Wednesday, June 15, 2011

প্রবালদ্বীপে



২০০৩ সালের ঈদুল ফিতর। আগে থেকেই প্ল্যান করেছিলাম টেকনাফ যাব। একবার গিয়ে এত ভালো লেগেছিল যে বারবার যেতে ইচ্ছে হত। তাছাড়া গতবার প্রতিকুল আবহাওয়ার জন্য সেন্ট মার্টিন যাওয়া সম্ভব হয়নি। এবার সম্ভব হলে যাবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল আমার পাঁচ ননদই কক্সবাজার চলে গেল ঈদের দিন, আর আমি পরের দিন বসে ছাগল রান্না করছি! হাফিজ সাহেবের এক জরুরী শিপমেন্টের কাজ করতে গিয়ে ঈদের ছুটি পর্যন্ত নেয়া হোলনা। হঠাৎ দুপুরবেলা বারোটায় উনি ফোন করে বললেন, “মনে হয় বিকেল নাগাদ কাজ হয়ে যাবে, তুমি ব্যাগ গুছাও- আমি আম্মাকে জানাচ্ছি”। ঈদের পরদিন, বাসট্রাক কিছুই চলছেনা। বুঝে নিলাম ভেসপায় যাওয়া হবে যেমন গিয়েছিলাম বরিশাল-কুয়াকাটা ২০০২ সালে। বাক্সে যথাসম্ভব অল্প জিনিস নিলাম যেন বাক্স ভারী না হয়।

দুপুর দু’টায় আমরা রওয়ানা দিলাম আম্মার প্রচন্ড আপত্তি আর আব্বার সানন্দ সম্মতি নিয়ে। আমাদের ভেসপাটা বরিশাল যাওয়া উপলক্ষ্যে মডিফাই করা হয়েছিল। যেহেতু রাদিয়া অধিকাংশ আমার কোলে বসবে বা আমাদের দু’জনের মাঝখানে, সিট বর্ধিত করা হয়েছিল প্রায় আট ইঞ্চি এবং সিটের পেছনে প্রায় আঠারো ইঞ্চি ব্যাকরেস্ট দিয়ে বসাটা আরামদায়ক করা হয়েছিল। ভেসপার পেছনে একটা স্টান্ডের মত লাগানো হয়েছিল যার ওপর স্যুটকেস দাঁড় করিয়ে নেয়া যায় এবং সামনে একটা স্টিলের ঝুড়ি লাগানো হয়েছিল যেটাতে টুকটাক জিনিসপত্র খাবারদাবার রাখা যায়। সব মিলিয়ে বলা চলে গরীবের গাড়ী, আমার ছাত্রীরা বলত হেলিকপ্টার।

হাফিজ সাহবে কাজপাগল মানুষ। সুতরাং প্রথমে গেলেন শিপমেন্ট ঠিকভাবে সম্পন্ন হোল কি’না আরেকবার নিশ্চিত করতে। যখন রাদিয়া আর আমি ভাবছি আজ আদৌ কোথাও যাওয়া হবে কি’না এ’সময় এসে বললেন কাজ হয়ে গিয়েছে- তখন বাজে চারটা। বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিয়ে একে একে কর্ণফুলী ব্রিজ, আমাদের আদিবাড়ী পটিয়া, আমার খালার বাড়ী চন্দনাইশ- ওখানে নেমে আসর নামাজ পড়ে আবার নানার বাড়ী সাতকানিয়া পেরিয়ে কক্সবাজারের কাছাকাছি ওনার এক বন্ধুর শ্বশুরবাড়ী দাঁড়ালেন মাগরিব নামাজের জন্য। তারপর সোজা একটানে কক্সবাজার। পথে যেতে যেতে চিন্তা করলাম বড় আপার (হাফিজ সাহেবের বড়বোন, ওনার কথার বাইরে কেউ চললে খবর আছে) শ্বশুরবাড়ী ছাড়া আর কোথাও থাকলে লঙ্কাকান্ড হয়ে যাবে অথচ ঐ বাসায় অলরেডি বড় আপা ছাড়াও আমার চার ননদ তাদের স্বামীসন্তানসহ অবস্থান করছে। এ’সময় ওদের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করা কি ঠিক হবে? যা থেকে কপালে বলে আমরা গিয়ে উঠলাম ওনার এক বন্ধুর হোটেলে। দুলাভাই খবর পেয়েই প্রচন্ড ক্ষেপে উঠলেন রাতেই এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। কিন্তু ওনাদের বাসায় যে হুলস্থুল আতিথেয়তা করা হয় তাতে একবার গেলে আর তিনদিনেও বের হওয়া যাবেনা। তাই রাদিয়া ঘুমিয়ে গিয়েছে, কাল সকালে নাহয় যাওয়া যাবে ইত্যাদি বলে ওনাকে ঠেক দেয়া গেল।

ফজরের নামাজ পড়েমাত্র হাফিজ সাহেব বললেন, “শোন, দুলাভাই ফোন করার আগেই আমাদের কেটে পড়তে হবে, নইলে এবারে আর টেকনাফের চেহারা দেখতে হবেনা!” যেমন কথা তেমন কাজ। ছ’টা বাজতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল, সকালেও কখনো কখনো টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু আমরা বৃষ্টিতে ভিজে রেগুলার কাজে আসা যাওয়া করতাম, প্রচন্ড বৃষ্টি ছাড়া রেনকোট ব্যবহার করা হতনা- তাই অসুবিধা হচ্ছিলোনা। বৃষ্টি বেশী বেড়ে গেলে একজায়গায় দশমিনিট দাঁড়ালাম। আমার ননদ আইরিন সেন্ট মার্টিন যাবার কথা ছিল, ওকে ফোন করলাম। জানা গেল বড় আপার শ্বশরবাড়ীতে এমনভাবে আটকিয়েছে যে এবার আর যেতে পারার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। শোকর করলাম যে আমরা দুলাভাইয়ের কথায় যাইনি। তার পাঁচমিনিট পর দুলাভাইয়ের ফোন, “তোমরা কোথায়? তোমাদের রুমে তো তালা মারা?” আমরা কোথায় শুনে তো বেচারা থ!

আমরা যখন রিসর্টে পৌঁছলাম যেখান থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে ইয়ট ছাড়ে, দেখি ইয়টে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই। এতদূর এসে এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে মন চাইলোনা। টান দিয়ে চলে গেলাম ফিশিং ঘাটে। ওখানে থেকেও সব নৌকা তখন বের হয়ে গিয়েছে। ওখানে একজন পরামর্শ দিলেন যেখান থেকে স্থানীয় লোকজনের যাতায়াতের জন্য যাত্রীবাহী ট্রলার ছাড়ে ওখানে চলে যেতে। দ্রুত ঐখানে পৌঁছে দেখি একটা ট্রলার তখনই ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাফিজ সাহবে টিকেট নিয়ে বাক্স আর রাদিয়াকে তুলে দিলেন ট্রলারে- এখন তো আর আমাদের না নিয়ে ট্রলার ছাড়তে পারবেনা! কিন্তু মটরসাইকেল রাখা হবে কোথায়? ঘাটের লোকজন বলল এখানে এক হাজী সাহবে আছেন, সবাই ওনাকে খুব বিশ্বাস করে, ওনার বাসায় রাখা যায়, বাসা ঘাটের পাশেই। কিন্তু তখন বাইক রেখে আসার সময় নেই। কি করা যায়? হাজী সাহেব তখন ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সব শুনে উনি বললেন উনি লোকমারফত বাইক বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। হাফিজ সাহবে হাজী সাহেবের হাতে বাইকের চাবি দিয়ে চলে এলেন।

ট্রলার চলছিল খুব দ্রুত গতিতে আর ট্রলার ঘাট ছিল ইয়টের ঘাটের অনেক পরে মানে নাফ নদীর মোহনার কাছাকাছি। কিছুদুর যাবার পর পেছনে ইয়ট দেখতে পেলাম। তখন ভাবলাম ইয়ট না পেয়ে ভালোই হোল- দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল ওখানে গাদাগাদি অবস্থা, বেচারার যেন চলতেই কষ্ট হচ্ছে! এমনসময় শুনি ইয়টের থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে, “হাআআআফিজ ভাআআআই …” আমরা তো অবাক! দেখি তিনজন মানুষ হুলস্থুল বেগে হাত নাড়ছে আর চিৎকার করছে। আরে! এ যে দেখি রুবেল, ইসমাইল আর আহসান ভাই! “সেন্ট মার্টিনে নেমে দেখা হবে”, বলতে বলতে আমাদের ট্রলার এগিয়ে গেল। এবার শান্তিমত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখার সুযোগ পেলাম। প্রথমবার যখন টেকনাফ আসি, পাহাড়ের ওপর এঁকেবেঁকে চলা পথ থেকে মোড় ঘুরতেই হঠাৎ সামনে উন্মোচিত হয় এক তীরের মত সোজা সবুজাভ স্বচ্ছ পানিযুক্ত নদী, এতে দুপাশে পাহাড় আর আকাশে মেঘের ছায়া- তখনই আমি নাফের প্রেমে পড়ে যাই! এই প্রেম আজও অক্ষত আছে। এর একপাশে টেকনাফের পাহাড় আরেকপাশে রেঙ্গুনের পাহাড়ের ছায়া পড়ে। রেঙ্গুনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম একসময় এই উপমাহাদেশের কত লোক ভাগ্যান্বেষণে রেঙ্গুন যেত! কত কাহিনীতেই এর উল্লেখ রয়েছে। আমার নানা নিজেও ওখানে ব্যবসা করেছে। পরে স্থানীয় মানুষের অসহিষ্ণুতার কারণে মুসলিমরা বিতাড়িত হয়, তার পরপরই রেঙ্গুনের ব্যবসাও বসে পড়ে। বড় আপার শ্বশুর ওখানকার স্থানীয় হওয়া সত্ত্বেও বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং সংসার পেতে এদেশী হয়ে যান।

আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে দূরে দ্বীপ দেখতে পেয়ে থমকে গেলাম। বাঁপাশে রেংগুনের পাহাড়ের শেষাংশ যেন প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে। এখানে পানি স্বচ্ছ নীল। তার মধ্যখানে বসে আছে সবুজ একটা দ্বীপ! অনন্ত নীল সমুদ্রের মাঝে সবুজ প্রাণের ছোঁয়া! বেশীক্ষণ উপভোগ করার সুযোগ পেলাম না। দ্বীপের কাছাকাছি যেতেই ট্রলার ভীষণভাবে দুলতে শুরু করল। হাফিজ সাহবে একদল লোকের সাথে গল্প করছিলেন এই আড়াই ঘন্টা জুড়েই। এবার ওনাকে ব্যাঘাত ঘটাতে হোল। উনি এসে রাদিয়াকে কোলে নিতেই সে বুদ্ধিমতি মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়ল। দুলতে দুলতে ট্রলার গিয়ে তীরে ঠেকতে সে আবার নিরাপদ বুঝে জেগে উঠলো। ট্রলার থেকে নেমে অন্য ট্রলারের ওপর দিয়ে পার হয়ে গিয়ে সাঁকো পেরোতে হত। সাঁকো ছিল বাঁশের তৈরী। যেখানে পা দেব সেখানে ফাঁকাফাঁকা আর পাশে কোন রেলিং নেই যা ধরে সামাল দেয়া যায়। হাফিজ সাহবের হাতে মেয়ে আর বাক্স। বরিশালের মানুষ বলে উনি এভাবে ট্রলার ডিঙ্গিয়ে সাঁকো পেরোতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি আটকে গেলাম। মাঝি হাত ধরে সাহায্য করতে চাইলো, কিন্তু আমি ছেলেদের হাত ধরিনা। শেষমেশ সাহস করে সার্কাসের ব্যালান্সিং অ্যাক্টের মত করে ঐ বাঁশের ব্রীজ পার হয়ে মাটিতে পা দিতেই যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।

আমাদের ট্রলারে যাদের সাথে হাফিজ সাহেব গল্প করছিলেন তাদের একজন ঢাকাস্থ আর্কিটেক্ট। বেচারা একবার বৌ নিয়ে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে এসে শেষে জমিতে ঘুমাতে বাধ্য হয়েছিলেন যেহেতু সিজন এলে এখানকার স্কুল থেকে শুরু করে বাসা বাড়ী পর্যন্ত পর্যটকদের বাসস্থানে পরিণত করেও সংকুলান করা সম্ভব হয়না। পরে উনি দ্বীপের একপ্রান্তে জমি কিনে কতগুলো বাংলোবাড়ী করে ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করেন- নাম দেন “সীমানা পেরিয়ে”। শিক্ষিত মানুষ, তাই প্রবাল দ্বীপের যাতে ক্ষতি না হয় সেভাবেই বাংলো তৈরী করেছেন। পক্ষান্তরে এখানে চারতলা পাঁচতলা হোটেল দেখে মনে হচ্ছিল এগুলোর মালিকরা পয়সার জন্য নিজেদের ঘিলু খুইয়ে বসেছেন। হাফিজ সাহবে ভদ্রলোকের সাথে যাবার ব্যবস্থা করতে করতে আমি রাদিয়াকে নিয়ে বালি পেরিয়ে সেন্ট মার্টিনের একমাত্র পাকা রাস্তার দিকে রওয়ানা দিলাম। দূরে দেখতে পাচ্ছিলাম আরেক ট্রলার থেকে লোক নামছে। হঠাৎ শুনি কে যেন চিৎকার করছে, “রেহনুমা ম্যাডাআআআম”। কাউকে না দেখে ভাবলাম আমি হয়ত ভুল শুনেছি। আবার শুনি সেই চিৎকার। এবার আর সন্দেহের অবকাশ নেই। বহুদূর থেকে দেখি কেউ একজন ছুটে আসছে- জসীম স্যার না? তাই তো আমাদের স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক জসীম স্যার! কাছে এসেই বললেন, “আপা, নৌকা থেকে নামতেই আপনাকে দেখে ছুটে এলাম। আমরা ছয়জন এসেছি প্রেসিডেন্সি থেকে”। আমি খুব উৎফুল্ল হয়ে বললাম, “তাহলে তো খুব মজা হবে, পথে আরো তিনজনকে আসতে দেখেছি”। পরে একটু সন্দেহ হোল, “আপনারা তো জানতেন না আমরা এখানে আসছি, তাহলে এই অপরিচিত জায়গায় এতদূর থেকে আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন এটা আমি?” উনি বললেন, “আপা, আপনি যখন হাঁটেন আপনার ডানহাতটা বাঁহাতের তুলনায় অনেক বেশী দোলে, আর পাশে রাদিয়ামনি। তাই নিশ্চিত হলাম যে এটা অবশ্যই রেহনুমা আপা”। এমন অদ্ভুত বিশ্লেষণ শুনে আমি থ হয়ে গেলাম! ওদের হোটেল রিজার্ভ করা ছিল। ঠিকানা দিয়ে ওরা চলে গেল। আমরা ভ্যানগাড়ীতে চড়ে দ্বীপের একমাথা থেকে আরেক মাথায় রওয়ানা দিলাম।

দ্বীপের মধ্যভাগেই মূলত লোকবসতি দেখে বোঝা গেল দ্বীপের তীরবর্তী অঞ্চল প্রায়ই ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে ধারণার সত্যতা খুঁজে পেলাম। ছোট্ট দ্বীপটা গাছগাছালীতে, বিশেষ করে নারকেল গাছে পরিপূর্ণ। একজায়গায় পুকুর কাটা হচ্ছিল, দেখি ওপরে কয়েক ইঞ্চি মাটির প্রলেপ ছাড়া নীচে পুরোটাই সাদা সাদা প্রবাল। এই নাজুক প্রাকৃতিক কাঠামোর তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র পয়সার পেছনে ছুটে যেসব আহাম্মকরা এখানে বিশাল হোটেল বিল্ডিং বানায় তাদের সাহস আর দায়িত্বহীনতার কথা চিন্তা করে আবারো শিউরে উঠলাম। সামান্য কয়েকটা অফিস বিল্ডিং আর স্কুল দেখলাম। কিন্তু অনেকগুলো মসজিদ, পরে জেনেছি তখন এগারোটা মসজিদ ছিল এইটুকু ছোট্ট একটা দ্বীপে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল লবনাক্ত সমদ্রের মাঝখানে হলেও এই দ্বীপের পানি সন্দর মিষ্টি আর ডাব ততোধিক মিষ্ট! আমি যেহেতু ডাব খুব পছন্দ করি, সেন্ট মার্টিন ছিল আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা।

পথের শেষে ধানক্ষেত পেরিয়ে “সীমানা পেরিয়ে” রিসর্ট। ভদ্রলোকের নামকরণের স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম। কয়েকটা ছোটছোট বাংলো। পানি আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। মাধ্যখানে খাবার জায়গা। যখন যা পাওয়া যায় সেটাই মেনু। একটা ছোট্ট পুকুর কাটা হচ্ছে পানির সরবরাহের জন্য। মালিক ভদ্রলোক দেখি তক্ষুণি কাজে লেগে গেলেন। আমরা যাবার আগেই বাংলোর সবগুলো রুম দখল হয়ে গিয়েছে। তাঁর নিজেরই থাকার জায়গা নেই। কিন্তু একরুমে দু’জন ব্যাচেলর ভদ্রলোককে দেখে তিনি তাঁদের অনুরোধ করলেন আমাদের জন্য রুম ছেড়ে দিতে। মহিলা আর শিশু দেখে ভদ্রলোকেরা বদান্যতার পরিচয় দিয়ে রুম ছেড়ে দিলেন। মালিক নিজে তাঁদের সাথে তাঁবু টাঙ্গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করলেন। রিসর্টের একপাশ থেকে একটা অতিকায় হোটেল দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রেসিডেন্সির ছয় শিক্ষক ওখানেই উঠেছেন। দুপুরে আলুভর্তা দিয়ে খেয়ে মনে হোল যেন অমৃত! খাওয়ার মাঝখানেই দেখি ইয়টের তিন যাত্রী ভবঘুরের মত এসে উপস্থিত। তাঁরা কোথাও থাকার জায়গা পাননি। বাংলোর মালিকের সাথে কথা বললে তিনি বললেন, “নো প্রব্লেম, আরেকটা তাঁবু টাঙ্গিয়ে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”। চমৎকার!

বিকেলে জসীম, রাশেদ, সাইফুদ্দিন স্যার, মোর্শেদ স্যারসহ আরো দু’জন এসে উপস্থিত হোল, “চলেন, সবাই মিলে ছেঁড়াদ্বীপ যাই!” ছেঁড়াদ্বীপ হোল সেন্ট মার্টিনের পাশে গজাতে থাকা আরেকটা প্রবাল দ্বীপ। ভাটার সময় সেন্ট মার্টিন থেকে হেঁটেই ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়া যায়। কিন্তু জোয়ারের সময় দ্বীপের মধ্যভাগ ছাড়া আর সবকিছু ডুবে যায়। যেহেতু ঐ একটি দিনই সম্বল আর দেরী না করে রুবেল, ইসমাইল আর আহসান ভাইকে ডেকে নিয়ে আমরা সবাই মিলে ট্রলার ভাড়া করতে গেলাম। রাশেদ আর আহসান ভাই তো একজন আরেকজনকে দেখে হতবাক! দুই ভাইই সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে এসেছে অথচ কেউই জানেনা ভাই এখানে!

ট্রলার পাওয়া গেল সহজেই। কিন্তু আমরা ট্রলারে উঠতেই ট্রলার একদিকে কাত হয়ে কেউ মাটিতে, কেউ পানিতে পড়ে গেলাম। এবার মাঝি আমাদের এমনভাবে ভাগ করে বসালো যেন ওজন ব্যালেন্স হয়। তারপর ট্রলার ছেড়ে দিল সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে। ইসমাইল হাত দিয়ে পানি তুলে রাদিয়াকে ছুঁড়ে দিতেই সে কটমট করে তাকিয়ে রইলো। সাইফুদ্দিন স্যার ইঞ্জিনের সামনে বসে ধোঁয়া গিলতে লাগলেন কিন্তু যদি গভীর সমুদ্রে ট্রলার উলটে যায় সেই ভয়ে কিছুতেই জায়গা পরিবর্তন করতে রাজী হলেন না। আমি হালের ওপর বসে সবার মজা করা দেখে মজা পেলাম। সাইফুদ্দিন স্যার আমার বাড়ীর লোক বলে আমাকে দিদি ডাকতেন। ওনাকে বললাম, “দাদা, আপনার প্রিয় গানটা গান, এর চেয়ে পার্ফেক্ট সেটিং আর পাবেন না”। বেচারা “ওরে নীল দরিয়া” গানটা খুব ভালোবাসেন, সুযোগ পেলেই গান কিন্তু ধোঁয়া গিলতে গিলতে এমনিতেই অবস্থা কাহিল, তাতে এই রসিকতা ওনার পছন্দ হোলনা। কিন্তু বেচারা এত ভদ্র যে কিছুই বললেন না।

প্রায় একঘন্টা পর অনেকটা ঘুরপথে আমরা ছেঁড়াদ্বীপ এসে পৌঁছলাম। মাঝি হয়ত আমাদের সমুদ্র দেখাতে চাইছিল। কিন্ত আসলে সমুদ্র তীরের নিরাপদ অবস্থান থেকে সাগরকে যেমন সুন্দর দেখায়, অবারিত নীল জলরাশি ছাড়া যখন আর কিছু দেখা যায়না তখন তাকে কেন যেন আর আপন মনে হয়না। ছেঁড়াদ্বীপের তীরে অনেক নিমিজ্জিত প্রবাল। তাই ট্রলার কাছে নেয়া সম্ভব হোলনা। কিন্তু নেমে দেখি কেবল গোড়ালী পর্যন্ত পানি তাই কোন সমস্যা হোলনা। পানি এত স্বচ্ছ যে প্রতিটা বালি, প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা প্রতিটা প্রাণীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দ্বীপে উঠে দেখি অসংখ্য ঝিনুকচূর্ণ। ঢেউয়ের তোড়ে ঝিনুক আছড়ে পড়ে প্রবালের বুকে, বারবার ঢেউয়ের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এই দ্বীপের কলেবর বৃদ্ধিতে এর অংশ হয়ে যায় একসময়। যেহেতু দ্বীপটিতে আঁকড়ে ধরার মত মাটি সৃষ্টি হয়নি তখনো কেবল স্থানীয়ভাষায় কেয়া নামে একধরণের কষ্টসহিষ্ণু গাছের বন আছে এখানে কোন কোন জায়গায়, এছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব চোখে পড়েনা। একজায়গায় এক বৃদ্ধ আর তার নাতি বসে কতগুলো অদ্ভুত মাছ দেখাচ্ছিল পর্যটকদের। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম সকলে। তাঁরাও এ’ দ্বীপে থাকেন না। সন্ধ্যা হলে চলে যান। রাতে নাকি এখানে পরীদের মেলা বসে, তারা সারারাত এখানে নাচে গায়, তাই কেউ ভয়ে রাতে এখানে আসেনা! ছোট ছেলেটি খুব আগ্রহ করে আমাদের একটি পাথর দেখাল, এর নাম নাকি মৌসুমী পাথর। পাথরটির কোন বিশেষত্ব দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর নাম মৌসুমী পাথর কেন?” সে খুব উত্তেজিত হয়ে জানাল, “নায়িকে মৌসুমী এতে বসে শ্যুটিং করেছিল, তাই”। বেচারার জন্য এটা জীবনের অন্যতম স্মরনীয় ঘটনা। আমাদের দলের কয়েকজন দুষ্টুমী করে বলল, “এই পাথর ছুঁলে কি বিয়ে হয়? তাহলে একে ছুঁয়ে দেখা যেতে পারে”!

কিছুক্ষণ পর রাদিয়া বলে দিল সে আর হাঁটতে পারবেনা। বেচারীরই বা দোষ কি? দ্বীপের মাটি তখনো এত বেশী অসমান এবং ভঙ্গুর যে পা ফেলতেই খুব কষ্ট হয়, আমার নিজেরই বারবার পায়ের পাতায় ক্র্যাম্প হচ্ছিল। পরে হাফিজ সাহবে এসে রাদিয়াকে ঘাড়ে তুলে নিলেন। কিছুদূর যাবার পর রুবেল বলল, “রাদিয়া, আব্বুর কষ্ট হচ্ছে, তুমি কিছুক্ষণ আমার কাছে আস”। মেয়ে বলে কি, “না, আমি আব্বুর কাছেই থাকব। তোমার নাম কি?” সে বল, “রুবেল”। মেয়ে বলল, “না, ওটা আমার আব্বুর নাম, তোমাকে রুবেল ডাকা যাবেনা”। রুবেল বলল, “তাহলে আমাকে কি ডাকবে?” রাদিয়া বল, “তোমার নাম এখন থেকে লাম মীম”। মেয়ের পাকা পাকা কথা শুনে আমি নিজেই হতবাক!

দ্বীপ ঘুরে এসে নৌকার দিকে যেতে যেতে দেখি সূর্য অস্ত যাচ্ছে। প্রশস্ত নীলিমায় যেখানে আকাশ আর সাগর মিশে গিয়েছে একাত্ম হয়ে তার ঠিক মধ্যখানে বিশাল লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে অবগাহন করছে, স্তিমিত হয়ে আসছে তার লালিমা। আমি সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পরে সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে গেলে মনে পড়ল আমি এতক্ষণ ভারী ক্যামেরাটা নিয়ে সম্পূর্ণ দ্বীপ প্রদক্ষিণ করে এলাম শুধু সূর্যাস্তের ছবি তোলার জন্য অথচ সেই ছবি কেবল হা করে গিলেই গেলাম, ক্যামেরাবন্দী করা হোলনা!

যেখানে নেমেছিলাম সেখানে পৌঁছে দেখি নৌকার নামনিশানা নেই। পরে দেখা গেল নৌকা অনেক দূরে। মাঝিকে অনেক ডেকেও কোন সাড়া পাওয়া গেলনা। শেষে হাফিজ সাহবে বললেন, “সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমি সাঁতরে গিয়ে নৌকা কাছে টেনে আনা যায় কিনা দেখি”। উনি রাদিয়াকে রাশেদের কাছে আর সাধের লেদার জ্যাকেট আমার কাছে দিয়ে নৌকার দিকে সাঁতার দিলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মাঝি ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু মূল সমস্যা সেটা নয়। আমরা যখন নেমেছি তখন ভাটা ছিল। নৌকা একই জায়গায় আছে কিন্তু এখন জোয়ারের কারণে ট্রলারের কাছাকাছি পানি অনেক গভীর। আমরা সবাই সাঁতার পারিনা তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হোল প্রবালের বা ট্রলারের ক্ষতি না করে একে যতটুকু কাছে টেনে আনা যায় তা চেষ্টা করা হবে। হাফিজ সাহবে একা এতবড় ট্রলার টেনে আনতে পারবেনা বলে রাশেদ রাদিয়াকে সাইফুদ্দিন স্যারের কাছে দিয়ে সাঁতরে চলে গেল। রাদিয়া ছোটখাট মানুষটাকে খুব পছন্দ করত, কিন্তু এই পানির মধ্যখানে ও যেন ওনাকে ঠিক ভরসা করতে পারলোনা। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল রুবেল সবচেয়ে লম্বা। সে তখন নিজ উদ্যোগেই রুবেলের কোলে চলে গেল!

ওদিকে নৌকা কাছাকাছি আনার পরও দেখা গেল গলা পানি পেরিয়ে নৌকায় উঠতে হচ্ছে। ট্রলার থেকে সিঁড়ি নামিয়ে মাঝি সবাইকে নৌকায় ওঠালো। কিন্তু আমি কিছুতেই সাহস করতে পারছিলাম না। প্রতিবার ঢেউ এলেই পায়ের নীচে বালি সরে যায়, বোরকা যেন পাখার মত মেলে গিয়ে আমাকে নিয়েই ভেসে যেতে চায়! আমি যেহেতু কারো হাত ধরবনা সবাই বলল, “হাফিজ ভাই, আপাকে নিয়ে আসেন”। উনি এসে আমার হাত ধরতেই বান্দরগুলো চেঁচাতে শুরু করল, “আহা, টাইটানিক হচ্ছে, দেখে যাও!” মনে মনে ভাবছিলাম, “ট্রলারে উঠে নেই বাছাধন! তারপর আমি তোমাদের দেখাচ্ছি টাইটানিক!” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হাফিজ সাহবে বললেন, “জ্যাকেটটা দাও, ভেজা টিশার্ট খুলে ফেলি”। আমি ভেজা গেঞ্জী নিয়ে হালের ওপর বসতে বসতে শুনি সবাই হায় হায় করে সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে ট্রলার উল্টানোর উপক্রম। কি ব্যাপার? হাফিজ সাহবে পিছলা সিঁড়ি দিয়ে লেদার জ্যাকেটসহ পানিতে পড়ে গিয়েছেন! উঠে এলেন সাথে সাথেই কিন্তু বান্দরগুলো উৎফুল্ল হয়ে শুরু করে দিল, “এ’তো দেখি সত্যিকারের টাইটানিক!” আমার চালাক কন্যা বাবাকে ভেজা দেখে রুবেলের কাছেই থাকা সাব্যাস্ত করে চটপট ঘুমিয়ে পড়ল।

এবার মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় মাঝি ঘুরপথে না গিয়ে দ্রুত ফিরে গেল। গিয়ে সবাই গোসল করে নামাজ পড়ে নিলাম। রাতে হাফিজ সাহবে ফ্লাইং ফিশ খাবার জন্য বাজারে গেলেন। কিন্তু আমি তখন এত ক্লান্ত যে কোনক্রমে নামাজ পড়ে বাচ্চাকে খাইয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোরে দেখি কুক বেচারা একপ্লেট ভাত, একটু ডাল আর দু’টো ডিমের ঝোল নিয়ে এলেন। উনি খেয়াল করেছেন যে আমি রাতে কিছু খাইনি। নাস্তা রেডি হতে দেরী হবে। তাই মা মেয়ের জন্য বাসা থেকেই রান্না করে নিয়ে এসেছেন। মানুষের এই মহত্ব আমাকে ভীষণ স্পর্শ করে। বাকহারা হয়ে গেলাম।

সকালেই প্রেসিডেন্সি গ্রুপ এসে বিদায় নিয়ে গেল। ওরা প্রথম ট্রলারেই টেকনাফ ফিরে যাবে, ওখান থেকে সোজা চট্টগ্রাম। রুবেলরা যাবে দুপুরে, ইয়টে। আমরা সবাই নাস্তা খেয়ে দ্বীপ প্রদক্ষিন করতে বের হলাম। দ্বীপের উত্তরে একটা ভাঙ্গাচোরা টিনের চালার পাশে সাইনবোর্ড দেয়া “হুমায়ুন আহমেদের বাড়ী”। দেখে খুব হাসি পেল। উত্তরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম টেকনাফের শেষাংশে জেগে ওঠা বর্ধিষ্ণু চর যেন কিছুদিনের মধ্যেই সেন্ট মার্টন এসে ঠেকবে। পরে পেপারে দেখেছি এক বিজ্ঞানী বিশ্লেষণ করে মত দিয়েছেন এ্মনটিই হতে যাচ্ছে। আর কিছুদূর গিয়ে এক স্কুলশিক্ষকের সাথে দেখা হোল। তিনি আমাদের বুঝিয়ে বললেন কিভাবে এই ছোটছোট কীটগুলো বছরের পর বছর পরিশ্রম করে এক একটা প্রবাল কলোনী গড়ে তোলে, এই প্রবাল কলোনী সাগর ফুঁড়ে উ্ঠে এলে এতে ঝিনুকচূর্ণ, নদীবাহিত পলি জমে এই দ্বীপের সৃষ্টি হতে লেগে যায় হাজার বছর। অথচ এখানে পর্যটকরা এসে পানিতে নেমে, সাবান ব্যাবহার করে, প্রবাল ভেঙ্গে এবং ব্যাবসায়ীরা হোটেল নির্মাণ করে প্রবালের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। একসময় এখানে অসংখ্য সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসত। এখন তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে কারণ পর্যটকরা বিজ্ঞানীদের সাইনবোর্ড উপেক্ষা করে ডিম নষ্ট করে ফেলেন। তিনি আমাদের দেখালেন গতবছর কোথায় ওনার বাড়ী ছিল। তাকিয়ে দেখি ওখানে কেবল নীল জলরাশি। ওখানেই ছিল পর্যটকদের ঘাট। দ্বীপের ঐ অংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় এখনকার ঘাটটি তৈরী করা হয়। তাই এর এই করুণ অবস্থা। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাজারের দিকে এগোলাম। দূর থেকে দেখা গেল ইয়ট আসছে। যাবার সময় হয়ে এলো। আম্মার জন্য কিছু শুটকী কিনে রিসর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম। শুটকীওয়ালাদের সাথে কথা বলে জানা গেল একসময় এই এলাকার মালিকানা ছিল স্থানীয় লোকজনের। আজকাল বাইরের লোকজন এসে চড়া দামে তাদের জমি কিনে হোটেল বানাচ্ছে। বোকা এবং অভাবী লোকজন তাৎক্ষণিক লাভের কথা ভেবে জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছে। কিন্তু আগন্তুকদের দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ে কোন ধারণা বা চিন্তা নেই। তাই হয়ত বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ আর থাকবেনা। এটাই দ্বীপবাসীর ধারণা।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। রিসর্টে পৌঁছে দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঘাটে চললাম। ঘাটে পৌঁছে রুবেলরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমরা ট্রলারে উঠলাম। ট্রলার চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর ঢাকা থেকে আগত কিছু ছেলে গিটারে সুর তুলে গান ধরল। এমন সময় নদীতে মৃদুমন্দ বাতাস ছাড়ল। তাতেই ট্রলার যেভাবে দুলতে শুরু করল ওদের গান বন্ধ হয়ে গেল! আমি ভাবলাম মরলে ঘুমের মধ্যে মরে যাওয়া সুবিধাজনক। রাদিয়াকে হাফিজ সাহেবের কাছে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি বাপমেয়ে আচার খাচ্ছে, বার্মিজ আচার। বাতাস বন্ধ হয়েছে কিন্তু গান আর শুরু হয়নি। হঠাৎ নদীতে বিরাট এক মাছ লাফ দিয়ে উঠে আবার পানিতে ঢুকে গেল। বঙ্গোপসাগরে ডলফিন আছে কি? জানা হয়নি আজও।

ট্রলার যখন ঘাটে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা নেমেই হাজী সাহবের বাড়ী খুঁজে বের করলাম। দেখি ঘাটের সাথে সংলগ্ন আধুনিক ডিজাইনের ঘেরা দেয়া বাড়ী। এই অঞ্চলে এমন বাড়ী এই প্রথম চোখে পড়ল। বোঝাই যায় উনি বেশ অবস্থাপন্ন। গেটের কাছে পৌঁছতেই আমাদের বাইকটা দেখলাম বাড়ীর পাশে রাখা। প্ল্যান ছিল বাইক নিইয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে রওয়ানা দেব, মাগরিব যেখানে হয় পড়ে নেয়া যাবে। কিন্তু হাজী সাহেব কিছুতেই ছাড়লেন না। উনি নাস্তা খাওয়াবেনই খাওয়াবেন। অপরিচিত মানুষের এই আন্তরিকতা গ্রামাঞ্চলে ছাড়া দেখা যায় কি’না জানিনা। আমরা এই সুযোগে আসর নামাজ পড়েনিলাম, নাস্তা খেয়ে মাগরিব। উনি আমাদের ওনার পরিবারের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন মেজ ছেলে বাইরে আছে, মাগরিব পড়তে পড়তে এসে পড়বে। মাগরিবের পর বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় হাজীসাহেবের মেজ ছেলে এসে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল, “আরে! আপনারা আহমদের আপু আর দুলাভাই না? আহমদ তো আমার ক্লাসমেট!” মনে হোল পৃথিবীটা আসলে অনেক ছোট! চট্টগ্রাম থেকে এতদূরে, টেকনাফের এক অপরিচিত হাজীসাহবের বাসায় বাইক রেখে সেন্ট মার্টিন চলে গেলাম, এসে দেখি উনি পরিচিত! পুণর্বার বিদায় নিয়ে বাজারে গিয়ে মটরসাইকেলে বসেই কিছু কাপড় কিনে রওয়ানা দিতে গিয়ে মনে হোল, দেরী যেহেতু হয়েই গিয়েছে এক জায়গায় ঘুরে যাই।

২০০১ এর শেষদিকে আমরা প্রথম টেকনাফ এসেছিলাম দু’দিনের জন্য। একটা রেস্টহাউজে ছিলাম কিন্তু ওখানে খাবারের ব্যবস্থা ছিলোনা বলে “চিটাগাং রেস্টুরেন্ট” নামে এক জায়গায় দুপুরে আর রাতে খেতে যেতাম। মালিকের চার ছেলে, কোন মেয়ে নেই। কোন এক অজ্ঞাত কারণে উনি রাদিয়াকে আর রাদিয়া ওনাকে খুব পছন্দ করে ফেলল। আমরা খেতে গেলেই উনি অনুরোধ করে রাদিয়াকে নিয়ে যেতেন, আমরা খেতে খেতে ওকে পাশে বসিয়ে নিজ হাতে খাওয়াতেন। কিন্তু ওর জন্য টাকা দিতে গেলে উনি কিছুতেই নিতে রাজী হতেন না। মানুষের ভালোবাসার ঋণ কি শোধ করা যায়? তাই ওখানে গেলাম ওনার সাথে দেখা করে রাদিয়াকে দেখিয়ে নিয়ে আসতে। বসার সময় ছিলোনা। কিন্তু উনি খুশীতে বাকহারা হয়ে গেলেন। এমন ঘটনা তাঁর জীবনে প্রথম। রাদিয়ার জন্য দুয়া করলেন, ওকে এক প্যাকেট জুস দিলেন। তারপর আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। পাঁচমিনিটের ব্যাপার, কিন্তু বেচারার হাসিটা ছিল প্রাণজুড়ানো।

পথে উঠে বুঝতে পারলাম সমুদ্রের মধ্যখানে আমরা শীতকাল টের পাইনি, কিন্তু অভ্যন্তরভাগে যেতে যেতে খবর হয়ে যাবে। হাফিজ সাহবে একখানা আর রাদিয়াকে আমার দিকে ফিরিয়ে ওকেসহ জড়িয়ে আমি একখানা লেদার জ্যাকেট পরে নিলাম। কিন্তু বাতাসের বেগের কারণে বেশ শীত করতে লাগল। আমাদের দুজনের মাঝখানে থাকায় রাদিয়ার গায়ে বাতাস বা ঠান্ডা লাগছিলোনা এটাই ছিল ভরসা। কিন্তু যতক্ষণে আমরা বড় আপাদের বাড়ী গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে আমার হাড়সহ কাঁপতে শুরু করেছে। ঘরে ঢুকতেই বড় আপার শ্বাশুড়ি আমাকে নিয়ে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা দু’টো মাটির চুলার মধ্যখানে মোড়া দিয়ে বসিয়ে গায়ে ছ’খানা শাল চাপিয়ে দিলেন। বড় আপা মুরগী রান্না করতে লাগলেন আর ওনার দুই ননদ চালের রুটি বানাতে বসল। বড় আপাদের বাড়ীতে একমাত্র চাঁটগাঁইয়া সদস্য বলে এই বাড়ীতে আমার আদর আলাদা- যেন দ্বিতীয় বাপের বাড়ী! কিন্তু কোন আদরে কোন কাজ হোলনা। এই কাঁপাকাঁপি আরো দু’দিন অব্যাহত ছিল।

পরদিন আমরা বাজারে গেলাম ওদের জন্য কিছু কিনতে। ফেরার পথে হাফিজ সাহেব বললেন, “চল, সীবীচটা দেখে যাই”। যেতে ইচ্ছে করছিলনা। গিয়ে বুঝলাম না এলেই ভালো হত। সেন্ট মার্টিনের স্বচ্ছ নীল পানি- যার ভেতর দিয়ে সন্ধ্যার আবছায়াতেও গলা পানির নীচে প্রতিটা বালি দেখা যায়- এরপর কক্সবাজারের ঘোলা পানি দেখতে আর কোনদিন ভালো লাগবেনা। ফিরে গিয়ে হাফিজ সাহেব পাড়ার সব বাচ্চাদের বাইকে চরালেন কিছুক্ষণ। আমি বড় আপার ছোট ননদ মিলুকে বায়না করলাম শুটকী ভর্তা খাব। ও বাড়ীর শুটকী ভর্তা স্পেশাল। তারপর দুপুরে খেয়ে খালাম্মা, বড় আপা আর তাঁর ননদদের প্রচন্ড আপত্তির মুখে চট্টগ্রাম ফিরে চললাম জীবিকার তাগিদে।

পথে কিছুক্ষণের জন্য নানাবাড়ীতে বিরতি নিলাম, মাগরিবের নামাজ পড়লাম। চলে যাব শুনে মামীরা মনখারাপ করলেন, কিন্তু কিছুই করার নেই- থাকার উপায় নেই।

ঘরে ফিরে মনে হোল কয়েকটা মূহূর্ত স্বর্গে ছিলাম। তারপর আবার ফিরে এসেছি এই মাটির পৃথিবীতে।

No comments:

Post a Comment