যেবার প্রথম বক্তৃতা দেই, তখন আমি ক্লাস ফাইভে। স্কুলে যাবার আগে থেকেই কাঁপাকাঁপি। মঞ্চে যখন নাম ডাকা হোল, মনে হোল আমি শ্রবনশক্তি হারিয়েছি। স্টেজে উঠে অনুভব করলাম পা দু’টো মোমের মত গলে যাচ্ছে। কোনক্রমে স্ক্রিপ্টে মুখ গুঁজে বক্তৃতা শেষ করলাম- মাইক্রোফোনের সাথে মুখের, দর্শকদের সাথে চোখের কোন সংযোগ ব্যাতিরেকেই। মঞ্চ থেকে নেমে এসে সারা শরীরে ঘাম ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারলাম না।
এটা কেবল আমার ঘটনা নয়। অধিকাংশ বক্তাই এমন অনুভব করে থাকেন।
তাহলে ভালো বক্তা হওয়া যায় কি করে?
অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং পড়াশোনা থেকে কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছি।
পূর্বপ্রস্তুতিঃ বিশেষ করে যারা নতুন বক্তা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যারা অভিজ্ঞ তাদের জন্যও এই পর্বটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
১। বিষয় নির্বাচনঃ কখনো কখনো বক্তৃতার বিষয় নির্ধারিত থাকে বা কয়েকটি নির্ধারিত বিষয় থেকে নির্বাচনের সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে বক্তার খুব একটা করণীয় কিছু থাকেনা। নিজে থেকে বিষয় নির্বাচন করতে হলে এমন বিষয় নির্বাচন করা উচিত যে বিষয় সম্পর্কে আপনার মোটামুটি ধারণা বা আগ্রহ আছে। একেবারে নতুন বিষয়ের ওপরেও বলা যায় কিন্তু সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে যদি প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় বা তথ্য পাওয়া না যায়। বিষয়বস্তুর পাশাপাশি বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত সময়কাল জেনে নিতে ভুলবেন না।
২। নির্ধারিত বিষয়ের ওপর পড়াশোনাঃ এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন বিষয় সম্পর্কে বলার জন্য ঐ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন, সেটা কেবল পান্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য নয় বরং শ্রোতার আকাংখাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য। পাশাপাশি বক্তব্য বিষয়ের ওপর পরিস্কার ধারণা থাকলে বক্তা নিজেও বলার ক্ষেত্রে আরাম বোধ করেন এবং সাহস পান। তাই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যথাসম্ভব পড়াশোনা বা তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়বস্তুকে আয়ত্ত্বে আনা অত্যন্ত জরুরী।
৩। ফোকাস নির্ধারনঃ এই ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ বক্তা বক্তৃতা দেয়ার সময় কোন আঙ্গিকে কথা বলবেন আগে থেকে নির্ধারণ না করার ফলে শ্রোতাদের ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটিয়ে ফেলেন। স্বীয় পান্ডিত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা এত ব্যাপক বিষয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন বা একই বিষয়ের এত বেশী আঙ্গিক নিয়ে বলতে শুরু করেন যে দর্শকবৃন্দ খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে বক্তা বলতে থাকেন আর শ্রোতা শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকলেও মানসিকভাবে অন্যত্র বিরাজ করেন অথবা নিজেরা কথাবার্তা বলা শুরু করেন। বক্তাকে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে নিতে হবে তিনি কোন আঙ্গিক থেকে বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করবেন এবং বক্তৃতার কোন পর্যায়ে ঐ ফোকাস থেকে বিচ্যূত হওয়া চলবেনা।
৪। বিষয়বস্তুকে নিজের মত ঢেলে সাজানোঃ পড়াশোনা বা আলোচনার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য বক্তা নিজের মত ঢেলে সাজাবেন। এক্ষেত্রে দু’টি বিষয় তাকে বিবেচনা করতে হবে। তাঁকে মাথায় রাখতে হবে তাঁর শ্রোতা কারা এবং শ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁকে বক্তৃতার বিষয়বস্তু ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্ধারিত ফোকাসের সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়ে না যায় আবার অপ্রয়োজনীয় কিছু এসে শ্রোতাদের বিরক্তির উদ্রেক না করে।
৫। স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করাঃ এই কাজটি যারা করেন তাদের বক্তৃতা সুন্দর ও সুচারু হয়ে থাকে। কেননা পূর্বপ্রস্তুতি যেকোন জিনিসকেই সৌন্দর্যমন্ডিত করে। সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি একবার কষ্ট করে লিখে ফেললে সম্পূর্ণ বক্তব্য সুসজ্জিত অবস্থায় সামনে পাওয়া যায়, এতে পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা সহজ হয়, সময় পরিমাপ বা প্র্যাক্টিস করতেও সুবিধা হয়। স্ক্রিপ্ট থাকলে যে স্ক্রিপ্ট দেখে পড়তে হবে বা এর বাইরে কিছু বলা যাবেনা ব্যাপারটা তেমন নয়। কিন্তু একবার স্ক্রিপ্ট তৈরী করলে লিখতে গিয়ে বিষয়বস্তু ঝালাই হয়ে যায়, তাই স্ক্রিপ্ট সাথে রাখার প্রয়োজন হয়না- পয়েন্টগুলো সংক্ষিপ্ত (কিউকার্ড) আকারে সাথে রাখাই যথেষ্ট।
৬। প্র্যাক্টিসঃ সভাস্থলে বক্তৃতা দেয়ার আগে নিজের ঘরে কয়েকবার প্র্যাক্টিস করুন। উচ্চারণ, সময় এবং যা বলছেন তা কতটুকু বোধগম্য হচ্ছে এসব ব্যাপারে আন্দাজ করুন। যেসব অংশে দুর্বলতা অনুভব করেন সেসব প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, পরিবর্ধন না বর্জন করুন- বেশী বেশী চর্চা করুন। সবচেয়ে ভালো হয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাক্টিস করলে যাতে বক্তব্যের সাথে প্রকাশভঙ্গীর সামঞ্জস্য রক্ষা হচ্ছে কিনা সহজে বোঝা যায়।
৭। পোশাক নির্বাচনঃ অনুষ্ঠানের প্রকার ও প্রকৃতি অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করা উচিত। ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে অধিকতর ফরমাল এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা মেজাজের অনুষ্ঠানের জন্য ঐভাবে পোশাক পরা ভালো। তবে পোশাক এতটা জমকালো হওয়া উচিত নয় যাতে বক্তা বা বক্তব্যের পরিবর্তে পোশাক মূখ্য হয়ে পড়ে। পোশাক রুচিশীল হওয়া প্রয়োজন যাতে বক্তার ব্যাপারে শ্রোতাদের পজিটিভ ধারণার সৃষ্টি হয়।
অনুষ্ঠানে- আপনার বক্তৃতার আগেঃ আপনার বক্তৃতার আগে নিম্নোক্ত কাজগুলোর জন্য কিছু সময় ব্যায় করুন।
১। সময়ের আগে পৌঁছানঃ সভাস্থলে সময়ের আগে পৌঁছনোর চেষ্টা করুন যেন লোকসমাগম হবার আগেই সভাকক্ষের সাথে পরিচিত হতে পারেন। মঞ্চের প্রবেশপথ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো চিনে নিন। নিজেকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত করে নিলে সহজেই কনফিডেন্স আসে।
২। উপস্থাপকের সাথে বন্ধুত্ব করুনঃ উপস্থাপকের সাথে পরিচিত হয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব করে নিন। যেকোন সমস্যার ক্ষেত্রে উপস্থাপক হতে পারে আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
৩। আপনার সময় জেনে নিনঃ বক্তাদের মাঝে আপনার ক্রম এবং বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত সময় জেনে নিন। মানসিক প্রস্তুতির জন্য এটি অত্যন্ত জরুরী।
৪। পরিচিত হনঃ আপনার আশেপাশে সবার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করুন। অন্যান্য বক্তাদের সাথে পরিচিত হলে তাদের কাছে কিছু জানার সুযোগ থাকবে। শ্রোতাদের সাথে পরিচিত হলে মঞ্চে উঠে মনে হবে বন্ধুদের সমাবেশে গল্প করছেন, সুতরাং নার্ভাস লাগবেনা। তাছাড়া শ্রোতারা আপনার ব্যাপারে পজিটিভ ধারণা পোষণ করলে আপনার বক্তৃতার প্রতি অনায়াসে আকৃষ্ট হবে।
৫। অন্যদের বক্তৃতা মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ আপনি যদি অন্য বক্তাদের বক্তৃতার সময় মনোসংযোগ না করেন তাহলে দর্শকশ্রোতা আপনার উদাহরণ অনুসরণপূর্বক আপনার বলার সময় অমনোযোগী হবে। তাছাড়া না শিখলে শেখাবেন কি করে? অনেকক্ষেত্রে প্রসঙ্গ টানার জন্য, ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য বা এক বিষয় বারবার পুণরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকার জন্য অন্য বক্তাদের বক্তব্য মন দিয়ে শোনা জরুরী।
৬। আপনাকে ডাকার আগেই মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিনঃ তড়িঘড়ি করে মঞ্চের দিকে ছুটতে হলে মঞ্চে উঠে হাঁপাবেন। সুতরাং, আপনার ক্রম অনুযায়ী প্রস্তুত থাকুন যেন উপস্থাপক আপনার নাম ঘোষনা করার সাথে সাথে উপস্থিত হতে পারেন এবং ধীরেসুস্থে মঞ্চে আরোহণ করতে পারেন।
৭। জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিনঃ মঞ্চে ওঠার আগে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। এতে টেনশন হ্রাস পাবে। এই কাজটি স্বাভাবিকভাবে করুন যাতে আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে না হয়।
বক্তৃতার সময়ঃ এখন আপনি পুরোপুরি প্রস্তুত। সুতরাং, নীচের ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে বক্তৃতা দিন।
১। সময় নিন, সময় দিনঃ মঞ্চে উঠেই আপনি হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করবেন এমনটা কেউ আশা করেনা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নিন মুখের সাথে মাইকের অ্যাডজাস্টমেন্ট ঠিক হচ্ছে কিনা। যদি মাইক না থাকে, অনুষ্ঠানস্থলের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করুন কতটা জোরে কথা বললে সবাই শুনতে পাবেন। শোতৃমন্ডলীকে কথাবার্তা থামিয়ে আপনার বক্তব্য শোনার জন্য প্রস্তুত হবার সময় দিন। এই সুযোগে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিন এবং ছাড়ুন, অনেক আরাম বোধ করবেন।
২। দর্শকদের দিকে তাকানঃ দর্শকশ্রোতা অনেক কষ্ট করে আপনার বক্তব্য শুনতে এসেছেন। তাঁদের মূল্যায়ন করুন। তাঁদের দিকে তাকান। যদি ভয় লাগে তাহলে উঁচু জায়গায় থাকলে তাদের মাথার তালুর দিকে এবং সমতলে অবস্থান করলে তাদের কপালের দিকে তাকান। দর্শক মনে করবেন আপনি তাঁদের দিকে তাকিয়েছেন, তাঁরা খুশী হবেন। আপনার কারো সাথে চোখাচোখি হবেনা, সুতরাং নার্ভাস লাগবেনা। ভীতি প্রশমিত হলে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন অনেক বন্ধু আপনার কথা মন দিয়ে শুনছেন আর অনেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বসে আছেন।
৩। সঠিকভাবে দাঁড়ানঃ একেবারে ঋজুভঙ্গীতে দাঁড়ালে অস্বাভাবিক বা আতংকিত মনে হবে। আবার একেবারে ঢিলে দিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে আনস্মার্ট। সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ান। যদি সামনে ডায়াস থাকে, দেখে নিন আপনাকে ডায়াসের সামনে থেকে দেখা যাবে কি’না। নতুবা মাইক হাতে নিয়ে ডায়াসের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কুন্ঠিত হবেন না। এসব ক্ষেত্রে উপস্থাপকের সহযোগিতা অনেক কাজে লাগবে। বসা অবস্থায় বক্তৃতা দিলে স্বাভাবিকভাবে বসুন। সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালে বা বসলে দর্শকদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়।
৪। গলার স্বরঃ অনেক বক্তা এত জোরে কথা বলেন যে শ্রোতাদের, বিশেষ করে মাইকের কাছাকাছি উপবিষ্ট শ্রোতাদের, অসম্ভব কষ্ট হয়। তাঁরা কথা শুনবেন কি দুয়া করতে থাকেন কখন বক্তা মঞ্চ থেকে নেমে তাদের উদ্ধার করবেন। আবার অনেকে এমনভাবে কথা বলেন যে কিছুই শোনা যায়না, তখন শ্রোতৃমন্ডলী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন, সভাকক্ষে বিশৃংখলা বিরাজ করে। অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিকে দেখেছি দর্শকশ্রোতা কথার মধ্যখানেই তালি দিতে শুরু করেছে যেন তিনি কথা বন্ধ করে মঞ্চত্যাগ করেন। গলার স্বর স্বাভাবিক এবং শ্রুতিমধুর রাখুন যেন শ্রোতৃমন্ডলী আপনার কথার প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ পান।
৫। প্রকাশভঙ্গীঃ চেহারা স্বাভাবিক রাখুন। কথা বলার সময় যা বলছেন তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসুন বা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা বজায় রাখুন, প্রয়োজন হলে হাত বা চেহারার মাধ্যমে আপনার বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলে ধরুন। তবে মাথা চুলকানো, গালে হাত দেয়া ইত্যাদি বর্জনীয়।
৬। অভিবাদনঃ এতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু আপনার দর্শকশ্রোতার পজিটিভ প্রতিক্রিয়া বাড়বে অনেকখানি। অভিবাদন এমন হওয়া উচিত যা উপস্থিত শ্রোতাদের আবেগ অনুভুতিকে মাথায় রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। এই পর্বটি অতিরিক্ত দীর্ঘ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
৭। মূল বক্তব্য উপস্থাপনঃ এটি আপনার বক্তৃতার প্রাণ। আপনার দর্শকদের শ্রেণীবিন্যাস মাথায় রেখে শব্দ এবং উচ্চারণ নির্বাচন করুন। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা সর্বাবস্থায় সর্বাপেক্ষা নিরাপদ কেননা এটি অধিকাংশ দর্শক সহজেই বুঝতে পারেন। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ধীরগতিতে কথা বলুন এবং প্রয়োজন হলে বক্তৃতার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ছেঁটে সময় বিন্যাস করুন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণের প্রতি মনোযোগী হন। আপনি কি বললেন তা যদি আপনার শ্রোতা ধরতেই না পারেন তাহলে আপনার সব কষ্টই জলে যাবে। সুতরাং, কথার পরিমাণের প্রতি মনোযোগী না হয়ে মানের ব্যাপারে সচেতন হন।
৮। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করুনঃ কথা বলার সময় এমনভাবে কথা বলুন যেন আপনি দ্বিপাক্ষিক আলাপে অংশগ্রহণ করছেন। দর্শকদের প্রশ্ন করুন, তাদের ভাবিয়ে তুলুন, প্রয়োজনে সামান্য কৌতুক করুন- মোটকথা দর্শকশ্রোতাকে আপনার বক্তৃতায় আগ্রহী করে তুলুন।
৯। প্রয়োজন অনুযায়ী মূল স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন করুনঃ চাহিদা বা প্রয়োজন অনুযায়ী মূল স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন করা যায় যেহেতু স্ক্রিপ্ট তখন আপনার মুখস্থ। তবে পরিবর্তনগুলো সংক্ষেপে লিখে নিলে মূল বক্তব্য থেকে খেই হারানোর ভয় থাকেনা। অন্যান্য বক্তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে তাঁরা হুবহু কি বলেছেন তা লিখে নিন এবং এর প্রেক্ষিতে আপনি কি বলতে চান তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরার মত পয়েন্ট এর সাথেই লিখে রাখুন। যথেষ্ট সাহসী বা অভিজ্ঞ না হলে বড় ধরণের পরিবর্তনে না যাওয়াই শ্রেয়।
১০। বিদায়ঃ সব ভালো যার শেষ ভালো। যেকোন বক্তৃতার সৌন্দর্য নির্ভর করে বক্তৃতার বিষয়বস্তুকে সুন্দরভাবে গুটিয়ে এনে দর্শকশ্রোতাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার ওপর। বক্তা অনেক বললেন অথচ উপসংহার টানতে ভুলে গেলেন বা তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, এতে সম্পূর্ণ আবহই নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই কাজগুলোর জন্য কয়েকটি সেকেন্ড হাতে সময় রাখা প্রয়োজন।
বক্তৃতার পরঃ বক্তৃতা শেষ, কাজ শেষ? না, সবে তো কাজ শুরু!
১। আগ্রহীদের সাথে কথা বলুনঃ আপনার বক্তৃতা শেষ হলে অনেকেই আপনার সাথে কথা বলতে আসবে। সবাইকে আন্তরিকতার সাথে সময় দিন- পজিটিভ কমেন্ট মন দিয়ে শুনুন, নেগেটিভ কমেন্ট আরো বেশী গুরুত্বসহকারে মনে গেঁথে নিন- যারা নেগেটিভ মন্তব্যের সাথে সাথে উত্তরণের জন্য পরামর্শ দেবেন তারাই আপনার সত্যিকার শুভাকাংখী। ভালো মন্তব্য এবং তোষামোদের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখুন। পাশাপাশি নেগেটিভ মন্তব্যে মন খারাপ করবেন না। মানুষ মাত্রেই ভুল হবে। এই ভুল থেকে উত্তরণের জন্যই তো জীবন!
২। নিজেকে মূল্যায়ন করুনঃ বাসায় ফিরে স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে বসুন। আপনার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাটি আরেকবার মাথায় ভেতর রিওয়াইন্ড করে দেখুন কোথায় কি ভালো হয়েছে, কোথায় আরো ভাল করা যেত, কি করলে ভুলত্রুটি এড়ানো যেত, ভবিষ্যতে কি করে আরো ভালো করা যেতে পারে। যারা যা মন্তব্য করেছে তা সততার সাথে বিচার করে দেখুন। যা যা দুর্বলতা খুঁজে পেলেন তার থেকে উত্তরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। পাশাপাশি ভালো দিকগুলো চর্চা করতে থাকুন।
অচিরেই আপনি হয়ে উঠবেন ভালো বক্তা!
এটা কেবল আমার ঘটনা নয়। অধিকাংশ বক্তাই এমন অনুভব করে থাকেন।
তাহলে ভালো বক্তা হওয়া যায় কি করে?
অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং পড়াশোনা থেকে কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছি।
পূর্বপ্রস্তুতিঃ বিশেষ করে যারা নতুন বক্তা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যারা অভিজ্ঞ তাদের জন্যও এই পর্বটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
১। বিষয় নির্বাচনঃ কখনো কখনো বক্তৃতার বিষয় নির্ধারিত থাকে বা কয়েকটি নির্ধারিত বিষয় থেকে নির্বাচনের সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে বক্তার খুব একটা করণীয় কিছু থাকেনা। নিজে থেকে বিষয় নির্বাচন করতে হলে এমন বিষয় নির্বাচন করা উচিত যে বিষয় সম্পর্কে আপনার মোটামুটি ধারণা বা আগ্রহ আছে। একেবারে নতুন বিষয়ের ওপরেও বলা যায় কিন্তু সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে যদি প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় বা তথ্য পাওয়া না যায়। বিষয়বস্তুর পাশাপাশি বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত সময়কাল জেনে নিতে ভুলবেন না।
২। নির্ধারিত বিষয়ের ওপর পড়াশোনাঃ এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন বিষয় সম্পর্কে বলার জন্য ঐ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন, সেটা কেবল পান্ডিত্য প্রদর্শনের জন্য নয় বরং শ্রোতার আকাংখাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য। পাশাপাশি বক্তব্য বিষয়ের ওপর পরিস্কার ধারণা থাকলে বক্তা নিজেও বলার ক্ষেত্রে আরাম বোধ করেন এবং সাহস পান। তাই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যথাসম্ভব পড়াশোনা বা তথ্য সংগ্রহ করে বিষয়বস্তুকে আয়ত্ত্বে আনা অত্যন্ত জরুরী।
৩। ফোকাস নির্ধারনঃ এই ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ বক্তা বক্তৃতা দেয়ার সময় কোন আঙ্গিকে কথা বলবেন আগে থেকে নির্ধারণ না করার ফলে শ্রোতাদের ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটিয়ে ফেলেন। স্বীয় পান্ডিত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা এত ব্যাপক বিষয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন বা একই বিষয়ের এত বেশী আঙ্গিক নিয়ে বলতে শুরু করেন যে দর্শকবৃন্দ খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে বক্তা বলতে থাকেন আর শ্রোতা শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকলেও মানসিকভাবে অন্যত্র বিরাজ করেন অথবা নিজেরা কথাবার্তা বলা শুরু করেন। বক্তাকে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে নিতে হবে তিনি কোন আঙ্গিক থেকে বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করবেন এবং বক্তৃতার কোন পর্যায়ে ঐ ফোকাস থেকে বিচ্যূত হওয়া চলবেনা।
৪। বিষয়বস্তুকে নিজের মত ঢেলে সাজানোঃ পড়াশোনা বা আলোচনার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য বক্তা নিজের মত ঢেলে সাজাবেন। এক্ষেত্রে দু’টি বিষয় তাকে বিবেচনা করতে হবে। তাঁকে মাথায় রাখতে হবে তাঁর শ্রোতা কারা এবং শ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁকে বক্তৃতার বিষয়বস্তু ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্ধারিত ফোকাসের সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়ে না যায় আবার অপ্রয়োজনীয় কিছু এসে শ্রোতাদের বিরক্তির উদ্রেক না করে।
৫। স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করাঃ এই কাজটি যারা করেন তাদের বক্তৃতা সুন্দর ও সুচারু হয়ে থাকে। কেননা পূর্বপ্রস্তুতি যেকোন জিনিসকেই সৌন্দর্যমন্ডিত করে। সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি একবার কষ্ট করে লিখে ফেললে সম্পূর্ণ বক্তব্য সুসজ্জিত অবস্থায় সামনে পাওয়া যায়, এতে পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা সহজ হয়, সময় পরিমাপ বা প্র্যাক্টিস করতেও সুবিধা হয়। স্ক্রিপ্ট থাকলে যে স্ক্রিপ্ট দেখে পড়তে হবে বা এর বাইরে কিছু বলা যাবেনা ব্যাপারটা তেমন নয়। কিন্তু একবার স্ক্রিপ্ট তৈরী করলে লিখতে গিয়ে বিষয়বস্তু ঝালাই হয়ে যায়, তাই স্ক্রিপ্ট সাথে রাখার প্রয়োজন হয়না- পয়েন্টগুলো সংক্ষিপ্ত (কিউকার্ড) আকারে সাথে রাখাই যথেষ্ট।
৬। প্র্যাক্টিসঃ সভাস্থলে বক্তৃতা দেয়ার আগে নিজের ঘরে কয়েকবার প্র্যাক্টিস করুন। উচ্চারণ, সময় এবং যা বলছেন তা কতটুকু বোধগম্য হচ্ছে এসব ব্যাপারে আন্দাজ করুন। যেসব অংশে দুর্বলতা অনুভব করেন সেসব প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, পরিবর্ধন না বর্জন করুন- বেশী বেশী চর্চা করুন। সবচেয়ে ভালো হয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাক্টিস করলে যাতে বক্তব্যের সাথে প্রকাশভঙ্গীর সামঞ্জস্য রক্ষা হচ্ছে কিনা সহজে বোঝা যায়।
৭। পোশাক নির্বাচনঃ অনুষ্ঠানের প্রকার ও প্রকৃতি অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করা উচিত। ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে অধিকতর ফরমাল এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা মেজাজের অনুষ্ঠানের জন্য ঐভাবে পোশাক পরা ভালো। তবে পোশাক এতটা জমকালো হওয়া উচিত নয় যাতে বক্তা বা বক্তব্যের পরিবর্তে পোশাক মূখ্য হয়ে পড়ে। পোশাক রুচিশীল হওয়া প্রয়োজন যাতে বক্তার ব্যাপারে শ্রোতাদের পজিটিভ ধারণার সৃষ্টি হয়।
অনুষ্ঠানে- আপনার বক্তৃতার আগেঃ আপনার বক্তৃতার আগে নিম্নোক্ত কাজগুলোর জন্য কিছু সময় ব্যায় করুন।
১। সময়ের আগে পৌঁছানঃ সভাস্থলে সময়ের আগে পৌঁছনোর চেষ্টা করুন যেন লোকসমাগম হবার আগেই সভাকক্ষের সাথে পরিচিত হতে পারেন। মঞ্চের প্রবেশপথ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো চিনে নিন। নিজেকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত করে নিলে সহজেই কনফিডেন্স আসে।
২। উপস্থাপকের সাথে বন্ধুত্ব করুনঃ উপস্থাপকের সাথে পরিচিত হয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব করে নিন। যেকোন সমস্যার ক্ষেত্রে উপস্থাপক হতে পারে আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
৩। আপনার সময় জেনে নিনঃ বক্তাদের মাঝে আপনার ক্রম এবং বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত সময় জেনে নিন। মানসিক প্রস্তুতির জন্য এটি অত্যন্ত জরুরী।
৪। পরিচিত হনঃ আপনার আশেপাশে সবার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করুন। অন্যান্য বক্তাদের সাথে পরিচিত হলে তাদের কাছে কিছু জানার সুযোগ থাকবে। শ্রোতাদের সাথে পরিচিত হলে মঞ্চে উঠে মনে হবে বন্ধুদের সমাবেশে গল্প করছেন, সুতরাং নার্ভাস লাগবেনা। তাছাড়া শ্রোতারা আপনার ব্যাপারে পজিটিভ ধারণা পোষণ করলে আপনার বক্তৃতার প্রতি অনায়াসে আকৃষ্ট হবে।
৫। অন্যদের বক্তৃতা মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ আপনি যদি অন্য বক্তাদের বক্তৃতার সময় মনোসংযোগ না করেন তাহলে দর্শকশ্রোতা আপনার উদাহরণ অনুসরণপূর্বক আপনার বলার সময় অমনোযোগী হবে। তাছাড়া না শিখলে শেখাবেন কি করে? অনেকক্ষেত্রে প্রসঙ্গ টানার জন্য, ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য বা এক বিষয় বারবার পুণরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকার জন্য অন্য বক্তাদের বক্তব্য মন দিয়ে শোনা জরুরী।
৬। আপনাকে ডাকার আগেই মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিনঃ তড়িঘড়ি করে মঞ্চের দিকে ছুটতে হলে মঞ্চে উঠে হাঁপাবেন। সুতরাং, আপনার ক্রম অনুযায়ী প্রস্তুত থাকুন যেন উপস্থাপক আপনার নাম ঘোষনা করার সাথে সাথে উপস্থিত হতে পারেন এবং ধীরেসুস্থে মঞ্চে আরোহণ করতে পারেন।
৭। জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিনঃ মঞ্চে ওঠার আগে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। এতে টেনশন হ্রাস পাবে। এই কাজটি স্বাভাবিকভাবে করুন যাতে আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে না হয়।
বক্তৃতার সময়ঃ এখন আপনি পুরোপুরি প্রস্তুত। সুতরাং, নীচের ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে বক্তৃতা দিন।
১। সময় নিন, সময় দিনঃ মঞ্চে উঠেই আপনি হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করবেন এমনটা কেউ আশা করেনা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নিন মুখের সাথে মাইকের অ্যাডজাস্টমেন্ট ঠিক হচ্ছে কিনা। যদি মাইক না থাকে, অনুষ্ঠানস্থলের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করুন কতটা জোরে কথা বললে সবাই শুনতে পাবেন। শোতৃমন্ডলীকে কথাবার্তা থামিয়ে আপনার বক্তব্য শোনার জন্য প্রস্তুত হবার সময় দিন। এই সুযোগে কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিন এবং ছাড়ুন, অনেক আরাম বোধ করবেন।
২। দর্শকদের দিকে তাকানঃ দর্শকশ্রোতা অনেক কষ্ট করে আপনার বক্তব্য শুনতে এসেছেন। তাঁদের মূল্যায়ন করুন। তাঁদের দিকে তাকান। যদি ভয় লাগে তাহলে উঁচু জায়গায় থাকলে তাদের মাথার তালুর দিকে এবং সমতলে অবস্থান করলে তাদের কপালের দিকে তাকান। দর্শক মনে করবেন আপনি তাঁদের দিকে তাকিয়েছেন, তাঁরা খুশী হবেন। আপনার কারো সাথে চোখাচোখি হবেনা, সুতরাং নার্ভাস লাগবেনা। ভীতি প্রশমিত হলে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন অনেক বন্ধু আপনার কথা মন দিয়ে শুনছেন আর অনেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বসে আছেন।
৩। সঠিকভাবে দাঁড়ানঃ একেবারে ঋজুভঙ্গীতে দাঁড়ালে অস্বাভাবিক বা আতংকিত মনে হবে। আবার একেবারে ঢিলে দিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে আনস্মার্ট। সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ান। যদি সামনে ডায়াস থাকে, দেখে নিন আপনাকে ডায়াসের সামনে থেকে দেখা যাবে কি’না। নতুবা মাইক হাতে নিয়ে ডায়াসের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কুন্ঠিত হবেন না। এসব ক্ষেত্রে উপস্থাপকের সহযোগিতা অনেক কাজে লাগবে। বসা অবস্থায় বক্তৃতা দিলে স্বাভাবিকভাবে বসুন। সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালে বা বসলে দর্শকদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়।
৪। গলার স্বরঃ অনেক বক্তা এত জোরে কথা বলেন যে শ্রোতাদের, বিশেষ করে মাইকের কাছাকাছি উপবিষ্ট শ্রোতাদের, অসম্ভব কষ্ট হয়। তাঁরা কথা শুনবেন কি দুয়া করতে থাকেন কখন বক্তা মঞ্চ থেকে নেমে তাদের উদ্ধার করবেন। আবার অনেকে এমনভাবে কথা বলেন যে কিছুই শোনা যায়না, তখন শ্রোতৃমন্ডলী নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন, সভাকক্ষে বিশৃংখলা বিরাজ করে। অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তিকে দেখেছি দর্শকশ্রোতা কথার মধ্যখানেই তালি দিতে শুরু করেছে যেন তিনি কথা বন্ধ করে মঞ্চত্যাগ করেন। গলার স্বর স্বাভাবিক এবং শ্রুতিমধুর রাখুন যেন শ্রোতৃমন্ডলী আপনার কথার প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ পান।
৫। প্রকাশভঙ্গীঃ চেহারা স্বাভাবিক রাখুন। কথা বলার সময় যা বলছেন তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসুন বা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা বজায় রাখুন, প্রয়োজন হলে হাত বা চেহারার মাধ্যমে আপনার বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলে ধরুন। তবে মাথা চুলকানো, গালে হাত দেয়া ইত্যাদি বর্জনীয়।
৬। অভিবাদনঃ এতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু আপনার দর্শকশ্রোতার পজিটিভ প্রতিক্রিয়া বাড়বে অনেকখানি। অভিবাদন এমন হওয়া উচিত যা উপস্থিত শ্রোতাদের আবেগ অনুভুতিকে মাথায় রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। এই পর্বটি অতিরিক্ত দীর্ঘ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
৭। মূল বক্তব্য উপস্থাপনঃ এটি আপনার বক্তৃতার প্রাণ। আপনার দর্শকদের শ্রেণীবিন্যাস মাথায় রেখে শব্দ এবং উচ্চারণ নির্বাচন করুন। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা সর্বাবস্থায় সর্বাপেক্ষা নিরাপদ কেননা এটি অধিকাংশ দর্শক সহজেই বুঝতে পারেন। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ধীরগতিতে কথা বলুন এবং প্রয়োজন হলে বক্তৃতার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ছেঁটে সময় বিন্যাস করুন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণের প্রতি মনোযোগী হন। আপনি কি বললেন তা যদি আপনার শ্রোতা ধরতেই না পারেন তাহলে আপনার সব কষ্টই জলে যাবে। সুতরাং, কথার পরিমাণের প্রতি মনোযোগী না হয়ে মানের ব্যাপারে সচেতন হন।
৮। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করুনঃ কথা বলার সময় এমনভাবে কথা বলুন যেন আপনি দ্বিপাক্ষিক আলাপে অংশগ্রহণ করছেন। দর্শকদের প্রশ্ন করুন, তাদের ভাবিয়ে তুলুন, প্রয়োজনে সামান্য কৌতুক করুন- মোটকথা দর্শকশ্রোতাকে আপনার বক্তৃতায় আগ্রহী করে তুলুন।
৯। প্রয়োজন অনুযায়ী মূল স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন করুনঃ চাহিদা বা প্রয়োজন অনুযায়ী মূল স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন করা যায় যেহেতু স্ক্রিপ্ট তখন আপনার মুখস্থ। তবে পরিবর্তনগুলো সংক্ষেপে লিখে নিলে মূল বক্তব্য থেকে খেই হারানোর ভয় থাকেনা। অন্যান্য বক্তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে তাঁরা হুবহু কি বলেছেন তা লিখে নিন এবং এর প্রেক্ষিতে আপনি কি বলতে চান তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরার মত পয়েন্ট এর সাথেই লিখে রাখুন। যথেষ্ট সাহসী বা অভিজ্ঞ না হলে বড় ধরণের পরিবর্তনে না যাওয়াই শ্রেয়।
১০। বিদায়ঃ সব ভালো যার শেষ ভালো। যেকোন বক্তৃতার সৌন্দর্য নির্ভর করে বক্তৃতার বিষয়বস্তুকে সুন্দরভাবে গুটিয়ে এনে দর্শকশ্রোতাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার ওপর। বক্তা অনেক বললেন অথচ উপসংহার টানতে ভুলে গেলেন বা তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, এতে সম্পূর্ণ আবহই নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই কাজগুলোর জন্য কয়েকটি সেকেন্ড হাতে সময় রাখা প্রয়োজন।
বক্তৃতার পরঃ বক্তৃতা শেষ, কাজ শেষ? না, সবে তো কাজ শুরু!
১। আগ্রহীদের সাথে কথা বলুনঃ আপনার বক্তৃতা শেষ হলে অনেকেই আপনার সাথে কথা বলতে আসবে। সবাইকে আন্তরিকতার সাথে সময় দিন- পজিটিভ কমেন্ট মন দিয়ে শুনুন, নেগেটিভ কমেন্ট আরো বেশী গুরুত্বসহকারে মনে গেঁথে নিন- যারা নেগেটিভ মন্তব্যের সাথে সাথে উত্তরণের জন্য পরামর্শ দেবেন তারাই আপনার সত্যিকার শুভাকাংখী। ভালো মন্তব্য এবং তোষামোদের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখুন। পাশাপাশি নেগেটিভ মন্তব্যে মন খারাপ করবেন না। মানুষ মাত্রেই ভুল হবে। এই ভুল থেকে উত্তরণের জন্যই তো জীবন!
২। নিজেকে মূল্যায়ন করুনঃ বাসায় ফিরে স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে বসুন। আপনার সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাটি আরেকবার মাথায় ভেতর রিওয়াইন্ড করে দেখুন কোথায় কি ভালো হয়েছে, কোথায় আরো ভাল করা যেত, কি করলে ভুলত্রুটি এড়ানো যেত, ভবিষ্যতে কি করে আরো ভালো করা যেতে পারে। যারা যা মন্তব্য করেছে তা সততার সাথে বিচার করে দেখুন। যা যা দুর্বলতা খুঁজে পেলেন তার থেকে উত্তরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। পাশাপাশি ভালো দিকগুলো চর্চা করতে থাকুন।
অচিরেই আপনি হয়ে উঠবেন ভালো বক্তা!
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete