‘অমানুষ!’
হুংকার শুনে পেছনে তাকিয়ে নাইমা বুঝতে পারল কথাটা তাকেই বলা হয়েছে। ওখানে শ্বশুরমহাশয়, শ্বাশুড়ীমা, ওর স্বামী বসা। কেউ ওর ননদকে জিজ্ঞেস করলনা কি কারণে এতবড় একটা গালি তাকে দেয়া হোল। শ্বশুরমহাশয় শান্তিপ্রিয় ভালোমানুষ। তিনি নাইমার প্রতি স্ত্রীকন্যাদের এসব ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু নাক গলিয়ে তাদের বিরাগভাজন হতে নারাজ। স্বামী বেচারা সংসারের চাপে অস্থির। কিছু বলতে গেলে ঘরে অশান্তির সৃষ্টি হবে, ঝটকাটা যাবে নাইমার ওপর দিয়েই। তাই নাইমা নিজেই মুস্তাফাকে বলেছে সে যেন কখনো কিছু না বলে। ফলে সবাই নির্বাক। নাইমার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির জবাবে নাজ কোনপ্রকার ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলনা। মুখ বাঁকিয়ে বীরদর্পে ভেতরে চলে গেল। নাইমা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে সাথে তিনজন মহিলা আর ওর বাচ্চাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নাইমার বিয়ে হয়েছে দশবছর। এখনো কেন সে এই ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে শেখেনি? এতদিনে তো ওর অভ্যস্ত হওয়া উচিত ছিল! নাকি এই ব্যাপারগুলোই এমন যে কেউ অভ্যস্ত হতে পারেনা?
ট্যাক্সিতে বসে ওর মন হারিয়ে যায় স্মৃতির সেলুলয়ডে। দশ বছর আগে যেদিন সে এ’ বাড়ীতে প্রথম পা রাখে, মুস্তাফার বড়বোন ওকে বসিয়ে সুপরামর্শ দেন, ‘দেখ, তুমি কখনো মনে কোরনা তুমি আমাদের একজন। তুমি যাই কিছু করনা কেন, আমরা তোমাকে আপন মনে করবনা, বুঝলে? সুতরাং তুমি আপন হবার চেষ্টাও কোরনা। তুমি বৌ, বৌয়ের মতই থেকো’। নাইমা হতভম্ব হয়ে ভাবে, বৌ কি কোন আলাদা শ্রেণীর প্রাণী? একজন মানুষ যদি একটি পরিবারের জন্য তার বাবামা, ভাইবোন, শৈশব কৈশোরের সোনালী দিন কাটানো সেই বাড়ীঘর, সেই প্রাণের মেলার সাথী বন্ধু- সব, সব ছেড়ে আসতে পারে, তবে কেন সে এই পরিবারে বাকী জীবনটা এক আগন্তুক হয়েই কাটাতে বাধ্য হবে? সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, কথাটা যিনি বললেন তিনি নিজেই আরেক বাড়ীর বৌ! তবু কেন তিনি তাকে আশ্বাস দিলেন না, বললেন না, ‘আজ থেকে এটাই তোমার বাড়ী, তুমি আমাদেরই পরিবারের একজন’? হোক না মিথ্যা! একজন মানুষকে মিথ্যামিথ্যিই যদি একটু ভালোবাসা দেয়া হয়, হতেও তো পারে তা একসময় সত্যি! একটু দরদমাখা কথা, পারে তো বুকের ভেতর সব ছেড়ে আসার ক্ষতে সামান্য মলম হতে!
বিয়ের পরদিন থেকেই নাইমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে রান্নাঘরে। মুস্তাফা বিরক্ত হয়, ‘তুমি আসার আগেও পঁয়ত্রিশ বছর এ’ সংসারে খাওয়াদাওয়া চলেছে তো! তোমাকে এখনই রান্নাঘরে যেতে হবে কেন?’ নাইমা বোঝাতে পারেনা সে ঘরের সবাইকে খুশী করতে চায়, সবার ভালোবাসা পেতে চায়। মুস্তাফা বলবে, ‘কেন, আমার ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?’ বেচারা! বয়স হয়েছে কিন্তু ম্যাচুরিটি আসেনি। বিয়ের আসরে নাইমার বান্ধবীর স্বামী মুস্তাফার সালামের জবাব দেয়নি বলে মুস্তাফার চোখ ছলছল করে ওঠে, ঘরে এসে বারবার নালিশ করে নাইমার কাছে। কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজী না ওর মা নতুন বৌকে রান্নাঘরে যেতে বলতে পারে। ওর মায়ের মত মানুষ কি দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি হতে পারে? নাইমা এই ধারণা নষ্ট করে দিতে চায়না। সে জানে বিয়ের পর পর ওদের একসাথে সময় কাটানো প্রয়োজন- পরস্পরকে বোঝার জন্য, জানার জন্য- এই সময় আর কখনো ফিরে আসবেনা। কিন্তু মুস্তাফাকে সে জন্ম দেয়নি, মানুষও করেনি। যিনি এই কষ্ট করে তাকে একজন ভালো স্বামী উপহার দিয়েছেন তার ব্যাপারে সে মুস্তাফাকে কোন বিরূপ ধারণা দিতে চায়না।
নাইমা বোঝে, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মায়েরা ভুলে যান তাঁরাও একসময় বৌ ছিলেন। নতুন মেয়েটিকে আপন করে নেয়ার পরিবর্তে তারা তার কাছে এত বেশী আশা করতে শুরু করেন যা সুপারম্যানের পক্ষেও পূরণ করা অসম্ভব! বাসার বুয়ার প্রতি যতটুকু সহানুভূতি দেখানো হয়, বৌ ততটুকুরও দাবী রাখেনা। তার ইচ্ছাঅনিচ্ছা বলতে কিছু থাকেনা- কোনদিন শরীরে বা মানসিকতায় না কুলালে বৌ হয়ে যায় ‘কুঁড়ে’, ‘আলসে’ বা ভাগ্য খারাপ হলে ‘বেয়াদব’ খেতাবের স্বত্ত্বাধিকারী। এই চাহিদার বিপরীতে এক হেরে যাওয়া রেস জেতার জন্য প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে সে। সে জানত একসময় সে হেরে যাবে। তবে হারটা এত তাড়াতাড়ি আসবে সে ভাবেনি।
বিয়ের পর ছোট ননদটাকে সে বুকের ভেতরকার সব ভালোবাসা ঢেলে দেয়। নিজের ভাইবোনদের ছেড়ে আসার কষ্ট নাজকে ভালোবাসা উজার করে দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বাজারে একটা সুন্দর জিনিস দেখলে নিজের জন্য না কিনে ওর জন্য নিয়ে আসে, অসুখবিসুখ হলে সব ছেড়ে দিয়ে সেবাযত্ন করে। কিন্তু শ্বাশুড়ীমা’র আস্কারায় নাজ ওর সাথে প্রচন্ড দুর্ব্যবহার করতে থাকে। যাকে এতখানি ভালোবাসে তার কাছ থেকে আঘাত পেতে পেতে সে আর সহ্য করতে পারছিলনা। একদিন শ্বাশুড়ীমাকে একান্তে ডেকে বলল, ‘মা, আজ তিনবছর আমি আপনাদের সাথে আছি। যদি আমি ভুল করি বা অন্যায় করি আপনি আমাকে দু’টো থাপ্পর দিয়েন, বুঝিয়ে দিয়েন, বকা দিয়েন, যা ইচ্ছে কোরেন। আপনি আমার মা, আমি কিছুই মনে করবনা। কিন্তু নাজ আমার ছোটবোন। ও যখন আপনাদের সামনেই আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে, আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। সে ছোটমানু্ষ, বোঝেনা, কিন্তু আপনি যদি ওকে বুঝিয়ে বলেন, ও নিশ্চয়ই এ’ব্যাপারে সচেতন হবে’।
উনি জবাব দিলেন, ‘শোন, তুমি নিজেকে এত ভালো মনে কর কেন? নিজেকে খারাপ মনে করতে শেখ। তুমি খারাপ বলেই নাজ তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। ও যা করে ঠিক করে’।
নাইমা স্তম্ভিত হয়ে গেল। একজন মানুষ শত আঘাত সহ্য করতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তার আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানি করার চেয়ে কঠিন আঘাত আর কি হতে পারে? সে যাকে মা ডাকল তিনি তার সম্মানবোধই ধূলিস্যাৎ করে দিলেন! নাজ যদি আজ নাইমার সাথে দুর্ব্যবহার করে বাঁধা না পায়, কাল শ্বশুরবাড়ী গিয়ে সে সবার সাথে এই ব্যবহারই করবে। ওরা কি তা সহ্য করবে? শ্বাশুড়ীমা ওকে কষ্ট দেয়ার জন্য নাজকে ব্যবহার করতে গিয়ে যে নিজের মেয়ের জীবনটাই পক্ষান্তরে ধ্বংস করতে যাচ্ছে্ন তা কি তিনি বোঝেন না?
নাইমা একেবারে নেতিয়ে পড়ল। এতদিন যে প্রাণপণ চেষ্টা ছিল সবাইকে খুশী করার, শরীরের বাইরে গিয়ে সবার জন্য করার, নিজেকে দমন করে সবার চাহিদা মেটানোর- হঠাৎ সব কেমন অর্থহীন মনে হতে লাগল। সে নিজের ব্যাপারেই দ্বিধায় পড়ে গেল, ‘আমি কি সত্যিই খারাপ? আমি তো জেনেশুনে কারো ক্ষতি করিনা, কাউকে কষ্ট দেইনা, সম্ভব হলে উপকার করার চেষ্টা করি, না পারলে ক্ষমা চেয়ে নেই। তাহলে আমি কি এমন খারাপ কাজ করলাম যে যাকে মা মনে করলাম তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন আমি খারাপ বলেই আমার সাথে পশুতুল্য আচরণ করা যায়?’ ওর বুকটা খা খা করে ওঠে। কিন্তু চোখে পানি আসেনা। মুস্তাফাকে বললেও সে বিশ্বাস করবেনা। আর বলার স্বভাব তো নাইমার নেই। বাবামাকে বলার প্রশ্নই আসেনা, তাহলে ওঁরা চিন্তিত হবেন মেয়ে কষ্টে আছে ভেবে।
একমাস এই কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে সে সিদ্ধান্তে আসে, কে কি বলল বা করল তার সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই। একজন মানুষ হিসেবে ওর দায়িত্ব পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সবার প্রতি আন্তরিকতার সাথে মানবিক দায়িত্ব পালন করা, সে তাই করবে। কে খুশী হল বা না হল তা কোন মানুষের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং ওর পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সে করে যাবে। যা ওর পক্ষে করা সম্ভব নয় তা ছেড়ে দেবে যেহেতু মরে গিয়েও মানুষকে খুশী করা সম্ভব নয়।
বাচ্চা হবার পর দেখা গেল আরেক ঝামেলা। শ্বাশুড়ীমা বড়মেয়েকে সাথে রাখেন যাতে উনি ওর বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারেন, সে নিশ্চিন্তে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু নাইমাকে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘দেখ, শাহীনের তিনটা বাচ্চা দেখার পর আমার পক্ষে তোমার বাচ্চা রাখা সম্ভব না। তুমি দরকার হলে লেখাপড়া বন্ধ করে দাও। আমি তোমার বাচ্চা দেখতে পারবনা’।
নাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘মা, এই শিশুটি শুধু আমার নয়, শাহীনের মত ওর বাবা মুস্তাফাও আপনার সন্তান। শাহীনের সন্তানদের মত ওরও অধিকার আছে আপনার ওপর। আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন তখন আমিই থাকব আপনার পাশে, শাহীন চলে যাবে ওর নিজের সংসারে। মাঝে মাঝে সে আপনাকে দেখে যাবে। কিন্তু দিনরাত সেবাযত্ন আপনি আমার কাছেই পাবেন’।
কথাগুলো সে বলছিল মনে মনে। বাবামা শিখিয়েছেন মুরুব্বীদের মুখে মুখে কথা বলতে হয়না। বড় হয়ে বুঝেছে ব্যাপারটা শোভন নয়। সুতরাং সে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে চলে যায়।
নাইমার বাবামা থাকে আরেক জেলায়। সে ওখানে গিয়ে থাকলে এখানে ঘরের কাজ কে করবে? সুতরাং, উপায় একটাই, সে শিশুটিকে ইউনিভার্সিটিতে সাথে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। নাইমা কিছু না বললেও মুস্তাফা ততদিনে বুঝতে পারে কিছু কিছু। সে আর আপত্তি করেনা। কোন মুখে সে আপত্তি করবে? ওর মাবোনের আচরণ স্ত্রীর সামনে ওকে কত খাটো করে তা তো সে মুখ ফুটে বলতে পারেনা। অথচ ওদের ফেলে শুধু বৌ নিয়ে চলে যাওয়াও তো মানুষের কাজ নয়! নাইমাও তাতে রাজী হবেনা। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোস্তফা, ‘নাইমা, তোমার দীর্ঘশ্বাস তো অন্তত আমি শুনতে পাই, কিন্তু আমার এ’বুকে যে কত দীর্ঘশ্বাস জমে আছে তা তো আমি তোমাকেও বুক চিরে দেখাতে পারিনা!’
বছরের পর বছর কেটে যায়। নাইমা লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরী পায়। চাকরীতেও সে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যায়। এখন সে চাইলেই আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা তার কাছে অমানবিক মনে হয়। বৃদ্ধ বাবামা, বোনকে ফেলে সে কি করে মুস্তাফাকে বলবে তাকে নিয়ে আলাদা থাকার জন্য? ওরা ওর সাথে কি আচরণ করলেন তা ওর বিবেচ্য নয়। ওর বিবেচ্য হোল সে ওদের সাথে কেমন আচরণ করল। মানুষ হবার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা তো এটাই যে সে সর্বাবস্থায় মানবিক আচরণ করবে। সে যদি প্রতিশোধস্পৃহার অন্তরালে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয় তবে সে কি করে একজন উন্নত মানুষ হবে? শুধু একটা জায়গায় সে বারবার ধরা খেয়ে যায়। সব বুঝেও কেন ও ওদের কথাবার্তা আচরণে কষ্ট পায়? কেন সে এর উর্ধ্বে যেতে পারেনা? নিজের ওপর খুব রাগ হয় নাইমার। এখন শ্বাশুড়ীমা ওকে বেশ আদর করেন। কিন্তু কেন যেন সে কিছুই অনুভব করতে পারেনা। যখন ক্ষুধা থাকে তখন পানিভাতও অমৃত মনে হয়, ক্ষিদে মরে গেলে বিরিয়ানীও মজা লাগেনা। ওর মায়া, ভালোবাসাপ্রত্যাশী কোমল মনটা ঘাতপ্রতিঘাতে মারা গেছে আজ বহুবছর, সেজন্যই কি? নিজেকে খুব ছোটলোক মনে হয় নাইমার। কিন্তু সে শত চেষ্টা করেও কিছুই অনুভব করতে পারেনা।
এই ক’বছরে নাইমা নিজের পৃথিবীর বিস্তৃতি ঘটিয়েছে অনেক। ক্ষুদ্র গন্ডীর বাইরে এসে সে আবিস্কার করেছে এক বিরাট পৃথিবী যেখানে ওর প্রয়োজন আছে, যেখানে সে খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। পরের কারণে স্বার্থ বলি দিতে পারলেই মানুষের জীবন পরিতৃপ্ত হয়। সে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার এমন পথ খুঁজে পেয়েছে যা সে নিজে গাড়ীবাড়ী শানশওকত নিয়ে থাকলেও পেতনা।
নাইমা গরীব দুঃস্থদের লেখাপড়া, বিয়ে, ব্যাবসা ইত্যাদি কাজে সহায়তা করতে শুরু করে। সমাজের হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর সাথে কাজ করতে গিয়ে সে আবিস্কার করে, একজন দরিদ্র ব্যাক্তি সামান্য একটু উচ্ছিষ্ট ভাত তরকারী বা কাপড় পেয়ে যখন দাঁত কেলিয়ে হাসে তাতে যে আন্তরিক উচ্ছ্বাস থাকে তা যেকোন ধন্যবাদকে ম্লান করে দেয়। কোন রোগী বা মরণাপন্ন ব্যাক্তির হাত ধরে যখন সে বসে থাকে তখন সে অনুভব করে কিচ্ছু না বলে কতকিছু বলা যায়। একজন অসুস্থ মানুষকে এতটুকু সান্তনা দেয়ায় যে কি পরিতৃপ্তি সে কোনদিন জানতে পারতনা যদি সে এই জগতে জড়িত না হত। কেউ মারা গেলে সে বাড়ীতে গিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করা, মেহমানদের সামলে মৃতের আত্মীয় স্বজনের বোঝা হালকা করা এক অবর্ণনীয় শান্তি বয়ে আনে নাইমার মনে।
সেদিন সন্ধ্যায় এক বাসা থেকে ফোন আসে হঠাৎ ওদের মা মারা গিয়েছেন। আধুনিক শিক্ষার কল্যাণে আশেপাশে কেউ লাশ গোসল করাতে জানেনা। নাইমা তৎক্ষণাৎ খবর পাঠায় ওর দরিদ্র বন্ধুদের যারা এই শিক্ষায় অগ্রসর। সে প্রস্তুত হতে হতে ঐ তিনজন মহিলা নাজের ঘরে বসেছিল যেহেতু ড্রয়িং রুমে শ্বশুরশ্বাশুড়ী আর মুস্তাফা আলাপ করছিল। তাড়াহুড়ায় সে জুতো পায়েই নাজের ঘরে ঢুকে পড়ে। এরই খেসারত দিতে হয় তাকে এতগুলো মানুষের সামনে গালি শুনে।
লাশ ধোয়া বন্ধুদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে রাত বারোটায় ঘরে ফেরে নাইমা। চরম ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। মৃতের বাড়ীতে কান্নাকাটির রোল, খাবার পাবে কোথায়? বাচ্চাটাও তখন পর্যন্ত কিছু খায়নি। কলিং বেল টিপে বুঝতে পারে সবাই শুয়ে পড়েছে। মুস্তাফা এসে দরজা খুলে দেয়। নাইমা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে খাবার কিছু নেই। ততক্ষণে মুস্তাফা দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে এসে পড়েছে, ‘নাহিদকে আমার কাছে দাও। তুমি গিয়ে কাপড় বদলে নামাজ পড়ে এস’।
নাইমা নামাজ পড়ে এসে দেখে মুস্তাফা এর মধ্যেই ভাত ডাল রেঁধে ডিম ভেজে রেখেছে। নাহিদ খাচ্ছে।
এত রাতে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। তাই নাইমা আর মুস্তাফা দু’জনেই চুপ করে থাকে। কিন্তু নাইমার মনটা আনন্দে ভরে যায়। এই ছোট ছোট খুশীগুলোই তো জীবনকে অর্থবহ করে তোলে! এই খুশীগুলো আসে অন্যের জীবনে আনন্দ বয়ে আনার মাধ্যমে, অন্যের বোঝা হাল্কা করার উপহার হিসেবে। নাইমা মনে মনে হিসেব কষে, ‘যে মানুষের জন্য আনন্দ নিয়ে আসে, তাদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করে, সে কি অমানুষ হতে পারে?... না মনে হয়… খুব বেশী কিছু না হলেও, সে মনে হয় মানুষ!’
হিসেবটা শেষপর্যন্ত মিলাতে পেরে নাইমার চোখেমুখে তৃপ্তির ছটা ছড়িয়ে পড়ে। স্ত্রীর হাসি মুস্তাফার মনেও দোলা দিয়ে যায়। সংসারের চাপে সে স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতা, বিশ্বাস এবং সহযোগিতা দিয়ে ওর জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে চলেছে। মুস্তাফা আর নাইমা পরস্পরের দিকে তাকায়। কোন কথা না বলেও দুই সহযোগীর চোখে চোখে হয়ে যায় অনেক আন্তরিকতা, আশ্বাস আর আনন্দের কথোপকথন…
হুংকার শুনে পেছনে তাকিয়ে নাইমা বুঝতে পারল কথাটা তাকেই বলা হয়েছে। ওখানে শ্বশুরমহাশয়, শ্বাশুড়ীমা, ওর স্বামী বসা। কেউ ওর ননদকে জিজ্ঞেস করলনা কি কারণে এতবড় একটা গালি তাকে দেয়া হোল। শ্বশুরমহাশয় শান্তিপ্রিয় ভালোমানুষ। তিনি নাইমার প্রতি স্ত্রীকন্যাদের এসব ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু নাক গলিয়ে তাদের বিরাগভাজন হতে নারাজ। স্বামী বেচারা সংসারের চাপে অস্থির। কিছু বলতে গেলে ঘরে অশান্তির সৃষ্টি হবে, ঝটকাটা যাবে নাইমার ওপর দিয়েই। তাই নাইমা নিজেই মুস্তাফাকে বলেছে সে যেন কখনো কিছু না বলে। ফলে সবাই নির্বাক। নাইমার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টির জবাবে নাজ কোনপ্রকার ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলনা। মুখ বাঁকিয়ে বীরদর্পে ভেতরে চলে গেল। নাইমা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে সাথে তিনজন মহিলা আর ওর বাচ্চাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নাইমার বিয়ে হয়েছে দশবছর। এখনো কেন সে এই ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে শেখেনি? এতদিনে তো ওর অভ্যস্ত হওয়া উচিত ছিল! নাকি এই ব্যাপারগুলোই এমন যে কেউ অভ্যস্ত হতে পারেনা?
ট্যাক্সিতে বসে ওর মন হারিয়ে যায় স্মৃতির সেলুলয়ডে। দশ বছর আগে যেদিন সে এ’ বাড়ীতে প্রথম পা রাখে, মুস্তাফার বড়বোন ওকে বসিয়ে সুপরামর্শ দেন, ‘দেখ, তুমি কখনো মনে কোরনা তুমি আমাদের একজন। তুমি যাই কিছু করনা কেন, আমরা তোমাকে আপন মনে করবনা, বুঝলে? সুতরাং তুমি আপন হবার চেষ্টাও কোরনা। তুমি বৌ, বৌয়ের মতই থেকো’। নাইমা হতভম্ব হয়ে ভাবে, বৌ কি কোন আলাদা শ্রেণীর প্রাণী? একজন মানুষ যদি একটি পরিবারের জন্য তার বাবামা, ভাইবোন, শৈশব কৈশোরের সোনালী দিন কাটানো সেই বাড়ীঘর, সেই প্রাণের মেলার সাথী বন্ধু- সব, সব ছেড়ে আসতে পারে, তবে কেন সে এই পরিবারে বাকী জীবনটা এক আগন্তুক হয়েই কাটাতে বাধ্য হবে? সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, কথাটা যিনি বললেন তিনি নিজেই আরেক বাড়ীর বৌ! তবু কেন তিনি তাকে আশ্বাস দিলেন না, বললেন না, ‘আজ থেকে এটাই তোমার বাড়ী, তুমি আমাদেরই পরিবারের একজন’? হোক না মিথ্যা! একজন মানুষকে মিথ্যামিথ্যিই যদি একটু ভালোবাসা দেয়া হয়, হতেও তো পারে তা একসময় সত্যি! একটু দরদমাখা কথা, পারে তো বুকের ভেতর সব ছেড়ে আসার ক্ষতে সামান্য মলম হতে!
বিয়ের পরদিন থেকেই নাইমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে রান্নাঘরে। মুস্তাফা বিরক্ত হয়, ‘তুমি আসার আগেও পঁয়ত্রিশ বছর এ’ সংসারে খাওয়াদাওয়া চলেছে তো! তোমাকে এখনই রান্নাঘরে যেতে হবে কেন?’ নাইমা বোঝাতে পারেনা সে ঘরের সবাইকে খুশী করতে চায়, সবার ভালোবাসা পেতে চায়। মুস্তাফা বলবে, ‘কেন, আমার ভালোবাসা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?’ বেচারা! বয়স হয়েছে কিন্তু ম্যাচুরিটি আসেনি। বিয়ের আসরে নাইমার বান্ধবীর স্বামী মুস্তাফার সালামের জবাব দেয়নি বলে মুস্তাফার চোখ ছলছল করে ওঠে, ঘরে এসে বারবার নালিশ করে নাইমার কাছে। কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজী না ওর মা নতুন বৌকে রান্নাঘরে যেতে বলতে পারে। ওর মায়ের মত মানুষ কি দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি হতে পারে? নাইমা এই ধারণা নষ্ট করে দিতে চায়না। সে জানে বিয়ের পর পর ওদের একসাথে সময় কাটানো প্রয়োজন- পরস্পরকে বোঝার জন্য, জানার জন্য- এই সময় আর কখনো ফিরে আসবেনা। কিন্তু মুস্তাফাকে সে জন্ম দেয়নি, মানুষও করেনি। যিনি এই কষ্ট করে তাকে একজন ভালো স্বামী উপহার দিয়েছেন তার ব্যাপারে সে মুস্তাফাকে কোন বিরূপ ধারণা দিতে চায়না।
নাইমা বোঝে, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মায়েরা ভুলে যান তাঁরাও একসময় বৌ ছিলেন। নতুন মেয়েটিকে আপন করে নেয়ার পরিবর্তে তারা তার কাছে এত বেশী আশা করতে শুরু করেন যা সুপারম্যানের পক্ষেও পূরণ করা অসম্ভব! বাসার বুয়ার প্রতি যতটুকু সহানুভূতি দেখানো হয়, বৌ ততটুকুরও দাবী রাখেনা। তার ইচ্ছাঅনিচ্ছা বলতে কিছু থাকেনা- কোনদিন শরীরে বা মানসিকতায় না কুলালে বৌ হয়ে যায় ‘কুঁড়ে’, ‘আলসে’ বা ভাগ্য খারাপ হলে ‘বেয়াদব’ খেতাবের স্বত্ত্বাধিকারী। এই চাহিদার বিপরীতে এক হেরে যাওয়া রেস জেতার জন্য প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে সে। সে জানত একসময় সে হেরে যাবে। তবে হারটা এত তাড়াতাড়ি আসবে সে ভাবেনি।
বিয়ের পর ছোট ননদটাকে সে বুকের ভেতরকার সব ভালোবাসা ঢেলে দেয়। নিজের ভাইবোনদের ছেড়ে আসার কষ্ট নাজকে ভালোবাসা উজার করে দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। বাজারে একটা সুন্দর জিনিস দেখলে নিজের জন্য না কিনে ওর জন্য নিয়ে আসে, অসুখবিসুখ হলে সব ছেড়ে দিয়ে সেবাযত্ন করে। কিন্তু শ্বাশুড়ীমা’র আস্কারায় নাজ ওর সাথে প্রচন্ড দুর্ব্যবহার করতে থাকে। যাকে এতখানি ভালোবাসে তার কাছ থেকে আঘাত পেতে পেতে সে আর সহ্য করতে পারছিলনা। একদিন শ্বাশুড়ীমাকে একান্তে ডেকে বলল, ‘মা, আজ তিনবছর আমি আপনাদের সাথে আছি। যদি আমি ভুল করি বা অন্যায় করি আপনি আমাকে দু’টো থাপ্পর দিয়েন, বুঝিয়ে দিয়েন, বকা দিয়েন, যা ইচ্ছে কোরেন। আপনি আমার মা, আমি কিছুই মনে করবনা। কিন্তু নাজ আমার ছোটবোন। ও যখন আপনাদের সামনেই আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে, আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। সে ছোটমানু্ষ, বোঝেনা, কিন্তু আপনি যদি ওকে বুঝিয়ে বলেন, ও নিশ্চয়ই এ’ব্যাপারে সচেতন হবে’।
উনি জবাব দিলেন, ‘শোন, তুমি নিজেকে এত ভালো মনে কর কেন? নিজেকে খারাপ মনে করতে শেখ। তুমি খারাপ বলেই নাজ তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। ও যা করে ঠিক করে’।
নাইমা স্তম্ভিত হয়ে গেল। একজন মানুষ শত আঘাত সহ্য করতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তার আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানি করার চেয়ে কঠিন আঘাত আর কি হতে পারে? সে যাকে মা ডাকল তিনি তার সম্মানবোধই ধূলিস্যাৎ করে দিলেন! নাজ যদি আজ নাইমার সাথে দুর্ব্যবহার করে বাঁধা না পায়, কাল শ্বশুরবাড়ী গিয়ে সে সবার সাথে এই ব্যবহারই করবে। ওরা কি তা সহ্য করবে? শ্বাশুড়ীমা ওকে কষ্ট দেয়ার জন্য নাজকে ব্যবহার করতে গিয়ে যে নিজের মেয়ের জীবনটাই পক্ষান্তরে ধ্বংস করতে যাচ্ছে্ন তা কি তিনি বোঝেন না?
নাইমা একেবারে নেতিয়ে পড়ল। এতদিন যে প্রাণপণ চেষ্টা ছিল সবাইকে খুশী করার, শরীরের বাইরে গিয়ে সবার জন্য করার, নিজেকে দমন করে সবার চাহিদা মেটানোর- হঠাৎ সব কেমন অর্থহীন মনে হতে লাগল। সে নিজের ব্যাপারেই দ্বিধায় পড়ে গেল, ‘আমি কি সত্যিই খারাপ? আমি তো জেনেশুনে কারো ক্ষতি করিনা, কাউকে কষ্ট দেইনা, সম্ভব হলে উপকার করার চেষ্টা করি, না পারলে ক্ষমা চেয়ে নেই। তাহলে আমি কি এমন খারাপ কাজ করলাম যে যাকে মা মনে করলাম তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন আমি খারাপ বলেই আমার সাথে পশুতুল্য আচরণ করা যায়?’ ওর বুকটা খা খা করে ওঠে। কিন্তু চোখে পানি আসেনা। মুস্তাফাকে বললেও সে বিশ্বাস করবেনা। আর বলার স্বভাব তো নাইমার নেই। বাবামাকে বলার প্রশ্নই আসেনা, তাহলে ওঁরা চিন্তিত হবেন মেয়ে কষ্টে আছে ভেবে।
একমাস এই কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে সে সিদ্ধান্তে আসে, কে কি বলল বা করল তার সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই। একজন মানুষ হিসেবে ওর দায়িত্ব পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে সবার প্রতি আন্তরিকতার সাথে মানবিক দায়িত্ব পালন করা, সে তাই করবে। কে খুশী হল বা না হল তা কোন মানুষের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং ওর পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সে করে যাবে। যা ওর পক্ষে করা সম্ভব নয় তা ছেড়ে দেবে যেহেতু মরে গিয়েও মানুষকে খুশী করা সম্ভব নয়।
বাচ্চা হবার পর দেখা গেল আরেক ঝামেলা। শ্বাশুড়ীমা বড়মেয়েকে সাথে রাখেন যাতে উনি ওর বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারেন, সে নিশ্চিন্তে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু নাইমাকে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘দেখ, শাহীনের তিনটা বাচ্চা দেখার পর আমার পক্ষে তোমার বাচ্চা রাখা সম্ভব না। তুমি দরকার হলে লেখাপড়া বন্ধ করে দাও। আমি তোমার বাচ্চা দেখতে পারবনা’।
নাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘মা, এই শিশুটি শুধু আমার নয়, শাহীনের মত ওর বাবা মুস্তাফাও আপনার সন্তান। শাহীনের সন্তানদের মত ওরও অধিকার আছে আপনার ওপর। আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন তখন আমিই থাকব আপনার পাশে, শাহীন চলে যাবে ওর নিজের সংসারে। মাঝে মাঝে সে আপনাকে দেখে যাবে। কিন্তু দিনরাত সেবাযত্ন আপনি আমার কাছেই পাবেন’।
কথাগুলো সে বলছিল মনে মনে। বাবামা শিখিয়েছেন মুরুব্বীদের মুখে মুখে কথা বলতে হয়না। বড় হয়ে বুঝেছে ব্যাপারটা শোভন নয়। সুতরাং সে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে চলে যায়।
নাইমার বাবামা থাকে আরেক জেলায়। সে ওখানে গিয়ে থাকলে এখানে ঘরের কাজ কে করবে? সুতরাং, উপায় একটাই, সে শিশুটিকে ইউনিভার্সিটিতে সাথে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। নাইমা কিছু না বললেও মুস্তাফা ততদিনে বুঝতে পারে কিছু কিছু। সে আর আপত্তি করেনা। কোন মুখে সে আপত্তি করবে? ওর মাবোনের আচরণ স্ত্রীর সামনে ওকে কত খাটো করে তা তো সে মুখ ফুটে বলতে পারেনা। অথচ ওদের ফেলে শুধু বৌ নিয়ে চলে যাওয়াও তো মানুষের কাজ নয়! নাইমাও তাতে রাজী হবেনা। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোস্তফা, ‘নাইমা, তোমার দীর্ঘশ্বাস তো অন্তত আমি শুনতে পাই, কিন্তু আমার এ’বুকে যে কত দীর্ঘশ্বাস জমে আছে তা তো আমি তোমাকেও বুক চিরে দেখাতে পারিনা!’
বছরের পর বছর কেটে যায়। নাইমা লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরী পায়। চাকরীতেও সে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যায়। এখন সে চাইলেই আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা তার কাছে অমানবিক মনে হয়। বৃদ্ধ বাবামা, বোনকে ফেলে সে কি করে মুস্তাফাকে বলবে তাকে নিয়ে আলাদা থাকার জন্য? ওরা ওর সাথে কি আচরণ করলেন তা ওর বিবেচ্য নয়। ওর বিবেচ্য হোল সে ওদের সাথে কেমন আচরণ করল। মানুষ হবার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা তো এটাই যে সে সর্বাবস্থায় মানবিক আচরণ করবে। সে যদি প্রতিশোধস্পৃহার অন্তরালে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয় তবে সে কি করে একজন উন্নত মানুষ হবে? শুধু একটা জায়গায় সে বারবার ধরা খেয়ে যায়। সব বুঝেও কেন ও ওদের কথাবার্তা আচরণে কষ্ট পায়? কেন সে এর উর্ধ্বে যেতে পারেনা? নিজের ওপর খুব রাগ হয় নাইমার। এখন শ্বাশুড়ীমা ওকে বেশ আদর করেন। কিন্তু কেন যেন সে কিছুই অনুভব করতে পারেনা। যখন ক্ষুধা থাকে তখন পানিভাতও অমৃত মনে হয়, ক্ষিদে মরে গেলে বিরিয়ানীও মজা লাগেনা। ওর মায়া, ভালোবাসাপ্রত্যাশী কোমল মনটা ঘাতপ্রতিঘাতে মারা গেছে আজ বহুবছর, সেজন্যই কি? নিজেকে খুব ছোটলোক মনে হয় নাইমার। কিন্তু সে শত চেষ্টা করেও কিছুই অনুভব করতে পারেনা।
এই ক’বছরে নাইমা নিজের পৃথিবীর বিস্তৃতি ঘটিয়েছে অনেক। ক্ষুদ্র গন্ডীর বাইরে এসে সে আবিস্কার করেছে এক বিরাট পৃথিবী যেখানে ওর প্রয়োজন আছে, যেখানে সে খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। পরের কারণে স্বার্থ বলি দিতে পারলেই মানুষের জীবন পরিতৃপ্ত হয়। সে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার এমন পথ খুঁজে পেয়েছে যা সে নিজে গাড়ীবাড়ী শানশওকত নিয়ে থাকলেও পেতনা।
নাইমা গরীব দুঃস্থদের লেখাপড়া, বিয়ে, ব্যাবসা ইত্যাদি কাজে সহায়তা করতে শুরু করে। সমাজের হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর সাথে কাজ করতে গিয়ে সে আবিস্কার করে, একজন দরিদ্র ব্যাক্তি সামান্য একটু উচ্ছিষ্ট ভাত তরকারী বা কাপড় পেয়ে যখন দাঁত কেলিয়ে হাসে তাতে যে আন্তরিক উচ্ছ্বাস থাকে তা যেকোন ধন্যবাদকে ম্লান করে দেয়। কোন রোগী বা মরণাপন্ন ব্যাক্তির হাত ধরে যখন সে বসে থাকে তখন সে অনুভব করে কিচ্ছু না বলে কতকিছু বলা যায়। একজন অসুস্থ মানুষকে এতটুকু সান্তনা দেয়ায় যে কি পরিতৃপ্তি সে কোনদিন জানতে পারতনা যদি সে এই জগতে জড়িত না হত। কেউ মারা গেলে সে বাড়ীতে গিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করা, মেহমানদের সামলে মৃতের আত্মীয় স্বজনের বোঝা হালকা করা এক অবর্ণনীয় শান্তি বয়ে আনে নাইমার মনে।
সেদিন সন্ধ্যায় এক বাসা থেকে ফোন আসে হঠাৎ ওদের মা মারা গিয়েছেন। আধুনিক শিক্ষার কল্যাণে আশেপাশে কেউ লাশ গোসল করাতে জানেনা। নাইমা তৎক্ষণাৎ খবর পাঠায় ওর দরিদ্র বন্ধুদের যারা এই শিক্ষায় অগ্রসর। সে প্রস্তুত হতে হতে ঐ তিনজন মহিলা নাজের ঘরে বসেছিল যেহেতু ড্রয়িং রুমে শ্বশুরশ্বাশুড়ী আর মুস্তাফা আলাপ করছিল। তাড়াহুড়ায় সে জুতো পায়েই নাজের ঘরে ঢুকে পড়ে। এরই খেসারত দিতে হয় তাকে এতগুলো মানুষের সামনে গালি শুনে।
লাশ ধোয়া বন্ধুদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে রাত বারোটায় ঘরে ফেরে নাইমা। চরম ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। মৃতের বাড়ীতে কান্নাকাটির রোল, খাবার পাবে কোথায়? বাচ্চাটাও তখন পর্যন্ত কিছু খায়নি। কলিং বেল টিপে বুঝতে পারে সবাই শুয়ে পড়েছে। মুস্তাফা এসে দরজা খুলে দেয়। নাইমা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে খাবার কিছু নেই। ততক্ষণে মুস্তাফা দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে এসে পড়েছে, ‘নাহিদকে আমার কাছে দাও। তুমি গিয়ে কাপড় বদলে নামাজ পড়ে এস’।
নাইমা নামাজ পড়ে এসে দেখে মুস্তাফা এর মধ্যেই ভাত ডাল রেঁধে ডিম ভেজে রেখেছে। নাহিদ খাচ্ছে।
এত রাতে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। তাই নাইমা আর মুস্তাফা দু’জনেই চুপ করে থাকে। কিন্তু নাইমার মনটা আনন্দে ভরে যায়। এই ছোট ছোট খুশীগুলোই তো জীবনকে অর্থবহ করে তোলে! এই খুশীগুলো আসে অন্যের জীবনে আনন্দ বয়ে আনার মাধ্যমে, অন্যের বোঝা হাল্কা করার উপহার হিসেবে। নাইমা মনে মনে হিসেব কষে, ‘যে মানুষের জন্য আনন্দ নিয়ে আসে, তাদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করে, সে কি অমানুষ হতে পারে?... না মনে হয়… খুব বেশী কিছু না হলেও, সে মনে হয় মানুষ!’
হিসেবটা শেষপর্যন্ত মিলাতে পেরে নাইমার চোখেমুখে তৃপ্তির ছটা ছড়িয়ে পড়ে। স্ত্রীর হাসি মুস্তাফার মনেও দোলা দিয়ে যায়। সংসারের চাপে সে স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতা, বিশ্বাস এবং সহযোগিতা দিয়ে ওর জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে চলেছে। মুস্তাফা আর নাইমা পরস্পরের দিকে তাকায়। কোন কথা না বলেও দুই সহযোগীর চোখে চোখে হয়ে যায় অনেক আন্তরিকতা, আশ্বাস আর আনন্দের কথোপকথন…