জীবনে একবারই প্রেমে পড়েছিলাম। তাও শিমু আর আমি একসাথে, একইসময়, একই লোকের …
ছোটবেলা থেকেই আমার কোনকিছুতে আগ্রহের ঘাটতি ছিলোনা। বাবার সাথে পাখী শিকার, মাছ ধরতে যাওয়া, কাঠ কেটে ফার্নিচার বানানো, ছবি আঁকা, চিঠি লেখালেখি – নিজে নিজে লুকিয়ে চুরিয়ে গল্পকবিতা লেখালেখি, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা – স্ট্যাম্প, কার্ড, পাথর জমানো- কেক, বিস্কুট, পুডিং বানানো – আর দিনরাত বই পড়া …
বই পড়তে পড়তে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতাম; দেশ, বিদেশ আর মহাবিশ্ব ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম; নানান আশ্চর্য, অদ্ভুত আর আজগুবি জিনিস দেখতে দেখতে অভিভুত হয়ে যেতাম; নিউটন, সক্রেটিস আর শেক্সপিয়ারের সাথে আলাপ শেষই হতনা; কখনো রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম আর কখনো ইদ্রিস (আ) এর সাথে বেহেস্ত দোজখ ঘুরে আসতাম!
তরপরে সময় পেলে বুয়াদের প্রিয় ছবি দেখতাম, “বন্ধু হতে গিয়ে আমি শত্রু বলেই গণ্য হলাম” বা “কিয়া হুয়া তেরা ওয়াদা, উয়ো কাসাম, উয়ো ইরাদা”। ভাইদের সাথে কার্টুন দেখতাম সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত!
আমার নিজের পৃথিবী নিয়ে আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যে এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে আমার কখনো মনেই হয়নি। মাত্র কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়েই আমি পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে জীবন কাটাচ্ছিলাম।
তারপর অনার্সে ভর্তি হলাম। ক্লাসের সবাই বলতে লাগল, “আমাদের ক্লাসে ঠিক তোমার মত আরেকটা মেয়ে আছে”। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার পর একমাস চলে গেল, আমার মত আরেকটা মেয়ে, আমারই ক্লাসে পড়ে, অথচ তাকে আমি কোনদিন দেখিনি! তার কয়েকদিন পর ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুরা পরিচয় করিয়ে দিলো, “এই যে, শিমু, যার কথা বলছিলাম তোমাকে!” দেখলাম আমার মতই লম্বা, চওড়ায় আমার চাইতেও কম, আমার মতই সাদা অ্যাপ্রন সাদা স্কার্ফ পরা একটা মেয়ে। আমি দেখতে ভালো না কিন্তু ও দেখতে বেশ সুন্দর। পরিচিতি পর্ব শেষ হতে না হতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। আমরা যে যে যার যার জায়গায় বসে পড়লাম। বাসায় যাওয়ার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে আছি সে সময় আবার শিমুর সাথে দেখা। ও বলল, “তুমি নামাজ পড় তো?” আমি একটু আশ্চর্য হলাম, তারপরও বললাম, “হ্যাঁ, তুমি?” ও বলল, “আমিও। আমাদের মনে হয় বন্ধুত্ব হবে”। তারপর দু’জনে রিক্সা নিয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে রওয়ানা দিলাম। যেতে যেতে ভাবলাম এমন অদ্ভুত মানুষ কোনদিন দেখিনি!
কয়েকদিন যেতে না যেতেই টের পেলাম কেন শিমুকে কোনদিন দেখিনি। আমি ক্লাসে যেতাম ক্লাস শুরু হবার অন্তত আধঘন্টা আগে, সবার সাথে কথা বার্তা বলতাম, তারপর ধীরে সুস্থে সেলিনার পাশে গিয়ে বসতাম। অনার্সের প্রথম দিন থেকে মাস্টার্সের শেষদিন পর্যন্ত সেলিনার পাশেই বসেছি। আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে কম কথা হত ওর সাথে আর তাই ওর সাথে বসলে ক্লাসের মাঝখানে ডিস্টার্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে কম। সেলিনাও আগে আসলে আমার জন্য ফার্টবেঞ্চে জায়গা রাখত। শিমু আসত থার্ড পিরিয়ডে, ঘুম থেকে উঠে আরাম আয়েশ করে, ঢুলতে ঢুলতে। স্যার/ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে আস্তে করে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে বসত। গল্প করত পুরা ক্লাস আর ক্লাসের ওপর কমেন্ট্রি লিখত। ওর নামই হয়ে গেল “থার্ড পিরিয়ড শিমু”।
কিন্তু ক্লাসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। কিছুদিন পর আমিও এর কারণটা বুঝতে পারলাম। ওর মানুষের সাথে মেশার, চিন্তা করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমার চেহারায়ই মনে হয় কিছু একটা সমস্যা আছে। আমি দুষ্টুমী করলেও মানুষ অনেকক্ষণ চিন্তা করে আমি সত্যিই দুষ্টুমী করছি কি’না, যেন আমি শুধু সিরিয়াস কথাই বলতে পারি, আমি দুষ্টুমী করব এটা অসম্ভব ব্যাপার! আর ও দুষ্টুমী করতে করতে অনেক কড়া কড়া কথা বলে ফেলত অথচ কেউ কিছু মনে করতনা। যেমন একদিন এক বান্ধবী বলল,”তোদের প্র্যাক্টিকাল খাতাটা দিস তো, আমি কাল ক্লাস করতে পারিনি”। আমি বললাম, “ঠিক আছে, কোন সমস্যা নাই”। শিমু বলল, “কেন, কাল কই ছিলি?” সেই বান্ধবী বলল, “কাল ‘ও’র সাথে বাইরে গেছিলাম”। আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কার সাথে, তার আগেই শিমু বলল, “আমরা তোকে খাতা দিতে পারবনা। আমরা শুধু ভদ্র মেয়েদের খাতা দেই আর তুই হলি স্বরে অ ভদ্র”। অথচ সেই বান্ধবী হাসতে হাসতে চলে গেল!
কিভাবে যেন শিমুর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের একটা গল্প ছিলো, দুই বুড়োর যারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারেনা কিন্তু একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারেনা। আমাদের ক্লাসের সুতপা প্রায়ই বলত, “তোদের দু’জনকে দেখলেই আমার ঐ দুই বুড়ার কথা মনে হয়”। সেকন্ড ইয়ারে উঠে আমরা হয়ে গেলাম ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কোলরিজ, দুই পার্টনার! শিমু ছিল ফিলসফার প্রকৃতির তাই ওর নাম ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর আমার ছিল প্রচন্ড মেজাজ তাই আমার নাম কোলরিজ! আর থার্ড ইয়ারে ও আমার চেয়েও আমার ভাইকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত ছিল। ওর বিয়ে হয়েছে আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে।
ক্লাসে ছাড়া আর সব জায়গায় আমরা একসাথে ঘুরতাম। একদিন কমনরুমে আপুরা আমাদের জিজ্ঞেস করল আমরা জমজ কি’না! আরেকবার একব্যাক্তি তার এক বান্ধবীকে বললেন অমুক ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আছে যে দেখতে এমন এমন। কিন্তু বান্ধবী এটাই নির্ধারণ করতে পারলেন না যে মেয়েটা শিমু না আমি! তাই ঐযাত্রা আমরা দু’জনেই কোরবানী হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম। আমার বিয়ের বহু পরে একদিন আগ্রাবাদ হোটেলে গেছি হাফিজ সাহেবের সাথে। ওখানকার এক কর্মকর্তা দূর থেকে আমাকে দেখে হাফিজ সাহেবকে বললেন, “আপনার বৌ তো আমার কাজিন হয়!” আমি তো হতবাক! কাছে যাওয়ার পর উনি বললেন, “আপনি শিমু না?” বেচারাকে নিরাশ করে বলতে হোল, “না ভাই আমি শিমুর বান্ধবী”।
ওর সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমার অনেক মানুষজনের সাথে পরিচয় হোল। আর আমার বান্ধবীর সাথে চলতে চলতে বুঝতে পারলাম ও কেন এত অন্যমনষ্ক থাকে। আমি পৃথিবীর শুধু ইনোসেন্ট দিকটাই দেখেছি। কিন্তু ও আরো অনেক কিছু জানত যা আমি কখনো কোন বইয়ে পড়িনি। সমাজ সংসারের এই পঙ্কিলতা নিয়ে ও অনেক ভাবত। আর ওর এই ভাবনা আমাকেও অনেক ভাবতে শেখালো। আমি আমার নিরাপদ বুদবুদ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলাম যদিও ওর মত করে পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরতে আমি কখনোই পারিনি, পারবনা।
ও আমাকে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত আর আমার পরিবার যেহেতু ঠিক ইসলামিক ছিলোনা, আমার সবরকম চেষ্টায় ও সবসময় উৎসাহ দিত। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি বক্তৃতা দেয়ার সময় ও আমাকে ইশারা করে হাসতে মনে করিয়ে দিত। কলেজের বাইরেও আমরা প্রতিদিন প্রায় দু’ঘন্টা কথা বলতাম পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে যেন আমাদের আলাপ আলোচনার ফসল হিসেবে পৃথিবী সুন্দর, শংকামুক্ত, স্বপ্নীল হয়ে যাবে! আমরা যখন সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেলাম, তখন দেখা গেল দেশে আসলে অধিকাংশই আমরা কলেজ থেকে ওর বাসায় চলে যেতাম। কখনো অন্যান্য বান্ধবীদের নিয়ে আমরা স্টাডি গ্রুপ করে পড়তাম বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে বিবিধ সাব্জেক্ট নিয়ে গবেষনা করতাম। কখনো শপিং করতে যেতাম যা আমাকে কোনদিন করতে হয়নি, সুতরাং শিমুই ছিল ভরসা। কখনো দু’জনে মিলে ওর সমস্ত মামাখালাদের বাসায় বেড়াতে বের হতাম। দিনের কিয়দংশ ওর বাসায় কাটিয়ে বাসায় ফিরেই আবার ফোনে আলাপ শুরু হত। পরীক্ষার সময় একবার ও আমাকে হাইজ্যাক করে ওর বাসায় নিয়ে গেল দু’জনে মিলে পড়ার জন্য।
এভাবেই চলছিল জীবন।
একদিন শুক্রবারের মুভি দেখছি অলস সময় কাটানোর জন্য। কোন বিখ্যাত কিছু না। বিটিভির সাপ্তাহিক মুভি। গল্পটাও এমন বিশেষ মনে রাখার মত কিছু ছিলোনা বা হয়ত খেয়াল করে দেখিনি বলেই মনে নেই। কিন্তু ছবিটাতে একজন ল্যাংড়া সৈনিক ছিলো। ঐ অভিনেতাও তেমন আহামরি কেউ নয় নিশ্চয়ই কারণ এর আগে বা পরে তাকে আর কোথাও দেখিনি। দেখতেও তেমন কিছু না। কিন্তু বেচারার জন্য আমার এমন কষ্ট লাগছিল!
ছবি শেষ হতেই শিমুর সাথে যোগাযোগ। কে ফোন করেছিলাম তাও মনে নেই। ফোন করেই ও বলল, “রেহনুমা, আমি প্রেমে পড়ে গেছি!”
আমি বললাম, “আমিও!”
ও বলল, “কার সাথে?”
আমি বললাম, “আগে বল তুমি কার সাথে?”
ও বলল, “একজন সৈনিকের সাথে …”
আমি বললাম, “লোকটা ল্যাংড়া, তাই তো?”
ও প্রথমে বলল, “হ্যাঁ”, তারপর একটু পর যখন খেয়াল করল আমি কি বলেছি, অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি করে জানলে?”
“সেটাই তো দুঃখ হে বন্ধু!”, বললাম আমি, “আমরা দুজনেই একই লোকের প্রেমে পড়েছি!”
এই নিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টুমী করার পর শিমু বলল, “হায় রে! হলিউড, বলিউড মায় ঢালিউদের কোন হিরোদের দেখে আমাদের অ্যাকশন রি-অ্যাকশন কিছুই হোলনা, আর একজন ল্যাংড়া সৈনিককে নিয়ে আমাদের দুই বান্ধবীর টানাটানি!” অনেকক্ষণ হাসলাম দু’জনে।
ক’দিন আগে ক্যানাডিয়ান কোন পুরাতন ছবির চ্যানেলে দেখাচ্ছিলো ছবিটা। ছবিটা দেখার মত কিছু না। কিন্তু ঐ ল্যাংড়া সৈনিককে দেখে আবার আগের মতই মায়া লাগল। কিন্তু এবার আরো বেশী মায়া লাগল শিমুর জন্য যে আজ আমার কাছ থেক অনেক অনেক দূরে, ইচ্ছা হলেও ফোন করে যাকে বলতে পারিনা, “শিমু আমি প্রেমে পড়ে গেছি!”
ছোটবেলা থেকেই আমার কোনকিছুতে আগ্রহের ঘাটতি ছিলোনা। বাবার সাথে পাখী শিকার, মাছ ধরতে যাওয়া, কাঠ কেটে ফার্নিচার বানানো, ছবি আঁকা, চিঠি লেখালেখি – নিজে নিজে লুকিয়ে চুরিয়ে গল্পকবিতা লেখালেখি, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা – স্ট্যাম্প, কার্ড, পাথর জমানো- কেক, বিস্কুট, পুডিং বানানো – আর দিনরাত বই পড়া …
বই পড়তে পড়তে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতাম; দেশ, বিদেশ আর মহাবিশ্ব ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম; নানান আশ্চর্য, অদ্ভুত আর আজগুবি জিনিস দেখতে দেখতে অভিভুত হয়ে যেতাম; নিউটন, সক্রেটিস আর শেক্সপিয়ারের সাথে আলাপ শেষই হতনা; কখনো রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম আর কখনো ইদ্রিস (আ) এর সাথে বেহেস্ত দোজখ ঘুরে আসতাম!
তরপরে সময় পেলে বুয়াদের প্রিয় ছবি দেখতাম, “বন্ধু হতে গিয়ে আমি শত্রু বলেই গণ্য হলাম” বা “কিয়া হুয়া তেরা ওয়াদা, উয়ো কাসাম, উয়ো ইরাদা”। ভাইদের সাথে কার্টুন দেখতাম সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত!
আমার নিজের পৃথিবী নিয়ে আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যে এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে আমার কখনো মনেই হয়নি। মাত্র কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়েই আমি পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে জীবন কাটাচ্ছিলাম।
তারপর অনার্সে ভর্তি হলাম। ক্লাসের সবাই বলতে লাগল, “আমাদের ক্লাসে ঠিক তোমার মত আরেকটা মেয়ে আছে”। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার পর একমাস চলে গেল, আমার মত আরেকটা মেয়ে, আমারই ক্লাসে পড়ে, অথচ তাকে আমি কোনদিন দেখিনি! তার কয়েকদিন পর ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুরা পরিচয় করিয়ে দিলো, “এই যে, শিমু, যার কথা বলছিলাম তোমাকে!” দেখলাম আমার মতই লম্বা, চওড়ায় আমার চাইতেও কম, আমার মতই সাদা অ্যাপ্রন সাদা স্কার্ফ পরা একটা মেয়ে। আমি দেখতে ভালো না কিন্তু ও দেখতে বেশ সুন্দর। পরিচিতি পর্ব শেষ হতে না হতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। আমরা যে যে যার যার জায়গায় বসে পড়লাম। বাসায় যাওয়ার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে আছি সে সময় আবার শিমুর সাথে দেখা। ও বলল, “তুমি নামাজ পড় তো?” আমি একটু আশ্চর্য হলাম, তারপরও বললাম, “হ্যাঁ, তুমি?” ও বলল, “আমিও। আমাদের মনে হয় বন্ধুত্ব হবে”। তারপর দু’জনে রিক্সা নিয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে রওয়ানা দিলাম। যেতে যেতে ভাবলাম এমন অদ্ভুত মানুষ কোনদিন দেখিনি!
কয়েকদিন যেতে না যেতেই টের পেলাম কেন শিমুকে কোনদিন দেখিনি। আমি ক্লাসে যেতাম ক্লাস শুরু হবার অন্তত আধঘন্টা আগে, সবার সাথে কথা বার্তা বলতাম, তারপর ধীরে সুস্থে সেলিনার পাশে গিয়ে বসতাম। অনার্সের প্রথম দিন থেকে মাস্টার্সের শেষদিন পর্যন্ত সেলিনার পাশেই বসেছি। আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে কম কথা হত ওর সাথে আর তাই ওর সাথে বসলে ক্লাসের মাঝখানে ডিস্টার্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে কম। সেলিনাও আগে আসলে আমার জন্য ফার্টবেঞ্চে জায়গা রাখত। শিমু আসত থার্ড পিরিয়ডে, ঘুম থেকে উঠে আরাম আয়েশ করে, ঢুলতে ঢুলতে। স্যার/ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে আস্তে করে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে বসত। গল্প করত পুরা ক্লাস আর ক্লাসের ওপর কমেন্ট্রি লিখত। ওর নামই হয়ে গেল “থার্ড পিরিয়ড শিমু”।
কিন্তু ক্লাসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। কিছুদিন পর আমিও এর কারণটা বুঝতে পারলাম। ওর মানুষের সাথে মেশার, চিন্তা করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমার চেহারায়ই মনে হয় কিছু একটা সমস্যা আছে। আমি দুষ্টুমী করলেও মানুষ অনেকক্ষণ চিন্তা করে আমি সত্যিই দুষ্টুমী করছি কি’না, যেন আমি শুধু সিরিয়াস কথাই বলতে পারি, আমি দুষ্টুমী করব এটা অসম্ভব ব্যাপার! আর ও দুষ্টুমী করতে করতে অনেক কড়া কড়া কথা বলে ফেলত অথচ কেউ কিছু মনে করতনা। যেমন একদিন এক বান্ধবী বলল,”তোদের প্র্যাক্টিকাল খাতাটা দিস তো, আমি কাল ক্লাস করতে পারিনি”। আমি বললাম, “ঠিক আছে, কোন সমস্যা নাই”। শিমু বলল, “কেন, কাল কই ছিলি?” সেই বান্ধবী বলল, “কাল ‘ও’র সাথে বাইরে গেছিলাম”। আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কার সাথে, তার আগেই শিমু বলল, “আমরা তোকে খাতা দিতে পারবনা। আমরা শুধু ভদ্র মেয়েদের খাতা দেই আর তুই হলি স্বরে অ ভদ্র”। অথচ সেই বান্ধবী হাসতে হাসতে চলে গেল!
কিভাবে যেন শিমুর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের একটা গল্প ছিলো, দুই বুড়োর যারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারেনা কিন্তু একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারেনা। আমাদের ক্লাসের সুতপা প্রায়ই বলত, “তোদের দু’জনকে দেখলেই আমার ঐ দুই বুড়ার কথা মনে হয়”। সেকন্ড ইয়ারে উঠে আমরা হয়ে গেলাম ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কোলরিজ, দুই পার্টনার! শিমু ছিল ফিলসফার প্রকৃতির তাই ওর নাম ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর আমার ছিল প্রচন্ড মেজাজ তাই আমার নাম কোলরিজ! আর থার্ড ইয়ারে ও আমার চেয়েও আমার ভাইকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত ছিল। ওর বিয়ে হয়েছে আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে।
ক্লাসে ছাড়া আর সব জায়গায় আমরা একসাথে ঘুরতাম। একদিন কমনরুমে আপুরা আমাদের জিজ্ঞেস করল আমরা জমজ কি’না! আরেকবার একব্যাক্তি তার এক বান্ধবীকে বললেন অমুক ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আছে যে দেখতে এমন এমন। কিন্তু বান্ধবী এটাই নির্ধারণ করতে পারলেন না যে মেয়েটা শিমু না আমি! তাই ঐযাত্রা আমরা দু’জনেই কোরবানী হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম। আমার বিয়ের বহু পরে একদিন আগ্রাবাদ হোটেলে গেছি হাফিজ সাহেবের সাথে। ওখানকার এক কর্মকর্তা দূর থেকে আমাকে দেখে হাফিজ সাহেবকে বললেন, “আপনার বৌ তো আমার কাজিন হয়!” আমি তো হতবাক! কাছে যাওয়ার পর উনি বললেন, “আপনি শিমু না?” বেচারাকে নিরাশ করে বলতে হোল, “না ভাই আমি শিমুর বান্ধবী”।
ওর সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমার অনেক মানুষজনের সাথে পরিচয় হোল। আর আমার বান্ধবীর সাথে চলতে চলতে বুঝতে পারলাম ও কেন এত অন্যমনষ্ক থাকে। আমি পৃথিবীর শুধু ইনোসেন্ট দিকটাই দেখেছি। কিন্তু ও আরো অনেক কিছু জানত যা আমি কখনো কোন বইয়ে পড়িনি। সমাজ সংসারের এই পঙ্কিলতা নিয়ে ও অনেক ভাবত। আর ওর এই ভাবনা আমাকেও অনেক ভাবতে শেখালো। আমি আমার নিরাপদ বুদবুদ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলাম যদিও ওর মত করে পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরতে আমি কখনোই পারিনি, পারবনা।
ও আমাকে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত আর আমার পরিবার যেহেতু ঠিক ইসলামিক ছিলোনা, আমার সবরকম চেষ্টায় ও সবসময় উৎসাহ দিত। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি বক্তৃতা দেয়ার সময় ও আমাকে ইশারা করে হাসতে মনে করিয়ে দিত। কলেজের বাইরেও আমরা প্রতিদিন প্রায় দু’ঘন্টা কথা বলতাম পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে যেন আমাদের আলাপ আলোচনার ফসল হিসেবে পৃথিবী সুন্দর, শংকামুক্ত, স্বপ্নীল হয়ে যাবে! আমরা যখন সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেলাম, তখন দেখা গেল দেশে আসলে অধিকাংশই আমরা কলেজ থেকে ওর বাসায় চলে যেতাম। কখনো অন্যান্য বান্ধবীদের নিয়ে আমরা স্টাডি গ্রুপ করে পড়তাম বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে বিবিধ সাব্জেক্ট নিয়ে গবেষনা করতাম। কখনো শপিং করতে যেতাম যা আমাকে কোনদিন করতে হয়নি, সুতরাং শিমুই ছিল ভরসা। কখনো দু’জনে মিলে ওর সমস্ত মামাখালাদের বাসায় বেড়াতে বের হতাম। দিনের কিয়দংশ ওর বাসায় কাটিয়ে বাসায় ফিরেই আবার ফোনে আলাপ শুরু হত। পরীক্ষার সময় একবার ও আমাকে হাইজ্যাক করে ওর বাসায় নিয়ে গেল দু’জনে মিলে পড়ার জন্য।
এভাবেই চলছিল জীবন।
একদিন শুক্রবারের মুভি দেখছি অলস সময় কাটানোর জন্য। কোন বিখ্যাত কিছু না। বিটিভির সাপ্তাহিক মুভি। গল্পটাও এমন বিশেষ মনে রাখার মত কিছু ছিলোনা বা হয়ত খেয়াল করে দেখিনি বলেই মনে নেই। কিন্তু ছবিটাতে একজন ল্যাংড়া সৈনিক ছিলো। ঐ অভিনেতাও তেমন আহামরি কেউ নয় নিশ্চয়ই কারণ এর আগে বা পরে তাকে আর কোথাও দেখিনি। দেখতেও তেমন কিছু না। কিন্তু বেচারার জন্য আমার এমন কষ্ট লাগছিল!
ছবি শেষ হতেই শিমুর সাথে যোগাযোগ। কে ফোন করেছিলাম তাও মনে নেই। ফোন করেই ও বলল, “রেহনুমা, আমি প্রেমে পড়ে গেছি!”
আমি বললাম, “আমিও!”
ও বলল, “কার সাথে?”
আমি বললাম, “আগে বল তুমি কার সাথে?”
ও বলল, “একজন সৈনিকের সাথে …”
আমি বললাম, “লোকটা ল্যাংড়া, তাই তো?”
ও প্রথমে বলল, “হ্যাঁ”, তারপর একটু পর যখন খেয়াল করল আমি কি বলেছি, অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি করে জানলে?”
“সেটাই তো দুঃখ হে বন্ধু!”, বললাম আমি, “আমরা দুজনেই একই লোকের প্রেমে পড়েছি!”
এই নিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টুমী করার পর শিমু বলল, “হায় রে! হলিউড, বলিউড মায় ঢালিউদের কোন হিরোদের দেখে আমাদের অ্যাকশন রি-অ্যাকশন কিছুই হোলনা, আর একজন ল্যাংড়া সৈনিককে নিয়ে আমাদের দুই বান্ধবীর টানাটানি!” অনেকক্ষণ হাসলাম দু’জনে।
ক’দিন আগে ক্যানাডিয়ান কোন পুরাতন ছবির চ্যানেলে দেখাচ্ছিলো ছবিটা। ছবিটা দেখার মত কিছু না। কিন্তু ঐ ল্যাংড়া সৈনিককে দেখে আবার আগের মতই মায়া লাগল। কিন্তু এবার আরো বেশী মায়া লাগল শিমুর জন্য যে আজ আমার কাছ থেক অনেক অনেক দূরে, ইচ্ছা হলেও ফোন করে যাকে বলতে পারিনা, “শিমু আমি প্রেমে পড়ে গেছি!”
No comments:
Post a Comment