা শুনে দুঃখে আমার চোখ জ্বলতে লাগল। কি বলে সান্তনা দেব খুঁজে পেলাম না তাই চুপ করে রইলাম। কিন্তু রিমা নিজেই বল্ল, “জানিস, আমার এই ছেলে নিয়ে আমার অনেক দুঃখ। কিন্তু এর বিনিময়ে আমি অনেক কিছু পেয়েছি যা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। আমি আগে কখনো নামাজ পড়িনি। কিন্তু আমার ছেলের এই অবস্থার পর থেকে আমি নামাজ পড়া শুরু করেছি আর ছাড়িনি। আল্লাহকে খুব কাছে মনে হয়। ওনার কাছে যখনই যা চাই তা পাই। আমি একসময় খুব উৎশৃংখল ছিলাম। কিন্তু এখন আমি ভালো কোনটা খারাপ কোনটা বুঝি এবং খারাপের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি। একসময় পর্দার ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিলোনা। এখন আমি পর্দা করে চলি। আগে পথের ধারে যেই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়েও দেখতাম না তাদের জন্য এখন খুব মায়া লাগে, কিছু করতে ইচ্ছা করে। আমি নিজেই বুঝি যে আমি এখন কোন ব্যপারে কষ্ট পাইনা, কেউ আমাকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা যদি আল্লাহ আমার সাথে থাকেন”। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম রিমার দিকে। আমার এই বান্ধবী একসময় বিশাল আকারের শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয়েও কথার আঘাত সইতে না পেরে নিজেকে ধ্বংস করে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। আর আজ সে এত সহ্যাতীত দুঃখের ভেতরেও পাহাড়ের মত শান্ত অটল! বিশ্বাস বুঝি একেই বলে! ওকে দেখে আমার মনে হোল আমি এক বেহেস্তী নারীর দিকে তাকিয়ে আছি!

Tuesday, November 9, 2010

ছাত্রীজীবনের স্মৃতি – কলেজ জীবন




ইন্টারমিডিয়েটের দু’টো বছর আমার জীবনে আলোর রশ্মি হয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছিল বান্ধবী শিখা সাহা। ভীষণ মায়াভরা দু’টো উজ্জ্বল চোখ ছিল ওর জোড়া ভ্রূর নীচে, শ্যামলা মিষ্টি চেহারার সাথে লম্বা লালচে চুল। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল ওর অসম্ভব সুন্দর মনটা। কারো বিপদে সে সবার আগে এগিয়ে যেত, কারো মনখারাপ হলে সাহচর্য দিত, কারো সাহায্যের প্রয়োজন হলে সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করত।

কিভাবে ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার নিজেরও মনে নেই। তখন আমরা আবুধাবী থেকে দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছি। এর আগে চট্টগ্রামে কখনো থাকা হয়নি, আত্মীয়স্বজন সব ঢাকায়। বাবার সাথেই বন্ধুত্ব ছিল বেশী। কিন্তু চাকরী ছেড়ে দেশে চলে আসার পর যাদের বাবা এত বছর ধরে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে এখন সাহায্য করার সামর্থ্য না থাকায় তাদের দুর্ব্যাবহারে আশ্চর্য তিক্ত বিরক্ত অসুস্থ হয়ে বাবাকে আমেরিকা চলে যেতে হোল। একটা নতুন জায়গায় এসে সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব একা সামাল দিতে গিয়ে মা তার সন্তানদের থেকে দূরে সরে গেল। এসময় আমরা তিন ভাইবোনই ছিলাম একে অপরের একমাত্র বন্ধু।

কলেজে গিয়ে দেখি এখানকার ছাত্রীরা বিদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের চেয়ে চিন্তাভাবনা আচারআচরণ কথাবার্তায় অনেক অগ্রসর, কাটা কাটা কথা বলে, অন্যকে কষ্ট দিতে কিছুমাত্র বিচলিত হয়না- ওদের দেখলে আমার ভয় লাগত। শিক্ষকরাও দেখি ছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিবর্তে নিজেদের আকাশচারী ফেরেস্তার মত কিছু মনে করে সে ধরণের আচরণ করতেন। নিজেকে ভীষণ একা মনে হত। আর ক্লাসের সবাই আমার সামনেই বলত আমাকে দেখলে ওদের মনে হয় আমি মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা কোন আজব প্রাণী। এ’সময়ই আমার শিখার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর থেকে দু’বছর আমাদের আর কখনো কেউ আলাদা দেখেনি।

আমি ওর নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ মনটাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। শিক্ষক পানি চাইলে সে তিনতলা থেকে নেমে নলকূপ থেকে পানি এনে দিত, সে শিক্ষককে যিনি ওর নামটাও জানার প্রয়োজন মনে করতেন না, যাঁর মুখ থেকে একটা ‘ধন্যবাদ’ উচ্চারিত হতনা কখনো। বিদেশ থেকে এসে দেশের আবহাওয়া পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে আমাদের ভাইবোনদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শরীর প্রায়ই খারাপ হয়ে যেত। কতবার শিখা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে গিয়ে আমার বাসায় ফোন করে জানিয়েছে যেন বাসা থেকে কেউ এসে নিয়ে যায় যদিও ও প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে খুব ভয় পেত। প্র্যাক্টিকালের সময় সবার সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ডেমন্সট্রেশন দেখতে পারতাম না। শিখা ছোটখাটো ছিল, তাই সামনে দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ পেত। পরে ও আমাকে আলাদা করে সব প্র্যাক্টিকাল শিখিয়ে দিত। ব্যাঙ, কেঁচো ধরতে ভয় পেতাম বলে ও ট্রেতে আটকে দিত। আর আমি? আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি। মাঝে মাঝে ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে যেতাম বাগান থেকে। মালা গাঁথতে গাঁথতে ঢাকায় থাকার দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতাম যখন ছোটবেলায় বান্ধবীরা দল বেঁধে শিউলী বা হিজলের মালা গাঁথতাম।

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, শিক্ষকদের ব্যাবহার সব মিলে পড়াশোনায় মন ছিলোনা মোটেও, পাশ করার আশা বা ইচ্ছা কোনটাই ছিলোনা। একদিন শিখা বাসায় এসে জানালো কলেজে ফর্মফিলাপ চলছে, আমি ফর্ম জমা দিয়েছি কি’না। আমি বললাম, আমি জানিইনা কিছু এ’ব্যাপারে। ও মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকে নিয়ে গেল ফর্মফিলাপ করতে, নিজ হাতে ফর্ম ফিলাপ করল, টাকা জমা দিল, আমার ছবি ছিলোনা বলে কলেজের পাশের স্টুডিওতে নিয়ে ছবি তোলালো, পরদিন তারিখ শেষ তাই আমি কলেজে পৌঁছনোর আগেই দোকান থেকে ছবি নিয়ে অফিসে জমা দিয়ে দিল।

শিখা না থাকলে আমার পরীক্ষাই দেয়া হতনা। কিন্তু এই শিখাকেই হারিয়ে ফেললাম কয়েকবছর পর। তারপর কত যে খুঁজেছি, কতভাবে যে খুঁজেছি! পাইনি।

ওর মত পবিত্র মনের অধিকারী মেয়ে আমি দেখিনি বললেই চলে। সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলেও জানি কারো জীবনে দীপ্তিময়ী হয়ে আছে নিশ্চয়ই। দোয়া করি সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক; আমার মত অন্য কারো জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করুক।




আগামীকাল এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। পড়তে ইচ্ছা করছেনা। আর পড়ে কি হবে? গত দু’বছর আমি বই ছুঁয়েও দেখিনি, কোন পরীক্ষা পাশ করিনি, এখন পড়ে কি করব? বাবা এসেছে, মন ভালো। কিন্তু পাশ করা সুদূরপরাহত। রাত আটটা বাজে তখনো আমার পড়াশোনা করার কোন ইচ্ছা বা লক্ষণ নেই। বাবা বল্ল, “কাল কি পরীক্ষা?”
“ইংরেজী- ফার্স্ট আর সেকেন্ড পেপার।”
“পড়তে ইচ্ছে করছেনা?”
“না”।
“মনোপলি খেলবি।”
“হ্যাঁ”।
“চল”।
এইজন্যই আমার বাবাকে এত ভালো লাগে। কোন চাপাচাপি নেই। এসএসসিতে ছাড়া কোনদিন অংকে পাশ করিনি, বাবা কিছু বলেনি; ক্লাসের বই ছাড়া সব বই পড়তাম, বাবা সোৎসাহে কিনে দিত; কাল এইচএসসি পরীক্ষা আর পড়তে ইচ্ছা করছেনা দেখে বাবা মনোপলি খেলতে ডাকছে! বান্ধবীরা বলত, ‘এ’তো স্বপ্নের বাবা!’

রাত দশটা পর্যন্ত খেলে ঘুমাতে গেলাম। রাত একটার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম পরীক্ষা দিলে কি হবে আর না দিলে কি হবে? সিদ্ধান্তে এলাম যদি পরীক্ষা দেই ফেল করার সম্ভাবনা ৯০% যেহেতু শুধু আউটনলেজের ভিত্তিতে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু যদি ভাগ্যক্রমে পাশ করে যাই তাহলে আর এই কলেজের আঙ্গিনা মাড়াতে হবেনা। শেষের যুক্তিটা এত আকর্ষণীয় মনে হোল যে সাথে সাথে উঠে প্রায়নতুন বইগুলো নিয়ে বসে গেলাম। নৈঃশব্দের মধ্যে পড়া খুব ভালো হয়। সকাল ছয়টা পর্যন্ত পড়ে মনে হোল পাশ করলেও করতে পারি। তাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আটটার সময় বাবা জিজ্ঞেস করল, “কি রে, পরীক্ষা দিবি?” আমি হাই তুলে বললাম, “দিয়ে দেখি”।

প্রথমদিন দু’পেপার ইংরেজী দিয়ে আমার সর্বাঙ্গে ব্যাথা। এত সময় বসে থাকা হয়নি বহুদিন। বাসায় এসে পড়ব কি আহা উহু করতে করতে প্রাণ যায়! আমার ছোটভাই আহমদের হাতে যাদু আছে। ও কিছুক্ষণ ঘাড় টিপে দেয়ার পর যেন আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি থাকেনা কোন পরীক্ষার সময়ই। তাই সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে আবার রাত বারোটায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, সকাল ছ’টা পর্যন্ত পড়ে আটটা পর্যন্ত ঘুম, তারপর পরীক্ষা দিতে যাওয়া। বাকী সব পরীক্ষা এভাবেই দিয়েছিলাম।




প্র্যাক্টিকালে বরাবরই কাঁচা ছিলাম। প্রথমদিন ছিল বায়োলজি। সকালে বোটানী আর বিকেলে জুওলজি। সকালে লাউয়ের ডাঁটার প্রস্থচ্ছেদ। কিছুতেই যথেষ্ট পাতলা হয়না। শিখা ধারে কাছে কোথাও নেই, আমার গ্রুপেই নেই। ল্যাব হেল্পার আংকেল এসে বললেন, “তুমি এত মোটা মোটা করে এগুলো কি কাটছ? তোমার পাশের ওকে দেখ, কি সুন্দর পাতলা পাতলা করে কাটছে!” পাশের বান্ধবীর লাউয়ের ডাঁটা কাটা দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের ট্রের দিকে তাকালাম। যেটা সবচেয়ে পাতলা মনে হোল সেটা মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে যা থাকে কপালে ভেবে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি ছিলাম দরজার পাশেই তাই এক্সটার্নাল স্যার এসে সবার আগে আমারটাই দেখলেন। দেখে উনি ভীষণ অভিভূত হয়ে গেলেন, এত সুন্দর কাটা উনি কমই দেখেছেন! আমি তো থ, বলে কি? উনি পুরো রুম দেখে এসে আবার আমার প্রস্থচ্ছেদের প্রশংসা করে চলে গেলেন। পরে জেনেছিলাম আমি যখন বান্ধবীর লাউয়ের ডাঁটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছি তখন আংকেল আমার লাউয়ের ডাঁটা কেটে রেখে গেছিলেন। আহা! কত মায়া ছিল মানুষটার মনে!

বিকেলে ছিল জুওলজি। শিখাদের গ্রুপ সকালে তেলাপোকা কেটে সব তেলাপোকা শেষ করে ফেলেছে। তাই আমাদের ভাগ্যে পড়ল ব্যাঙ। আমি মোটামোটি ব্যাঙ বেচারার বাইরেটা কেটে শেষ করেছি, নাড়িভুড়ি তখনো বের করতে পারিনি, শুনি আমার মৌখিক পরীক্ষার ডাক পড়েছে। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার রোল সবার শেষে, অর্থাৎ আমার মৌখিক শেষ হলেই স্যার ব্যাঙ দেখতে আসবেন। আমি দরজার পাশেই, সুতরাং এসেও ব্যাঙ কাটা শেষ করার সময় পাবোনা। কিন্তু কিছুই করার নেই।

মৌখিক পরীক্ষার ব্যাপারে আমার কোনকালে ভয়ডর ছিলোনা। কিছু না পারলেও তো আর আমাকে মারতে মায় কামড় দিতে পারবেনা! গিয়ে দেখি স্যার অভিনব পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছেন। দু’জন করে একসাথে ডেকে তাদের একজনকে দিয়ে আরেকজনের পরীক্ষা নিচ্ছেন, কিছুক্ষণ পর যে টিকে যাচ্ছে তাকে তিনি নিজে প্রশ্ন করছেন। সাথের বান্ধবী ছিল লাজুক ধরণের তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি টিকে গেলাম। প্রশ্নপর্ব শেষ করে স্যার গল্প করতে শুরু করলেন। বান্ধবী খুব মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল কিন্তু আমার মাথায় কাজ করছে আমার ব্যাঙ-এর কি হবে?

পরীক্ষা শেষে যেতে যেতে দেখি স্যার আমাদের পিছু পিছু আসছেন। আমার তো মাথায় বাড়ি! এখন কি হবে? প্রথমেই স্যার এলেন আমার ব্যাঙ দেখতে, আমি চোখ বুজে রইলাম। শুনি স্যার বলছেন, “বাহ, যেমন ভাইভা তেমন ব্যাঙ কাটা!” আমি মনে মনে ভাবছি, “আমার ভাইভা তো এত খারাপ হয়নি!” উনি ম্যাডামের দিকে ফিরে বললেন, “ও ভাইভাতে খুব ভালো করেছে”। ম্যাডাম ভারী সুন্দর একটা হাসি দিলেন। আমি ভাবলাম এই আধাকাটা ব্যাঙ-এর মধ্যে কি দেখে উনি এত খুশী হয়ে গেলেন? অনুসন্ধান করার জন্য খুব সাহস করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ব্যাঙ ভারী সুন্দর করে কাটা, নাড়িভুড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!পরে জানলাম আমাদের দেরী দেখে ম্যাডাম নিজেই আমার বাকী কাজ সম্পন্ন করেছেন! ধন্যবাদ ম্যাডাম!




সেদিন বিকেলে বাবার এক বন্ধু নববিবাহিতা আন্টিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আংকেল আমেরিকা ফিরে যাচ্ছেন, তাই। আন্টি মাত্র ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছেন, পড়াশোনার সাথে তখনো সংশ্লিষ্ট। উনি আমাকে দেখে বললেন, “তোমার রেজাল্ট কি?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “কিসের রেজাল্ট?” উনি একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুমি ইন্টার দিয়েছ না এ’বছর?” আমি বললাম, “জ্বী”। উনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললেন, “এইচএসসি’র রেজাল্ট দিয়েছে তো চারদিন হোল। তুমি জানোনা?” এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আমি নিজেই ভুলে গেছিলাম যে পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট আসে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়! আমার মত ঝাড়াহাতপা ছাত্রী মনে হয় আল্লাহর দুনিয়াতে আর নেই!

তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে, বাইরে বৃষ্টি, অন্ধকার। তবুও ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি। কলেজে গিয়ে দেখি দারোয়ান ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। উনি আমাকে দেখে বললেন, “সবাই এসে রেজাল্ট দেখে গিয়েছে, আপনিই শুধু আসেননি। আমি তো মনে করেছিলাম আপনার কিছু হয়েছে। আপনি বেঁচে আছেন দেখে আশ্বস্ত হলাম”। বলে কি?! আমি তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে রেজাল্ট দেখার জন্য নোটিসবোর্ড দেখতে গেলাম। সেকেন্ড ডিভিশন চেক করলাম, আমার নাম্বার নেই- না থাকারই কথা। থার্ড ডিভিশন চেক করলাম, ওখানেও আমার নাম্বার নেই। কি আর করা? দারোয়ান ভাইকে জানালাম আমি ফেল করেছি। বাসায় ফিরে দেখি মেহমান বসে আছেন আমার রেজাল্ট জানার জন্য- সবাইকে জানালাম আমি ফেল করেছি। আমাকে এত অবিচলিত দেখে মেহমান নিজেই ঘাবড়ে গেলেন। মা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাঁদের পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পানি খেয়ে মিষ্টি খান”।

তার তিনদিন পর পেপারে পড়ছি সম্পূর্ণ কুমিল্লা বোর্ডে প্রায় ২ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ২০০০ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। আমি আর কোথা থেকে পাশ করব? এমন সময় ওর ও লেভেল পড়ুয়া বান্ধবী মুনমুনকে নিয়ে শিখা এসে উপস্থিত, “মিষ্টি খাওয়াও”। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “এটা কি নতুন সিস্টেম নাকি?” শিখা বল্ল, “নতুন সিস্টেম মানে?” “এই যে, ফেল করে মিষ্টি খাওয়ানো!” ও চোখ কপালে তুলে বল্ল, “বল কি?” “আমি পাশ করিনি তো!” আমি সত্যি বলছি বুঝতে পেরে ও আমাকে কান ধরে চেয়ার থেকে ওঠালো, ঐভাবেই কলেজে নিয়ে গেল, নোটিসবোর্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেখাল, “এটা কি?” অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম না আমি জেগে আছি না ঘুমিয়ে। তারপর শিখার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সামনে আমতা আমতা করে বললাম, “আমি তো ফার্স্ট ডিভিশন চেক করিনি!”

এই ঘটনা কি করে হোল আমি আজও জানিনা। আল্লাহর রহমতের যে কোন সীমা নেই তা সেদিন আমি এই আলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি। তাই তো তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি”। আমার বাবামাকে তাঁদের উদার মনোভাব এবং বিশ্বাসের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!

Monday, November 8, 2010

ভূমিকম্প

২১শে নভেম্বর, ১৯৯৭, চট্টগ্রাম। মাগরিবের নামাজ পড়ছিলাম। পাশে আমার ছোটভাই মোহাম্মদ। হঠাৎ দে্খি কাপড়ের আলমারীটা ওর গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছে! কিছু বোঝার আগেই একহাতে ধরে ফেললাম আলমারীটা- রিফ্লেক্স। বুঝতে বেশী সময় লাগলোনা যে ভূমিকম্প হচ্ছে; হচ্ছে হয়ত বেশ কিছুক্ষণ ধরেই কিন্তু নামাজের মধ্যে নড়াচড়ায় থাকায় বুঝতে পারিনি। আমাদের বাড়ীটা ছিল ৫০ বছরের পুরনো আর আমি নিজে এর মেরামতর কাজ করিয়েছি তাই আমি জানি এই ধরনের জোরালো ভূমিকম্পে বাড়ী ভেঙ্গে পড়তে পারে যেকোন সময়। কোন কথা না বলে একহাতে আলমারী ধরে রেখেই মোহাম্মদকে নামাজের মধ্যখানে ঠেলে বের করে দিলাম রুম থেকে। তারপর আলমারী ছেড়ে দিয়ে পরের রুমে যেতেই দেখি আরেক ভাই আহমদ জায়নামাজ ভাঁজ করছে। মোহাম্মদকে একহাতে ধরে আরেকহাতে আহমদের কান ধরলাম। তখন কি ধরছি দেখার সময় নেই, ওদের বের করাটাই জরুরী। দুজনকে নিয়ে ডাইনিং রুম হয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। সামনের দিকে যাওয়াটা নিরাপদ মনে হোলনা যেহেতু ড্রয়িং রুমের অধিকাংশই কাঁচের আর ভূমিকম্পের সময় কাঁচ ভেঙ্গে ছিটানোটা একটা বড় বিপদ। পেছনে বের হয়েই শুনি ছোটমামা জোরে জোরে আজান দিচ্ছে। বেচারা ভয়ে পশ্চিম দিকের পরিবর্তে পূর্বদিকে ফিরে আজান দিচ্ছে! মামাকে বললাম, “তুমি প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কিসের আজান দিচ্ছ? দু’দিক থেকেই বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়তে পারে”। মামাকেও টেনে নিয়ে চললাম আমাদের সাথে সামনের আঙ্গিনায়, আমগাছটার নীচে। এগুলো সবই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। একটু পর ভূমিকম্প থেমে গেল। তবুও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যখন মনে হোল এবার ঘরে ঢোকা যেতে পারে, ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলাম।

আলো জ্বালতেই দেখি ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরে গিয়েছে। পরে জেনেছি ৬.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পে চট্টগ্রামের প্রায় বিল্ডিংযেই সেদিন ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। একটা পাঁচতলা ভবন ধ্বসে পড়ে ২২ জন মারা গেছিল আর বিল্ডিংযের অনেকখানিই মাটিতে দেবে গিয়েছিল। সে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে চারবছর বয়সী একটা শিশু আটকা পড়ে কয়েকদিন বেঁচে থাকলেও কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। শিশুটির জন্য মনে হয় সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম কেঁদেছে কিন্তু তাতেও তাকে বাঁচানো যায়নি। ভূমিকম্পের সময় মানুষের মাথা ঠিকমত কাজ করেনা। শিশুটির বাবামা ভাইবোন বাড়ী থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় কারোরই ওর কথা মনে হয়নি। যখন সবাই সুস্থির হোল তখন ওদের ফ্লোর মাটির নীচে চলে গিয়েছে।

আমাদের পাড়ার মসজিদে তখন মাগরিবের নামাজ হচ্ছিলো। নামাজের মধ্যখানে অনেকের সাথে বাবার ছোটবেলার বন্ধু ফরিদ মামা দৌড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। ভূমিকম্পের পর ইমাম সাহেবের সাথে ওনার ছেলেকে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে দেখে ওনার মনে পড়লো যে সাথে আসা ছেলেকে রেখেই উনি চলে এসেছেন! আর আমার ভাই আহমদ পরে স্বীকার করল যে সে আগেই নামাজ শেষ করায় বুঝতে পারেছিল যে ভূমিকম্প হচ্ছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে জায়নামাজ ভাঁজ করেই বেরোবে! বিপদের সময় মানুষ কত অসহায় হয়ে যায় যে সে সঠিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে! আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি সেদিন আমাকে স্থিরতা দিয়েছিলেন। নইলে আমার বাবামা যখন ইরান থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল তখন আমি কি বলতাম?

এরকম আরো অসংখ্য ভূমিকম্প দেখেছি চট্টগ্রামে। এর কিছু কিছু স্মরনীয় হয়ে আছে এর সাথে বিজড়িত স্মৃতির কারণে। ২০০০ সালের দু’টো ভূমিকম্পের কথা মনে পড়ে। একটা বছরের প্রথমদিকে আরেকটা শেষদিকে। প্রথমটির সময় রাত চারটেয় জেগে বসে আছি, শরীর ভালো লাগছিলোনা। হঠাৎ পুরো বিল্ডিং দুলে উঠলো। সাথে সাথে পাশের ঘরের সারি সারি অ্যাকুয়ারিয়ামের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে ছলকে পড়তে শুরু করল, স্টিলের র‌্যাকশুদ্ধ এমন গুড়গুড় করে কাঁপতে শুরু করল যে মনে হচ্ছিল সব উপুড় হয়ে উলটে পড়বে। হাফিজ সাহেব দেখি নির্বিকার শুয়ে ঘুমোচ্ছেন! ওনাকে ডাক দিয়ে বুঝতে পারলাম উনি জেগেছেন কিন্তু নড়াচড়া করার প্রয়োজন মনে করছেন না! আমিও ভাবলাম এই পাঁচতলার ওপর থেকে যাব কোথায়? তাই বসেই রইলাম। একটু পরে ভূমিকম্প থেমে গেলে হাফিজ সাহেব উঠে আলো জ্বালিয়ে ওনার গোল্ডফিশ, এঞ্জেলফিশদের দঙ্গল্ দেখে এসে আনন্দের সাথে জানালেন যে ওনার মাছের ব্যাবসা অক্ষত আছে। তারপর ওপাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন! আমি মেজাজ খারাপ করে বসে রইলাম- ওনার হবু সন্তানের মা বমি করে মরে ওনার খবর নেই আর ওনার মাছেরা ভয় পেল কি’না দেখার জন্য উনি কষ্ট করে গাত্রোত্থান করেন!

সে বছরের শেষদিকে। তখন আমি আইআইইউসি তে শিক্ষকতা শুরু করেছি, সাথে আমার কয়েকমাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে যাই। সেদিন বিকেলে ডিপার্টমেন্টের মিটিং ছিল। কি কারণে যেন ডিপার্টমেন্টের বয়োজ্যেষ্ঠ দু’জনের ভীষণ ঝগড়া লেগে গেল। বাকীরা অসহায়ের মত বসে আছি। হঠাৎ দু’জনেই ঝগড়া থামিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিলেন, একটু পরে আবার আচমকা ফিরে এলেন। তাঁদের এই আচরণ আমাদের ঝগড়ার চাইতেও অদ্ভুত মনে হোল। জিজ্ঞেস করার পর দু’জনেই খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, “ঝগড়ার মধ্যখানে আমাদের হঠাৎ মনে হোল ভূমিকম্প হচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি তোমাদের ফেলেই দৌড় দিলাম। কিন্তু একটু পরে দেখি তোমরা বা বিল্ডিংযের আর কেউই পালানোর কোন চেষ্টা করছেনা। তখন ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এলাম”।

২০০৪ সালের সুনামীর সময় আমরা ঢাকায়। সকালে ঘুমের মধ্যে তীব্র ধাক্কায় আমি উঠে বসলাম। সবাই যখন জেগে উঠে আলাপ করছে আমি বললাম ভূমিকম্প আর আমার বাবা আর তার জামাই বলে কি’না বড় ট্রাক যাবার ভাইব্রেশনকে আমি ভূমিকম্প মনে করে ভুল করেছি! পরে তো পৃথিবীব্যাপী সবাই দেখেছে সুনামীর প্রলয়তান্ডব। একদিন বান্ধবী নাহিদ আপার সাথে রিক্সায় করে গ্রীণ রোড দিয়ে আসার সময় আমরা আলাপ করছিলাম যে ঢাকায় যদি চট্টগ্রামের মত ভূমিকম্প হত তাহলে কেউ বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মানুষ যাবে কোথায়? এত বড় বড় বিল্ডিং, নামার আগেই তো সব শেষ! আর কেউ যদি নেমেও আসে, দাঁড়ানোর মত নিরাপদ জায়গাটুকুও তো নেই! চারপাশের বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েই সে মারা পড়বে!

২০০৬ সালে একদিন ফজর নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছি। বিছানার নড়াচড়ায় বিরক্ত হয়ে আধোঘুমের মধ্যে হাফিজ সাহেবকে বললাম, “উফ! আপনার এই বিশাল দেহ নিয়ে বিছানা নাড়াচ্ছেন কেন?” উনি জবাব দিলেন, “পুরো বিল্ডিং আমি নাড়াই না?” ওনার কথায় ঘুম ছুটে গেল। সত্যিই তো! আমার দ্বিতীয় সন্তানের আসন্ন জন্ম উপলক্ষ্যে আমি খাট বহিষ্কার করেছি, মাটিতে বিছানা পাতা, এই বিছানা উনি নাড়বেন কি করে? পুরো বিল্ডিংই দুলছে!

কুর'আনে বিভিন্ন জায়গায় যে ভূমিকম্পের বর্ণনা এসেছে তার সাথে মিল খুঁজে পাই এইসব অভিজ্ঞতার। কোথাও বলা হয়েছে মানুষ মাতালের মত আচরন করবে যদিও তারা মাতাল হবেনা; কোথাও বলা হয়েছে তারা তর্করত থাকা অবস্থায়ই কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে এবং তারা তর্ক থামিয়ে বলবে, “হায় এখন তো আমরা পরিবার পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারবনা!”; আর কোথাও বলা হয়েছে যে শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন জনপদে ভূমিকম্প দিয়ে সব ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। মনে হয় আমরা এত দুর্বল- শারিরীক এবং মানসিকভাবে- যে আমাদের শাস্তি দেয়ার জন্য খুব বেশী বিপদ প্রয়োজন হয়না। অথচ বিপদ কেটে গেলেই আমরা এমন একটা ভাব করি যেন আমরা কত শক্তিশালী বা বুদ্ধিমান! যারা বুদ্ধিমান, এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়- তাঁরা তাঁদের জীবনের মূল্য বুঝতে পারেন এবং একে কাজে লাগানোর অন্য সর্বোতভাবে সচেষ্ট হন। কিন্তু যারা নির্বোধ, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা তাঁদের মধ্যে কোন ভাবান্তর সৃষ্টি করতে পারেনা এবং উদ্দেশ্যহীনভাবেই তাদের দিন কাটতে থাকে।

Sunday, November 7, 2010

আমার বোনকে বলি


আপু, (ভুল করে লিখিনি, ছোটবোনদের আদর করে আপু ডাকি)

আসসালামু আলাইকুম।

আমি ছোটবেলা থেকেই অসহায় দুর্বলদের প্রতি ভীষণ সহানুভূতিশীল ছিলাম। কেন জানিনা, এরকম কাউকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর একটা প্রচন্ড কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। রিক্সাওয়ালারা যখন রিক্সা থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে পানি খায় বা একটা শুকনো বানরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, আমার মনে হয় আমার হৃৎপিন্ডটাও যেন ঐ রুটির মত টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার চোখ থেকে পানি বেরোয়না তাই জ্বলতে থাকে, শীতল হওয়ার সুযোগ পায়না।

আমার নিজের রক্ত পড়ে ভেসে গেলেও পাত্তা দেইনা কিন্তু অন্য কারো আঙ্গুল থেকে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখলেও আমি অসুস্থ হয়ে যাই। হাসপাতালে আমি রোগী দেখব কি, নিজেই কাতরাতে থাকি!

এগুলো মানুষ ভালো চোখে দেখেনা। যেমন একবার আমাদের স্কুলে এক ছেলে ভর্তি হোল, আমাদের ক্লাসে, ক্লাস সিক্সে। ছেলেটা ছোটবেলা থেকে বিদেশী স্কুলে পড়েছে, তাই ওর হাবভাবে একটা বিদেশী বিদেশী ভাব ছিল যেটা আমার পর্যন্ত হাসি পেত যদিও আমি খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করি যেন আমার ব্যবহারে কেউ কষ্ট না পায়। শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত, কেউ ওর সাথে কথা বলতনা। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমি আর বেচারার মনখারাপ করা চেহারাটা সহ্য করতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওকে আস্তে আস্তে আমাদের চালচলনের সাথে পরিচিত করে দেব যাতে ও সবার সাথে মিলেমিশে চলতে পারে। আমি যখন ওর সাথে মিশতে শুরু করলাম আমাদের অনেক ছেলেমেয়েই ওর সাথে কথা বলতে শুরু করল কারণ আমি লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো না হলেও খেলাধুলার জন্য আমি ছিলাম অপরিহার্য। আমি আমার এই জনপ্রিয়তা ব্যবহার করলাম ওকে একটা অবস্থান তৈরী করে দেয়ার জন্য। লাভ হোল এই যে একদিন আমাদের সিনিয়র এক মেয়ে ধুয়া তুলল যে সে ঐ ছেলেকে নাকি ফোন করে বলেছে সে আমি (বলাই বাহুল্য আমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলতাম না), ছেলেটা নাকি বলেছে সে আমাকে ভালোবাসে! অথচ সে আমাকে স্কুলবাসে বলছিল কেউ একজন বারবার ফোন করে কেটে দিচ্ছিল সেদিন। এসব ফালতু ব্যপার আমি পাত্তা দেইনা।তাই যখন সে মেয়ে পুরো স্কুলে রাষ্ট্র করে দিলো যে এমন এমন ঘটেছে আমি নির্বিকার রইলাম, কিন্তু ঐ ছেলে তো কেঁদে ফেলার অবস্থা। সে বারবার বলছে, "বিশ্বাস কর আমি তোমাকে ভালোবাসিনা!" আমি ওকে বললাম, "শোন, তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমাকে ভালোবাসবে না তো কে বাসবে? তুমি চুপচাপ থাক, আমি জানি এসব মিথ্যা কথা। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।" পরে শিক্ষকরা ঐ মেয়েকে ভালোভাবে ধরলেন এবং সে স্বীকার করতে বাধ্য হোল যে সে বানোয়াট খবর প্রচার করেছে। ছেলেটা না'কি খুব সুন্দর ছিল (আশ্চর্য! আমি কোনদিন খেয়াল করলাম না!), কিন্তু ওকে পাত্তা না দিয়ে আমার মত একটা কুৎসিত মেয়ের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এজন্য হিংসায় পড়ে সে এমন একটা গল্প ফেঁদেছে। তার পরে দু'টো বছর ওর কত খারাপ গিয়েছে ওর ডায়রীতে পড়েছিলাম। কতবার যে সে মাফ চেয়েছে এর জন্য! আমি ভাবলাম, আমি ওকে কি মাফ করব, ঐ এক পাপের শাস্তি তো বেচারী দু'বছর ভোগ করেই ফেলেছে!

সুতরাং, এসব করে আসলে মানুষ তোমাকে শুধু সাময়িকভাবে কষ্ট দিতে পারবে, আর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কিন্তু একটা জিনিস শিখেছি আমার এক খালাকে দেখে। ওর স্বামী ওকে খুব ভালোবাসত। অনেক কিছু কিনে দিত। সে সরল মনে এগুলো ওর শ্বাশুড়ী ননদদের বলত, দেখাত। পরে ওরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে ওর শ্বাশুড়ী ওর স্বামীকে বাধ্য করল ওকে তালাক দিতে। পরে শ্বাশুড়ী মারা গেলে ওর স্বামী আবার ওকে বিয়ে করে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। সুতরাং, এমন মানুষের সাথে এমন জিনিস শেয়ার করা উচিত না যেটা সে হজম করতে পারেনা।

এজন্যই বলি, বন্ধুত্ব থাক, তবে আচরণ হোক নিয়ন্ত্রিত।

আমাদের দেশ মুসলিমপ্রধান হলেও ইসলামের প্রতিফলন আমাদের জাতীয় জীবনে বিরল। তাই তুমি যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছ আমি তাতে মোটেও আশ্চর্য হইনা। এজন্যই হয়ত রাসূল (সা) বলেছেন, আমাদের যুগে এসে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা রাখার মতই কঠিন হবে। আমরা যারা আইআইইউসি তে একসাথে কাজ করতাম (মহিলারা), দেখা যেত কোথাও গিয়ে একাত্ম হতে পারতাম না। এটার মূলে অহংকার না, চিন্তার ভিন্নতা। একবার আমি সকালে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে এক দাওয়াতে গেলাম। ওখানে মেজবানের গ্রামের বাড়ী থেকে সব আত্মীয় স্বজন এসেছেন। কিন্তু তাদের জামাকাপড় সাজগোজ দেখে আমি চমকে গেলাম। এক মহিলা দেখি সবার মধ্যেই জামা তুলে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন! আশে পাশে সব পুরুষরা চলাফেরা করছে। আমার এত অস্বস্তি লাগছিল যে মনে হচ্ছিল আমি কোথাও পালিয়ে যাই। একটু পরে এক পুরুষ আত্মীয় এসে ঐ অবস্থাতেই ওনার সাথে হাসিতামাশা শুরু করল। ঐ লোক আমার সামনে দাঁড়ানো বলে উঠতেও পারছিলাম না, কিন্তু লজ্জায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটু পরে ঐ লোক চলে গেলে আমি না খেয়েই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঐ মহিলা আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, 'সরি, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি"। উনি একটু অবাক হয়ে গ্রামের ভাষায়ই বললেন, "ও, আমি তো মনে করেছি আপনিও আমার মত গ্রাম থেকে এসেছেন!" আমি কি বলব বুঝে না পেয়ে বললাম, "জ্বী না, আমি ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছি"। উনি এমনভাবে তাকালেন যে বুঝলাম শুধুমাত্র বোরকা পরার কারণেই উনি ধারণা করেছেন আমি গ্রাম থেকে এসেছি আর এই বেহায়াপনা করে উনি শুহুরে খ্যাতিতে উন্নীত হয়েছেন। আমার এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায় কিন্তু মানুষের চিন্তার গন্ডির সীমাবদ্ধতা দেখলে মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়।

আপু, তুমি মনে কষ্ট পেয়োনা। আনন্দিত হও যে তুমি যে পথের সন্ধান পেয়েছ কত বড় বড় কবি সাহিত্যিক চিন্তাবিদ আজীবন ভেবেচিন্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ তাকে খুঁজে বের করতে পারেননি! এর জন্য কি কোনদিন শুকরিয়া করে শেষ করা যাবে?

দোয়া কোর,

মাআসসালাম,

রেহনুমা

Wednesday, October 27, 2010

ছাত্রীজীবনের স্মৃতি (স্কুলজীবন)


১. অহসন

ভাবছেন ভুল লিখেছি? নাহ, আমাদের ক্লাসের আহসান বানানে এত কাঁচা ছিল যে ক্লাস ফাইভের পরীক্ষার খাতায় নিজের নাম সে এভাবেই লিখেছিল। তারপর থেকে শাস্তিস্বরূপ সমাজ টিচার বলে দেন সবাই যেন ওকে ‘অহসন’ ডাকে। আমি নিজে লেখাপড়ায় আহামরি কিছু না হলেও যারা জ্ঞানপিপাসু তাদের সবসময় শ্রদ্ধা করতাম। তাই লাকী তিথি মিনহাজের মত মেধাবীদের ভীড়ে ওকে খুব একটা গণ্য করা হতনা।

একদিন আমার ছোটভাই আহমদ বাসায় এসে জানালো ক্লাসে ওর এক বান্ধবী হয়েছে। ক্লাস ওয়ানের সে বান্ধবী আবার ওকে সপরিবারে দাওয়াত করেছে! সে কান্নাকাটি করে বাবামাকে রাজী করিয়ে ফেল্ল ওদের বাসায় যাবে। মেয়েটি ছিল খুব সুন্দরী। তাই ক’দিন আমরা ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করলাম। পরে একদিন ঐ আংকেল ফোন করে দাওয়াত দিলেন।

ওদের বাসায় গিয়ে দেখি আহমদের সুন্দরী বান্ধবী হোল আহসানের ছোটবোন! ওদের বাসায় যেতেই সে আহমদকে নিয়ে ওর রুমে খেলতে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ গোঁ ধরে বড়দের মধ্যে বসে রইলাম। শেষে আংকেল বললেন, “তুমি বড়দের মধ্যে বসে কি করছ? আহসান, ওকে নিয়ে যাও। তোমরা একসাথে খেল”। মেজাজটা বিগড়ে গেল। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার ভাই বা তার বান্ধবীর কোন দেখা নেই। অগত্যা আহসানই শেষ ভরসা।

যেহেতু ক্লাসে আমাদের খুব একটা কথাবার্তা হতনা, দু’জনেই ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। তাই কথা বার্তা না বলে সে ওর বিভিন্ন খেলনা আমাকে দেখাতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে দেখি কোন খেলনাই আমি পুরোপুরি চিনতে পারছিনা! সবই মনে হোল এক খেলনার এক পার্টের সাথে আরেক খেলনার আরেক পার্ট নিখুঁতভাবে জোড়া দেয়া অথচ এগুলো দিব্যি ব্যাটারী দিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে! আমি আগ্রহী হয়ে উঠলে আহসানও বেশ সাবলীল হয়ে উঠলো। সে বল্ল বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করা ওর নেশা। সে খুটখাট করে টুকটাক মেরামত শুরু করেছিল দু’বছর আগে। এখন টিভি থেকে ট্রানজিস্টার সব ঠিক করতে পারে। একই প্রযুক্তি খেলনার ওপর প্রয়োগ করলে কি হয় দেখার জন্যই সে খেলনাগুলো নিয়ে এই পরীক্ষা চালিয়েছে!

সেদিন বুঝলাম, কাউকে বাইরে দেখে বোঝার উপায় নেই তার মধ্যে কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ওর বাবামা ওর মেধাকে চিহ্নিত করে তাকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কিন্তু সে মেধা আবিষ্কার করার কথা ছিল আমাদের শিক্ষকদের- কেননা শিক্ষকদের দায়িত্ব কেবল পড়ানো নয়, ছাত্রছাত্রীদের সুপ্ত মেধাকে চিহ্নিত করে তাকে বিকশিত করার চেষ্টা করাও। হায়! ক’জন শিক্ষক এই দায়িত্ব পালন করেন?

পুনশ্চঃ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আহসান টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। যেহেতু ওটাই ওর ক্ষেত্র ছিল, নিশ্চয়ই সে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল।


২. ক্লাস পালানো

জীবনে একবার ক্লাস পালিয়েছিলাম! তখন আমরা ক্লাস সিক্সে পড়ি। আবুধাবী সরকারের নির্দেশে সব স্কুলে দু’টো পেপার এক্সট্রা পড়ানো হত। আরবী আর কুর’আন মিলে এক পেপার, ইউ.এ.ই. সোশ্যাল স্টাডিজ আরেক পেপার। আরবী পড়াতেন এক ঈজিপ্সিয়ান শিক্ষক। কেউ পড়া না পারলে তিনি তাদের মাথায় চাঁটি মারতেন। তবে শুধু ছেলেদের। দুঃখজনক ঘটনা হোল, আগের বছর ‘ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় ‘আরবী মেয়ে’ সাজার পর থেকে উনি কেন যেন আমাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করলেন। লাভ হোল এই যে একমাত্র আমার বেলায় উনি মেয়ে হলেও পড়া না পারলে চাঁটি মারার ভয় দেখাতেন!

সেদিন পড়া ছিল ‘সূরা আলাক’ মুখস্ত করা। কিছুতেই প্রথম সাত আয়াতের পর মনে রাখতে পারিনা! ক্লাসের ছেলেদের সাথে কথা বলে কিছুটা সান্তনা পেলাম যে শুধু আমি না, আর কেউ পুরোটা মুখস্ত পারেনা। আরবী ক্লাসের আগের পিরিয়ডে জানা গেল লাকী পুরোটা মুখস্ত করে এসেছে। ও ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, সবকিছুতে পার্ফেক্ট। খুব মেজাজ খারাপ হোল। কে বলেছে ওকে এত ভালো হতে? ছেলেরা ওকে থ্রেট দিল ও যদি বলে ও পুরোটা শিখে এসেছে, ওকে মেরেই ফেলবে! কিন্তু মনে শান্তি পেলাম না।

কুর’আন ক্লাসের আগে আগে আমি আর তিথি গেলাম ওজু করতে। আমাদের স্কুলের নিজস্ব প্রেমিস ছিলোনা। একটা আরবী স্কুলে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ঐ প্রেমিসে বিকেলে আমরা ক্লাস করতাম। স্কুলের দু’টো ভাগ ছিল, আমাদের ক্লাস চলত একভাগে। দু’ভাগের মধ্যখানে ছিল ওজু করার জায়গা। ওখানে কোন ক্লাসরুম ছিলোনা। মেয়েদের ওজু করার জায়গাটা একটু বাগান দিয়ে ঘেরা। ওজু করতে করতে তিথি আর আমি আলাপ করতে শুরু করলাম আজকে ক্লাসে কি হতে পারে। কথা বলতে বলতে আমরা এর এমন ভয়াবহ এক চিত্র কল্পনা করে বসলাম যে শেষমেশ আর ক্লাসে ফিরে যেতে সাহসে কুলালনা। সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাস পালাবো। কিচ্ছু করার দরকার নেই। আরবী স্যার ছিলেন একজনই। উনি আমাদের ক্লাসে থাকলে আর কেউ এখানে ওজু করতে আসবেনা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, অন্ধকার। তাছাড়া জায়গাটা বাগান দিয়ে ঘেরা। সুতরাং, এখানে বসে থাকলে আমাদের কেউ দেখতে পাবেনা। তবুও এই অন্যায় কোনদিন করিনি, ভীষণ ভয় লাগতে শুরু করল। ধুকপুক করতে করতে মনে হোল হৃৎপিন্ডটা ফেটেই যাবে। দু’জনে কথা বলতে বলতে সময় মনে হয় শেষই হয়না! যখন মনে হোল বুকটা মনে হয় ব্যাথা করতে করতে মরেই যাব, শেষপর্যন্ত ঘন্টা বাজল! খুব দেখেশুনে স্যার নিরাপদে অন্য ক্লাসে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়ার পর আমরা চোরের মত ক্লাসে ঢুকলাম।

আমাদের দেখে ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। জেনে খুব মর্মাহত হলাম যে সেদিন স্যার ‘সূরা আলাক’ ধরেননি, শুধু গল্প করে চলে গিয়েছেন!

পুনশ্চঃ আমাদের পড়াশোনায় নিবেদিতপ্রাণ বান্ধবী লাকী এখন ডাক্তার। তিথি আর আমি এখনো একসাথে আছি ক্যাল্গেরীতে! এখনো ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি, কিন্তু নির্ভয়ে। ঐ দিনের কথা মনে হলে ভীষণ হাসি পায়!


৩. বন্ধুত্ব

ক্লাস সিক্সে বিজ্ঞান ক্লাসে একটা প্রজেক্ট ছিল পিনহোল ক্যামেরা। এতে একটা ক্যামেরা বানাতে হয় যার ভেতর দিয়ে দেখলে মোমবাতি উলটো দেখা যায়। যেদিন টিচারকে দেখাতে হবে আমরা সবাই খুব সাবধানে নিজের নিজের ক্যামেরা সামলে রাখলাম যেহেতু এগুলো এত ঠুনকো জিনিস দিয়ে বানানো ছিল যে যেকোন মূহূর্তে অসাবধানতাবশত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

পঞ্চম পিরিয়ডে টিফিনের পর আহসান আর আশিক দুই বন্ধু একে অপরের ক্যামেরা নিয়ে বসল মন্তব্য করার জন্য। ঘটনাটা কি করে ঘটল আমরা কেউ লক্ষ্য করিনি। আশিককে চিৎকার করতে শুনে ক্লাসের পেছনে তাকিয়ে দেখি কিভাবে যেন ওর ক্যামেরাটা একটু চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে আর আহসান মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে আছে। সবাই আশিককে বোঝানোর চেষ্টা করল আহসান নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ওর ক্যামেরাটা নষ্ট করেনি, কিন্তু সে ক্ষেপে গিয়ে আহসানের ক্যামেরাটা পায়ের নীচে ফেলে মাড়িয়ে দুমড়ে মুচড়ে ওটার দফারফা করে দিল। তারপরও ওর মাথা ঠান্ডা হোলনা। টিচার যেকোনসময় আসবেন বলেও ওকে আমরা ক্লাসে আটকে রাখতে পারলাম না; সে মাঠে গিয়ে ঐ দুমড়ানো ক্যামেরাটাকে মাঠের এ’মাথা থেকে ও’মাথা লাথি দিয়ে নিয়ে যেতে থাকল। রুবী টিচার শব্দ শুনে ক্লাস ফোর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন লাভ হোলনা। বিজ্ঞান টিচার, মিসেস বজলুর রহমান, আবার স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেদিন উনি মিটিংযে আটকে পড়ায় ক্লাসে আসতে দেরী হচ্ছিল।

শেষপর্যন্ত হয়ত মাড়ানোর মত আর কিছু অবশিষ্ট ছিলোনা বলেই সে ক্লাসে ফিরে এলো। কিন্তু এসে মাত্র সে আহসানের টেবিলটা তুলে মেয়েদের সীটের পাশে বসিয়ে দিয়ে গেল, “যা, তুই মেয়েদের সাথে বস”, তারপর ওর আগের জায়গায় থুথু ছিটালো। শেষমেশ আর করার কিছু না পেয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল।

ভীষণ মেজাজ খারাপ হোল আমাদের মেয়েদের। ছেলেগুলো এরকম অভদ্র কেন?

সেদিন ক্লাস শেষে স্কুলবাসে বসে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমার জানালার বাইরেই একটা দৃশ্য দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল! আশিক আর আহসান একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে! আহসান বলছে, “ভুল হয়ে গেছে দোস্ত, মাফ করে দে ভাই”। আর আশিক ওকে জড়িয়ে ধরে বলছে, “আমার মাথার ঠিক ছিলোনা ভাই, তুই সব ভুলে যা, আমাকে মাফ করে দে”।

সেদিন ঠিক করলাম ছেলেরা হয়ত আসলে অত খারাপ না কারণ আমি হলফ করে বলতে পারি ৯০% মেয়ে, সে তাদের হৃদয় যত বড়ই হোকনা কেন, এ’রকম একটা ঘটনার পর পরস্পরের সাথে স্বাভাবিক হতে পারতনা, অন্তত এই রেকর্ড সময়ে তো নয়ই!

আমি এখনো কারো সাথে মনখারাপ হলে এই ঘটনা মনে করে নিজেকে প্রশস্ত করার চেষ্টা করি। আহা! সেই নিষ্পাপ মনটা যদি আমরা আজীবন ধরে রাখতে পারতাম!


৪. দ্য আগলী ডাকলিং

বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল থেকে আদৌ এসএসসি দেয়া যাবে কি’না ব্যাপারটা যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বাবা আমাকে একটা ও’লেভেল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য নিয়ে গেল। এই স্কুলে ছেলেমেয়েদের সেকশন আলাদা এবং অংকের জন্য একজন বৃদ্ধ শিক্ষক ছাড়া কোন পুরুষ শিক্ষক মেয়েদের পড়ান না। লৈখিক পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা। আমি যখন ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি তখনো শ্রীলঙ্কা থেকে ইংরেজীর শিক্ষক এসে পৌঁছননি তাই আমার ক্ষেত্রে ভাইভার জন্য ছেলেদের সেকশনের শিক্ষককে নিয়ে আসা হোল। ওনাকে দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। উনি ইংরেজ! বাংলাদেশ স্কুলে সবসময় শিক্ষকরা বলে এসেছেন আমি ইংরেজীতে ভালো না। আর এই ভদ্রলোক আমার কি অবস্থা করবেন?

যা থাকে কপালে বলে বসে পড়লাম। উনি আমাকে একটা গল্প পড়তে দিলেন, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘দ্য আগলী ডাকলিং’। আমি পড়তে পড়তে বিমুগ্ধ হয়ে ভুলেই গেছিলাম যে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি! মনে হচ্ছিল এটা যেন আমারই গল্প! স্যারের ডাকে পৃথিবীতে ফিরে এলাম। উনি আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ভাইভা শেষে আমার ইংরেজীর প্রশংসা করলেন (!),আমাকে কিছু ইসলামী উপদেশ দিলেন, তারপর আমাকে ছেড়ে দিলেন। ঐ পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করলাম। বহু পরে বুঝেছি কেন আমাকে বাংলা স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন আমি ইংরেজীতে কাঁচা কিন্তু ইংরেজী স্কুলে আমি ইংরেজীতে হাইয়েস্ট পেতাম। আমি ইংরেজী শিখেছি সেভাবে যেভাবে একজন রিক্সাওয়ালা ভাই বাংলা শিখেছেন। তিনি বাংলা বলার সময় কোন ভুল করেননা কিন্তু তাঁকে যদি ব্যাকরণ জিজ্ঞেস করা হয় উনি আকাশ থেকে পড়বেন, “ঐটা আবার কি জিনিস?”

সে যা হোক, এই শিক্ষকের সাথে যদিও আমার ঐ একবারের পর আর দেখা হয়নি, আমার জীবনে ওনার যে কি অবদান তা উনিও কোনদিন জানবেন না। ‘দ্য আগলী ডাকলিং’ গল্পটি এবং আমার ব্যাপারে তাঁর অ্যাসেসমেন্ট প্রথম আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল যে সবাই আমাকে যেমন অপদার্থ বলে বা আমি সুন্দর নই বলে আজেবাজে কমেন্ট করে এগুলো কোন মূখ্য বিষয় নয়! আমাকেই খুঁজে নিতে হবে আমি কি পারি এবং ধৈর্য্য আর ডিটারমিনেশনের সাথে এগিয়ে যেতে হবে।

পরবর্তীতে দেখলাম শুধু আমিই নই, ছাত্রী শিক্ষক সবাই ওনার ব্যাপারে কৌতুহলী ছিল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল তিনি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলিম। কিন্তু তিনি যখন ইসলামকে গ্রহণ করেছেন তখন পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছেন। স্কুলের মাঠের ওপাড়েই ছিলো ওনার বাসা। একদিন উনি ক্লাসে থাকাকালীন ছাত্রীদের ওনার বাসা দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। দেখলাম উনি ঠিক রাসূল (সা)এর আদর্শ অনুযায়ী মাটিতে শুতেন এবং ঘরে নূন্যতম পরিমাণ জিনিস ছিল যা একজন জন্মগত বৃটিশের জন্য অস্বাভাবিক। অংক স্যারের কাছে শুনেছি তিনি হাত দিয়ে খেতেন, চাকুরীর সময়টুকু ছাড়া রাসূল (সা)এর মত করে জামাকাপড় পরতেন। দেখেছি তিনি মানুষের সাথে সদ্ব্যাবহার করতেন, ভালো উপদেশ দিতেন। তাঁকে দেখেই আমার প্রথম ইসলাম সম্পর্কে নিজে নিজে লেখাপড়া করে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আজকের আমি।

হয়ত শিক্ষক হবার আগ্রহটাও তাঁকে দেখেই কেননা একজন মানুষের দশ মিনিটের সংস্পর্শ যদি কারো জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে, তবে আপত্তির কি আছে?

৫. পাগল

আমরা যখন ক্লাস এইটে, একদিন বাংলা স্যার এসে জিজ্ঞেস করলেন আমরা জীবনে কে কি হতে চাই। সবাই যে যার ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশ করতে লাগল।

ক্লাসের এক ছেলে কিছুতেই বলবে না। অনেকক্ষণ পর ওর ভাই (দু’ভাই একই ক্লাসে পড়ত) বলে দিল, “স্যার, ও ট্রাকড্রাইভার হতে চায়!” আসলে আগেরদিন বাবার কাছে পড়াশোনায় গাফলতির জন্য বকা খাওয়ার একপর্যায়ে সে জেদ করে এ’কথা বলেছিল। কিন্তু বেঈমান ছোটভাই সব ফাঁস করে দিল!

মেয়েদের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে যখন আমার পালা এলো, বললাম, “আমি এতকিছু হতে চাই যে আমি নিজেই ঠিক করতে পারিনা আমি আসলে কি হতে চাই! তবে আপাতত মানসিক রোগীদের ওপর একটা লেখা পড়ে ভাবছি মানসিক ডাক্তার হব। ওদের কষ্টের কথা এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে আমার মনে হয় ওদের একজনকেও সাহায্য করতে পারলে জীবন সার্থক হয়ে যাবে”। স্যারকে মনে হোল এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে উনি একটু কনফিউজড! অন্যমনষ্ক হয়ে উনি আমার পাশে বসা শিরিনকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি হতে চাও?” ও ছিল ভীষণ দুষ্ট। ও বল্ল, “স্যার, আমি পাগল হতে চাই!” স্যার চমকে উঠে বললেন, “বল কি? কেন?” ও বল্ল, “স্যার, আমার প্রিয় বান্ধবীর জন্য। নাহলে ও রোগী পাবে কোথায়?!”

পুনশ্চঃ সে’বছর শিরিন সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিল। নাহ, সিরিয়াস কিছু না। ‘ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইক’ প্রতিযোগিতায় সে এত বাস্তবভাবে পাগলের অভিনয় করেছিল যে প্রথম পুরস্কার ওর জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ফলাফল ঘোষনার আগেই!


৬. হুদা টিচার

মিসেস হুদা ছিলেন কেজির টিচার। আমি আবুধাবীর বাংলাদেশী স্কুলে ভর্তি হয়েছি ক্লাস ফাইভে। তাই ওনার ক্লাস কখনো পাইনি। তবে দূর থেকে ওনাকে আমরা সবাই খুব পছন্দ করতাম। মার্জিত রুচি, পরিশীলিত আচরণ, তীক্ষ্ণ মেধা আর শৈল্পিক ব্যাক্তিত্ব- সব মিলে উনি ছিলেন এক আদর্শ নারী।

চার বছর বয়স থেকেই বাবামা, দাদাদাদু আমাকে প্রচুর বই কিনে দিয়ে পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে দেয়। পাঁচবছর থেকে লেখালেখির শুরু। কিন্তু বই আর লেখালেখি আমাকে আস্তে আস্তে অসামাজিক করে তোলে। মানুষের সাথে কথা বলার চাইতে আমি এক কোণে একখানা বই নিয়ে বসে থাকা হাজারগুনে পছন্দ করতাম। আর কারো সামনে বক্তৃতা, বিতর্ক বা আবৃত্তি করতে বললে মনে হত যেন আমাকে কোরবানী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! ক্লাস ফাইভে উঠে বাবা আমাকে এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করতে লাগল। আমি যতই বই আর লেখালেখি নিয়ে মেতে থাকতে চাই, বাবা আমাকে ততই ঠেলে। আমি নিরুপায় হয়ে সবার সামনে গিয়ে ঘামতে থাকি, মাটির দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কি বলে আসি আমি নিজেই শুনতে পাইনা। এভাবেই চলতে লাগল বছরের পর বছর।

সেভেনে আমি অন্য স্কুলে ছিলাম। এইটে যখন জানা গেল বাংলাদেশ স্কুল থেকে এসএসসি দেয়া যাবে আমি আবার আমার আগের স্কুলে ফিরে এলাম। সেবার হুদা টিচার ছিলেন আমাদের বক্তৃতার বিচারকদের একজন। প্রতিযোগিতা শেষে উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি একটু অবাক হলাম যেহেতু ওনার সাথে আমাদের কোন সংস্পর্শ ছিলোনা। টিচারের কাছে গেলে উনি বললেন আমার বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট দেখবেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে উনি হতবাক হয়ে বললেন, “তাইত বলি, যে মেয়ে রেগুলার ম্যাগাজিনে লেখে সে বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট লিখতে পারেনা কেন? তোমার লেখা তো চমৎকার, তাহলে তোমার সমস্যা কি? তুমি কেন কনফিডেন্টলি বক্তৃতা দিতে পারোনা?” আমি চুপ করে রইলাম। উনি বুঝে নিলেন আমার সমস্যা কি। পরে আমাকে বলে দিলেন আমি যেন প্রতিদিন টিফিন টাইমে ওনার সাথে বসি।

উনি আমাকে সাতদিন বক্তৃতা আর আবৃত্তির বেসিক্স শেখালেন তার সাথে প্রতিদিন প্র্যাক্টিস। সাতদিন পর উনি বললেন, “এবার তুমি নিজে নিজে এগোতে পারবে। আমি তোমার পরবর্তী পারফর্মেন্সগুলোর দিকে নজর রাখব”।

প্রতিযোগিতা আর অনুষ্ঠানের কথা বাদ দিলাম। পরবর্তীতে ওনার এই শিক্ষা যে আমার কত কাজে লাগবে তা হয়ত উনিও কোনদিন ধারণা করতে পারেননি। কিন্তু আমার শিক্ষকতা জীবনে প্রতিটি দিন প্রতিটি মূহূর্ত আমি ওনার বদান্যতার কথা স্মরণ করেছি।

পুনশ্চঃ আমাদের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের একটা ছবি আছে যেখানে দেখতে পাচ্ছি আমি বক্তৃতা দিচ্ছি আর হুদা টিচার গালে হাত ঠেকিয়ে একমনে শুনছেন, চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। খুব জানতে ইচ্ছা করে উনি আমাকে নিয়ে যে কষ্ট করলেন এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আমার পার্ফরমেন্সে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি’না!


৭. আংকেল

ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার আগেরদিন বাংলা ক্লাসে রহিম স্যারের পরিবর্তে আনিস স্যারকে দেখে সবাই হকচকিয়ে গেলাম। স্যার বুঝতে পেরে জানালেন যে রহিম স্যার অসুস্থ বলে উনি ক্লাস নিতে এসেছেন। যেহেতু সব পড়া হয়ে গিয়েছে উনি বাংলা বই নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আনিস স্যার ইংরেজীর শিক্ষক হলেও বাংলা সাহিত্যে ওনার ভালো দখল ছিল। তাই উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একদম ভেতর থেকে প্রশ্ন করছিলেন। আমাদের ক্লাসে ছেলেরা যে শুধু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিলো তাই নয়, তাদের লেখাপড়া ছাড়া আর কোন বিষয়ে আগ্রহের অভাব ছিলোনা। তাই দেখা গেল মেয়েরা পটপট উত্তর দিয়ে যাচ্ছে অথচ ওরা হাতও তুলতে পারছেনা।

কিছুক্ষণ পর স্যার প্রশ্ন করলেন, “’কপোতাক্ষ নদ’ কে লিখেছেন?” শেষপর্যন্ত একটা সহজ প্রশ্ন পেয়ে ক্লাসের এক ছেলে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, মেয়েরা যাতে উত্তর দিতে না পারে সেজন্য সে খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেল্ল, “আমি পারি স্যার! আংকেল মুধুসূদন দত্ত!”

পুনশ্চঃ সেদিন হাসির তোড়ে ভেসে গেছিল আমাদের ক্লাস। স্যার কোনরকমে হাসি চেপে ক্লাস ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছিলেন প্রাণ খুলে হাসার জন্য। দুর্ভাগ্য আমার! ছেলেটা আমাদের বাসেই যেত। তাই ওকে যতবার দেখছিলাম ‘আংকেলের’ কথা মনে করে কিছুতেই হাসি বন্ধ করতে পারছিলাম না। রাতে যে পেটব্যাথা করছিল, মাগো, সে কথা মনে করতেই ভয় লাগে!


৮. রাশেদ

সেদিন খেলার মাঠে রাশেদকে না পেয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছিল। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা ক্লাস সেভেন এইট থেকেই খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভাইদের সাথে বড় হওয়ার কারণেই কি’না জানিনা আমি খুব একটা ভদ্রটাইপ মেয়ে হতে পারিনি কখনো। ক্লাস টেনে উঠে ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা ছাড়া আর গত্যান্তর রইলোনা আমার। সেদিন দেখি কেউ নেই। এদিক সেদিক ঘুরে টিফিন শেষের ঘন্টা বাজতে ক্লাসে ফিরে এলাম। দেখি আমাদের ক্লাসের সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছে রাশেদকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তো হতবাক! ঘটনা কি? ওদের ক্লাসের এক ছাত্রী ওকে কি বলে যেন ক্ষেপিয়েছে আর সেও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের ব্লেড দিয়ে কব্জী থেকে কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলেছে!

ভারী আশ্চর্য লাগল। ওরা চার ভাইবোন পড়ত আমাদের স্কুলে। সবাই ছোটখাট, ধবধবে ফর্সা আর সুন্দর। কিন্তু আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত ওর ছোট তিনবোনকে। ওরা প্রতিদিন স্কুলে জায়নামাজ নিয়ে আসত। সময় হলেই নিজেরা নামাজ পড়ত, বড় ভাইকে ডেকে নামাজ পড়াত, হোক ক্লাস বা পরীক্ষা। ওরা যেমন লেখাপড়ায় অগ্রগামী ছিল তেমনি খেলাধূলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কিন্তু কোন বাজে কাজে বা উলটাপালটা কথায় তাদের দেখতাম না। ওদের ভাই একটা মেয়ের কথায় এমন করতে পারে ভাবতেই অবাক লাগল!

দু’দিন পর রাশেদ আবার স্কুলে আসতে শুরু করল। ফুলশার্ট পরে। টিচাররা বলে দিয়েছিলেন কেউ যেন ওকে কিছু না বলে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা তো আর আমার জন্য প্রযোজ্য নয়! আচ্ছামত ঝাড়লাম ওকে।

কয়েকদিন পর হঠাৎ বায়োলজি স্যার এসে বললেন জবা ফুলের ডিসেকশন করাবেন। যেহেতু সেদিন রুটিনে বায়োলজি ক্লাস ছিলোনা আমরা কেউ বায়োলজি কিট নিয়ে যাইনি।স্যার বললেন, একটা ব্লেড পাওয়া গেলেও আমরা একে একে সবাই প্র্যাক্টিকালটা করতে পারতাম। সবাই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমি বললাম, “স্যার, আমি দেখি ক্লাস নাইনে কারো কাছে আছে কি’না”। গিয়ে সোজা রাশেদকে ধরলাম, “ব্লেড দাও”।
ও বল্ল, “কেন আপু?”
“আমাদের ফুল ডিসেকশন করার জন্য লাগবে”।
“আজকে তো ব্লেড আনিনি আপু”।
“অসম্ভব, আর কারো কাছে না থাকলেও তোমার কাছে অবশ্যই থাকবে”।
বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে বল্ল, “বিশ্বাস করেন আপু, আমি এখন ভালো হয়ে গিয়েছি। সত্যিই আমার কাছে ব্লেড নাই!”

কি আর করা? হাসতে হাসতে চলে এলাম। সেদিন হাত দিয়েই ব্লেডের কাজ চালাতে হয়েছিল ঐ জবাফুলগুলোর ওপর। আবুধাবীতে জবাফুল সবসময় মিলতোনা তাই যখন পাওয়া যেত তখনই বায়োলজি ক্লাসের আয়োজন করতে হত।

ক্লাস টেনের শেষে আমাদের শিক্ষকরা জানালেন আমাদের কোন ফেয়ারওয়েল দেয়া হবেনা। আমাদের পরীক্ষার ব্যাবস্থা হয়েছিল আবুধাবীস্থ বাংলাদেশ এম্বাসীতে। নতুন স্কুলের কন্সট্রাকশনের কাজ শুরু হয়েছে তাই স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে এই স্কুলের এসএসসি পরিক্ষার্থী প্রথম ব্যাচের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের জন্য ফান্ড ছিলোনা।

তা রাশেদ এই কথা কিছুতেই মেনে নিতে রাজী হোলনা, “আমি আপুদের কিছুতেই ফেয়ারওয়েল ছাড়া স্কুল ছেড়ে চলে যেতে দেবনা!” বেচারা সবার কাছ থেকে টাকাপয়সা সংগ্রহ করে, স্কুলের মাঠে টেবিল চেয়ার বিছিয়ে, উপহার কিনে, মানপত্রসহ সবার জন্য ব্যাক্তিগতভাবে কার্ড বানিয়ে আমাদের বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করল! ওর এই মায়া চিরিদিন মনে থাকবে।

পুনশ্চঃ আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে সে একবার বাসায় এসেছিল আমার বইখাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর আর কোনদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ওকে আর ওর অসাধারণ বোনদের আমার সবসময় মনে পড়ে।









Wednesday, October 20, 2010

আমি কিপটা বলছি

আমি ভীষণ কিপটা। যেমন আমি কখনো ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দেই না। একবার এক ভিক্ষুককে দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম। সে বোবা সেজে মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষে চাইত। বেচারার একটাও দাঁত ছিলোনা। দাঁত কি জন্মগতভাবে ওঠেনি নাকি ভিক্ষে করার জন্য সে উপড়ে ফেলেছিল আমি কখনো তাকে জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু এ’ছাড়া তার আর কোন সমস্যা ছিলোনা। তার একমাত্র কাজ ছিল কেউ এলে দরজা খুলে দেয়া। সদর দরজা ছিল বাসার দরজা থেকে খানিকটা দূরে। আমি তখন ছাত্রী। বাবামা থাকে ইন্ডিয়াতে। বারবার উঠে দরজা খুলতে গেলে পড়াশোনা ঘরের কাজ হয়না, তাই দারোয়ান রাখা। দাঁত নেই, ঝাল খেতে পারেনা তাই প্রতিদিন আমি নিজ হাতে তার জন্য রান্না করতাম। তখন বাসার কাজের লোকের বেতন হত সাধারণত দু থেকে তিনশ টাকার মধ্যে। আমি তার বেতন নির্ধারণ করেছিলাম পাঁচশ। কয়েকমাস কাজ করার পর সে একদিন আমার কাছে ছুটি নিয়ে গেল মায়ের সাথে দেখা করতে। সাতদিন পরও তার দেখা নেই। আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম সে অসুস্থ হয়ে পড়ল বা কোন বিপদ হোল কি’না। এ’সময় একদিন ভাইয়া এসে বল্ল ওকে আমাদের দোকানের সামনে ভিক্ষা করতে দেখেছে। আমি তো হতবাক! ওকে আমি এত বেতন দিলাম, এত যত্ন করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ালাম, আর সে কি’না …! ভাইয়াকে বললাম তাকে ধরে আনতে। সে এসে বোবার অভিনয় করতে শুরু করল। আমি বললাম, “তুমি মাসের পর মাস আমার সাথে কথা বলেছ, এখন বোবার অভিনয় করছ কেন? তুমি কাজ করবেনা ভালো কথা কিন্তু বলে তো যাবে!” সে তখন বল্ল, “আপা, আপনি এত আদর করেছেন যে আমি আপনাকে সামনাসামনি বলতে পারিনি, আপনি আমাকে অনেক টাকা বেতন দিতেন কিন্তু সে পরিমাণ টাকা আমি ভিক্ষা করে সপ্তাহে কামাতে পারি। তাই …” আমি কি বলব? তাকে যেতে দেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় রইলোনা।

আরেকবার ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে এক মহিলা ধরে বসল ভিক্ষা দিতেই হবে! স্বাস্থ্যবতী যুবতী কেন এভাবে ছেঁড়াফাটা কাপড় পরে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমেছে আমি বুঝে পেলাম না। তাকে বললাম, “আমার সাথে চল, আমি তোমাকে এক বাসায় কাজ দেব। ওরা খুব ভালো মানুষ। কাজও কম। তুমি ভালো থাকবে”। সে আরো কিছুক্ষণ ভিখারীরা সচরাচর যে ঘ্যানঘ্যানে টোনে কথা বলে সেভাবে টাকা চাইল। শেষে ট্রাফিক জ্যাম ছুটে গেলে যখন ট্যাক্সি চলতে শুরু করল হঠাৎ সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো, “হুহ! ভিক্ষা দেয়না আবার কাজ করতে বলে!” আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম আর আমার পাশে বসা আমার ননদ শেষপর্যন্ত হাসি সামলাতে না পেরে বলেই ফেল্ল, “ভাবী, তুমি খুব বোকা। তুমি কি মনে কর সে অভাবের কারণে ভিক্ষা করে? তুমি খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস কর!”

আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন এক বান্ধবী এসে জানালো কলেজে ব্যান্ড পার্টি আসবে। লীড সিঙ্গার আমাদের এক ছাত্রীর বয়ফ্রেন্ড। সে টাকাপয়সা নেবেনা। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ চান মেয়েরা অন্তত ৫ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ব্যান্ডদলকে কিছু উপহার দিক। আমার তখন ধর্ম সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলোনা। কিন্তু আমি এমন সম্পর্কে কখনো আস্থাশীল ছিলাম না যার কোন নীতিগত ভিত্তি নেই। যার অস্তিত্ব তাদের ঠকিয়ে টিকে থাকে যাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস আমাদের বড় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে সম্পর্কে আনন্দ আছে কিন্তু দায়িত্ব নেই তাকে আমি সম্মান করতে পারতাম না। তাছাড়া আমি নিজে গান ছেড়ে দিয়েছিলাম। যা আমি নিজে বিসর্জন দিয়েছি তাতে আমি আরেকজনকে কি করে উৎসাহিত করি? বান্ধবীকে বললাম, “আমি টাকা দিতে পারবনা”। সে বল্ল, “তুমি না এলে না এসো, পাঁচটাকা কোন ব্যাপার?” আমি বলেই ফেললাম, “পাঁচশ টাকাও কোন ব্যাপার না যদি আমি বিশ্বাস করি আমার এ’টাকায় কারো উপকার হবে। কিন্তু হুঁশজ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত নাচানাচি করার জন্য পাঁচটাকা কেন একপয়সাও আমি দেবনা”। বেচারী মুখ বেজাড় করে চলে গেল।

তাই বলি আমি খুব কিপটা। রিক্সাওয়ালা ভাইরা উলটাপালটা ভাড়া বললে আমি ঐ রিক্সায় উঠিনা তা সে আমার যত কষ্টই করতে হোকনা কেন, পেছনে পেছনে এসে ঠিক ভাড়া বল্লেও আমি আর তাদের দিকে ফিরে তাকাইনা। অথচ যারা ঠিক ভাড়া বলে তাদের নিজ থেকে কিছু বেশী দিতে আমার খারাপ লাগেনা। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? একবার কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখি প্রচন্ড ভীড়- অনেক ছাত্রছাত্রী, মাত্র কয়েকটা রিক্সা। ভাবছি কি কর্‌ব, এমনসময় এক রিক্সাওয়ালা ভাই দূর থেকে ডাক দিয়ে বললেন, “এই যে জুবিলী রোড আপা, মিনারা বোর্ডিঙ্ এর গলি, ছয়টাকা- আপা এদিকে আসেন”। বান্ধবীরা হতবাক হয়ে বল্ল, “আমরা রিক্সা পাইনা আর তোকে কি’না রিক্সাওয়ালা নিজে সেধে নিয়ে যায়!” এ’ঘটনা একবার নয় বহুবার ঘটেছে। তাই মনে হয় আমার ভাগ্যটা খুব ভালো। আমি নিজে যেমনই হইনা কেন, আল্লাহ সর্বস্তরের ভালোমানুষগুলোকে পথেপ্রান্তরে আমার সাথে মিলিয়ে দেন- হয়ত আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য!

একবার খবর পেলাম এক মেট্রিক পরিক্ষার্থী মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওর গার্মেন্টসকর্মী বিধবা মা এসে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ওর চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করার পর জানা গেল ওরা যে এলাকায় থাকে সেখানে বখাটে ছেলেরা মায়ের অনুপস্থিতিতে ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। সে ভয়ে বেহুঁস হয়ে পড়ার পর থেকেই অসুস্থ। হাফিজ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে ওদের আমাদের বিল্ডিং এ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্বা কিছুতেই ভাড়া দেবেন না যেহেতু আমাদের বাসার যে ভাড়া মহিলা ঐ পরিমাণ বেতনও পান না। উনিও জাস্টিফাইড কেননা রিটায়ার করার পর থেকে বিল্ডিং এর ভাড়াই আব্বার একমাত্র নিজস্ব ইনকাম। তখন কত যে মিথ্যা কথা বলে আব্বাকে রাজী করলাম! মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা আমার নীচতলায় থাকত। এত বছর ঐ ভাড়া কে চালিয়েছে আব্বা আজ পর্যন্ত জানেন না।

এভাবে পরীক্ষার্থীদের জন্য, বিয়ে দেয়ার জন্য, চিকিৎসার জন্য, ছোটছোট ছেলেমেয়েদের ম্যাগাজিন চালানোর জন্য, নলকূপ বসানোর জন্য, বাংলাদেশে ফেঁসে যাওয়া বিদেশীকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আরো নানান কাজে আল্লাহ একবারে সর্বোচ্চ ৫০,০০০ পর্যন্ত খরচ করার তাওফিক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। অনেক প্রজেক্টে নিজের টাকার পাশাপাশি সাহায্য পেয়েছি বাবামা, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এমনকি ছাত্রছাত্রীদের থেকে। এক ছাত্রীর কথা খুব মনে পড়ে। আমার প্রায় প্রজেক্টেই সে কন্ট্রিবিউট করত, প্রচুর পরিমাণে, যেমন একসাথে ত্রিশহাজার টাকাও সে দিয়েছে। কিন্তু এমন গোপনে সে টাকা দিত যেন সে চুরি করছে। সবসময় নতুন করে রিমাইন্ডার দিত যেন তার নাম কেউ না জানে। বাংলাদেশে এমন কত যে ভালো মানুষ আছে!

একবার এক মহিলাকে নিয়ে এক গার্মেন্টস মালিক ভাইয়ের কাছে গেলাম তাঁকে একটা চাকরী দেয়ার জন্য। উনি সম্ভ্রান্ত গৃহবধু ছিলেন কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশরের সম্পত্তির পাশাপাশি তাঁর স্বামীর অর্জিত বিশাল সম্পদ সব ভাসুর দেবররা দখল করে নিয়ে ওনাকে বঞ্চিত করেছে। ভাই সব শুনে বললেন, “রেহনুমা, আমি তাকে এই মূহূর্তেই চাকরী দিতে পারি। কিন্তু তিনি ঘর ছেড়ে চাকরী করতে আসছেন কেন বল? স্বামী মারা গিয়েছে, বাচ্চা দু’টোকে মানুষ করতে হবে, তাইত? কিন্তু উনি যদি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাইরে থাকেন তাহলে বাচ্চাগুলোকে মানুষ করবে কে?” আমি বললাম, “তাহলে কি করতে পারি ভাই? পরামর্শ দিন।” উনি বললেন, “উনি কি কি কাজ পারেন?” আমি বললাম, “উনি খুব ভালো সেলাই করতে পারেন”। ভাই বললেন, “ওনাকে বল বাজারের সেরা সেলাই মেশিন যেটা ওনার আরাম লাগে দেখে আমাকে জানাতে কত লাগবে”। ভদ্রমহিলাকে জানালাম। উনি সাতদিন মার্কেট সার্ভে করে ভয়ে ভয়ে জানালেন সবচেয়ে ভালো মেশিনটার দাম ১০,০০০ টাকা। আমি নিজেও একটু শংকিত বোধ করলাম কেননা ঐ মূহূর্তে ভাই কিছু দিলে বাকীটা আমার দেয়ার মত হাতে টাকা ছিলোনা। কিন্তু ভাইকে বলার সাথে সাথে উনি চেকবুক বের করে দশহাজার টাকার চেক সাইন করে দিলেন। শুধু চুপিচুপি বললেন এ’ব্যপারে যেন কেউ না জানে।

এসব কাজ করতে গিয়ে যে কত অসংখ্য অসাধারন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে! এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাই আমি কিপটা এ’ নিয়ে আমার কোন লজ্জা নেই। আমার বাবামা, জীবনসঙ্গী এবং যাদের সাথে আমার ওঠাবসা তারা এত ভালো এবং আমার এসব কাজের ব্যাপারে এত উৎসাহ দেন যে এতেই আমার জীবন সার্থক!

Tuesday, October 19, 2010

চট্টগ্রামের পর্দানশীন বোনেরা

আমাদের দেশে এটা প্রচলিত ধারণা যে সিলেট এবং চট্টগ্রামের লোকজন অপেক্ষাকৃত ধার্মিক হয়ে থাকে। হয়ত যারা এ’দেশে ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন তাঁদের অনেকের ঘাঁটি এসব অঞ্চলে থাকায় এতদঞ্চলে লোকজন ধর্মের ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হয়ে থাকবে আশা করেই এ’ধরণের ধারণা করা হয়ে থাকে। এ অনুমান কতটা সঠিক কতটা বেঠিক সে হিসেবে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান এবং জীবনের একটা অংশ এখানে কাটিয়েছি আমি। সে হিসেবে আমার বোনদের মধ্যে ইসলামের একটি মৌলিক বিধান পালন সংক্রান্ত যেসব ভুল ধারণা দেখেছি সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

কেউ যদি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে আমার ভুল ধরিয়ে দেন তাকে আমার সবচেয়ে বড় শুভাকাংখী মনে হয় কেননা তিনি বিচার বিশ্লেষন করে আমাকে আমার একটি ত্রুটি হতে মুক্ত হবার আহ্বান জানিয়েছেন। বোনেরা, আমি নিজেও আপনাদের একজন। তাই আপনারা আমার কথায় আহত না হয়ে যদি বোঝার চেষ্টা করেন আমরা উভয়েই উপকৃত হব।

আমি খুব একটা ইসলামিক পরিবারে জন্মাইনি। এখনো শিখছি। ইসলামের মৌলিক নিয়মগুলোর মধ্যে যে ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সবচেয়ে ঝামেলা হয় তা হোল পর্দা। আমরা অনেকেই জানিনা যে নামাজ বা রোজার মত পর্দাও পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ফরজ। অধিকাংশ মানুষ এখনো মনে করে পর্দা একটি অপশনাল ব্যাপার এবং এটি শুধু নারীদের জন্য প্রযোজ্য। অনেকের ধারণা পর্দা মানে শুধু একপ্রস্থ কাপড়। কিন্তু পর্দা মানে যে আচার আচরণ থেকে শুরু করে সৌন্দর্যের প্রদর্শন পর্যন্ত সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসা সেটা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি সেদিন থেকে আমি একে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি। সুকুমার রায়ের কবিতায় “নিয়মছাড়া হিসাবহীন” বাক্যাংশটি পড়তে যত ভালো লাগে আসলে কিন্তু প্রায় অনিয়মের মধ্যে তেমন ভালো কিছু পাওয়ার নেই।

আমি ফকীহ নই। সুতরাং পর্দাসংক্রান্ত ফিকাহের আলোচনায় যাবোনা। আমি সহজভাষায় যতটুকু বুঝি, পর্দা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন পোশাক যা শরীরের রঙ এবং আকৃতিকে ঢেকে রাখে এবং এমন আচরণ যা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে মানুষকে নিরাপদ রাখে। নারীদের আল্লাহ সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তাদের চুল থেকে নখ পর্যন্ত সবই আকর্ষনীয়- বিশ্বাস না হলে যেকোন ভাষায় যেকোন কবির প্রেমের কবিতা পড়ুন- তাই আল্লাহ তাদের শুধু মুখ এবং হাত ছাড়া বাকী সবটুকুই ঢেকে নিজেদের কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে বলেছেন যারা অবিসংবাদিতভাবে মেয়েটির ভালো চায়। পুরুষদের যেহেতু আল্লাহ ভারী কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাদের এমন আহামরি কোন সৌন্দর্য দেননি; সুতরাং তাদের জন্য শারিরীক পর্দার পরিধিও অনেক কম করে দিয়েছেন। আচরণের দিক থেকে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ কম বিধায় তাদের জন্য পর্দা অনেক বেশী কঠোর করে দেয়া হয়েছে- দৃষ্টি থেকে শুরু করে বাড়ীতে প্রবেশ পর্যন্ত সর্বত্র তাদের সাবধানতা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। এদিক থেকে মেয়েদের তরল গলায় বা আজেবাজে কথা বলা ছাড়া আর তেমন কোন বাঁধা দেয়া হয়নি। উভয়ের কথা বলার ক্ষেত্রে কেবল প্রয়োজনীয় কথার মধ্যেই সীমিত রাখার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে কেননা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণ থেকে কি কি হয় তা নিয়েই পৃথিবীর তাবৎ নাটক সিনেমা রচনা করা হয়।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আমি যখন আবুধাবী থেকে ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম থাকতে আসি তখন কিছু কিছু জিনিস দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যাই। আবুধাবীতে দেখতাম যারা পর্দা করতেন তাঁরা সম্পূর্ণভাবে করতেন আর যারা করতেন না তাঁরা করতেন না। চট্টগ্রাম এসে প্রথম দেখলাম মহিলারা বোরকা পরে হাঁটছেন কিন্তু তাদের মাথার কাপড় গলায় পেঁচানো! মাথাও ঢাকছেনা, শরীরও ঢাকছেনা! তাঁরা কখনো সেই স্বচ্ছ ওড়না তুলে আধামাথায় দিচ্ছেন আবার কখনো খুলে সবার সামনে চুল ঠিক করছেন। আমি মহাফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। যাদের দেখে আমি নিজেই হতবাক, স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখে আমার বাবামাকে বোঝানো কঠিন হবে আমি কেন পর্দা করতে চাই।

কলেজে যাওয়া শুরু করার পর দেখতে পেলাম অনেক মেয়েরা পরিবারের চাপে বাসা থেকে বোরকা পরে বেরোচ্ছে কিন্তু রিক্সায় উঠেই ওড়নাসহ খুলে শুধু অ্যাপ্রন পরে কলেজে আসছে! আরেকবার চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে এক অসাধারন সুন্দরীকে দেখলাম শ্বশুরবাড়ীর সবাই বিদায় জানাতে এসেছে। প্লেনে উঠেমাত্র দেখি তিনি বোরকা স্কার্ফ সব খুলে ফেললেন, পাশে বসা স্বামী নির্বিকার! আমার খুব মায়া লাগত ওদের জন্য। ওদের বাবামা সমাজ ওদের ওপর জগদ্দল পাথরের মত করে পর্দা চাপিয়ে দিয়েছে কিন্তু এর কি প্রয়োজন বা কেন করতে হবে তা তাঁরা নিজেরাই জানেননা। এটা তাঁদের কাছে একটা ফ্যামিলি ট্রেডিশন, আর কিছুই না। যা তারা বোঝেনা তা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে মেয়ারাই বা কি করে মেনে নেবে? আমার খুব দুঃখ হত। ওরা পর্দা করার সুযোগ পেয়েও খুলে ফেলছে আর আমি করতে চাইছি কিন্তু এই নিয়ে আমার পরিবার আমার ওপর মহাখাপ্পা!
চট্টগ্রামে একটা ট্রেডিশন আমার ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগে। যে মেয়েরা বাইরে পর্দা করে তারা ঘরে কেউ এলে নির্দ্বিধায় তাদের সামনে বেপর্দা অবস্থায় চলে যায়। এ’ব্যাপারটা যে কত হাস্যকর তা কারো মাথায়ই আসেনা! যদি পর্দার উদ্দেশ্য হয় যে ব্যাক্তি শুভাকাংখী নয় তার কাছ থেকে নিজের সৌন্দর্য গোপন করা তাহলে তার সামনে এই সৌন্দর্য এক জায়গায় গোপন আর আরেক জায়গায় প্রকাশ করলে কি লাভ? এর মানে এই নয় যে বাসায় মেহমান এলে বোরকা পরে যেতে হবে, কিন্তু মাথায় ওড়না তো দিতে হবে!

আরেকটা মজার ব্যাপার হোল বেপর্দা হয়ে ছবি তোলা! যে মেয়েটি পর্দা করে সেও বেপর্দা হয়ে ছবি তোলে এবং আজকাল ফেসবুকের কৃপায় সে ছবি সবাই দেখতে পায়। ক্যানাডায় আসার জন্য যখন ছবি তুলতে গেলাম ক্যামেরাম্যান খুব স্বাভাবিকভাবে বল্ল, “আপনি ওড়না খুলে ফেলেন”। আমি হাঁ করে তাকিয়ে বললাম, “মানে?” সে বল্ল, “মাথায় কাপড় দেয়া ছবি হলে আপনি ক্যানাডায় যেতে পারবেন না”। আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল, “আপনার কাজ ছবি তোলা আপনি ছবি তোলেন, ক্যানাডার সরকার আমাকে মাথায় কাপড় দিলে নেবে কি নেবেনা আপনার চিন্তা করতে হবেনা; আর না নিলেও সমস্যা নাই, ক্যানাডায় না গেলে আমার বেহেস্তের টিকেট ক্যান্সেল হবে বলে কথা নেই”।

আজকাল যেসব ফ্যাশন বেরোচ্ছে তাতে মনে হয় কাপড় কম পড়েছিল বিধায় জামা টাইট এবং সালোয়ার ছোট হয়ে গিয়েছে আর ওড়নার প্রস্থ কমে চিমসে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে লেটেস্ট ডিজাইনের জামা পরতে হবে বলে তো কোন কথা নেই। আমার এক বান্ধবী আজীবন কেবল পাঞ্জাবী স্টাইল পরলো। সে পর্দা করেনা কিন্তু সে বোঝে তাকে এই ডিজাইনেই সবচেয়ে ভালো লাগে। তাহলে আমাদের কেন এমন জামা পরতে হবে যাতে পর্দা চুলোয় যাক, ন্যূনতম ভদ্রতা পর্যন্ত বজায় থাকেনা? ভীষণ আশ্চর্য একটা ঘটনা হোল অনেকে হাফহাতা জামা পরে তার সাথে স্কার্ফ পরে, অনেকে বোরকা পরে এত টাইট যে মনে হয় এর চেয়ে শুধু জামা পরলেই ভালো হত আর অনেকের আচরনে পর্দার লেশমাত্র থাকেনা। যেহেতু হাতের কব্জী পর্যন্ত পর্দার অন্তর্ভুক্ত হাফহাতা জামার পরলে সাথে স্কার্ফ পরলেও পর্দার শর্ত পূরণ হয়না। বোরকার উদ্দেশ্য যেহেতু শরীরের আকার বোঝা না যাওয়া, টাইট বোরকা পরলে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছেনা। আর আচরণে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে একপ্রস্থ কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা পাওয়ার আশা দুরূহ। একবার বানিজ্যমেলায় গিয়েছি আমার মেয়ের জন্য ক্লিপ কিনতে। আমরা আই আই ইউ সি’র সব মহিলারা একসাথে যেতাম ভর দুপুরে যখন মেলা ফাঁকা থাকত। ক্লিপের দোকানে ঢুকে বাচ্চাদের ক্লিপ দেখছি এমন সময় দেখি এক বোরকাপরা মহিলা ঢুকলেন, কয়েকটা কাঁটা বেছে নিলেন, তারপর মাথার ওড়না খুলে একটা একটা করে কাঁটা মাথায় লাগিয়ে দোকানদারদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন তাঁকে দেখতে কেমন লাগছে! আমার চেহারা দেখে ফাহমিদা আমাকে টেনে নিয়ে গেল, “আপা, অন্য দোকানে চলেন”।

সবচেয়ে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা যায় বিয়েবাড়ীতে যে কারণে আমি আমার নিজের বিয়ের সময় পর্যন্ত বিয়েবাড়ীতে যেতে চাইনি। এক এক জনের সাজপোশাক দেখে আমি আর কিছুতেই তাদের চিনতে পারিনা। যেমন ধরুন এক বিয়েতে আমার ছাত্রীর মাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার ছাত্রী আসেনি?” উনি বললেন, “ঐতো বৌয়ের পাশে! আপনি ওকে দেখতে পাচ্ছেন না?” ছাত্রী ইউনিভার্সিটিতে বোরকা পরে আসে। আমি বৌয়ের আশেপাশে কোন ওড়না পরা মেয়েও দেখছিলাম না। আমার বিহবল চেহারা দেখে উনি বললেন, “ঐ যে লাল লেহেঙ্গা পরা!” এবার দেখতে পেলাম কিন্তু একনজর দেখেই আমি লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। বোরকা কোথায়? সে পরে এসেছে হিন্দি সিনেমার মত ছোট্ট একটা ব্লাউজ একখানা স্কার্টের সাথে, ঘাড় থেকে একপাশে ঝুলানো ওড়না! মনে মনে ধিক্কার দিলাম ওর মাকে যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে বোরকা পরে এসেছেন অথচ উনি এখন পর্দা না করলেও ওনার দিকে কেউ তাকাবেনা, আর যে মেয়েকে উনি বোরকা পরে ইউনিভার্সিটি পাঠান তাকে তিনি অর্ধউলঙ্গ করে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন যেখানে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ তাকে দেখছে! এটা বিয়েবাড়ীতে সচরাচর ঘটনা। অনেক বয়স্কা মহিলারা পর্যন্ত বিয়েবাড়ীতে গেলে বোরকা খুলে মাথার কাপড় ফেলে দেন। আর গহনার পরিমাণ এবং আকারের প্রতিযোগিতায় পর্দা যে কোথায় ফেলে দেয়া যায় তাছাড়া আর কিছু তখন কারো মাথায় থাকেনা। পর্দার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা হয় তবে বিয়েবাড়ীর এই প্রতিযোগিতাকে জ্ঞানের অভাব ছাড়া আর কি বলব?

পুরুষ সহকর্মীদের অনেকেই দুঃখ করতেন যে তাঁদের স্ত্রীদের এক এক বিয়েতে সাজার জন্য পার্লারের খরচ দিতে তাদের মাসের খরচ ব্যায় হয়ে যেত! প্রত্যেক অনুষ্ঠানের জন্য নতুন নতুন শাড়ী আর গহনার সেট চাই। দাওয়াত পেলেই বেচারাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ত!

পুরুষদের ব্যাপারেও বলতে হয় তাঁরা চোখের পর্দা করার ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন। বিশ্বাস না হয় দেখুন প্রত্যেক বিয়েবাড়ীতে মেয়েদের হলে ঢোকার জন্য পুরুষরা কিভাবে লাইন দেন। যেখানে বলা হয়েছে নিজের ঘরে পর্যন্ত প্রবেশ করার সময় নক করতে সেখানে চট্টগ্রামে খালাত ভাই, মামাত ভাই, ফুপাত ভাই, চাচাত ভাইরা বোনদের রুমে নক না করেই ঢুকে পড়ে যখনতখন, যেন এটা তাদের জন্মগত অধিকার! তাদের সুবিধা-অসুবিধা চিন্তা না করেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে তাদের ঘরে। নতুবা রান্নাঘরে বসে বসে গল্প করে। অথচ মেয়েদের রান্নাঘরে কাজ করার সময় পর্দা বজায় রাখা কতটা কঠিন ব্যাপার তা নিশ্চয় সবাই জানেন। হাসপাতালে সদ্যপ্রসূতির রুমে বসে থাকা পুরুষ আত্মীয়দের দেখুন যাদের নতুন মায়েরা না চলে যেতে বলতে পারেন না পারেন সঠিকভাবে বিশ্রাম নিতে। এক বান্ধবীর বিয়ের ছবি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ওর দু'পাশে, পেছনে সব ওর স্বামীর বন্ধুরা বসে ছবি তুলেছেন! ওর স্বামী যে তাঁদের বৌয়ের পাশে বসিয়ে নিজে ছবি তুল্লেন এ’ কি ধরণের আত্মসম্মান বা ওর পর্দার প্রতি উনি কি সম্মান দেখালেন?

এভাবে আরো অনেক বোঝার অভাব সংক্রান্ত সমস্যা আছে চট্টগ্রামের পর্দার ট্রেডিশনে। আমরা যদি ট্রেডিশন মনে না করে একে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করি এবং এ’ব্যাপারে সঠিকভাবে জানার চেষ্টা করি, যা শিখলাম সে অনুযায়ী পালন করি তাহলে এসব ভুল বুঝাবুঝির অবসান হতে পারে। আমি নিজে নিখুঁত নই তাই অন্যের ভুল ধরতে চাইনা। কিন্তু আমার মনে হয় যা করব তা সঠিকভাবে জেনেবুঝে করা উচিত যেন আমার কারণে আরেকজনের মধ্যে কোনপ্রকার অহেতুক সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি না হয়।

Friday, October 15, 2010

ক্ষণিকের দেখা


চলার পথে হঠাৎ দেখা কিছু কিছু মুখ অকারণেই মনে গেঁথে যায়, অবসরে শুধু শুধুই মানসপটে উঁকি দিয়ে যায়।

আমার খুব মনে পড়ে দুবাইগামী সেই যুবককে যাকে এয়ারপোর্টের বাসে উঠতে উঠতে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে আমার শিশুচোখ দু’টো খুব অবাক হয়েছিল, “এতবড় ছেলেরাও কাঁদে?!”

মানুষের ছোটখাটো মানবিক আচরণগুলো আমাকে খুব স্পর্শ করে। তাই মনে পড়ে এয়ারপোর্টের বাসে নিজের সীট ছেড়ে আমাদের বসতে দেয়া সেই ভ্রমণক্লান্ত ভদ্রলোকের কথা যাকে দেখে আমার বালিকামন বলেছিল, “আমার ছেলে হলে যেন এমন হয়!” মনে পড়ে কলকাতার ট্রামে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে যিনি ট্রামের পেছনে বসে ছিলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সামনে। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের দিয়ে তিনি খবর পাঠালেন আমি যেন তাঁর কাছে যাই। দাঁড়িয়ে থাকা নারীপুরুষের ভীড় ঠেলে তাঁর কাছে পৌঁছুলে তিনি ধুতি ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এই স্টপে নেমে যাব মা, আমার জায়গায় বসার জন্য তোমাকে ডেকেছি”। আমার এখনো অবাক লাগে তাঁর কাছেই এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনি কেন আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন সামনে থেকে যেখানে আমি ছিলাম একমাত্র বোরকাপরিহিতা যুবতী!

মাদ্রাজ থেকে কলকাতা আসার সময় দেখা প্লেনে দেখা এক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে। লম্বাচওড়া, ফর্সা, দাঁড়িওয়ালা চেহারা দেখে পাঠানের মত লাগল। কথা বলতে বলতে জানলাম তাঁর বাড়ী পাকিস্তান, তবে তিনি হিন্দু। যে দু’টো ধর্মের উৎপত্তি পাকিস্তানে- হিন্দু এবং শিখধর্ম, অথচ দু’টোর একটিও এখন পাকিস্তানের মূল ধর্ম নয় বা তাদের পাকিস্তানী অনুসারীদের কখনো দেখিনি- তাদের একজনকে দেখে আমার ভীষণ মজা লাগল, কারণ এটা একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। প্লেন থেকে নামার সময় উনি আমার ব্যাগ নিতে সাহায্য করতে চাইলে আমি মানা করলাম, “ব্যাগ অনেক ভারী, আপনি আল্গাতে পারবেন না”। উনি বললেন, “তুমি আমার সাইজ দেখেছ?” আমি বললাম, “ঠিক আছে, চেষ্টা করেই দেখেন”। ব্যাগ তুলতে গিয়ে উনি একপাশে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “বাপস, এর মধ্যে কি আছে? ইট নাকি?” আমি হাসতে হাসতে ব্যাগের আরেকপাশ ধরে বললাম, “না, বই, ওজনে না হলেও সম্মানের ভারে ভারী হয়ে যায়!”

মনে পড়ে বিসিএস পরীক্ষার ইন্টারভিউ দিতে যাবার ঘটনা। যাবার পথে পাশের সীটে বসা ভদ্রমহিলা খাইয়েছিলেন এই খুশীতে যে আমি আমার সার্টিফিকেটগুলো স্যুটকেসে না দিয়ে হাতে নিয়েছি। আসার পথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বডিগার্ড বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের চারজন ছিলেন বাসে আমার সামনে পেছনে পাশে বসা। তাঁরা আগেভাগেই চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে তাঁর নিরাপত্তার প্রস্তুতি নিতে। তাঁদের বিভিন্ন বাহিনী থেকে খন্ডকালীন রিক্রুট করা হয়। বেচারারা নিজ দায়িত্বে পুরো রাস্তা আমাকে দেখেশুনে রাখলেন! আমি আশ্চর্য হলে তাঁদের একজন বললেন, “আমাদেরও বোন আছে, আমরা আপনাকে দেখলে আমাদের বোনদেরও হয়ত কেউ দেখবে”।

এই চেহারার কালেকশন নিয়তই বেড়ে চলেছে। তার সাথে সাথে বেড়ে চলেছে এই বিশ্বাস যে পৃথিবীর মানুষগুলো আসলে খুব ভালো। পরিস্থিতির কারণে হয়ত আমরা অনেকসময় অনেক অদ্ভুত আচরণ করি কিন্তু স্বভাবগতভাবে মানুষ মূলত ভালো।

Friday, October 8, 2010

ভালোবাসা মানে কি ধরে রাখা না ছেড়ে দেয়া?




কোথাও পড়েছিলাম, When you love someone, you give them what they want. এখানে they শব্দটি মূখ্য এবং you শব্দটি গৌণ। অর্থাৎ যাকে ভালোবাসেন তার ইচ্ছেটাই মূখ্য।

আমরা আমাদের আশেপাশে সাধারণত দু’প্রকার ভালোবাসা দেখতে পাই। একপ্রকার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, ততটুকু, যতটুকু মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব। আরেকপ্রকার ভালোবাসায় স্বার্থের মিশ্রণ সুস্পষ্ট। প্রথমপ্রকার ভালোবাসায় ব্যাক্তি প্রিয়জনের জন্য তাই চায় যা প্রিয়জন চায় যদিও এতে করে সে প্রিয় ব্যাক্তিটির সংসর্গবঞ্চিত হয়। আর দ্বিতীয়প্রকার ভালোবাসায় সে প্রিয়জনকে ধরে রাখার জন্য তাকে কষ্ট দিতেও পিছপা হয়না।

আজকাল দ্বিতীয় প্রকার ভালোবাসার দৌড়াত্ম্য দেখে ভয় হয় যদি এ’বিষয়ে কিছু বলি, মানুষ মনে করবে আমি পাষানহৃদয়, ভালোবাসা কাকে বলে তার আমি কি জানি! আজ My Sister’s Keeper ছবিটি দেখে সাহস পেলাম যে আরো কিছু মানুষ আমার মত করে ভাবে।

বহুদিন অপেক্ষা করে ছিলাম ছবিটি দেখার জন্য। কাহিনী খুবই সাধারণ। এক ভদ্রমহিলা যখন জানতে পারলেন যে তার বড় মেয়েটির লিউকেমিয়া তখন তিনি আরেকটি সন্তান নিলেন যাতে করে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে তার শরীর থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে বড় সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তেরো বছর বয়সে উপনীত হয়ে ছোট মেয়েটি এক বিখ্যাত উকিলের সাথে কথা বলে কেস করে দিল যাতে তার শরীর থেকে আর কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেয়ার ওপর আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা সংগ্রহ করা যায়। বড় মেয়েকে দেখাশোনার জন্য কাজ ছেড়ে দেয়ার আগে মা নিজেও উকিল ছিলেন। তিনিও লড়াই না করে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নন। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না যে মেয়ে বড়বোনকে এত ভালোবাসে সে হঠাৎ এভাবে বেঁকে বসল কেন। কোর্টে কেসের শুনানীর এক পর্যায়ে ছোট মেয়েটির জবানবন্দী নেয়ার সময় দুই বোনের মধ্যবর্তী ভাইটি ফাঁস করে দেয় যে বড় মেয়েটি জানে তার রোগের কোন চিকিৎসা নেই, সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত অথচ মা চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। বড়বোন তখন ছোটটিকে বোঝালো সে এই “life of pain” থেকে বাঁচতে চায়, সে মৃত্যুর মাধ্যমে এই কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি চায়। তখন দুইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে মায়ের সাথে কথা বলে মাকে বোঝানোর চেয়ে এইভাবেই তার চিকিৎসা বন্ধ করে তাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করা যায়। শেষপর্যন্ত মা নিজেও বুঝতে পারেন মেয়েটি কি কষ্টে আছে এবং এই মূহূর্তে তার জন্য জীবনের চেয়ে মৃত্যুই সহজ। মেয়েটি মারা যায় কিন্তু তার পরিবার তাকে মনে রাখে সবসময়।

মৃত্যু একটি স্বাভাবিকতা। জন্মের সাথে সাথে মৃত্যু আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যে পরিণত হয়। জীবনের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা পরবর্তী পর্যায়ে চলে যাই। সক্রেটিস বিষপানের সময় তাঁর শিষ্যদের কাঁদতে দেখে বলেন, “Death may be the greatest of all human blessings.” মৃত্যুকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে একটিমাত্র ক্ষেত্রে আপত্তি থাকতে পারে; যদি আমরা মনে করি যে এটি সকল কিছুর সমাপ্তি।

পরিচিত মহলে বেশ কয়েকটি কেস দেখে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম যে বৃদ্ধ বাবামাকে মেশিন দিয়ে মাসের পর মাস vegetable state-এ রেখে দিয়ে তাদের নামমাত্র বাঁচিয়ে রাখা অন্যায়। তাঁরা তাঁদের আয়ু পূর্ণ করেছেন এবং যখন তাদের চলে যাবার সময় হবে তখন যেকোন এক উসিলায় মৃত্যু তাদের সামনে উপস্থিত হবে। সে সময় চিকিৎসার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু কোন চিকিৎসা নেই বলে মেশিন দিয়ে শুধু তাদের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁদের প্রতি জুলুম। আমি নিজেকে দিয়ে চিন্তা করি। আমার বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা যেদিন থেকে কাজ করবেনা সেদিন থেকে আমার বেঁচে থাকার কোন উদ্দেশ্য থাকবেনা। সেক্ষেত্রে আমার শরীরটকে যদি মেশিন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে আমার সন্তানেরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে মা আছেন বা আমরা টাকা পয়সার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মাকে বাঁচিয়ে রেখেছি- সেটা কি হাস্যকর হবেনা? কি জানি, আমি এতে পরিতৃপ্ত হবার মত কিছু দেখিনা। শরীরটা আমার হতে পারে কিন্তু আমি সেই শরীরের চেয়ে নিজেকে আরেকটু বেশী কিছু মনে করি। সেই বেশী কিছুর অস্তিত্ব যদি না থাকে তবে শুধু খোলটা জিইয়ে রাখা বোকামী নয় কি?

যাকে ভালোবাসি তাকে ধরে রাখার চেয়েও ছেড়ে দেয়া অনেক সময় অনেক বড় ভালোবাসার দাবী। এটা বুঝতে পারলে হয়ত আমরা বাবামাকে মেশিন দিয়ে জিইয়ে না রেখে তাদের জীবদ্দশায় তাদের সাথে সময় কাটানোর বা তাদের খুশী রাখার ওপরেই বেশী গুরুত্ব দিতাম।