Wednesday, June 15, 2011

বিয়ে - ৩

বরষাকে দেখলে মহাকাব্যের নায়িকা মনে হত। একটা প্রেম ছিল। ছেলেটা আচমকা মারা যাবার পর ওর নায়িকাসুলভ চেহারায় বিষন্নতার ছাপ মেঘনাদপ্রিয়ার কথাই মনে করিয়ে দিত। সে কারো সাথে খুব একটা কথা বলত না, কলেজে আসত ক্কচিৎ কখনো।

রাহির সাথে বরষার কথাবার্তা ‘কেমন আছ, ভালো আছি’র গন্ডী পেরোয় কলেজে মার্কশীট আনতে গিয়ে। দু’জনে দুই কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে, এই নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক কথা হয়ে গেল। বরষা রাহির ফোন নাম্বার চাইলে ও মনে মনে ভাবল, “দুই বছরে তোমার কারো সাথে কথা বলার সময় হয়নি, আর তুমি করবে আমাকে ফোন!”, কিন্তু নাম্বার দিয়ে দিল।

রাহিকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেলেই বরষা ওকে ফোন করল। তারপর থেকে প্রতিদিনই সে ফোন করত। রাহি বুঝতে পারল, বহুদিন পর বিষন্নতা কাটিয়ে উঠে বরষা হঠাৎ যখন আবিষ্কার করল ওর আশেপাশে আর কেউ অবশিষ্ট নেই তখন সে বন্ধুত্বের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাহির তাতে সমস্যা নেই। কিভাবে কিভাবে যেন সব সমস্যাগুলো খুঁজেপেতে ওর কাছে চলে আসে! সে এতে এত অভ্যস্ত যে ওর কাছে এখন এটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হয়।

অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েদের বেলা যা হয়, ছাত্রীত্ব বজায় রাখার জন্য যতটুকু ক্লাস না করলেই নয় তার বাইরে বরষা কোথাও যেতে পারত না। রাহি মাঝেমধ্যে বরষার বাসায় যেত বটে কিন্তু বিশাল বন্ধুগোষ্ঠীর সবাইকে সবসময় খুশী করা সম্ভব হতনা। তাই ওদের দু’জনের বন্ধুত্ব মূলত ফোনে ফোনেই অগ্রসর হতে থাকে। এভাবেই ওরা জেনে যায় পরস্পরের সমস্ত খবর, আদানপ্রদান হয় সকল সংবাদ।

প্রায় একবছর পর একদিন বরষা রাহিকে ফোন করে জানায়, “আজ আমাকে দেখতে আসবে”।
এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়, ওর জন্য প্রায় প্রতিদিনই নিদেনপক্ষে একহালি প্রস্তাব আসত, তার মধ্যে অনেক বেছেবুছেও ওকে প্রায়ই জনসমক্ষে প্রদর্শনী দিতে হত। তবে এবার ওকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছিল। রাহি খুব খুশী হোল বান্ধবীকে আনন্দিত দেখে।
হঠাৎ বরষা বলে বসল, “জানো? তোমার বিবেচনার ওপর আমার ভীষণ আস্থা। তুমি রাজী হলেই কেবল আমি এই বিয়েতে মত দেব, নতুবা নয়”।
বরষার শিশুসুলভ সরলতায় রাহি হেসে ফেলল, “শোন, সংসার আমি করবনা, করবে তুমি- পছন্দ করার দায়িত্ব তোমার আর তোমার পরিবারের। তারপর যেখানে যা সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন হয় আমি আছি ইনশাল্লাহ”।

বরপক্ষ চলে যাওয়ামাত্র রাহিকে ফোন করল বরষা। ওর কথা শুনেই রাহি বেশ বুঝতে পারছিল এই বিয়ের ব্যাপারে বরষার কোনপ্রকার দ্বিধা নেই। ওকে দেখার জন্য ওর হবু শ্বশুরবাড়ীর সবাই এসেছিল। সে তাদের আচরণে মুগ্ধ আর হবু শ্বাশুড়ীকে সে তখন থেকেই মা ডাকতে শুরু করে দিয়েছে! ওর গলায় উচ্ছাস শুনে রাহির মনে হোল বহুদিন পর বরষা স্বাভাবিক তরুণীসুলভ উচ্ছলতায় জেগে উঠেছে, যে বিষন্নতা ওকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখত তার লেশমাত্র নেই এই নতুন বরষায়! মন থেকে বান্ধবীর হবু শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে পছন্দ করে ফেলল রাহি।

সাতদিন পর হঠাৎ বরষার গলার সেই উচ্ছাস কেমন যেন স্তিমিত মনে হোল।
“কি হয়েছে বরষা?”, উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল রাহি।
“এমন লজ্জার কথা কি করে বলি রাহি? কি করে আব্বা আম্মাকে বোঝাই?”
“আগে বল তো কি হয়েছে?”
“আমার আপা এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চায়”।
“যাহ!”
“তুমিও যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর তাহলে কে করবে বল?”, হতাশ হয়ে যায় বরষা।
“আচ্ছা, আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তোমার এমন কেন মনে হোল আমাকে বুঝিয়ে বল। আমার তো মনে হয় বড় আপা তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন”।
“তা তো করেই, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ও কিছুতেই হিংসা দমন করতে পারছেনা।“
“হিংসা?”
“তোমাকে তো বলেছি ও পালিয়ে বিয়ে করেছে। সেজন্য ও আজ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ীতে বৌয়ের মর্যাদা পায়নি। আব্বা আম্মাও ওর সাথে বহুবছর যোগাযোগ রাখেননি। মাত্র গত বছর থেকে ওর অসহায়ত্বের কথা ভেবে ওরা ওকে বাসায় আসতে দিচ্ছেন। তাও আমাকে দেখানোর সময় ওকে ডাকা হয়নি। ওর বিয়েতে কেউ যায়নি ও ছাড়া। আর আমার বিয়েতে শুধু দেখার জন্যই সম্পূর্ণ শ্বশুরকুল এসেছিল। আব্বা আম্মা আমার বিয়েতে এমন ধুমধাম করছেন যা মানুষ সচরাচর বড় মেয়ের বিয়েতে করে। ও কিছুতেই এসব হজম করতে পারছেনা। আমাকে দেখে যাবার চারদিন পর যেদিন ওরা আংটি পরাতে এলো, আপা দুপুর থেকেই বাসায় এসে বসে রইলো। আম্মা মানা করার পরও সে অনুষ্ঠানে সবার সামনে এসে বসল। তখন ওকে পরিচয় করিয়ে দিতে হোল। পরদিন ও এসে আম্মাকে বলে, ‘এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও’। আম্মা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’ ও বলল, ‘ছেলের ফিগার ভালো না’। আম্মা বলল, ‘এতে বরষার যদি সমস্যা না হয় তো তোর সমস্যা কি? ওর শ্বাশুড়ী তো প্রতিদিন ফোন করে ওর সাথে কথা বলে। ও যেখানে খুশী সেখানে ফিগার দিয়ে কি হবে?’ কিন্তু আপাকে তো আমি চিনি। ও যা ঠিক করে তা করেই ছাড়ে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ও এই বিয়ে হতে দেবেনা”।
রাহি বলল, “তুমি তোমার আব্বা আম্মাকে জানিয়ে রাখ যে তোমার এই প্রস্তাব কতটা পছন্দ। শান্ত থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ”।

কিন্তু ঠিক হোলনা। সাতদিন প্রতিদিনই বরষা রাহিকে বড় আপার নানান কার্যক্রমের বিবরণ শোনাতে লাগল। মহিলার ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়ে রাহি মুগ্ধ! অষ্টম দিন বরষা ফোন করে বলল, “রাহি, আমি আংটি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। বড় আপা বিশ্বস্তসূত্রে খবর এনেছে ছেলের চারিত্রিক সমস্যা আছে”।
রাহি একটু অবাক হোল। আর যাই হোক, চারিত্রিক বিষয়ে মানুষ সহজে মিথ্যা বলেনা। সুতরাং, বড় আপা হয়ত এ’ব্যাপারে মিথ্যা বলেননি। তবু সে বরষাকে জিজ্ঞেস করল, “বিশ্বস্ত সূত্রটা কে, তুমি চেন?”
সে বলল, “মলি আপা, যিনি আমাদের বিয়ের ঘটকালী করেছেন।“
ব্যাপারটা রাহির কাছে বেখাপ্পা মনে হোল। কোন মহিলা কি জেনেশুনে আরেকজন মহিলার ক্ষতি করতে পারে? রাহি বলল, “বরষা, তুমি একবার মলি আপাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর। বল, বড় আপাকে উনি কি বলেছেন তুমি নিজে শুনতে চাও”।
“কি লাভ রাহি? আমি এই বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়েছি”।
“তারপরও তুমি একটা ফোন কর”।
“আচ্ছা, তুমি যখন বলছ আমি ফোন করে কথা বলছি”।

একঘন্টা পর বরষা ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির, “রাহি, আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমার আপা আমার এতবড় ক্ষতি করবে! মলি আপার সাথে ওর দেখাই হয়নি! আর উনি বলছেন, ‘তোমার আংটি পেয়েছি কিন্তু তুমি কি করে ধারণা করলে আমি তোমার এমন সর্বনাশ করতে পারি? এমন ছেলে তুমি আরেকটা পাবেনা’। কিন্তু আমি তো নিজের হাতে সব শেষ করে দিলাম! এখন আমি কি করব রাহি?”
রাহি সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেলনা।

দু’দিন পর বরষা ফোন করে জানালো ছেলে ওকে আংটি ফেরত পাঠিয়েছে। সাথে সাথে ওর আব্বাকে ফোন করে অনুমতি নিয়ে ওর সাথে কথা বলেছে। জীবনে প্রথম আলাপ। অথচ সে কি বকা! “আপনাকে আংটি কি মলি আপা পরিয়েছিল? আপনি কি বুঝে ওনাকে আংটি ফেরত পাঠালেন? ভাগ্য ভালো যে উনি আমার মাকে জানানোর আগে আমাকে খবর দিয়েছিলেন! আপনি জানেন আমার মা এই খবর পেলে কি পরিমাণ কষ্ট পেতেন? নিন, আমার ফোন নাম্বার রাখুন। ভবিষ্যতে আমার চরিত্র নিয়ে কোনপ্রকার সন্দেহ হলে সরাসরি আমাকে ফোন করে জেনে নেবেন। তারপর সন্তুষ্ট না হলে আমি নিজে এসে আংটি ফেরত নিয়ে যাব। শুনুন, আপনার এই কান্ডকীর্তির ব্যাপারে আমার মাকে জানানোর প্রয়োজন নেই। আরেকটা কথা, আপনি কি সারাজীবন এভাবে মানুষের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন না নিজেও কিছু বুদ্ধি খরচ করবেন?” বকা খেয়েও বরষা খুশী হোল। ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা গেল এবং হবু শ্বাশুড়ীকে কষ্ট দেয় হোলনা। ওর গল্প শুনে রাহিও বান্ধবীর খুশীতে আপ্লুত হোল।

বড় আপার চেষ্টা অব্যাহত রইলো। আব্বা আম্মা সাবধান হয়ে যাওয়াতে উনি সুবিধা করতে পারছিলেন না। সাতদিন পর উনি অস্থির হয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। বরষা বুঝতে পারছিল ওনার উদ্দেশ্য সুবিধার নয়। কিন্তু বুঝে উঠার আগেই উনি ওর আব্বা আম্মার রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলেন। ভেতর থেকে ফোন করার শব্দ পেয়ে সে দৌড়ে ড্রয়িং রুমের ফোন তুলেই ওপাশ থেকে ওর হবু বরের গলা শুনতে পেল, “হ্যালো”। বড় আপা নিজের পরিচয় দিলেন, তারপর বরষার চরিত্র নিয়ে যে বানোয়াট ফিরিস্তি শুরু করলেন তাতে বরষার দুচোখ দিয়ে প্লাবন নেমে এলো।
অনেকক্ষণ পর হবু বর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এসব কথা আমাকে কেন বলছেন”।
বড় আপা মোহনীয় কন্ঠে বললেন, “আমি আপনার শুভাকাংখী, আপনার উপকার করতে চাই”।
হবু বর বললেন, “সরি, যিনি নিজের বোনের ক্ষতি করেন, তার উপকার আমি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই”।
বরষার হৃদয় দুলে উঠলো। কিন্তু ততক্ষণে বড় আপা প্রচন্ড কর্কশ স্বরে এমন সব গালিগালাজ শুরু করেছে যা শুনে বরষার গা রি রি করতে লাগল। ভদ্রলোক কেন ফোন রেখে দিচ্ছেন না সে বুঝতে পারলোনা। কিন্তু উনি কোন জবাবও দিচ্ছেন না। প্রায় পনেরো মিনিত পর আপা নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন। বললেন, “আপনি আছেন না রণে ভঙ্গ দিয়েছেন?”
হবু বর বললনে, “আছি”।
বড় আপা আশ্চর্য হয়ে বললেন, “তাহলে কিছু বলছেন না যে?”
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, “আপনি তো পাগল, পাগলের কথায় কোন জবাব দিতে হয়না”।
বড় আপা ফোন ছুঁড়ে মেরে তারস্বরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। বরষা ফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওপাশ থেকে শোনা গেল, “ফোন রাখবেন না প্লীজ। আম জানি আপনি শুরু থেকেই শুনছেন”।
বরষা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “বড় আপার আচরণের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। বিশ্বাস করুন, আমি ওকে থামাতে গেছিলাম কিন্তু ও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে”।
হবু বর বললেন, “কোন সমস্যা নেই। উনি যেকোন কারণেই চাননা আমাদের বিয়েটা হোক। আপনি যে কাজটা করবেন তা হোল, এই ব্যাপারে আপনি কাউকে জানাবেন না, আপার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবেন। ওনাকে সফল হতে দেয়া যাবেনা, সুতরাং খেয়াল রাখবেন ওনার কারণে যেন বিয়েটা না ভাঙ্গে”।
বরষা অবাক হয়ে বলল, “এইমাত্র ও যা যা বলল, যা করল তারপরও আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?”
হবু বর বললেন, “উনি যা বলেছেন সব মিথ্যা- আপনিও জানেন, আমিও জানি। উনি তো এমন বাজে কথা আমার ব্যাপারেও বলেছিলেন। তারপরও তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন তাহলে আমি কেন আপনাকে অবিশ্বাস করব?”
“কিন্তু”
“কিন্তু কি?”
“বিয়ের পর আপনি আমাকে কথা শোনাবেন না তো?”
“শুনুন, আপনার বোন পাগল- আমি সুস্থমস্তিষ্ক, আর আপনার কোন সমস্যা থাকলে আমাকে এখনই বলতে পারেন”।
বরষা হাসতে আসতে ফোন রেখে দিল। পরে রাহি আর বরষা কথা বলতে বলতে হাসি থামাতেই পারছিল না!

বিয়ের আর সাতদিন বাকী। বরষা রাহিকে ফোন করে ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি আর পারিনা রে!
রাহি বলল, “আবার কি হোল?”
“বড় আপা আম্মাকে আল্টিমেটাম দিয়েছে এই বিয়ে হতে পারবেনা। হলে সে আর কোনদিন এই বাসায় আসবেনা। আব্বা বাড়ী গেছিলেন তা তো জানো। উনি বাড়ী থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। আব্বা এলেই আব্বা আম্মা ওদের বাসায় গিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসবে”।
রাহি কি করবে বুঝে পেলোনা। এতদিন পর মেয়েটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল, ওর বোন নিজের হিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে ওকে নিজ হাতে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। বাসায় আবার সান্ধ্য আইন। মাগরিবের পর বের হওয়া যাবেনা। কিচ্ছু না ভেবে সে বরষাকে বলল, “আমি আসছি”।

তখন মাগরিব পার হয়ে প্রায় এশার সময় হয়ে এসেছে। বহুকষ্টে আম্মুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একজন escort জোগাড় করে রাহি যখন বরষার বাসায় এসে পৌঁছুল তখন এশার আজান হচ্ছে। সে কখনো আব্বু আম্মুকে ছাড়া রাতে বের হয়নি। ওর নিজেরই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তবুও বান্ধবীকে সাহায্য করার তাগিদে সে যখন বরষা্দের ঘরে ঢুকল তখন শুধু ড্রইং রুম ছাড়া সর্বত্র অন্ধকার। বরষার ভাইরা্ বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। আন্টি বেড্রুমে শোয়া। বরষা আন্টির দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বড় আপা বিজয় সেলেব্রেট করার জন্য বাসায় চলে গিয়েছেন।

রাহির আওয়াজ পেতেই আন্টি এসে ওকে বেড্রুমে নিয়ে বসালেন। বেচারীকে পুরো পাগলের মত দেখাচ্ছে।
উনি রাহিকে সামনে বসিয়ে বললেন, “মাগো, আমার দুই মেয়ের মাঝে পড়ে আমি শেষ! ছোট মেয়ে বলে এখানে বিয়ে না হলে ও আর বিয়েই করবেনা। বড়টা বলে এখানে বিয়ে হলে সে আর বাসায় আসবেনা। এখন আমি কি করি বল তো?”
রাহি ঢোক গিলে বলল, “আন্টি, আমি অনেক ছোট। কিন্তু আপনি আনুমতি দিলে আমি ক’টা কথা বলতাম।“
“বল মা!”
“আপনার বা আংকেলের কি ছেলে বা ছেলের পরিবারের ব্যাপারে কোন সন্দেহ বা আপত্তি আছে?”
“না রে মা, আমাদের তো ঐবাড়ীর সবাইকে খুব পছন্দ আর আমার মেয়ে তো যেদিন ওকে দেখতে এলো সেদিন থেকেই শ্বাশুড়ীকে মা ডাকতে শুরু করেছে! ভদ্রমহিলা জানো ওকে প্রতিদিন ফোন করেন।”
“তার মানে এইখানে আপত্তি শুধু বড় আপার, তাইতো?”
“জ্বী”।
“বিয়েটা কি বড়আপার না বরষার?”
“বিয়ে তো বরষার”
“বড় আপা তো বিয়ে করে ফেলেছেন, তাইনা আন্টি? উনি বিয়ে করার সময় কার কার পরামর্শ নিয়েছিলেন?”
“কারোর না! জানায়ও তো নাই!”
“তাহলে আপনারা বরষার বিয়েতে ওনার কথাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?”
“ও যে নাছোড়বান্দা মা! বলছে এই বিয়ে হলে ও আর আসবেনা।”
“আপনারা তো স্বচ্ছায় ওনাকে বহুবছর এই বাসায় আসতে দেননি। আরো কিছুদিন না আসুক। বরষার বিয়েটা হয়ে গেলেই উনি আবার আসা শুরু করবেন। কিন্তু ওনার একটা অহেতুক আব্দারের জন্য আপনারা বরষার জীবনটা কেন নষ্ট করবেন? সে তো আপনাদের সবাইকে নিয়ে, সবার মানসম্মানের প্রতি খেয়াল রেখেই সুখী হতে চায়। সে যখন আপনাদের এত খেয়াল রাখে, আপনি কি চাননা আপনার এই মেয়েটি সুখী হোক?”
আন্টি মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আমার মাথা আর কাজ করেনা মা। তুমি বল আমি কি করব, যা বলবে তাই করব”।
“ঠিক তো আন্টি? ওয়াদা?”
“হ্যাঁ মা, ওয়াদা”।
“আপনি বিসমিল্লাহ বলে বরষার বিয়েটা দিয়ে দেন। বড় আপা আসতে চাইলে আসবে, না এলে না এলো। ওনার বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছে না? বরষার বিয়ের পরেও সব ঠিক হয়ে যাবে”।
রাহির কথাটা আন্টির খুব পছন্দ হোল। কিছুক্ষণ পর আংকেল এসে পৌঁছুলে সে তাঁকেও একই কথা বলল। আংকেল ওকে বসিয়ে রেখেই বরষার হবু শ্বশুরবাড়ীতে ফোন করলেন, “বাড়ী থেকে এসেছি তো, অনেক ক্লান্ত লাগছে। আজকে আর না আসি … না না, তেমন জরুরী কিছু না। এমনেই দেখাসাক্ষাতের জন্য আসতে চাচ্ছিলাম। এখন ইনশাল্লাহ বিয়ের আসরেই দেখা হবে বেয়াই। আসসালামু আলাইকুম”।

সাতদিন পর বরষার বিয়ে হয়ে গেল।

সাধারনত মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু বরষা চরম সুখের মধ্যেও ভোলেনি রাহির কথা, যে তাকে দুর্দিনে সঙ্গ দিয়েছিল।

No comments:

Post a Comment