Wednesday, June 15, 2011

বিয়ে ৪


রাশিদ ভাইকে নিয়ে অফিসে হাসাহাসির অন্ত নেই। মানুষটা হঠাৎ করেই দিনরাত এক্সারসাইজ করছে, মাপঝোঁক করে খাওয়া দাওয়া করছে- অথচ উনি পারলে দুইকদমও হাঁটেন না! একদিন রাহি ঠাট্টাচ্ছলে বলেই ফেলল, “কি রাশিদ ভাই, আমাদের হবু ভাবীকে ইম্প্রেস করার জন্যই কি এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা?” রাশিদ ভাই ভীষণ লজ্জা পেয়ে বললেন, “অনেকটা তাই”। এত্তবড় লোকটাকে মেয়েদের মত লজ্জা পেতে দেখে সে হাসি সামলাতে পারলনা। ওর উচ্ছসিত হাসি শুনে রাশিদ ভাই পালিয়ে বাঁচলেন।

এবার অফিসে জল্পনা কল্পনা শুরু হোল রাশিদ ভাই কাকে বিয়ে করার জন্য ফিট অ্যান্ড হ্যন্ডসাম হবার চেষ্টা করছেন। তিনি কিছুদিন আগে বাড়ী থেকে ফিরলেন। তাই অধিকাংশ ধারণা করল তিনি মেয়ে দেখার জন্য বাড়ী গেছিলেন। কেউ কেউ ধারণা করল অফিসের সুন্দরী ফারহানা- যে তাকে প্রায়ই ফুল দিয়ে যায় আর তিনি তৎক্ষণাৎ তা নিকটস্থ কোন পুরুষ বন্ধুকে সমর্পণ করে কৃতার্থ করেন- হয়ত শেষ পর্যন্ত তাঁর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।

রাহির অতসব ভাবাভাবিতে কাজ নেই। রাশিদ ভাই বিয়ে করবেন জেনে সে চটপট কয়েকটা হিসেব করে নিলো। প্রথমত যে মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করবেন সে কয়েকটি ফ্রি উপহার পাবে। যেমন কেউ কখনো রাশিদ ভাইকে নামাজ কাজা করতে দেখেনি। যার জবাবদিহিতার ভয় আছে সে নিশ্চয়ই একটি মেয়েকে ঠকাবে না। তিনি যে পদে অধিষ্ঠিত তাতে তিনি চাইলে ঘুষ খেয়ে লাল হয়ে যেতে পারেন কিন্তু তিনি একটি পয়সাও কখনো খেয়েছেন কেউ বলতে পারবেনা। বরং রাহিকে তিনি একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ম্যাডাম, পৈত্রিক সূত্রে একখানা বাড়ী পেয়েছি, যা বেতন পাই তাতে বাবা মা, দু’টো বোন আর আমার খাওয়া পরা হয়ে কিছু বাঁচে। মানুষের সুখী হবার জন্য আর কত চাই বলুন?” এটা রাশিদ ভাইয়ের আরেকটা গুন। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে বড়সাহেব পর্যন্ত সবার সাথে তিনি একই ব্যাবহার করেন। তাই সবাই এই সদালাপী আর হাসিখুশী মানুষটাকে খুব পছন্দ করে। দ্বিতীয়ত, কোন মেয়েকে সুখী এবং সৌভাগ্যবতী করার এটা মোক্ষম সুযোগ। সুতরাং, রাহি হিসেব করতে শুরু করল আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যে কাকে কাকে রাশিদ ভাইয়ের জন্য দেখা যায়। হিসেব নিকেশ করে দু’জনকে ওর পছন্দ হোল। ব্যাস, যেই ভাবা সেই কাজ। রাশিদ সাহেবের মাকে ফোন করে জানালো, “আন্টি, আমার পরিচিত এই দু’জন মেয়ে অসম্ভব ভালো। এদের মধ্যে একজনকে আপনি রাশিদ ভাইয়ের জন্য দেখতে পারেন”। কিন্তু আন্টি শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ফোন রেখে দিলেন, এত ভালো দু’টো প্রস্তাব দিল সে অথচ তিনি কোন আগ্রহ দেখালেন না! ভীষণ রাগ হোল ওর। কিন্তু পরে ভাবল হয়ত তিনি মেয়ে দেখে ফেলেছেন।

ওদিকে দু’দিন পর বাসায় একটা ফোন এলো। আব্বুর চেহারা দেখেই সে বুঝতে পারল ওর জন্য কোন প্রস্তাব এসেছে। সে মনে মনে আরেকটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোল।

রাহিদের পরিবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, এখানে ধর্ম নিতান্ত অপাংক্তেয় বা একেবারেই অনুপস্থিত। যারা ধর্ম পালন করে তারাও ধর্মের ব্যাপারে স্বচ্ছ কোন ধারণা না থাকায় এ’ব্যাপারে লজ্জিত থাকে। এর মধ্যে রাহি ধর্ম নিয়ে অল্পস্বল্প লেখাপড়া করে যখন পুরোপুরি ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল তখন এই ব্যাকওয়ার্ড মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন- এর কি হবে গো?! প্রথমে উপদেশ, তারপর অনুরোধ, তারপর আদেশ, শেষমেশ গালাগাল করেও যখন তাকে পর্দার মত বাড়াবাড়ি থেকে নিবৃত করা গেলনা তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন রাহিকে বিয়ের মাধ্যমেই সংশোধন করতে হবে। সুতরাং, রাহিও যথারীতি যেকোন প্রস্তাব এলেই যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠত- বিয়ে না করার যুদ্ধ।

তবে এক্ষেত্রে ওর বিশেষ একটা সুবিধা ছিল। ওর আব্বু সবসময় ওর সাথে খোলাখুলি আলাপ করতেন, মাঝেমাঝে উপদেশ বা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন, কিন্তু ওর মতামত পছন্দ হোক বা না হোক তিনি রাহির সিদ্ধান্তকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তাই বরাবরের মতই তিনি ওকে জানালেন, “তোমার জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে। রাশিদের আব্বা রাশিদের জন্য তোমার কথা বললেন। এখন তুমি হ্যাঁ বললে আমি আলাপ করতে পারি”। রাহি প্রথমে বুঝতে পারলনা, “কোন রাশিদ?” এবার আব্বু একটু অবাক হলেন, “তোমার অফিসের রাশিদ। তুমি কিছু জানোনা?” রাহি হতভম্ব হয়ে গেল, ‘বলে কি? প্রতিদিন দেখে হয় লোকটার সাথে, কই উনি তো কিছু বলেননি!’ সে আব্বুকে বলল, “আচ্ছা, আমি তোমাকে কাল বা পরশু জানাব”।

পরদিন অফিসে গিয়ে রাহি সম্পূর্ণ অফিস তোলপাড় করে ফেলল, “রাশিদ সাহেব কই?” শেষপর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেলে সে ডেকে মিটিং রুমে নিয়ে গেল। বেচারার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোথায় লুকাবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু রাহির তখন আহ্লাদিপনার মুড নেই। সে চড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “ঘটনা কি বলুন তো?”
রাশিদ সাহেব খুব গোবেচারা চেহারা করে বললেন, “কি ঘটনা ম্যাডাম?”
রাহির মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল, “আপনি কি করার চেষ্টা করছেন?”
রাশিদ সাহেব আরো মিইয়ে গিয়ে বললেন, “কই কিছু না তো!”
রাহি এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আপনি আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠালেন কি বুঝে?”
রাশিদ সাহবে ইতস্তত করে বললেন, “ম্যাডাম, জবাব দেব কি? আপনার চেহারা দেখেই তো ভয় লাগছে!”
হঠাৎ রাহির হাসি পেয়ে গেল। সে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “এবার বলুন আপনার উদ্দেশ্য কি?”
“ম্যাডাম, আমার উদ্দেশ্য আপনি সদয় হলে আপনাকে বিয়ে করা”।
“মানে”, খিঁচিয়ে উঠলো রাহি। কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেল যে ও রেগে গেলে রাশিদ সাহেবের কথা গুলিয়ে যায়। বহু কষ্টে চেহারাসুরত ঠিক করে সে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল, “শুনুন, আমি বিয়ে করবনা। শুধু আপনাকে না, কাউকেই করবনা। আপনি বরং আমার ফুপাত বোন বা বান্ধবীকে দেখুন। আমি আপনার আম্মাকে ওদের ব্যাপারে জানিয়েছি”।
“ঠিক আছে, তবে কেন করবেন না যদি একটু জানাতেন …”
“পুরুষরা বিয়ে করলে মনে করে মেয়েটাকে কিনে ফেলেছে। তার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা, রুচিপছন্দ, স্বাধীনতা থাকেনা- আমি ঐভাবে থাকতে পারবনা, তাই বিয়ে করবনা …”
“আমি আপনার স্বাধীনতায় কোথাও কখনো হস্তক্ষেপ করবনা, আমি আপনাকে আকাশে মুক্ত স্বাধীন ঘুড়ির মত উড়তে দেব, তারপর বলুন …”
রাশিদ সাহেবের গলার স্বরে, চেহারায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ- কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। রাহি খুব অবাক হয়ে গেল, উনি হঠাৎ এত কনফিডেন্স পেলেন কোথা থেকে?! সেও সিরিয়াস হয়ে বলল, “আপনি আসলে কি করতে চাচ্ছেন বলেন তো?”
এবার রাশিদ সাহেবকে দেখতে তেমনই গম্ভীর দেখাচ্ছে যেমন তিনি কাজের সময় হয়ে যান, “শুনুন ম্যাডাম। আপনি সবার সমস্যা সমাধান করেন। কিন্তু কেউ কল্পনাও করতে পারেনা যে আপনারও কোন সমস্যা থাকতে পারে, থাকতে পারে কোন কষ্ট বা কোন অনুভূতি। আমি জানতে পেরেছি আপনি ইসলাম পালন করার জন্য কি struggle করছেন। আমি আপনাকে এ’ব্যাপারে সাহায্য করতে চাই। নতুবা আমার এই মূহূর্তে বিয়ে করার কোন পরিকল্পনা ছিল না”।
রাহি এ প্রথম কিছু বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেলল।

বাসায় গিয়ে রাহি আব্বুকে জানাল সে এই বিয়ের প্রস্তাবে আগ্রহী। আব্বু ভীষণ অবাক হলেন। কারণ সে কখনো কোন প্রস্তাবে ন্যূনতম আগ্রহ দেখায়নি, এত বন্ধুবান্ধবের মাঝে কখনো কোন ছেলেকে ভালোলাগার কথা বলেনি, কোন পেশার লোক তাকে আকর্ষন করেনি- বরং একবার এক ডাক্তারের ব্যাপারে তাকে বোঝাতে গেলে সে ছুরি নিয়ে বলেছিল, “ঠিক আছে, আমি এই ছুরি দিয়ে ঐ ডাক্তারের পেট চিরে দেব, তারপর যদি সে নিজে নিজে জোড়া দিতে পারে তাহলেই বুঝব সে কত বড় ডাক্তার”। তারপর থেকে তিনি আর রাহিকে ঘাটান না। এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখানোতে তিনি ঠিক ধারণা করলেন তাঁর মেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছে। কিন্তু রাহির কিছু করার নেই।

দু’দিন পর রাশিদের বাবাচাচা এলো, ওর আব্বু আর চাচার সাথে কথা বলে ওদের বাসায় যাবার দাওয়াত দিয়ে গেল। পরদিন ওদের বাসা থেকে এসে রাহির আম্মু হুলস্থুল ক্ষেপে গেলেন, এই বিয়ে কিছুতেই হতে পারবেনা, ঐ বাড়ীতে সব মহিলা পর্দা করে। তাঁর মেয়ে গেঁয়ো ভূত হয়ে যাবে। রাহির আব্বু বললেন, “বিয়ে তো তোমার না, দেখি রাহি কি বলে”। “রাহি কি বলে মানে? বললাম তো এই বিয়ে হবেনা”। পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল। চাচা সবাইকে শান্ত হতে বলে রাহিকে নিয়ে আলাদা ঘরে চলে গেলেন।

রাহির মাথায় হাত দিয়ে চাচা বললেন, “মারে, আমি কখনো আমার নাজনীনের সাথে তোকে আলাদা করে দেখিনি। বাপ হিসেবেই তোকে ক’টা কথা বলি। রাশিদ খুব ভালো ছেলে, ওর পরিবারকেও আমার খুব ভালো লেগেছে যদিও ওরা চালচলনে আমাদের থেকে আলাদা। তবে কি জানিস মা, তুই চাইলে আরো ওপরে যেতে পারিস। বাকীটা তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমি তোর সাথে পথের শেষ পর্যন্ত আছি”।
আম্মুর পাগলামীর পর চাচার এই কথায় রাহির চোখে পানি এসে গেল। সে বলল, “চাচা, এর পরে যাই হোক, তোমার এ’কথা আমি সারাজীবন মনে রাখব”।
একটু পর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “চাচা, একেকজনের কাছে একেকটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। যে যা চায় তার কাছে বিবেচনার দিক থেকে সেটাই ওপরে। তোমরা ভাবছ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, টাকাপয়সা, গাড়ীবাড়ী যার আছে সে ওপরে। আর আমি ভাবছি যে ইসলামের পথে আমার সঙ্গী হবে সে আমার বিবেচনায় সবার ওপরে। পৃথিবীতে স্বল্পকালীন কিছু কষ্ট করে নেয়া যায়, কিন্তু অল্প সুখের জন্য অনন্তকাল কষ্টভোগ করার কি কোন অর্থ আছে বল? আমি এখানেই বিয়ে করতে চাই”।
“ঠিক আছে মা, আমার আর কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। বাকীটা আমি দেখব”।

চাচার পরামর্শে আব্বু রাশিদের সাথে কথা বললেন। বাসায় ফিরে তিনি রাহিকে বললেন, “এই ছেলে তোকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আর সম্মান দেবে- আমি জানি সুখী হবার জন্য আমার মেয়ের কাছে এই স্বাধীনতা আর সম্মান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার এই বিয়েতে আর কোন আপত্তি নেই”। স্বামীকেও ঝুঁকে পড়তে দেখে রাহির আম্মু ক্ষেপে গিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেলেন। রাহির এঙ্গেজমেন্টের সময় তিনি এলেন না। মেহেদী লাগাবার ব্যবস্থা করলেন আব্বু আর বান্ধবীরা মিলে। শেষপর্যন্ত বিয়ের আগের দিন চাচা অনেক সাধ্যসাধনা করে ভাবীকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন।

হলভর্তি লোকজনের সামনে সং সেজে বসে থাকা রাহির কাছে এত বিরক্তিকর ছিল যে সে বিয়েবাড়ীতে যেতে আগ্রহী ছিলোনা। তবু যেতে হোল। বিয়েবাড়ীতে দুইপক্ষের পার্থক্য ওর কাছে স্পষ্ট ধরা পড়লো। নদীর দুই ধারকে মেলানো হয়ত এর চেয়ে সহজ! সে বুঝতে পারল এ’বিয়ে যুদ্ধের শেষ নয়, শুরু। তবে এবার সে একা নয়, সাথে আছে এমন এক বন্ধু যে তার সাথে পথের শেষ পর্যন্ত যাবে।

No comments:

Post a Comment