বহুদিন পর দুই বান্ধবী মন ভরে গল্প করার সুযোগ পেল। মিনা বাপের বাড়ী এসেছে ক’দিন থাকতে। রাহির বর গেছে ঢাকায়। এ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? দু’জনেই এখন মিনার বাপের বাড়ী। বসে আছে ড্রইং রুমের ঝুল বারান্দায়। গভীর রাত। বাসার আর সবাই ঘুমে অচেতন। কিন্তু দুই বান্ধবীর তাতে ন্যূনতম মাথাব্যাথা নেই। মিনাদের বাড়ীর আশপাশটা কেমন যেন একটু গ্রাম গ্রাম ধরণের, রাতের বেলা ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, জোনাকীর আলো দেখা যায়। সাথে শেষরাত্রির একটু একটু বাতাস, আকাশে চাঁদের আলোর বন্যার মাঝে তারাদের সাঁতার কাটা। চমৎকার লাগে রাহির।
“তুই কেমন আছিস সত্যি করে বল তো রাহি?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মিনা যেন দৃষ্টি দিয়েই সত্যটা উদ্ঘাটন করে নেবে আজ।
ওর অনুসন্ধিৎসু চেহারা দেখে হাসি সামলাতে পারেনা রাহি, “কি বললে তোরা সবাই বিশ্বাস করবি যে আমি ভালো আছি?”
“আচ্ছা, তুই হলি একটা আগুনের গোলা আর রাশিদ ভাই হলেন পানির ড্রাম; তুই অসম্ভবরকম স্বাধীনতা পেয়ে বড় হয়েছিস- যেমন তুই রাজী বলে আংকেল বিয়ে দিয়ে দিলেন, আর দেখ ডাক্তারসাহেবের থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমার তোকে ভাড়া করে আনতে হয়েছে, তারপর একটা কনজার্ভেটিভ পরিবেশে গিয়ে তুই কি করছিস- এসব নিয়ে আমরা খুব চিন্তা করি রে!”
“শোন, লেকচার দিচ্ছিনা তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে দু’জনের বেসিক মানসিকতায় মিল থাকলে আর বাকী ব্যাপারগুলো উল্টো হলে সম্পর্কটা ভালো হয়, বৈচিত্র আসে, একজন অপরজনের থেকে কিছু শিখতে পারে। ভেবে দেখ আমরা দু’জনেই হুলস্থুল মেজাজী হলে কবে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলতাম!”
মিনা হাসতে হাসতে বলে, “এখনো যে করিসনি তাতেই তো আমরা অবাক হয়ে যাই! আর পারিবারিক ক্ষেত্রে যেসব পার্থক্য, সেগুলো সামাল দিস কিভাবে?”
রাহি গম্ভীর হয়ে বলে, “একেবারে ভিন্ন দুই পরিবেশ থেকে এসে একে অপরের সাথে একেবারে মিশ খেয়ে যাওয়া সহজ নয়। এর জন্য উভয়পক্ষের সময় প্রয়োজন, সহনশীলতার প্রয়োজন আর দরকার একে অপরকে বোঝার আগ্রহ। তবে ইসলাম আমাদের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, পরস্পরকে সম্মান করতে একে অপরের প্রতি সহনশীল হতে শেখায়। রাশিদ সাহেব খেয়াল রাখেন তাঁর পরিবার যেন আমাকে ভুল না বোঝে, আর আমাকে আগেভাগে বলে দেন কার কি পছন্দ কেমন মনোভাব। তাহলে যেকোন পরিস্থিতি বোঝা, সামাল দেয়া সহজ হয়ে যায়”।
“মজার পার্টনারশিপ তো তোদের! আহারে আমার খালাত ভাইটা যদি একটু বুদ্ধি খরচ করত!”
“কেন রে, ভাইজান আবার কি অন্যায় করল?”
“তুই চাকরীতে ঢোকার পর থেকে তো তোকে পাওয়াই মুশকিল। কত কথা যে জমে আছে! জানিস তো ভাইজান বিয়ে করেছে।“
“হ্যাঁ”।
“বিয়ের আগে ভাইজান বলত, ‘মিনা, দেখিস আমি এমন মেয়ে বিয়ে করব যে আমার সাথে মিলে আমাদের পরিবারটাকে সংশোধন করে ইসলামের পথে নিয়ে আসবে’। ওর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে খুঁজেপেতে এরকম একটা মেয়ে ঠিক করলাম। খালা, খালাত বোনরা কিছুতেই রাজী না। এই মেয়ে তাদের সাথে মিশ খাবেনা- ওরা সিরিয়াল দেখতে গেলে এই মেয়ে ওদের নামাজের জন্য ডেকে নিয়ে যাবে, ওরা বিয়েবাড়ীতে যাবার জন্য পার্লারে সাজতে যাবে আর এই মেয়ে ঢেকেঢুকে ওদের সাথে গেলে ওদের স্মার্ট ইমেজের বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। ওরা ভাইজানকে বলল, ‘তুমি আগে আমাদের পছন্দের একটা মেয়ে দেখ, তারপর তোমার ভালো না লাগলে নাহয় ঐ মেয়েকেই বিয়ে কোর’। ওরা দেখেশুনে এক অসাধারণ সুন্দরীকে দেখালো আর ভাইজান এক বলেই কুপোকাত! বিলকুল ভুলে গেল ওর সমস্ত সংকল্প, পরিকল্পনা। ভাবী খুবই ভালো মেয়ে, খালা আর খালাত বোনদের সাথে ওর সম্পর্ক খুব ভালো- বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে সিরিয়াল দেখতে বসে, প্রত্যেক বিয়েতে নতুন কাপড়, নতুন সাজ। কিন্তু ভাইজান কি পেল? ওর পরিবার কি পেল?”
রাহি কি উত্তর দেবে খুঁজে পায়না।
হঠাৎ ফুঁসে ওঠে মিনা, “সেদিন ভাইজান দেখা করতে এসেছিল। বলে, ‘আমার বৌ আমাকে ভালোবাসেনা- নামাজ পড়ার ব্যাপারে গাফলতি করে, মাথায় তো দূরে থাক গায় পর্যন্ত ঠিকভাবে ওড়না দেয়না, কত বইপত্র এনে দেই কিন্তু ওর পড়ার কোন ইচ্ছা বা জানার কোন কৌতুহল নেই’। মনে মনে বলি, ‘ব্যাটা তুই মেয়েদের কি মনে করিস? যে পাত্রে রাখা হবে সেই পাত্রের আকৃতি ধারণ করবে। মেয়েরা কি মানুষ নয়? এতদিন সে যে বিশ্বাস, ধ্যানধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তুমি বলবে আর সে সুবোধ বালিকার মত সব ত্যাগ করে নিজেকে তোমার রংয়ে রাঙ্গিয়ে নেবে? কোথায় পেয়েছ এসব ফালতু ফিলসফি? বেচারী নিজের সৃষ্টিকর্তাকেই ভালোবাসতে শেখেনি, তোমাকে ভালোবাসবে কোথা থেকে?’ বাইরে বললাম, ‘বিয়ে যখন করে ফেলেছ শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা কর’। রাহি, ঘোড়াকে পানির কাছে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু তাকে জোর করে পানি খাওয়ানো যায়না। ওকে এই ভুলের মাশুল সারাজীবন গুণতে হবে”।
বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই নীরব। তারপর কি যেন ভেবে মিনা একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রাহি চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকায়, “কি ভাবছিস?”
“এই যে যারা ইসলাম বোঝে তারা বিয়ে করার সময় ইসলামকে প্রাধান্য দেয়না, ফলে দু’জনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়”।
“বুঝলাম না”।
“শোন, এমনিতেই আমরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করলেও ইসলাম প্রকৃতপক্ষে বুঝে, জানে বা মানে এমন মানুষের সংখ্যা ক’জন? তার ওপর ভাইজানের মত ছেলেরা, যারা নিজেরা ইসলাম বোঝে, তারা এমন মেয়েদের বিয়ে করছে যাদের প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। ফলে না তারা নিজেরা সুখী হতে পারছে না পারছে স্ত্রীদের সুখী করতে। যখন তাদের সন্তান হচ্ছে তখন সন্তানেরা মায়ের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারণা পাচ্ছেনা আর বাবামায়ের প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বে সন্তান সবসময় মায়ের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। তাছাড়া ভেবে দেখ, যে পুরুষ বিয়ে করার সময় উদাসীন তুই কি মনে করিস সে সন্তানের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই শূণ্যস্থান পূরণ করার জন্য তৎপর হয়? ফলে দ্বিতীয় জেনারেশনে যেতে না যেতেই ঐ পরিবার থেকে ইসলামের বিলুপ্তি। তারপর দেখ এর উল্টো চিত্র। সামান্য ক’টা ইসলাম জানা ছেলে যখন অন্যত্র বিয়ে করছে তখন যে ক’টা মেয়ে ইসলাম জানে তাদের বিয়ে করতে হচ্ছে এমন ছেলেদের যারা ইসলাম বোঝেনা। ফলে তারা প্রথমেই মেয়েগুলোকে পর্দা ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। আমাদের মেয়েদের ছোটবেলা থেকে স্বামীর অধিকার সম্পর্কে এমন আকাশচুম্বী ধারণা দেয়া হয় যে তা স্বয়ং কুর’আনে কি আছে তাকেও ছাড়িয়ে যায়। ফলে যদি আল্লাহর কথা আর স্বামীর কথা দ্বান্দ্বিক হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে সে যে স্বামীকে ‘না’ বলার অধিকার রাখে, এ’টুকু অধিকার সে প্রয়োগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সামাজিক একটা চাপ তো আছেই। একটা ঘরের একটা পিলার যদি তুই ফেলে দিস আগেপরে পুরো ঘরটাই ড্যামেজ হয়ে যাবে। সুতরাং যে মেয়েটা তার জীবনের সবচেয়ে অর্থবহ অবদান রাখার সম্ভাবনার শুরুতেই কম্প্রোমাইজ করে, সে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনা। ফলাফল, এই পরিবারে প্রথম জেনারেশন থেকেই ইসলামের বিলুপ্তি। বৃহত্তর পরিসরে গিয়ে দেখ এক বিশাল নামধারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হচ্ছে যাদের অধিকাংশই কালিমা পর্যন্ত জানেনা। ফলে জনসংখ্যা জরীপে মুসলিমদের যে বিশাল সংখ্যা দেখে আমরা আনন্দিত হই সেটাই তো আসলে আমাদের দুঃখিত হবার কারণ”।
মিনার চিন্তার গভীরতায় রাহির মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল।
[imghttp://www.sonarbangladesh.com/blog/uploads/rehnuma201103151300156902_1531979022_e704bded72.jpg]
কিছুক্ষণ চিন্তায় মশগুল থেকে রাহি বলল, “মিনা, আমাদের ছেলেরা এভাবে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূণ্য হয়ে বিয়ের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন সেটা তো একটু ভাববি!”
মিনা বলল, “ওদের মাথার সমস্যা তাই”।
হেসে ফেলল রাহি, “তুই হুলস্থুল রেগে আছিস, নইলে তুই নিজেও দেখতে পেতি। মাথার সমস্যাই বটে। আমাদের বাপ মায়েরা নিজেরা অল্পবয়সে বিয়ে করেছে। তারপর খুব তাড়াতাড়িই ভুলে গিয়েছে অল্পবয়সে মানুষের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলো কেমন থাকে। আমাদের এই সমাজে এতরকম প্রলোভন, পথভ্রষ্ট হবার এত বেশী সুযোগ যে আমাদের এই ভাইবোনগুলোকে বাঁচানোর জন্য যথাসময়ে বিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের গার্ডিয়ানদের আমাদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, বিদেশ যাওয়া নিয়ে যত টেনশন তার ১% টেনশনও নেই তাদের সন্তানদের চরিত্র বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে। ছেলেমেয়েরা লজ্জায় বলতে পারেনা আর বাবামায়েরা ভাব করে তারা কিছু বোঝেনা। এই লজ্জা লজ্জা খেলায় একসময় বলি হয়ে যায় চরিত্র বা সংকল্প- যে উইকেট আগে পড়ে। বাবামাদের বললে বলে, ‘সে কি চাকরী করে? ওর বৌকে খাওয়াবে কি?’ আচ্ছা বাবা, ‘আমার বোন যদি বিয়ের পরেও মাসের পর মাস জামাই নিয়ে বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় থাকে, খায়, লেখাপড়া করে তাতে তোমাদের গায়ে লাগেনা আর ছেলের বৌ এলেই যত সমস্যা? সে তো নিজের রিজিক নিয়েই আসে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো ছেলের বৌদের মনে করা হয় সে পরিবারে দেবে কিন্তু পরিবার থেকে পাবার তার কোন হক নেই- যতদিন সে কর্মক্ষম থাকে ততদিন তার শ্বশুরবাড়ীতে ঠাঁই হয়, আর অসুস্থ হলেই দাও পাঠিয়ে বাপের বাড়ী!- মাঝখানে ছেলেটার চরিত্র মাটি হয়ে যায়”।
মিনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “বুঝি রে রাহি, সব বুঝি। আমাদের এই মধ্যরাতের আড্ডায় আমরা দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান করে ফেলি অথচ বাস্তবে আমরা কতটুকুই বা করতে পারি?”
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে দুই বান্ধবী পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কবে সেখানে আলো ফুটবে?
“তুই কেমন আছিস সত্যি করে বল তো রাহি?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মিনা যেন দৃষ্টি দিয়েই সত্যটা উদ্ঘাটন করে নেবে আজ।
ওর অনুসন্ধিৎসু চেহারা দেখে হাসি সামলাতে পারেনা রাহি, “কি বললে তোরা সবাই বিশ্বাস করবি যে আমি ভালো আছি?”
“আচ্ছা, তুই হলি একটা আগুনের গোলা আর রাশিদ ভাই হলেন পানির ড্রাম; তুই অসম্ভবরকম স্বাধীনতা পেয়ে বড় হয়েছিস- যেমন তুই রাজী বলে আংকেল বিয়ে দিয়ে দিলেন, আর দেখ ডাক্তারসাহেবের থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমার তোকে ভাড়া করে আনতে হয়েছে, তারপর একটা কনজার্ভেটিভ পরিবেশে গিয়ে তুই কি করছিস- এসব নিয়ে আমরা খুব চিন্তা করি রে!”
“শোন, লেকচার দিচ্ছিনা তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে দু’জনের বেসিক মানসিকতায় মিল থাকলে আর বাকী ব্যাপারগুলো উল্টো হলে সম্পর্কটা ভালো হয়, বৈচিত্র আসে, একজন অপরজনের থেকে কিছু শিখতে পারে। ভেবে দেখ আমরা দু’জনেই হুলস্থুল মেজাজী হলে কবে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলতাম!”
মিনা হাসতে হাসতে বলে, “এখনো যে করিসনি তাতেই তো আমরা অবাক হয়ে যাই! আর পারিবারিক ক্ষেত্রে যেসব পার্থক্য, সেগুলো সামাল দিস কিভাবে?”
রাহি গম্ভীর হয়ে বলে, “একেবারে ভিন্ন দুই পরিবেশ থেকে এসে একে অপরের সাথে একেবারে মিশ খেয়ে যাওয়া সহজ নয়। এর জন্য উভয়পক্ষের সময় প্রয়োজন, সহনশীলতার প্রয়োজন আর দরকার একে অপরকে বোঝার আগ্রহ। তবে ইসলাম আমাদের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, পরস্পরকে সম্মান করতে একে অপরের প্রতি সহনশীল হতে শেখায়। রাশিদ সাহেব খেয়াল রাখেন তাঁর পরিবার যেন আমাকে ভুল না বোঝে, আর আমাকে আগেভাগে বলে দেন কার কি পছন্দ কেমন মনোভাব। তাহলে যেকোন পরিস্থিতি বোঝা, সামাল দেয়া সহজ হয়ে যায়”।
“মজার পার্টনারশিপ তো তোদের! আহারে আমার খালাত ভাইটা যদি একটু বুদ্ধি খরচ করত!”
“কেন রে, ভাইজান আবার কি অন্যায় করল?”
“তুই চাকরীতে ঢোকার পর থেকে তো তোকে পাওয়াই মুশকিল। কত কথা যে জমে আছে! জানিস তো ভাইজান বিয়ে করেছে।“
“হ্যাঁ”।
“বিয়ের আগে ভাইজান বলত, ‘মিনা, দেখিস আমি এমন মেয়ে বিয়ে করব যে আমার সাথে মিলে আমাদের পরিবারটাকে সংশোধন করে ইসলামের পথে নিয়ে আসবে’। ওর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে খুঁজেপেতে এরকম একটা মেয়ে ঠিক করলাম। খালা, খালাত বোনরা কিছুতেই রাজী না। এই মেয়ে তাদের সাথে মিশ খাবেনা- ওরা সিরিয়াল দেখতে গেলে এই মেয়ে ওদের নামাজের জন্য ডেকে নিয়ে যাবে, ওরা বিয়েবাড়ীতে যাবার জন্য পার্লারে সাজতে যাবে আর এই মেয়ে ঢেকেঢুকে ওদের সাথে গেলে ওদের স্মার্ট ইমেজের বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। ওরা ভাইজানকে বলল, ‘তুমি আগে আমাদের পছন্দের একটা মেয়ে দেখ, তারপর তোমার ভালো না লাগলে নাহয় ঐ মেয়েকেই বিয়ে কোর’। ওরা দেখেশুনে এক অসাধারণ সুন্দরীকে দেখালো আর ভাইজান এক বলেই কুপোকাত! বিলকুল ভুলে গেল ওর সমস্ত সংকল্প, পরিকল্পনা। ভাবী খুবই ভালো মেয়ে, খালা আর খালাত বোনদের সাথে ওর সম্পর্ক খুব ভালো- বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে সিরিয়াল দেখতে বসে, প্রত্যেক বিয়েতে নতুন কাপড়, নতুন সাজ। কিন্তু ভাইজান কি পেল? ওর পরিবার কি পেল?”
রাহি কি উত্তর দেবে খুঁজে পায়না।
হঠাৎ ফুঁসে ওঠে মিনা, “সেদিন ভাইজান দেখা করতে এসেছিল। বলে, ‘আমার বৌ আমাকে ভালোবাসেনা- নামাজ পড়ার ব্যাপারে গাফলতি করে, মাথায় তো দূরে থাক গায় পর্যন্ত ঠিকভাবে ওড়না দেয়না, কত বইপত্র এনে দেই কিন্তু ওর পড়ার কোন ইচ্ছা বা জানার কোন কৌতুহল নেই’। মনে মনে বলি, ‘ব্যাটা তুই মেয়েদের কি মনে করিস? যে পাত্রে রাখা হবে সেই পাত্রের আকৃতি ধারণ করবে। মেয়েরা কি মানুষ নয়? এতদিন সে যে বিশ্বাস, ধ্যানধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তুমি বলবে আর সে সুবোধ বালিকার মত সব ত্যাগ করে নিজেকে তোমার রংয়ে রাঙ্গিয়ে নেবে? কোথায় পেয়েছ এসব ফালতু ফিলসফি? বেচারী নিজের সৃষ্টিকর্তাকেই ভালোবাসতে শেখেনি, তোমাকে ভালোবাসবে কোথা থেকে?’ বাইরে বললাম, ‘বিয়ে যখন করে ফেলেছ শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা কর’। রাহি, ঘোড়াকে পানির কাছে নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু তাকে জোর করে পানি খাওয়ানো যায়না। ওকে এই ভুলের মাশুল সারাজীবন গুণতে হবে”।
বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই নীরব। তারপর কি যেন ভেবে মিনা একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রাহি চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকায়, “কি ভাবছিস?”
“এই যে যারা ইসলাম বোঝে তারা বিয়ে করার সময় ইসলামকে প্রাধান্য দেয়না, ফলে দু’জনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়”।
“বুঝলাম না”।
“শোন, এমনিতেই আমরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করলেও ইসলাম প্রকৃতপক্ষে বুঝে, জানে বা মানে এমন মানুষের সংখ্যা ক’জন? তার ওপর ভাইজানের মত ছেলেরা, যারা নিজেরা ইসলাম বোঝে, তারা এমন মেয়েদের বিয়ে করছে যাদের প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। ফলে না তারা নিজেরা সুখী হতে পারছে না পারছে স্ত্রীদের সুখী করতে। যখন তাদের সন্তান হচ্ছে তখন সন্তানেরা মায়ের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারণা পাচ্ছেনা আর বাবামায়ের প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বে সন্তান সবসময় মায়ের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। তাছাড়া ভেবে দেখ, যে পুরুষ বিয়ে করার সময় উদাসীন তুই কি মনে করিস সে সন্তানের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই শূণ্যস্থান পূরণ করার জন্য তৎপর হয়? ফলে দ্বিতীয় জেনারেশনে যেতে না যেতেই ঐ পরিবার থেকে ইসলামের বিলুপ্তি। তারপর দেখ এর উল্টো চিত্র। সামান্য ক’টা ইসলাম জানা ছেলে যখন অন্যত্র বিয়ে করছে তখন যে ক’টা মেয়ে ইসলাম জানে তাদের বিয়ে করতে হচ্ছে এমন ছেলেদের যারা ইসলাম বোঝেনা। ফলে তারা প্রথমেই মেয়েগুলোকে পর্দা ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। আমাদের মেয়েদের ছোটবেলা থেকে স্বামীর অধিকার সম্পর্কে এমন আকাশচুম্বী ধারণা দেয়া হয় যে তা স্বয়ং কুর’আনে কি আছে তাকেও ছাড়িয়ে যায়। ফলে যদি আল্লাহর কথা আর স্বামীর কথা দ্বান্দ্বিক হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে সে যে স্বামীকে ‘না’ বলার অধিকার রাখে, এ’টুকু অধিকার সে প্রয়োগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। সামাজিক একটা চাপ তো আছেই। একটা ঘরের একটা পিলার যদি তুই ফেলে দিস আগেপরে পুরো ঘরটাই ড্যামেজ হয়ে যাবে। সুতরাং যে মেয়েটা তার জীবনের সবচেয়ে অর্থবহ অবদান রাখার সম্ভাবনার শুরুতেই কম্প্রোমাইজ করে, সে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনা। ফলাফল, এই পরিবারে প্রথম জেনারেশন থেকেই ইসলামের বিলুপ্তি। বৃহত্তর পরিসরে গিয়ে দেখ এক বিশাল নামধারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হচ্ছে যাদের অধিকাংশই কালিমা পর্যন্ত জানেনা। ফলে জনসংখ্যা জরীপে মুসলিমদের যে বিশাল সংখ্যা দেখে আমরা আনন্দিত হই সেটাই তো আসলে আমাদের দুঃখিত হবার কারণ”।
মিনার চিন্তার গভীরতায় রাহির মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল।
[imghttp://www.sonarbangladesh.com/blog/uploads/rehnuma201103151300156902_1531979022_e704bded72.jpg]
কিছুক্ষণ চিন্তায় মশগুল থেকে রাহি বলল, “মিনা, আমাদের ছেলেরা এভাবে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূণ্য হয়ে বিয়ের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কেন সেটা তো একটু ভাববি!”
মিনা বলল, “ওদের মাথার সমস্যা তাই”।
হেসে ফেলল রাহি, “তুই হুলস্থুল রেগে আছিস, নইলে তুই নিজেও দেখতে পেতি। মাথার সমস্যাই বটে। আমাদের বাপ মায়েরা নিজেরা অল্পবয়সে বিয়ে করেছে। তারপর খুব তাড়াতাড়িই ভুলে গিয়েছে অল্পবয়সে মানুষের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলো কেমন থাকে। আমাদের এই সমাজে এতরকম প্রলোভন, পথভ্রষ্ট হবার এত বেশী সুযোগ যে আমাদের এই ভাইবোনগুলোকে বাঁচানোর জন্য যথাসময়ে বিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের গার্ডিয়ানদের আমাদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, বিদেশ যাওয়া নিয়ে যত টেনশন তার ১% টেনশনও নেই তাদের সন্তানদের চরিত্র বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে। ছেলেমেয়েরা লজ্জায় বলতে পারেনা আর বাবামায়েরা ভাব করে তারা কিছু বোঝেনা। এই লজ্জা লজ্জা খেলায় একসময় বলি হয়ে যায় চরিত্র বা সংকল্প- যে উইকেট আগে পড়ে। বাবামাদের বললে বলে, ‘সে কি চাকরী করে? ওর বৌকে খাওয়াবে কি?’ আচ্ছা বাবা, ‘আমার বোন যদি বিয়ের পরেও মাসের পর মাস জামাই নিয়ে বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় থাকে, খায়, লেখাপড়া করে তাতে তোমাদের গায়ে লাগেনা আর ছেলের বৌ এলেই যত সমস্যা? সে তো নিজের রিজিক নিয়েই আসে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো ছেলের বৌদের মনে করা হয় সে পরিবারে দেবে কিন্তু পরিবার থেকে পাবার তার কোন হক নেই- যতদিন সে কর্মক্ষম থাকে ততদিন তার শ্বশুরবাড়ীতে ঠাঁই হয়, আর অসুস্থ হলেই দাও পাঠিয়ে বাপের বাড়ী!- মাঝখানে ছেলেটার চরিত্র মাটি হয়ে যায়”।
মিনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “বুঝি রে রাহি, সব বুঝি। আমাদের এই মধ্যরাতের আড্ডায় আমরা দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান করে ফেলি অথচ বাস্তবে আমরা কতটুকুই বা করতে পারি?”
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে দুই বান্ধবী পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, কবে সেখানে আলো ফুটবে?
No comments:
Post a Comment