মাহমুদ বুঝতে পারছেনা কান্নার শব্দ কোথা থেকে আসছে। দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর চোখ আটকে আছে দিশার চেহারায়। চেহারাটা সুন্দর না- চোখের নীচে গাঢ় নীলবর্ণ কালি পড়েছে, ঠোঁট ফেটে চৌচির, মুখ শুকিয়ে চিমসে গেছে, কিন্তু ওর চোখ দু’টো … আহ! যে চোখ দু’টো তাকিয়ে আছে ওর মরণাপন্ন বাবার চেহারার দিকে, সে চোখের মায়া আর সবকিছু মলিন করে দিয়েছে যেন! এই মায়া যেন পৃথিবীর সব গতি থমকে দেবে, এই প্রচন্ড ভালোবাসা বুঝি ওর বাবাকে বাঁচিয়ে তু্লবে এই মরণব্যাধি থেকে! কিন্তু কান্নাটা থামছেই না! কাঁদছে কে? দিশার চেহারা থেকে চোখ না সরিয়েই মাহমুদ কি যেন একটা সুইচ চাপ দিল আর সাথে সাথে শুনতে পেল হাবিবের কন্ঠ, “মাহমুদ, বাবা আর নেই!” মাহমুদের ঘুম ছুটে গেল। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে সে বলল, “আমি এক্ষুণি আসছি”।
হাবিবের বাবা সাতদিন আগে স্ট্রোক করেছেন। হাবিব প্রথমেই মাহমুদকে ফোন করল গাড়ীর জন্য। ওরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে পড়েছে, একসাথে খেলেছে, দু’জনের সব দুঃখকষ্ট ভাগ করে নিয়েছে। দু’জনের সামাজিক স্ট্যাটাসের বৈষম্য সবার চোখে ধরা পড়লেও ওদের দু’জন কেন যেন ব্যাপারটা কখনো খেয়ালই করেনি। মাহমুদ সারাজীবন সবকিছুতে এগিয়ে থেকেও কখনো লেখাপড়ায় হাবিবকে টপকাতে পারেনি। হাবিব সবসময় বলত, “তোর তো বাবা ছাড়া আর কোনকিছুর অভাব নেই আর আমাদের মেধা ছাড়া আর সবকিছুর অভাব- এভাবেই আল্লাহ ভারসাম্য বজায় রাখেন- হা হা হা…”। হাবিবের বাবাকে হাসপাতালে নেয়ার মূহূর্ত থেকে মাহমুদ হাবিবের পাশেই ছিল এই সাতটা দিন। এমনকি রাতে বাসায় ফিরে শুতে গেলেও সেলফোনটা বালিশের পাশে রাখত যেন হাবিব ফোন করলেই ধরতে পারে। রেডী হবার জন্য আলো জ্বালাতেই ঘড়িতে চোখ পড়ল, রাত দু’টো বেজে তের মিনিট।
হাবিবের বাবা মাহমুদের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকদের কখনো খুব একটা টাকাপয়সা হয়না, তাঁরও হয়নি। তবে সম্মান ছিল সবার কাছে। তিনি ছেলেমেয়েদের আর কিছু দিতে না পারলেও উত্তম শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন। হাবিব ভালো রেজাল্ট করে চাকরী পাওয়ার পর থেকে পরিবারটি কেবল একটু সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু স্যারের ভাগ্যে এই সুখ বেশিদিন ছিলোনা হয়ত।
হাসপাতালে পৌঁছেই মাহমুদ দেখতে পেল এরই মাঝে একটা ছোটখাট ভীড় জমে উঠতে শুরু করেছে। হাবিবের করুন মুখটা দেখে সে আশ্বস্ত করল, “তুই বস, আমি সব ব্যবস্থা করছি”। স্যারকে শেষবারের মত দেখার জন্য বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সে দেখতে পেল চাচী অবুঝ শিশুর মত কাঁদছেন, “তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে!...” যে মেয়েটা গত সাতটা দিন বাবার পাশ ছেড়ে এক মূহূর্তের জন্য নড়েনি, সেই দিশাকে কোথাও দেখা গেলনা।
মাহমুদ জানে এখন অনেক কাজ। দাফনকাফন থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিল দেয়া পর্যন্ত সব যথাসম্ভব দ্রুত সারতে হবে। কিন্তু মনটা এত খারাপ! কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য একটা মূহূর্ত নেয়া কি খুব অন্যায় হবে? সে ভীড় কাটিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু হাওয়া বইছে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মারা যাওয়ার জন্য সুন্দর একটি রাত। নাহ! সময় নষ্ট করলে চলবেনা। যাওয়া দরকার। চাঁদের দিকে পেছন ফিরতেই মনে হোল দেয়ালের সাথে কিসের যেন ছায়া। দিশা না? হ্যাঁ, দিশাই তো! মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে সে। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কে জানে কোন মহাশূণ্যের পানে। ওকে দেখেছে বলে মনে হোলনা। মাহমুদ ছোটবেলা থেকে হাবিবের বন্ধু হলেও দিশাকে খুব একটা দেখার সুযোগ হয়নি। মেয়েটাকে মনে হয় কেউই খুব একটা ঘোরাঘুরি করতে দেখেনি। বইপত্র নিয়েই থাকত। মাহমুদ ওর মায়ের দেখা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া ছাড়া ওর সাথে খুব একটা কথা হয়েছে বলেও মনে করতে পারলোনা। কিন্তু এই মেয়েটাই গত ক’দিন স্যারের পাশে থেকে যা করেছে, মাহমুদ কল্পনা করার চেষ্টা করেছে সে নিজের মায়ের জন্য এতটা করতে পারত কি’না। সে একবার ভাবল চলে যাবে, কারো গভীর কষ্টের মূহূর্তে তাকে একা ছেড়ে দেয়াই হয়ত উচিত। কিন্তু কেন যেন ওর মনে হোল এই মেয়েটার আর কষ্ট পাবার ক্ষমতা নেই- স্বপ্নের কথাটা মনে করেই কি?
সে বলল, “দিশা”।
দিশা কেমন যেন ফাঁকা চোখে তাকাল, যেন চিনতে পারেনি। সে আবার বলল, “দিশা, চাচী প্রচন্ড কান্নাকাটি করছেন, তোমার মনে হয় ওনার সাথে থাকা উচিত”।
দিশা কিচ্ছু না বলে ঢলতে ঢলতে মায়ের কাছে চলে গেল। মাহমুদের হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠল। একজন মানুষ কি করে সর্বাবস্থায় নিজের চেয়ে অপরকে অগ্রাধিকার দেয়? সে কেন এই পরিবারটার মত হতে পারেনা?
পরদিন স্যারের দাফন হয়ে গেল। সবাই বাড়ী চলে গেল। একটা জলজ্যান্ত মানুষের শুধু কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কোন চিহ্ন রইলোনা।
একমাস পর সুলতানা বেগম আবার ছেলের কাছে বিয়ের কথা পাড়লেন। এবার যে মেয়ে পাওয়া গেছে তাতে তিনি খুশীতে গদ গদ। মেয়ে সুন্দরী, আগেই খোঁজ নিয়ে নিয়েছেন লেখাপড়ায় আহামরি না হলেও খারাপ নয়, অনেক বড়লোকের কন্যা। মাহমুদ বলল, “মা, তোমার দেখা মেয়ে আমি দেখব, অবশ্যই দেখব। কিন্তু আমি একটা মেয়ে দেখেছি, তুমি দেখবে?”
সুলতানা বেগম মুচকি হেসে বললেন, “বাহ! আমার ছেলে প্রেম করছে আর আমি টেরই পাইনি!”
মাহমুদ বলল, “না মা, তুমি যা ভাবছ তা না। আমি একটা মেয়ে দেখেছি। মেয়েটা আহামরি সুন্দর না কিন্তু মায়া আছে। লেখাপড়ায় তুখোড় কিন্তু অহংকার নেই। বাবামা’র টাকাপয়সার গরম নেই কিন্তু আদবকায়দায় জুড়ি নেই। আমার মনে হয় তোমার পছন্দ হবে”।
সুলতানা বেগম বললেন, “আচ্ছা, দেখব আর কি”।
মাহমুদ বুঝল মা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। সে বলল, “মা, আমি আজিম স্যারের মেয়ে, হাবিবের বোনের কথা বলছি”।
মা চলে যাচ্ছিলেন, সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। একমূহূর্ত পর উনি যখন ওর দিকে ঘুরলেন মাহমুদ স্পষ্ট দেখতে পেল মায়ের চোখে অবিশ্বাস, “তুই বলছিস কি? ওরা তো গরীব! মেয়ের বাবাও নেই। তুই কি ওর সাথে প্রেম করছিস?”
মাহমুদের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, আমি প্রেম করলে সবার আগে তুমি জানতে। মেয়েটা জানেও না আমি ওকে বিয়ে করার কথা ভাবছি, জানলে ও রাজী হবে কি’না তাও জানিনা। হাবিবের সাথে পর্যন্ত আমার এ’ব্যাপারে কোন কথা হয়নি। আর তুমি কি আবোল তাবোল ভাবছ! তুমিই আমাকে শিখিয়েছ সব মানুষই সমান, গরীবের জন্য তোমার মন কাঁদে, অথচ নিজের ছেলের বেলা তুমি গরীব বলে একটা মেয়ের শিক্ষাদিক্ষা পরিবার স্বভাবচরিত্র সব তুচ্ছ করে কেবল তার আর্থিক অবস্থাটাই দেখলে! আর বাবার কথা বলছ? বাবা তো আমারও নেই!...”
বেশী বলা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে মাহমুদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাতদিন পর মা আর মাহমুদ খেতে বসেছে। গত সাতদিন মা খুব একটা কথা বলেননি মাহমুদের সাথে। খাবার মাঝখানে মা ইতস্তত করে ভাতের গ্রাসটা মুখে দিতে গিয়েও নামিয়ে রাখলেন। ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন, “বাবা, তুই আমাকে আবারও শেখালি। ছোটবেলা থেকে তোকে শিখিয়ে আসছি ইসলামে ধনী গরীব, কালো ধলোর কোন পার্থক্য নেই। অথচ আমি মেয়ে দেখার সময় ঠিকই এই পার্থক্য করেছি। আজ বিশবছর ধরে এই পাড়ায় আছি, কোনদিন দিশার ব্যাপারে বা ওর পরিবারের ব্যাপারে খারাপ কিছু শুনিনি। আজিম স্যারের দুই ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায়, আদবকায়দায় শ্রেয়। আর ওদের পরিবার যে নিজেরা কষ্ট করেও অন্যের কষ্ট লাঘব করার জন্য ছুটে আসে তা তো কতবার স্বচক্ষে দেখেছি! নইলে ওরা অনেক ভালো অবস্থায় থাকতে পারত। হাবিব ছেলেটা আমাদের কাছ থেকে যা টাকা ধার করেছিল ওর বাবার অসুস্থতার সময় না চাইতেই শোধ করতে শুরু করেছে সেই প্রথম সপ্তাহ থেকে। অথচ কত বড়লোকের কাছে টাকার জন্য ধর্ণা দিতে হয় কতবার! কি আশ্চর্য এই মেয়েটাকে আমি চোখের সামনে দেখেও ওকে কক্ষনো আমার ছেলের জন্য কল্পনাও করিনি”। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুলতানা বেগম, “কত ক্ষুদ্র মন আমার! বলা কত সহজ অথচ কার্যত আমি প্রমাণ করলাম বলা আর করা এক জিনিস নয়!...”
মাহমুদ চেয়ার ছেড়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের চোখের দিকে তাকাল যেখানে চিকচিক করছে ক’ফোঁটা অশ্রু, “মা, তোমার মন যে কত বড় তুমি নিজেই জানোনা! মানুষ ভুল করে আবার সেই ভুলের ওপরেই দন্ডায়মান থাকে। কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি তুমি নিজেকে বিশ্লেষণ কর, সংশোধন কর, নিজের ভুল অকপটে স্বীকার কর। আমার এই মাকে আমি এমন এক বৌ এনে দিতে চাই যে তাকে দেখেশুনে রাখবে, কোন কষ্ট পেতে দেবেনা আর কষ্ট যদি আসেই তবে তা তোমার সাথে ভাগ করে নেবে। মা, যে নিজের বাবামাকে সম্মান করতে শেখে সে অন্যের বাবামাকেও শ্রদ্ধা করতে জানে। আমার দিশার সাথে কখনো কোন আলাপচারীতা হয়নি কিন্তু ও ওর বাবার জন্য যা করেছে … আমি তখনই ভেবেছি আমার মায়ের জন্য আমি এমনই এক দরদী মেয়েকে চাই…”
ছেলের কথায় মা আর অশ্রু সামলাতে পারলেন না, ভাত হাতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।
দু’দিন পর মাহমুদ আর ওর মা হাবিবের বাসায় গেল। হাবিবের মা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদের অপ্যায়ন করলেন, স্বামীর শেষ দিনগুলোতে তাদের সাহায্যের কথা স্মরণ করে তাদের ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু মাহমুদের মা দিশার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কথা জানাতে চাচী কেমন যেন ভড়কে গেলেন। “আপা, আপনারা অনেক বড়লোক। আপনি বলেছেন এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার …”, চাচীর গলার স্বর মিইয়ে গেল। মা কি বলতে চাইছেন বুঝতে পেরে হাবিব বলল, “আন্টি, আমরা আপনাদের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ, মাহমুদ আমার বাবার জন্য যা করেছে তা কেবল একজন আপন ভাইই করতে পারে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে আপনাদের অনেক নীচে। আমি চাইনা আমার বোন মনে করুক আমরা আপনাদের থেকে ফায়দা নেয়ার জন্য তাকে আপনাদের কাছে বিয়ে দিচ্ছি”। সুলতানা বেগম আর যাই মনে করে আসুন না কেন, এমন বাঁধার সম্মুখীন হবেন ভাবেননি। তিনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।
মাহমুদ মায়ের পাশ থেকে উঠে হাবিবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “চাচী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, দিশাকে ডাকুন। ওর ব্যাপারে কথা হচ্ছে সুতরাং ওর শোনা দরকার”।
চাচী ইতস্তত করে দিশাকে ডাকলেন। সলতানা বেগম এই প্রথম মনোযোগ দিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। হাল্কাপাতলা, মায়াবী চেহারা, বাবার চেহারার ছাপ আছে, লেখাপড়া করতে করতে নিজের যত্ন নেয়া হয়না কিন্তু বেশ বুঝতে পারলেন ঠিক মত যত্ন নিলে মেয়েটির স্বাস্থ্য চেহারা দেখার মত হবে। আফসোস হোল কেন তিনি চোখের সামনে থাকা এই মেয়েটির কথা আগে ভাবেননি। হাবিব দিশাকে সব খুলে বলল। দিশা হতবাক হয়ে মাহমুদের দিকে তাকালো। সুলতানা বেগমের কোন সন্দেহ রইলোনা যে আসলেই এমনকি দিশার সাথেও মাহমুদের কোন আলাপ হয়নি।
সুলতানা বেগম উঠে মেয়েটির কাছে গিয়ে চিবুক ধরে তাকে আদর করলেন। তাঁর মনে হোল এটি যেন তাঁর নিজেরই মেয়ে! তিনি ওর পাশেই বসে পড়লেন, “আপা, আমার কোন মেয়ে নেই। আপনার মেয়েটি আমাকে দিন। আমি বৌ নয় মেয়ে চাইতে এসেছি। সেক্ষেত্রে কোন সামাজিক পার্থক্য বা দেনাপাওনার হিসেব আমাদের মাঝে বাঁধার দেয়াল রচনা করতে পারেনা, তাইনা?”
চাচীর চোখের কোণ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হাবিব মাহমুদকে জড়িয়ে ধরল, দিশা সুলতানা বেগমের আঁচলে মুখ লুকাল- মা ছেলে দুই ভাইবোনের কাঁধের ওপর থেকে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল- সে হাসিতে আত্মার বন্ধন …
হাবিবের বাবা সাতদিন আগে স্ট্রোক করেছেন। হাবিব প্রথমেই মাহমুদকে ফোন করল গাড়ীর জন্য। ওরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে পড়েছে, একসাথে খেলেছে, দু’জনের সব দুঃখকষ্ট ভাগ করে নিয়েছে। দু’জনের সামাজিক স্ট্যাটাসের বৈষম্য সবার চোখে ধরা পড়লেও ওদের দু’জন কেন যেন ব্যাপারটা কখনো খেয়ালই করেনি। মাহমুদ সারাজীবন সবকিছুতে এগিয়ে থেকেও কখনো লেখাপড়ায় হাবিবকে টপকাতে পারেনি। হাবিব সবসময় বলত, “তোর তো বাবা ছাড়া আর কোনকিছুর অভাব নেই আর আমাদের মেধা ছাড়া আর সবকিছুর অভাব- এভাবেই আল্লাহ ভারসাম্য বজায় রাখেন- হা হা হা…”। হাবিবের বাবাকে হাসপাতালে নেয়ার মূহূর্ত থেকে মাহমুদ হাবিবের পাশেই ছিল এই সাতটা দিন। এমনকি রাতে বাসায় ফিরে শুতে গেলেও সেলফোনটা বালিশের পাশে রাখত যেন হাবিব ফোন করলেই ধরতে পারে। রেডী হবার জন্য আলো জ্বালাতেই ঘড়িতে চোখ পড়ল, রাত দু’টো বেজে তের মিনিট।
হাবিবের বাবা মাহমুদের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকদের কখনো খুব একটা টাকাপয়সা হয়না, তাঁরও হয়নি। তবে সম্মান ছিল সবার কাছে। তিনি ছেলেমেয়েদের আর কিছু দিতে না পারলেও উত্তম শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন। হাবিব ভালো রেজাল্ট করে চাকরী পাওয়ার পর থেকে পরিবারটি কেবল একটু সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু স্যারের ভাগ্যে এই সুখ বেশিদিন ছিলোনা হয়ত।
হাসপাতালে পৌঁছেই মাহমুদ দেখতে পেল এরই মাঝে একটা ছোটখাট ভীড় জমে উঠতে শুরু করেছে। হাবিবের করুন মুখটা দেখে সে আশ্বস্ত করল, “তুই বস, আমি সব ব্যবস্থা করছি”। স্যারকে শেষবারের মত দেখার জন্য বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সে দেখতে পেল চাচী অবুঝ শিশুর মত কাঁদছেন, “তুমি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে!...” যে মেয়েটা গত সাতটা দিন বাবার পাশ ছেড়ে এক মূহূর্তের জন্য নড়েনি, সেই দিশাকে কোথাও দেখা গেলনা।
মাহমুদ জানে এখন অনেক কাজ। দাফনকাফন থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিল দেয়া পর্যন্ত সব যথাসম্ভব দ্রুত সারতে হবে। কিন্তু মনটা এত খারাপ! কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য একটা মূহূর্ত নেয়া কি খুব অন্যায় হবে? সে ভীড় কাটিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু হাওয়া বইছে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মারা যাওয়ার জন্য সুন্দর একটি রাত। নাহ! সময় নষ্ট করলে চলবেনা। যাওয়া দরকার। চাঁদের দিকে পেছন ফিরতেই মনে হোল দেয়ালের সাথে কিসের যেন ছায়া। দিশা না? হ্যাঁ, দিশাই তো! মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে সে। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কে জানে কোন মহাশূণ্যের পানে। ওকে দেখেছে বলে মনে হোলনা। মাহমুদ ছোটবেলা থেকে হাবিবের বন্ধু হলেও দিশাকে খুব একটা দেখার সুযোগ হয়নি। মেয়েটাকে মনে হয় কেউই খুব একটা ঘোরাঘুরি করতে দেখেনি। বইপত্র নিয়েই থাকত। মাহমুদ ওর মায়ের দেখা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া ছাড়া ওর সাথে খুব একটা কথা হয়েছে বলেও মনে করতে পারলোনা। কিন্তু এই মেয়েটাই গত ক’দিন স্যারের পাশে থেকে যা করেছে, মাহমুদ কল্পনা করার চেষ্টা করেছে সে নিজের মায়ের জন্য এতটা করতে পারত কি’না। সে একবার ভাবল চলে যাবে, কারো গভীর কষ্টের মূহূর্তে তাকে একা ছেড়ে দেয়াই হয়ত উচিত। কিন্তু কেন যেন ওর মনে হোল এই মেয়েটার আর কষ্ট পাবার ক্ষমতা নেই- স্বপ্নের কথাটা মনে করেই কি?
সে বলল, “দিশা”।
দিশা কেমন যেন ফাঁকা চোখে তাকাল, যেন চিনতে পারেনি। সে আবার বলল, “দিশা, চাচী প্রচন্ড কান্নাকাটি করছেন, তোমার মনে হয় ওনার সাথে থাকা উচিত”।
দিশা কিচ্ছু না বলে ঢলতে ঢলতে মায়ের কাছে চলে গেল। মাহমুদের হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠল। একজন মানুষ কি করে সর্বাবস্থায় নিজের চেয়ে অপরকে অগ্রাধিকার দেয়? সে কেন এই পরিবারটার মত হতে পারেনা?
পরদিন স্যারের দাফন হয়ে গেল। সবাই বাড়ী চলে গেল। একটা জলজ্যান্ত মানুষের শুধু কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কোন চিহ্ন রইলোনা।
একমাস পর সুলতানা বেগম আবার ছেলের কাছে বিয়ের কথা পাড়লেন। এবার যে মেয়ে পাওয়া গেছে তাতে তিনি খুশীতে গদ গদ। মেয়ে সুন্দরী, আগেই খোঁজ নিয়ে নিয়েছেন লেখাপড়ায় আহামরি না হলেও খারাপ নয়, অনেক বড়লোকের কন্যা। মাহমুদ বলল, “মা, তোমার দেখা মেয়ে আমি দেখব, অবশ্যই দেখব। কিন্তু আমি একটা মেয়ে দেখেছি, তুমি দেখবে?”
সুলতানা বেগম মুচকি হেসে বললেন, “বাহ! আমার ছেলে প্রেম করছে আর আমি টেরই পাইনি!”
মাহমুদ বলল, “না মা, তুমি যা ভাবছ তা না। আমি একটা মেয়ে দেখেছি। মেয়েটা আহামরি সুন্দর না কিন্তু মায়া আছে। লেখাপড়ায় তুখোড় কিন্তু অহংকার নেই। বাবামা’র টাকাপয়সার গরম নেই কিন্তু আদবকায়দায় জুড়ি নেই। আমার মনে হয় তোমার পছন্দ হবে”।
সুলতানা বেগম বললেন, “আচ্ছা, দেখব আর কি”।
মাহমুদ বুঝল মা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। সে বলল, “মা, আমি আজিম স্যারের মেয়ে, হাবিবের বোনের কথা বলছি”।
মা চলে যাচ্ছিলেন, সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। একমূহূর্ত পর উনি যখন ওর দিকে ঘুরলেন মাহমুদ স্পষ্ট দেখতে পেল মায়ের চোখে অবিশ্বাস, “তুই বলছিস কি? ওরা তো গরীব! মেয়ের বাবাও নেই। তুই কি ওর সাথে প্রেম করছিস?”
মাহমুদের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মা, আমি প্রেম করলে সবার আগে তুমি জানতে। মেয়েটা জানেও না আমি ওকে বিয়ে করার কথা ভাবছি, জানলে ও রাজী হবে কি’না তাও জানিনা। হাবিবের সাথে পর্যন্ত আমার এ’ব্যাপারে কোন কথা হয়নি। আর তুমি কি আবোল তাবোল ভাবছ! তুমিই আমাকে শিখিয়েছ সব মানুষই সমান, গরীবের জন্য তোমার মন কাঁদে, অথচ নিজের ছেলের বেলা তুমি গরীব বলে একটা মেয়ের শিক্ষাদিক্ষা পরিবার স্বভাবচরিত্র সব তুচ্ছ করে কেবল তার আর্থিক অবস্থাটাই দেখলে! আর বাবার কথা বলছ? বাবা তো আমারও নেই!...”
বেশী বলা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে মাহমুদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাতদিন পর মা আর মাহমুদ খেতে বসেছে। গত সাতদিন মা খুব একটা কথা বলেননি মাহমুদের সাথে। খাবার মাঝখানে মা ইতস্তত করে ভাতের গ্রাসটা মুখে দিতে গিয়েও নামিয়ে রাখলেন। ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন, “বাবা, তুই আমাকে আবারও শেখালি। ছোটবেলা থেকে তোকে শিখিয়ে আসছি ইসলামে ধনী গরীব, কালো ধলোর কোন পার্থক্য নেই। অথচ আমি মেয়ে দেখার সময় ঠিকই এই পার্থক্য করেছি। আজ বিশবছর ধরে এই পাড়ায় আছি, কোনদিন দিশার ব্যাপারে বা ওর পরিবারের ব্যাপারে খারাপ কিছু শুনিনি। আজিম স্যারের দুই ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায়, আদবকায়দায় শ্রেয়। আর ওদের পরিবার যে নিজেরা কষ্ট করেও অন্যের কষ্ট লাঘব করার জন্য ছুটে আসে তা তো কতবার স্বচক্ষে দেখেছি! নইলে ওরা অনেক ভালো অবস্থায় থাকতে পারত। হাবিব ছেলেটা আমাদের কাছ থেকে যা টাকা ধার করেছিল ওর বাবার অসুস্থতার সময় না চাইতেই শোধ করতে শুরু করেছে সেই প্রথম সপ্তাহ থেকে। অথচ কত বড়লোকের কাছে টাকার জন্য ধর্ণা দিতে হয় কতবার! কি আশ্চর্য এই মেয়েটাকে আমি চোখের সামনে দেখেও ওকে কক্ষনো আমার ছেলের জন্য কল্পনাও করিনি”। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুলতানা বেগম, “কত ক্ষুদ্র মন আমার! বলা কত সহজ অথচ কার্যত আমি প্রমাণ করলাম বলা আর করা এক জিনিস নয়!...”
মাহমুদ চেয়ার ছেড়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের চোখের দিকে তাকাল যেখানে চিকচিক করছে ক’ফোঁটা অশ্রু, “মা, তোমার মন যে কত বড় তুমি নিজেই জানোনা! মানুষ ভুল করে আবার সেই ভুলের ওপরেই দন্ডায়মান থাকে। কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি তুমি নিজেকে বিশ্লেষণ কর, সংশোধন কর, নিজের ভুল অকপটে স্বীকার কর। আমার এই মাকে আমি এমন এক বৌ এনে দিতে চাই যে তাকে দেখেশুনে রাখবে, কোন কষ্ট পেতে দেবেনা আর কষ্ট যদি আসেই তবে তা তোমার সাথে ভাগ করে নেবে। মা, যে নিজের বাবামাকে সম্মান করতে শেখে সে অন্যের বাবামাকেও শ্রদ্ধা করতে জানে। আমার দিশার সাথে কখনো কোন আলাপচারীতা হয়নি কিন্তু ও ওর বাবার জন্য যা করেছে … আমি তখনই ভেবেছি আমার মায়ের জন্য আমি এমনই এক দরদী মেয়েকে চাই…”
ছেলের কথায় মা আর অশ্রু সামলাতে পারলেন না, ভাত হাতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।
দু’দিন পর মাহমুদ আর ওর মা হাবিবের বাসায় গেল। হাবিবের মা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদের অপ্যায়ন করলেন, স্বামীর শেষ দিনগুলোতে তাদের সাহায্যের কথা স্মরণ করে তাদের ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু মাহমুদের মা দিশার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কথা জানাতে চাচী কেমন যেন ভড়কে গেলেন। “আপা, আপনারা অনেক বড়লোক। আপনি বলেছেন এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার …”, চাচীর গলার স্বর মিইয়ে গেল। মা কি বলতে চাইছেন বুঝতে পেরে হাবিব বলল, “আন্টি, আমরা আপনাদের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ, মাহমুদ আমার বাবার জন্য যা করেছে তা কেবল একজন আপন ভাইই করতে পারে। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে আপনাদের অনেক নীচে। আমি চাইনা আমার বোন মনে করুক আমরা আপনাদের থেকে ফায়দা নেয়ার জন্য তাকে আপনাদের কাছে বিয়ে দিচ্ছি”। সুলতানা বেগম আর যাই মনে করে আসুন না কেন, এমন বাঁধার সম্মুখীন হবেন ভাবেননি। তিনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।
মাহমুদ মায়ের পাশ থেকে উঠে হাবিবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “চাচী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, দিশাকে ডাকুন। ওর ব্যাপারে কথা হচ্ছে সুতরাং ওর শোনা দরকার”।
চাচী ইতস্তত করে দিশাকে ডাকলেন। সলতানা বেগম এই প্রথম মনোযোগ দিয়ে মেয়েটিকে দেখলেন। হাল্কাপাতলা, মায়াবী চেহারা, বাবার চেহারার ছাপ আছে, লেখাপড়া করতে করতে নিজের যত্ন নেয়া হয়না কিন্তু বেশ বুঝতে পারলেন ঠিক মত যত্ন নিলে মেয়েটির স্বাস্থ্য চেহারা দেখার মত হবে। আফসোস হোল কেন তিনি চোখের সামনে থাকা এই মেয়েটির কথা আগে ভাবেননি। হাবিব দিশাকে সব খুলে বলল। দিশা হতবাক হয়ে মাহমুদের দিকে তাকালো। সুলতানা বেগমের কোন সন্দেহ রইলোনা যে আসলেই এমনকি দিশার সাথেও মাহমুদের কোন আলাপ হয়নি।
সুলতানা বেগম উঠে মেয়েটির কাছে গিয়ে চিবুক ধরে তাকে আদর করলেন। তাঁর মনে হোল এটি যেন তাঁর নিজেরই মেয়ে! তিনি ওর পাশেই বসে পড়লেন, “আপা, আমার কোন মেয়ে নেই। আপনার মেয়েটি আমাকে দিন। আমি বৌ নয় মেয়ে চাইতে এসেছি। সেক্ষেত্রে কোন সামাজিক পার্থক্য বা দেনাপাওনার হিসেব আমাদের মাঝে বাঁধার দেয়াল রচনা করতে পারেনা, তাইনা?”
চাচীর চোখের কোণ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হাবিব মাহমুদকে জড়িয়ে ধরল, দিশা সুলতানা বেগমের আঁচলে মুখ লুকাল- মা ছেলে দুই ভাইবোনের কাঁধের ওপর থেকে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল- সে হাসিতে আত্মার বন্ধন …
No comments:
Post a Comment