মাহমুদ আর ওর মা যেন দুই দেহ একপ্রাণ। এই ছেলেটিকে মা যেমন ভালোবাসেন, তেমনি ছেলেও মায়ের প্রতি বিশেষ যত্নশীল। সে কখনো মাকে নিরাশ হতে দেয়নি। লেখাপড়ায় যেমন এগিয়ে ছিল সবসময় ঠিক তেমনি পড়ালেখা শেষ করেই ভালো চাকরী পেয়েছে নিজ যোগ্যতায়। মাহমুদের মা, সুলতানা বেগমের অনেক আশা এবার ছেলেকে বিয়ে করাবেন। সে চাকরী পাওয়া মাত্র উনি মেয়ে দেখতে শুরু করেছেন। অনেক দেখেশুনে ওনার বান্ধবী শায়লার মেয়েকে পছন্দ হোল।
একদিন মাহমুদ অফিস থেকে আসতেই উনি খাবার টেবিলে কথাটা তুললেন। মা-ছেলের মাঝে কোন ব্যাবধান ছিলোনা। মাহমুদ বলল, “বেশ তো, তোমার পছন্দ হলে আমার তো মনে হয় পছন্দ হবে”।
মা বললেন, “আমি ওর একটা ছবি এনেছি, দেখবি?”
মাহমুদ বলল, “নাহ, চেহারা দেখে কি হবে? তবে ওর সাথে একবার কথা বলা গেলে ভালো হত। যার সাথে সারা জীবন থাকব তার মনমানসিকতা আমার সাথে মিলবে কি’না সেটা একটু যাচাই করে নিলে মনে হয় খারাপ হয়না”।
ছেলে আপত্তি করেনি তাতেই মা খুশী। বললেন, “আমি কালই শায়লার সাথে কথা বলে মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করছি”।
শায়লা জানালেন, “কাল মেয়ের রেজাল্ট দেবে, অনার্স থার্ড ইয়ার। দুপুর নাগাদ সে বাসায় চলে আসবে। তোমরা মা ছেলে বিকেলে চলে আস। তাহলে আমরা দুই বান্ধবী ডাইনিং রুমে বসে গল্প করব আর ওরা ড্রইং রুমে বসে যা বলার, যা জানার সব সেরে নিতে পারবে। আমরা ওদের দেখতে পেলাম আর ওরা ওদের মত কথা বলতে পারল”।
প্রস্তাবটা সুলতানার পছন্দ হোল। মাহমুদকে বললে সেও জানাল, কাল বৃহস্পতিবার বলে অফিসে কাজের চাপ বিশেষ নেই। সুতরাং সে একটু আগে আগে চলে আসতে পারবে।
পরদিন মাহমুদ আর সুলতানা বেগম মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চললেন মেয়ে দেখতে। শায়লা প্রস্তুত ছিলেন। মেহমানদের যথাযথ অপ্যায়ন করে উনি মেয়েকে ডাকলেন। মেয়ে এলে উনি মাহমুদের সাথে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুলতানাকে বললেন, “চল তো আমরা খাবারগুলো ভেতরে নিয়ে যাই!” মাহমুদ ইশারা বুঝতে পারল। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার সাথে ভনিতা করে লাভ নেই, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের মায়েরা এত বছর ধরে বান্ধবী হবার পরও আমাদের কেন আজই প্রথম দেখা হচ্ছে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ল।
সে বলল, “আমার মনে হয় প্রথমে নিজের ব্যাপারে কিছু বলা উচিত। বাবা নেই। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন। সুতরাং, আমার প্রথম প্রায়োরিটি থাকবে আমার মাকে দেখাশোনা করা। দেখাশোনা আমিই করব, কিন্তু আমার স্ত্রীকে এই ব্যাপারে সহনশীল হতে হবে। আমার মায়ের পেছনে আমার সময় বা টাকাপয়সা ব্যায় নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অশান্তি করা যাবেনা”।
মেয়েটি আবার মাথা নাড়ল।
মেয়েটির চুপচাপ ভাব দেখে মাহমুদের কেমন যেন খটকা লাগল, সে বলল, “আপনার কি কোথাও পছন্দ আছে? থাকলে বলুন, আমি কাউকে জানাব না, বলব আমার এখানে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই”।
এবার মেয়েটি নড়েচড়ে বসল, “নাহ, আমার কোথাও পছন্দ নেই”।
“আপনার যদি আমাকে পছন্দ না হয় তাও আপনি সরাসরি বলতে পারেন। বিয়ে তো আর বারবার করা যাবেনা, সুতরাং মনে কোন অশান্তি রেখে রাজী হবেন না”।
মেয়েটি কিছু বললনা। এই অবস্থায় মাহমুদ কি বলবে খুঁজে পেলোনা। শেষমেশ বলল, “আপনার আজ রেজাল্ট দেবার কথা ছিল, রেজাল্ট কেমন হোল?”
মেয়েটি একটু ইতস্তত করে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস … ফার্স্ট”।
মেয়েটির ইতস্তত ভাব মাহমুদের চোখ এড়ালোনা। সে বলল, “দেখুন, আমি আবারও বলছি। বিয়ে আমার কাছে অত্যন্ত সিরিয়াস একটা ব্যাপার। আশা করছি আপনিও ব্যাপারটাকে হাল্কাভাবে নিচ্ছেন না। আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?”
মেয়েটি আবার কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকাল।
বাসায় এসে সুলতানা বেগম গদ গদ হয়ে ছেলেকে বললেন, “কি? মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর না?”
মাহমুদ বলল, “হ্যাঁ”।
“ওরা খুব ভদ্রলোক”।
“জ্বী মা, শায়লা আন্টিকে দেখলে বোঝা যায়”।
“ওদের আর্থিক অবস্থাও আমাদের মতই, সুতরাং তোকে কেউ ছোট করবেনা”।
“জ্বী মা”।
“তাহলে শায়লাকে হ্যাঁ বলে দেই?”
“না মা”।
“সে কি? কেন?”
“আমি আরেকটু ভেবে দেখি”।
“কেন বাবা? বলছিস তো পছন্দ হয়েছে। তাহলে এত ভাবাভাবির কি আছে?”
“এত না মা … একটু। কি যেন একটা আমার ঠিক মনে হচ্ছেনা। আমাকে দু’টা দিন সময় দাও”।
মা চোখ কপালে তুলে চলে গেলেন।
পরদিন মাহমুদ মায়ের কাছে মেয়েটির ছবি চেয়ে নিল। মা খুশী হয়ে গেলেন যে ছেলে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মাহমুদ ছবি নিয়ে বন্ধু হাবিবের বাসায় গেল। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হোল যে হাবিবের বোন আর তার দেখা মেয়েটি একসাথে পড়ে। সে হাবিবকে বলল, “তোর যদি আপত্তি না থাকে আমি একটু দিশার সাথে কথা বলতে চাই।
হাবিব বলল, “আপত্তি কিসের? দিশা, একটু এদিকে আয় তো! মাহমুদ একটু কথা বলবে”, মাহমুদকে চোখ টিপে বলল, “এই উসিলায় যদি ওকে পড়ার টেবিল থেকে তোলা যায়!”
দিশা এসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া! মিষ্টি খান। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি”।
চমকে উঠল মাহমুদ। কিন্তু কেউ কিছু বোঝার আগে সে মুখে একটা আস্ত মিষ্টি পুরে দিয়ে ভাবতে লাগল এর পরে কথা কিভাবে এগোনো যায়।
মিষ্টি শেষ করে সে দিশাকে বলল, “আচ্ছা, এই ছবিটা দেখ তো! এই মেয়েটাকে আমাদের এক আত্মীয়ের জন্য দেখা হচ্ছে। শুনলাম সে তোমার সাথে পড়ে। ওর ব্যাপারে কি জানো বল তো?”
দিশা ছবি দেখে একটু ইতস্তত করতে লাগল। মাহমুদ বুঝে পেলোনা কি সমস্যা।
সে বলল, “কি দিশা? মেয়েটার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
দিশা তাড়াতাড়ি বল, “নাহ ভাইয়া। ও ভালো মেয়ে”
“তাহলে কি?”
“আপনি তো বরপক্ষের লোক। আপনাকে বলা যাবেনা”।
মাহমুদ মরিয়া হয়ে উঠল, “শোন, বিয়ের ব্যাপারে লুকোচুরি করতে হয়না। তুমি নির্দ্বিধায় বল। বরপক্ষকে কি বলতে হবে আমি বুঝেশুনে বলব”।
দিশাও সমান মরিয়া হয়ে বলল, “আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। ভাইয়া, আমি বলতে চাচ্ছিনা”।
মাহমুদের এবার আরো খটকা লাগল। সে বলল, “দিশা, আমার জানা প্রয়োজন কি এমন ঘটনা যা তুমি বলতে চাইছনা!”
হাবিব বলল, “বলে দে দিশা, তুই না বললেও কেউ না কেউ বলবে। মাহমুদ দায়িত্বশীল ছেলে। সে বরপক্ষকে বুঝেশুনে যা বলার তাই বলবে”।
দিশা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া, প্লীজ আপনি কাউকে বলবেন না। ও ভালো মেয়ে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। প্রতিবার কোনক্রমে থার্ড ক্লাসে পাশ করে আসছে কিন্তু বাবামা’র ভয়ে বাসায় গিয়ে বলে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। গতকাল কে যেন ওকে দেখতে এসেছে। ও বলে দিয়েছে ও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। পরে আমাকে ফোন করে বলল। আমার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি ভাইয়া। সে যা বলেছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সে বাবামাকে মিথ্যা বলছে সেটাই যথেষ্ট খারাপ কথা তার ওপর একটা বাইরের মানুষকে এরকম একটা মিথ্যা বলা আমার ঠিক মনে হয়নি। এই বিয়েটা হলে ঐ ভদ্রলোক সব জানতে পারবেন। তখন উনি ওর বাবামাকে প্রতারক মনে করবেন। এটা কি ওর বাবামা’র প্রতি সুবিচার হবে?”
মাহমুদ দিশাকে আশ্বস্ত করে চলে এলো।
বাসায় এসে মাহমুদ মাকে জানিয়ে দিল সে এ বিয়ে করবেনা। সুলতানা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এটুকু ব্যাপারে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কোন যুক্তি নেই। আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলে কিছুতেই রাজী না হলে তিনি বান্ধবীকে কি বলবেন। শেষে রাগ করে তিনি মাহমুদের সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন, অসুস্থতার ভান করলেন। কিন্তু ছেলে কিছুতেই গললনা।
কয়েকদিন পর খাবার টেবিলে সুলতানা বেগম চুপচাপ খাচ্ছেন আর মাহমুদ চোখে কৌতুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে বলল, “মা, সত্যি করে বল তো, তুমি কি শায়লা আন্টিকে কি বলবে সেটা নিয়ে বেশী চিন্তিত নাকি তোমার ছেলে সুখী হবে কি’না সেটা নিয়ে?”
সুলতানা বেগমের গলায় ভাত যেন আটকে রইল। ছেলের সাথে কথা না বলার সংকল্প ভুলে গিয়ে উনি বললেন, “বাবা, তোর সুখই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুই কেন এটুকু কথার ওপর বিয়েতে নারাজ সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বল। আমি তো এই মেয়ের আর কোন ত্রুটি দেখিনা”।
“দেখ না সেটা ঠিক না মা, বল দেখতে চাও না। দেখ মা, কথাটা এটুকু আবার অনেক বড়ও বটে। আমিও জানি আমাদের সাংসারিক জীবনে সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেও যা ফেল করলেও তা- ওর রেজাল্টের ফলে আমাদের দাম্পত্য জীবনে কোন হেরফের হবেনা। কিন্তু আমি যার সাথে সারাজীবন সংসার করব তার ওপর আস্থা রাখতে পারাটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে যদি আমাকে জানাত সে ফেল করেছে তাহলেও আমি বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হতাম। কিন্তু যে আমাকে এত তুচ্ছ একটা বিষয়ে মিথ্যা বলল তাকে আমি আমার জীবন দিয়ে কিভাবে বিশ্বাস করব? আমি কি করে বুঝব যে সে আমাকে অন্যান্য ব্যাপারেও মিথ্যা বলছেনা?”
মা তার ভুল বুঝতে পেরে নিজের ভুলের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। কিন্তু মাহমুদ তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারল এই ভাবনাটা মায়ের মনেও দোলা দিয়েছে আবার তিনি এটাও চিন্তা করেছেন যে বান্ধবীকে কি বলবেন।
মাহমুদ চেয়ার ছেড়ে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসল, মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল, “মা, আমি তো তোমারই ছেলে, তুমি না বললেও বুঝি তোমার মনে কি কাজ করছে। শায়লা আন্টিকে আমাদের বলার কোন প্রয়োজন নেই আমরা কেন রাজী না। মেয়েটার রেজাল্ট বিষয়ে কিছু বলে ওর জীবনটা বিষিয়ে দেয়ার কোন দরকার নেই আমাদের। আন্টিকে বল, ‘আমার ছেলে খারাপ, সে এক জায়গায় প্রেম করে’ বা যা তোমার বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এটুকুর জন্য আমাকে এমন বিয়ে করতে বাধ্য কোরনা মা যাকে তোমার ছেলে কোনদিন মন থেকে বিশ্বাস করতে পারবেনা”।
সুলতানা বেগমের চোখে পানি চলে এলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে উনি বললেন, “আজ আমার ছেলেই আমাকে শেখাল কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল! আজকে আমার খুশীর অন্ত নেই রে বাবা! তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে কোন কিছুতে বাধ্য করবনা। এ’কদিন তোকে যে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য তুই আমাকে মাফ করে দে বাবা। আমি এখনই শায়লার সাথে কথা বলছি”।
মাহমুদ শুনতে পেল মা ফোনে বলছেন, “শায়লা? হ্যাঁ, সুলতানা বলছি। না রে বোন। আমার ছেলেটা একটা আস্ত পাগল। কিছুতেই সে এখন বিয়ে করতে রাজী হয়না। বলে নতুন চাকরী, এখন ওখানেই কনসেন্ট্রেশন দেয়া জরুরী। যাক, সময় তো পড়েই আছে। তোমার মেয়েরও অনার্স শেষ হতে আরো একবছর বাকী। দেখা যাক এই এক বছরে ওরা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয় কি’না। ঠিক আছে বোন, রাখি। আবার পরে কথা হবে”।
মাহমুদ মুচকি হেসে শুতে চলে গেল। মায়েরা বোঝে সবই … কিন্তু কেন যে পাগলামী করে!
একদিন মাহমুদ অফিস থেকে আসতেই উনি খাবার টেবিলে কথাটা তুললেন। মা-ছেলের মাঝে কোন ব্যাবধান ছিলোনা। মাহমুদ বলল, “বেশ তো, তোমার পছন্দ হলে আমার তো মনে হয় পছন্দ হবে”।
মা বললেন, “আমি ওর একটা ছবি এনেছি, দেখবি?”
মাহমুদ বলল, “নাহ, চেহারা দেখে কি হবে? তবে ওর সাথে একবার কথা বলা গেলে ভালো হত। যার সাথে সারা জীবন থাকব তার মনমানসিকতা আমার সাথে মিলবে কি’না সেটা একটু যাচাই করে নিলে মনে হয় খারাপ হয়না”।
ছেলে আপত্তি করেনি তাতেই মা খুশী। বললেন, “আমি কালই শায়লার সাথে কথা বলে মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করছি”।
শায়লা জানালেন, “কাল মেয়ের রেজাল্ট দেবে, অনার্স থার্ড ইয়ার। দুপুর নাগাদ সে বাসায় চলে আসবে। তোমরা মা ছেলে বিকেলে চলে আস। তাহলে আমরা দুই বান্ধবী ডাইনিং রুমে বসে গল্প করব আর ওরা ড্রইং রুমে বসে যা বলার, যা জানার সব সেরে নিতে পারবে। আমরা ওদের দেখতে পেলাম আর ওরা ওদের মত কথা বলতে পারল”।
প্রস্তাবটা সুলতানার পছন্দ হোল। মাহমুদকে বললে সেও জানাল, কাল বৃহস্পতিবার বলে অফিসে কাজের চাপ বিশেষ নেই। সুতরাং সে একটু আগে আগে চলে আসতে পারবে।
পরদিন মাহমুদ আর সুলতানা বেগম মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চললেন মেয়ে দেখতে। শায়লা প্রস্তুত ছিলেন। মেহমানদের যথাযথ অপ্যায়ন করে উনি মেয়েকে ডাকলেন। মেয়ে এলে উনি মাহমুদের সাথে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুলতানাকে বললেন, “চল তো আমরা খাবারগুলো ভেতরে নিয়ে যাই!” মাহমুদ ইশারা বুঝতে পারল। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার সাথে ভনিতা করে লাভ নেই, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের মায়েরা এত বছর ধরে বান্ধবী হবার পরও আমাদের কেন আজই প্রথম দেখা হচ্ছে?”
মেয়েটি মাথা নাড়ল।
সে বলল, “আমার মনে হয় প্রথমে নিজের ব্যাপারে কিছু বলা উচিত। বাবা নেই। মা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছেন। সুতরাং, আমার প্রথম প্রায়োরিটি থাকবে আমার মাকে দেখাশোনা করা। দেখাশোনা আমিই করব, কিন্তু আমার স্ত্রীকে এই ব্যাপারে সহনশীল হতে হবে। আমার মায়ের পেছনে আমার সময় বা টাকাপয়সা ব্যায় নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অশান্তি করা যাবেনা”।
মেয়েটি আবার মাথা নাড়ল।
মেয়েটির চুপচাপ ভাব দেখে মাহমুদের কেমন যেন খটকা লাগল, সে বলল, “আপনার কি কোথাও পছন্দ আছে? থাকলে বলুন, আমি কাউকে জানাব না, বলব আমার এখানে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই”।
এবার মেয়েটি নড়েচড়ে বসল, “নাহ, আমার কোথাও পছন্দ নেই”।
“আপনার যদি আমাকে পছন্দ না হয় তাও আপনি সরাসরি বলতে পারেন। বিয়ে তো আর বারবার করা যাবেনা, সুতরাং মনে কোন অশান্তি রেখে রাজী হবেন না”।
মেয়েটি কিছু বললনা। এই অবস্থায় মাহমুদ কি বলবে খুঁজে পেলোনা। শেষমেশ বলল, “আপনার আজ রেজাল্ট দেবার কথা ছিল, রেজাল্ট কেমন হোল?”
মেয়েটি একটু ইতস্তত করে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস … ফার্স্ট”।
মেয়েটির ইতস্তত ভাব মাহমুদের চোখ এড়ালোনা। সে বলল, “দেখুন, আমি আবারও বলছি। বিয়ে আমার কাছে অত্যন্ত সিরিয়াস একটা ব্যাপার। আশা করছি আপনিও ব্যাপারটাকে হাল্কাভাবে নিচ্ছেন না। আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?”
মেয়েটি আবার কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকাল।
বাসায় এসে সুলতানা বেগম গদ গদ হয়ে ছেলেকে বললেন, “কি? মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর না?”
মাহমুদ বলল, “হ্যাঁ”।
“ওরা খুব ভদ্রলোক”।
“জ্বী মা, শায়লা আন্টিকে দেখলে বোঝা যায়”।
“ওদের আর্থিক অবস্থাও আমাদের মতই, সুতরাং তোকে কেউ ছোট করবেনা”।
“জ্বী মা”।
“তাহলে শায়লাকে হ্যাঁ বলে দেই?”
“না মা”।
“সে কি? কেন?”
“আমি আরেকটু ভেবে দেখি”।
“কেন বাবা? বলছিস তো পছন্দ হয়েছে। তাহলে এত ভাবাভাবির কি আছে?”
“এত না মা … একটু। কি যেন একটা আমার ঠিক মনে হচ্ছেনা। আমাকে দু’টা দিন সময় দাও”।
মা চোখ কপালে তুলে চলে গেলেন।
পরদিন মাহমুদ মায়ের কাছে মেয়েটির ছবি চেয়ে নিল। মা খুশী হয়ে গেলেন যে ছেলে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মাহমুদ ছবি নিয়ে বন্ধু হাবিবের বাসায় গেল। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হোল যে হাবিবের বোন আর তার দেখা মেয়েটি একসাথে পড়ে। সে হাবিবকে বলল, “তোর যদি আপত্তি না থাকে আমি একটু দিশার সাথে কথা বলতে চাই।
হাবিব বলল, “আপত্তি কিসের? দিশা, একটু এদিকে আয় তো! মাহমুদ একটু কথা বলবে”, মাহমুদকে চোখ টিপে বলল, “এই উসিলায় যদি ওকে পড়ার টেবিল থেকে তোলা যায়!”
দিশা এসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া! মিষ্টি খান। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি”।
চমকে উঠল মাহমুদ। কিন্তু কেউ কিছু বোঝার আগে সে মুখে একটা আস্ত মিষ্টি পুরে দিয়ে ভাবতে লাগল এর পরে কথা কিভাবে এগোনো যায়।
মিষ্টি শেষ করে সে দিশাকে বলল, “আচ্ছা, এই ছবিটা দেখ তো! এই মেয়েটাকে আমাদের এক আত্মীয়ের জন্য দেখা হচ্ছে। শুনলাম সে তোমার সাথে পড়ে। ওর ব্যাপারে কি জানো বল তো?”
দিশা ছবি দেখে একটু ইতস্তত করতে লাগল। মাহমুদ বুঝে পেলোনা কি সমস্যা।
সে বলল, “কি দিশা? মেয়েটার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
দিশা তাড়াতাড়ি বল, “নাহ ভাইয়া। ও ভালো মেয়ে”
“তাহলে কি?”
“আপনি তো বরপক্ষের লোক। আপনাকে বলা যাবেনা”।
মাহমুদ মরিয়া হয়ে উঠল, “শোন, বিয়ের ব্যাপারে লুকোচুরি করতে হয়না। তুমি নির্দ্বিধায় বল। বরপক্ষকে কি বলতে হবে আমি বুঝেশুনে বলব”।
দিশাও সমান মরিয়া হয়ে বলল, “আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। ভাইয়া, আমি বলতে চাচ্ছিনা”।
মাহমুদের এবার আরো খটকা লাগল। সে বলল, “দিশা, আমার জানা প্রয়োজন কি এমন ঘটনা যা তুমি বলতে চাইছনা!”
হাবিব বলল, “বলে দে দিশা, তুই না বললেও কেউ না কেউ বলবে। মাহমুদ দায়িত্বশীল ছেলে। সে বরপক্ষকে বুঝেশুনে যা বলার তাই বলবে”।
দিশা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া, প্লীজ আপনি কাউকে বলবেন না। ও ভালো মেয়ে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। প্রতিবার কোনক্রমে থার্ড ক্লাসে পাশ করে আসছে কিন্তু বাবামা’র ভয়ে বাসায় গিয়ে বলে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। গতকাল কে যেন ওকে দেখতে এসেছে। ও বলে দিয়েছে ও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। পরে আমাকে ফোন করে বলল। আমার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি ভাইয়া। সে যা বলেছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সে বাবামাকে মিথ্যা বলছে সেটাই যথেষ্ট খারাপ কথা তার ওপর একটা বাইরের মানুষকে এরকম একটা মিথ্যা বলা আমার ঠিক মনে হয়নি। এই বিয়েটা হলে ঐ ভদ্রলোক সব জানতে পারবেন। তখন উনি ওর বাবামাকে প্রতারক মনে করবেন। এটা কি ওর বাবামা’র প্রতি সুবিচার হবে?”
মাহমুদ দিশাকে আশ্বস্ত করে চলে এলো।
বাসায় এসে মাহমুদ মাকে জানিয়ে দিল সে এ বিয়ে করবেনা। সুলতানা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এটুকু ব্যাপারে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কোন যুক্তি নেই। আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলে কিছুতেই রাজী না হলে তিনি বান্ধবীকে কি বলবেন। শেষে রাগ করে তিনি মাহমুদের সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন, অসুস্থতার ভান করলেন। কিন্তু ছেলে কিছুতেই গললনা।
কয়েকদিন পর খাবার টেবিলে সুলতানা বেগম চুপচাপ খাচ্ছেন আর মাহমুদ চোখে কৌতুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে বলল, “মা, সত্যি করে বল তো, তুমি কি শায়লা আন্টিকে কি বলবে সেটা নিয়ে বেশী চিন্তিত নাকি তোমার ছেলে সুখী হবে কি’না সেটা নিয়ে?”
সুলতানা বেগমের গলায় ভাত যেন আটকে রইল। ছেলের সাথে কথা না বলার সংকল্প ভুলে গিয়ে উনি বললেন, “বাবা, তোর সুখই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুই কেন এটুকু কথার ওপর বিয়েতে নারাজ সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বল। আমি তো এই মেয়ের আর কোন ত্রুটি দেখিনা”।
“দেখ না সেটা ঠিক না মা, বল দেখতে চাও না। দেখ মা, কথাটা এটুকু আবার অনেক বড়ও বটে। আমিও জানি আমাদের সাংসারিক জীবনে সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেও যা ফেল করলেও তা- ওর রেজাল্টের ফলে আমাদের দাম্পত্য জীবনে কোন হেরফের হবেনা। কিন্তু আমি যার সাথে সারাজীবন সংসার করব তার ওপর আস্থা রাখতে পারাটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে যদি আমাকে জানাত সে ফেল করেছে তাহলেও আমি বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হতাম। কিন্তু যে আমাকে এত তুচ্ছ একটা বিষয়ে মিথ্যা বলল তাকে আমি আমার জীবন দিয়ে কিভাবে বিশ্বাস করব? আমি কি করে বুঝব যে সে আমাকে অন্যান্য ব্যাপারেও মিথ্যা বলছেনা?”
মা তার ভুল বুঝতে পেরে নিজের ভুলের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। কিন্তু মাহমুদ তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারল এই ভাবনাটা মায়ের মনেও দোলা দিয়েছে আবার তিনি এটাও চিন্তা করেছেন যে বান্ধবীকে কি বলবেন।
মাহমুদ চেয়ার ছেড়ে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসল, মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল, “মা, আমি তো তোমারই ছেলে, তুমি না বললেও বুঝি তোমার মনে কি কাজ করছে। শায়লা আন্টিকে আমাদের বলার কোন প্রয়োজন নেই আমরা কেন রাজী না। মেয়েটার রেজাল্ট বিষয়ে কিছু বলে ওর জীবনটা বিষিয়ে দেয়ার কোন দরকার নেই আমাদের। আন্টিকে বল, ‘আমার ছেলে খারাপ, সে এক জায়গায় প্রেম করে’ বা যা তোমার বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এটুকুর জন্য আমাকে এমন বিয়ে করতে বাধ্য কোরনা মা যাকে তোমার ছেলে কোনদিন মন থেকে বিশ্বাস করতে পারবেনা”।
সুলতানা বেগমের চোখে পানি চলে এলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে উনি বললেন, “আজ আমার ছেলেই আমাকে শেখাল কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল! আজকে আমার খুশীর অন্ত নেই রে বাবা! তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে কোন কিছুতে বাধ্য করবনা। এ’কদিন তোকে যে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য তুই আমাকে মাফ করে দে বাবা। আমি এখনই শায়লার সাথে কথা বলছি”।
মাহমুদ শুনতে পেল মা ফোনে বলছেন, “শায়লা? হ্যাঁ, সুলতানা বলছি। না রে বোন। আমার ছেলেটা একটা আস্ত পাগল। কিছুতেই সে এখন বিয়ে করতে রাজী হয়না। বলে নতুন চাকরী, এখন ওখানেই কনসেন্ট্রেশন দেয়া জরুরী। যাক, সময় তো পড়েই আছে। তোমার মেয়েরও অনার্স শেষ হতে আরো একবছর বাকী। দেখা যাক এই এক বছরে ওরা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয় কি’না। ঠিক আছে বোন, রাখি। আবার পরে কথা হবে”।
মাহমুদ মুচকি হেসে শুতে চলে গেল। মায়েরা বোঝে সবই … কিন্তু কেন যে পাগলামী করে!
imo for pc
ReplyDelete