Wednesday, June 15, 2011

গন্ডগোল



আমরা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। সামনে পরীক্ষা। পলি আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। আলাপ আলোচনা পরীক্ষার প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে বলাই বাহুল্য। মধ্যখানে শিমু ফোন করল। বললাম, “পলি তো এখন আমার বাসায়, ওর সাথে কথা বল”। পলিকে শিমুর সাথে কথা বলতে দিয়ে ওর জন্য নাস্তা রেডি করছি, দেখি সে হুট করে ফোন রেখে চলে এলো।
আমি বললাম, “এত তাড়াতাড়ি কথা শেষ?”
সে বলল, “আর বোলোনা, এক ফাজিল ঢুকে পড়েছে মাঝখানে ক্রস কানেকশনে”।
“বলতে ফোন রেখে দিতে”।
পলি বলল, “আমরা জানলে তো যে মাঝখানে কেউ শুনছে!”
“তাহলে টের পেলে কি করে?”
“হয়েছে কি, শিমু আমাকে জিজ্ঞেস করল পড়াশোনা কেমন চলছে। আমি বললাম, ‘পড়াশোনার সাথে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে সেই কবে!’ ও বলল, ‘আবার বিয়ে করে ফেল’। তখন মাঝখানে কে যেন বলে উঠলো, ‘ওমা! তাহলে তো দ্বিতীয় বিয়ে হয়ে যাবে!’ আমি আর শিমু দু’জনেই অবাক, ‘কে কথা বলল?’ তখন লোকটা বলল, ‘আপনাদের কথা শুনতে বিরক্ত লাগছে, ফোন রাখেন, আমার এক জায়গায় জরুরী ফোন করতে হবে’…!!!”



আমাদের থার্ড ইয়ার অনার্স পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ চলছে। সেই সকাল দশটা থেকে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে ফর্ম জমা দেয়ার অফিসের সামনে কোলাহল করছে। অথচ যিনি ফর্ম জমা নিচ্ছেন তিনি নির্বিকার। নড়েন তো নড়েন, চরেন তো চরেন। আমার রোল নং সবার শেষে। ঐ ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে আমি ওপরতলায় গিয়ে বসে রইলাম। সন্দেহ নেই আজ তিনটার আগে আমার ফর্ম জমা দেয়া হবেনা। বান্ধবী সোমারও রোল নাম্বার আমার কাছাকাছি। কিন্তু সে আশায় বুক বেঁধে অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। বারোটার সময় সে এসে মহা উৎসাহে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল, “আর বেশী কেউ বাকী নেই। আমাদের মনে হয় একটার মধ্যে হয়ে যেতে পারে”। অবশেষে দুপুর একটায় আমাদের মাত্র চারজন বাকী দেখেও লোকটার পাষান হৃদয়ে কোন করুণার সঞ্চার হোলনা। উনি অফিস বন্ধ করে ভাত খেতে চলে গেলেন। সোমা, পলি আমি আর এক বান্ধবী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্দার করছি কিন্তু ওনার ফিরে আসার নাম নেই।

লোকটা ফিরে এলো দুপুর সাড়ে তিনটায়। এসে অফিসে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে ওনার পৌনে চারটা বাজল। সোমা বলল, “চাচা, ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে, প্লীজ একটু তাড়াতাড়ি করুন”। চাচা বললেন, “দাঁড়ান, আমি আগে পানটা খেয়ে নেই”। বলে উনি আয়েশ করে পান চিবুতে লাগলেন আর আমরা হা হয়ে ওনার কান্ড দেখতে লাগলাম। সোমা আর রাগ সামলাতে পারলনা, ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে বলল, “এই পান খেয়ে যেন তোর ডিসেন্ট্রি হয়!” ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা মুখে হাত চাপা দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম! আর চাচা হা হয়ে মুখ বন্ধ করতে ভুলে গেলেন, ওনার মুখের দুপাশ বেয়ে লাল লাল পিক ঝরতে লাগল!

সোমা পরে সিটিভির প্রথম ঘোষিকা হয়েছিল।



আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে চাকরী করছি দু’বছর হোল। একদিন দুপুর দু’টা বাজতে দশমিনিট। দু’টায় আমার একটা ক্লাস আছে। অন্য ডিপার্টমেন্টে নবাগত এক শিক্ষক এলেন আমার সাথে পরিচিত হতে। তিন চার মিনিট কথা বলে আমি উসখুস করতে লাগলাম। পাঁচ ছয়মিনিট পর আমার অস্থিরতা খালি চোখেই ধরা পড়ার মত ছিল। কিন্তু বেচারা মহা উৎসাহে কথা বলছেন তো বলছেন। আট মিনিটের মাথায় লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, “ভাই, আপনার সাথে পরে কথা বলব, আমার মেয়েরা অপেক্ষা করছে”।
উনি বললেন, “কয় মেয়ে আপা?”
উনি কি বুঝাতে চাইছেন তাড়াহুড়ায় আমার মাথায় তখন খেলেনি। আমি বললাম, “চল্লিশ জন”।
বেচারার আতংকিত চেহারা খেয়াল হোল বিশাল গন্ডগোল হয়ে গেছে! তিনি কি ভাবছেন বুঝতে পেরে আমার নিজেরই তখন চক্ষু চড়কগাছ।
তাড়াতাড়ি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, “না না ভাই, ভয় পাবেন না! আমার একটাই মেয়ে। কিন্তু আমি মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিনা। আমার ছাত্রীরা অপেক্ষা করছে ক্লাসের জন্য। ওদের কথা বলছিলাম!”



ইউনিভার্সিটির রুটিনে স্থানাভাবে সবার নামের আদ্যক্ষর দিয়েই শিক্ষক কে তা ইন্ডিকেট করা হত। আমার আদ্যক্ষর ছিল RBA. সহকর্মীরা দুষ্টুমী করে মেয়েদের ভয় দেখাতেন, “বেশী ঝামেলা করলে RABকে ডাকব”। সেজন্যই কি’না জানিনা, ছাত্রীরা ভীষণ ভয় পেত। আমি এই ভয় ভাঙ্গানোর জন্য মাঝেমাঝে ওদের সাথে দুষ্টুমী করতাম।

একদিন দু’জন ছাত্রী এসে ভয়ে ভয়ে জানাল আমি যে রুমে ক্লাস নেয়ার কথা সে রুমে একজন বহিরাগত শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, তিনি বলেছেন তাঁর আরো একঘন্টা লাগবে”।
বললাম, “স্যারকে বলনি বের হয়ে যেতে?”
ওরা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “ম্যাডাম, এক্ষণি যাচ্ছি!”
মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “আহারে আমার কন্যারা! স্যার ক্লাস নিক। তোমরা দেখ আর কোন রুম খালি আছে কি’না। এসে আমাকে জানাও”।
কিছুক্ষণ পর ওরা এসে জানালো ৪০৩ এবং ৫০৩ দুটোই খালি আছে।
আমি বললাম, “৪০৩ এই বসি, ৫০৩ হলে তো হারাম হয়ে যাবে!”
ওরা কিছুক্ষণ হা করে রইলো। একটু পরে টের পেয়ে মুচকি হেসে চলে গেল। আপনারা কি বুঝেছেন কি বললাম?

No comments:

Post a Comment