আমি বিশ্বাস করি যে যা চায় আল্লাহ তাকে তাই মিলিয়ে দেন। তবুও যেদিন ইন্টারভিউ দিতে গেলাম সেদিন থেকেই টেনশন হচ্ছিল চাকরী যদি হয়ে যায় তাহলে নামাজ কোথায় পড়ব? আরেক সমস্যা হোল এখানকার পুরুষরা। ক্যানাডিয়ানদের অন্যান্য দেশ এবং জাতি সম্পর্কে ধারণা এত কম যে তাদের কিছুতেই বোঝানো যায়না আমরা কেন পুরুষদের সাথে হ্যান্ডশেক করিনা। বরং তারা মনে করে হাত বাড়িয়ে না দিলে আমরা তাদের অভদ্র মনে করব!
আজ প্রথমদিন বলে তাড়াতাড়ি যেতে হোল। সাড়ে সাতটায় পৌঁছতে হবে। সূর্যোদয় হয় সাড়ে আটটায়, ফজর শুরু ছ’টা পঞ্চান্নতে। ইন্টারভিউর দিন হিসেব করেছিলাম বাসা থেকে অফিসে পৌছতে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। ফজর নামাজের কি হবে ভেবে মাথা খারাপ লাগছিল চাকরীর খবর পাবার পর একসপ্তাহ ধরেই। শেষমেশ ঠিক করলাম যা থাকে কপালে, নামাজ পড়েই বের হব! আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সময় হবার সাথে সাথেই নামাজ পড়ে দৌড়। রাস্তার দু’ধারে নিকষ কালো অন্ধকারেও চিকচিক করতে থাকা বরফের স্তুপের দিকে তাকানোর পর্যন্ত সুযোগ হোলনা। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই দেখি ট্রেন আসছে। উঠে পড়লাম একেবারে পেছনে। ডাউনটাউন পৌঁছে ট্রেনের পেছনে রাস্তা পাড় হয়ে একব্লক যেতেই Husky Energyর বিশালকায় দুই টাওয়ার। এটা ক্যানাডার সবচেয়ে বড় অয়েল কোম্পানীগুলোর একটা। ঢুকে রিসেপশনে গিয়ে দেখি ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটা বাজে। বুঝতে পারলাম না এ’কি করে সম্ভব!
পাঁচমিনিটের মধ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে এলিনর এলো আমাকে আইডি কার্ড করার জন্য নিয়ে যেতে। মহিলা দেখে স্বস্তি পেলাম। সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের কাজ শেষে এলাম ষোল তলায়, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অফিসে, যেখানে আমার কাজ। ভাগ্য ভালো এই ডিপার্টমেন্টে শুধু একজন পুরুষ কর্মী আছেন এবং ট্রেনিং উপলক্ষ্যে তিনি অনুপস্থিত। সুতরাং কোন পুরুষের বাড়িয়ে দেয়া হাত স্পর্শ বা উপেক্ষা কোনটাই করতে হোলনা। ক্যানাডাকে নারীরাজ্য বলা যায়, তারপরও এটা অভাবনীয় সৌভাগ্য বলতে হবে। আমার বস ক্যাথারিন মহিলা। ওর রুম আর আমার রুম সামনাসামনি। সে কিছুক্ষণ পরপর এসে নানান জিনিস দেখিয়ে দিতে লাগল, আমিও প্রয়োজনমত ওর রুমে হানা দিয়ে যা লাগে নিয়ে আসতে লাগলাম। এলিনর একফাঁকে এসে পুরো অফিস ঘুরিয়ে দেখাল, কিচেন, বাথ্রুম, প্রিন্টিংরুমসহ। বসে বসে ভাবতে লাগলাম বাংলাদেশে যে চাকরী করেছি এতে কোন “বস” প্রথা ছিলনা, তাতেই এক একেকজন দায়িত্বপ্রাপ্তের হম্বতম্বি হাবভাব দেখে মনে হত আমরা তাঁদের দাসানুদাস! আর যদি তাদের এখানকার মত নাম ধরে ডাকতাম তাহলে কি হত!! এখানে কেউ কাউকে হুকুম করেনা। আমার টেবিলে কাজ রাখা আছে, আমি আমার ইচ্ছেমত সময়ে করতে পারি। কোনকিছু তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হলে বস চিঠি লিখে অনুরোধ করে আগাম ধন্যবাদ দিয়ে। আর আমার জন্মভূমিতে মানুষের ন্যূনতম মর্যাদা দেন না কেউ যদি সামনে কোনক্রমে একটা টেবিল আর চেয়ার থাকে!
কাজ সহজ, সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু অশান্তি লাগছিল নামাজের কথা ভেবে। ক্যাথারিনকে ইমেল করলাম আমি আমার রুমে যুহর আর আসর নামাজ পড়ব প্রতিদিন, সময়টা আমার লাঞ্চটাইম থেকে পুষিয়ে দেব। সে চিঠির জবাব না দিয়ে সরাসরি আমার রুমে এসে উপস্থিত, “দাঁড়াও আমি তোমার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করছি। তুমি কেন কষ্ট করে কাজের জায়গায় নামাজ পড়বে? তাহলে তো তুমি ঠিকমত মনোযোগ দিতে পারবেনা!” ওর আগ্রহ দেখে আমি নিজেই ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলাম।
একটু পর এক দাঁড়িওয়ালা বয়স্ক ভদ্রলোক এসে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে ভীষণ খুশী হয়ে সালাম দিলেন। আমি তো হতবাক! বললাম, “আমি অফিস ঘুরে দেখার সময় প্রত্যেক রুমের বাইরে নাম চেক করেছি, কোন মুসলিমের নাম দেখিনি। আপনি কোথা হতে এলেন?” উনি বললেন, “আমি অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। এদিক দিয়ে যাবার সময় প্রথমে বোরকাপরা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, পরে নাম দেখে কনফার্ম হয়ে কথা বলতে এলাম”। আমি বললাম, “চাচা, ভালোই হোল আপনাকে পেয়ে গেলাম। আমি জায়নামাজ নিয়ে এসেছি, এখান থেকে কিবলা কোনদিকে বলুন”। উনি বললেন, “এখানে নামাজের জায়গা আছে, পাঁচ ওয়াক্তই জামাতে নামাজ হয়। সাড়ে বারোটায় প্রস্তুত থেক, আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব”। মনের ওপর থেকে যেন হিমালয় পর্বত সরে গেল, বাতাসে ভাসতে লাগলাম।
অজু করে রুমে এসেছি, বারোটা বাজে, বান্ধবী জেনী এসে হাজির হোল। জেনী আর আমি গতবছর একসাথে সিআরটিপি কোর্সে ছিলাম। সবাই বলেছিল চাইনিজরা কারো সাথে খুব একটা মেশেনা, নিজেরা নিজেরাই থাকে। কিন্তু সবার মত চাইনিজদের সাথেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল ঐ আড়াই মাসেই। সে বছর দু’মাস কাজ করেছিলাম এখানকার বৃহৎ গ্যাস কোম্পানী অ্যাল্টাগ্যাসে। কিন্তু আমার ছেলে ডেকেয়ারে যেতে চায়না। ওখানে সবাই ওকে বিশেষ আদর করা সত্ত্বেও সে দিনে একবারই হাসে, যখন আমি ওকে নিতে যাই। শেষপর্যন্ত হাফিজ সাহেব আর আমি মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলাম ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি আর কাজ করবনা। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে জেনী এই এক বছর আমার পেছনে লেগেই ছিল চাকরী করার জন্য। বারবার নানান ছুতায় ওকে মানা করছিলাম। ক’দিন আগে সে ফোন করে বল্ল, “তোমার জন্য একটা কাজ পেয়েছি আমাদের ডিপার্টমেন্টে। এবার আর না করবেনা”। সে গিয়ে বসকে কি কি বলে যে বোঝাল আল্লাহই জানেন, কিন্তু ক্যাথারিন আমাকে ফোন করে একটা ছোটখাট ইন্টারভিউ নিয়ে বল্ল পরদিন অফিসে যেতে, দেড়ঘন্টার ইন্টারভিউর জন্য। আল্লাহর রহমতে ইন্টারভিউ সবসময় ভালোই হয় আমার। একমাত্র কারণ এই যে আমি কখনো কিছুতে ঘাবড়ে যাইনা। বড়জোর চাকরী হবেনা, আর কি হতে পারে? এ’কারণেই প্রথমবারে বিসিএস পাশ করেছিলাম- চল্লিশ মিনিট ইন্টারভিউ নেবার পর পরীক্ষকরা নিজেরাই ঠেকানোর চেষ্টা করা ছেড়ে দিলেন, হা হা হা …। গতকাল আলিম ভাইকে ফোন করে খবরটা জানাতেই উনি বললেন, “আমরা চাকরী খুঁজে মরি, চাকরী পাইনা আর তুমি ঘরে বসে চাকরী পেয়ে যাও! যাও বোন, মন দিয়ে চাকরী কর, আল্লাহ তোমার ইচ্ছা পূরণ করুন”।
সাড়ে বারোটায় চাচা এসে পাশের বিল্ডিংযে নিয়ে গেলেন। ঐ বিল্ডিংযের নীচের তলায় পুরুষ মহিলাদের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা, কুর’আন হাদিসের বই রাখা। কেউ চিন্তা করবে ডাউনটাউনের জুমা মসজিদের পাশাপাশি এরকম আরো ছোটছোট অনেক জায়গা আছে নামাজ পড়ার যদি কেউ খুঁজে নিতে চায়?! হালাল খাবারের দোকানের প্রাচুর্য থেকে ধারণা করেছিলাম এখানে মুসলিমদের আধিপত্য। এবার নিশ্চিত হলাম। চাচাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে উনি বললেন, "সবার ভাগ্যে নামাজ পড়া হয়না মা, এই ডাউনতাউনে এত নামাজ পড়ার জায়গা অথচ অনেক মুসলিমই নামাজকে গুরুত্ব দেয়না। আমি উসিলা বটে কিন্তু তোমার আগ্রহের কারণেই আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন"। নামাজ পড়ে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। চাচা চলে গেলেন ব্যাংকে টাকা তুলতে, আমি চলে এলাম অফিসে। এসে দেখি ক্যাথারিন দরজা খুলছে, চাবি বের না করেই ঢুকে পড়লাম ভেতরে!
আসর নামাজ পড়ে ক্যাথারিনকে ধন্যবাদ দিতে গেলাম কাজ বুঝে নিতে সাহায্য করার জন্য। সে বরং আমাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল ওর টিমে যোগদান করার জন্য! এই ভদ্রতা তো আমাদের থাকা উচিত ছিল! বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলাম। স্টেশনে দেখি বাড়ী গামী মানুষের ভিড়। আগামীকাল থেকে দেরী করে যাব, দেরী করে আসব- মাগরিবসহ পড়ে। অফিস থেকে সাথে নিরাপত্তারক্ষী এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে যায় কেউ সন্ধ্যার পর থাকলে, তাই চিন্তা নেই। কিন্তু আজ এই ভিড় ঠেলেই উঠতে হোল। ট্রেনে ঢুকেই বুঝতে পারলাম আজ কপালে দুর্ভোগ আছে। লোকজনের ঠেলাঠেলির মধ্যেই বাড়ী পৌঁছতে হবে। এই সময় এক চাইনীজ দাদা ইশারায় ডাকলেন। ওনার পাশের সিটটা খালি হয়েছে। আল্লাহর কাছে শোকর করলাম। এতগুলো সুন্দরী মেয়ের মধ্যে দাদাজানের আমাকেই চোখে পড়ল!
আসলেই আল্লাহর রহমতের সীমা নেই। যে যা চায় তাকে তিনি তাই দেন!
আজ প্রথমদিন বলে তাড়াতাড়ি যেতে হোল। সাড়ে সাতটায় পৌঁছতে হবে। সূর্যোদয় হয় সাড়ে আটটায়, ফজর শুরু ছ’টা পঞ্চান্নতে। ইন্টারভিউর দিন হিসেব করেছিলাম বাসা থেকে অফিসে পৌছতে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। ফজর নামাজের কি হবে ভেবে মাথা খারাপ লাগছিল চাকরীর খবর পাবার পর একসপ্তাহ ধরেই। শেষমেশ ঠিক করলাম যা থাকে কপালে, নামাজ পড়েই বের হব! আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। সময় হবার সাথে সাথেই নামাজ পড়ে দৌড়। রাস্তার দু’ধারে নিকষ কালো অন্ধকারেও চিকচিক করতে থাকা বরফের স্তুপের দিকে তাকানোর পর্যন্ত সুযোগ হোলনা। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই দেখি ট্রেন আসছে। উঠে পড়লাম একেবারে পেছনে। ডাউনটাউন পৌঁছে ট্রেনের পেছনে রাস্তা পাড় হয়ে একব্লক যেতেই Husky Energyর বিশালকায় দুই টাওয়ার। এটা ক্যানাডার সবচেয়ে বড় অয়েল কোম্পানীগুলোর একটা। ঢুকে রিসেপশনে গিয়ে দেখি ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটা বাজে। বুঝতে পারলাম না এ’কি করে সম্ভব!
পাঁচমিনিটের মধ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে এলিনর এলো আমাকে আইডি কার্ড করার জন্য নিয়ে যেতে। মহিলা দেখে স্বস্তি পেলাম। সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের কাজ শেষে এলাম ষোল তলায়, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অফিসে, যেখানে আমার কাজ। ভাগ্য ভালো এই ডিপার্টমেন্টে শুধু একজন পুরুষ কর্মী আছেন এবং ট্রেনিং উপলক্ষ্যে তিনি অনুপস্থিত। সুতরাং কোন পুরুষের বাড়িয়ে দেয়া হাত স্পর্শ বা উপেক্ষা কোনটাই করতে হোলনা। ক্যানাডাকে নারীরাজ্য বলা যায়, তারপরও এটা অভাবনীয় সৌভাগ্য বলতে হবে। আমার বস ক্যাথারিন মহিলা। ওর রুম আর আমার রুম সামনাসামনি। সে কিছুক্ষণ পরপর এসে নানান জিনিস দেখিয়ে দিতে লাগল, আমিও প্রয়োজনমত ওর রুমে হানা দিয়ে যা লাগে নিয়ে আসতে লাগলাম। এলিনর একফাঁকে এসে পুরো অফিস ঘুরিয়ে দেখাল, কিচেন, বাথ্রুম, প্রিন্টিংরুমসহ। বসে বসে ভাবতে লাগলাম বাংলাদেশে যে চাকরী করেছি এতে কোন “বস” প্রথা ছিলনা, তাতেই এক একেকজন দায়িত্বপ্রাপ্তের হম্বতম্বি হাবভাব দেখে মনে হত আমরা তাঁদের দাসানুদাস! আর যদি তাদের এখানকার মত নাম ধরে ডাকতাম তাহলে কি হত!! এখানে কেউ কাউকে হুকুম করেনা। আমার টেবিলে কাজ রাখা আছে, আমি আমার ইচ্ছেমত সময়ে করতে পারি। কোনকিছু তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হলে বস চিঠি লিখে অনুরোধ করে আগাম ধন্যবাদ দিয়ে। আর আমার জন্মভূমিতে মানুষের ন্যূনতম মর্যাদা দেন না কেউ যদি সামনে কোনক্রমে একটা টেবিল আর চেয়ার থাকে!
কাজ সহজ, সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু অশান্তি লাগছিল নামাজের কথা ভেবে। ক্যাথারিনকে ইমেল করলাম আমি আমার রুমে যুহর আর আসর নামাজ পড়ব প্রতিদিন, সময়টা আমার লাঞ্চটাইম থেকে পুষিয়ে দেব। সে চিঠির জবাব না দিয়ে সরাসরি আমার রুমে এসে উপস্থিত, “দাঁড়াও আমি তোমার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করছি। তুমি কেন কষ্ট করে কাজের জায়গায় নামাজ পড়বে? তাহলে তো তুমি ঠিকমত মনোযোগ দিতে পারবেনা!” ওর আগ্রহ দেখে আমি নিজেই ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলাম।
একটু পর এক দাঁড়িওয়ালা বয়স্ক ভদ্রলোক এসে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে ভীষণ খুশী হয়ে সালাম দিলেন। আমি তো হতবাক! বললাম, “আমি অফিস ঘুরে দেখার সময় প্রত্যেক রুমের বাইরে নাম চেক করেছি, কোন মুসলিমের নাম দেখিনি। আপনি কোথা হতে এলেন?” উনি বললেন, “আমি অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। এদিক দিয়ে যাবার সময় প্রথমে বোরকাপরা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, পরে নাম দেখে কনফার্ম হয়ে কথা বলতে এলাম”। আমি বললাম, “চাচা, ভালোই হোল আপনাকে পেয়ে গেলাম। আমি জায়নামাজ নিয়ে এসেছি, এখান থেকে কিবলা কোনদিকে বলুন”। উনি বললেন, “এখানে নামাজের জায়গা আছে, পাঁচ ওয়াক্তই জামাতে নামাজ হয়। সাড়ে বারোটায় প্রস্তুত থেক, আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব”। মনের ওপর থেকে যেন হিমালয় পর্বত সরে গেল, বাতাসে ভাসতে লাগলাম।
অজু করে রুমে এসেছি, বারোটা বাজে, বান্ধবী জেনী এসে হাজির হোল। জেনী আর আমি গতবছর একসাথে সিআরটিপি কোর্সে ছিলাম। সবাই বলেছিল চাইনিজরা কারো সাথে খুব একটা মেশেনা, নিজেরা নিজেরাই থাকে। কিন্তু সবার মত চাইনিজদের সাথেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল ঐ আড়াই মাসেই। সে বছর দু’মাস কাজ করেছিলাম এখানকার বৃহৎ গ্যাস কোম্পানী অ্যাল্টাগ্যাসে। কিন্তু আমার ছেলে ডেকেয়ারে যেতে চায়না। ওখানে সবাই ওকে বিশেষ আদর করা সত্ত্বেও সে দিনে একবারই হাসে, যখন আমি ওকে নিতে যাই। শেষপর্যন্ত হাফিজ সাহেব আর আমি মিলে পরামর্শ করে ঠিক করলাম ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত আমি আর কাজ করবনা। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে জেনী এই এক বছর আমার পেছনে লেগেই ছিল চাকরী করার জন্য। বারবার নানান ছুতায় ওকে মানা করছিলাম। ক’দিন আগে সে ফোন করে বল্ল, “তোমার জন্য একটা কাজ পেয়েছি আমাদের ডিপার্টমেন্টে। এবার আর না করবেনা”। সে গিয়ে বসকে কি কি বলে যে বোঝাল আল্লাহই জানেন, কিন্তু ক্যাথারিন আমাকে ফোন করে একটা ছোটখাট ইন্টারভিউ নিয়ে বল্ল পরদিন অফিসে যেতে, দেড়ঘন্টার ইন্টারভিউর জন্য। আল্লাহর রহমতে ইন্টারভিউ সবসময় ভালোই হয় আমার। একমাত্র কারণ এই যে আমি কখনো কিছুতে ঘাবড়ে যাইনা। বড়জোর চাকরী হবেনা, আর কি হতে পারে? এ’কারণেই প্রথমবারে বিসিএস পাশ করেছিলাম- চল্লিশ মিনিট ইন্টারভিউ নেবার পর পরীক্ষকরা নিজেরাই ঠেকানোর চেষ্টা করা ছেড়ে দিলেন, হা হা হা …। গতকাল আলিম ভাইকে ফোন করে খবরটা জানাতেই উনি বললেন, “আমরা চাকরী খুঁজে মরি, চাকরী পাইনা আর তুমি ঘরে বসে চাকরী পেয়ে যাও! যাও বোন, মন দিয়ে চাকরী কর, আল্লাহ তোমার ইচ্ছা পূরণ করুন”।
সাড়ে বারোটায় চাচা এসে পাশের বিল্ডিংযে নিয়ে গেলেন। ঐ বিল্ডিংযের নীচের তলায় পুরুষ মহিলাদের আলাদা নামাজের ব্যবস্থা, কুর’আন হাদিসের বই রাখা। কেউ চিন্তা করবে ডাউনটাউনের জুমা মসজিদের পাশাপাশি এরকম আরো ছোটছোট অনেক জায়গা আছে নামাজ পড়ার যদি কেউ খুঁজে নিতে চায়?! হালাল খাবারের দোকানের প্রাচুর্য থেকে ধারণা করেছিলাম এখানে মুসলিমদের আধিপত্য। এবার নিশ্চিত হলাম। চাচাকে ধন্যবাদ দিতে গেলে উনি বললেন, "সবার ভাগ্যে নামাজ পড়া হয়না মা, এই ডাউনতাউনে এত নামাজ পড়ার জায়গা অথচ অনেক মুসলিমই নামাজকে গুরুত্ব দেয়না। আমি উসিলা বটে কিন্তু তোমার আগ্রহের কারণেই আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন"। নামাজ পড়ে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। চাচা চলে গেলেন ব্যাংকে টাকা তুলতে, আমি চলে এলাম অফিসে। এসে দেখি ক্যাথারিন দরজা খুলছে, চাবি বের না করেই ঢুকে পড়লাম ভেতরে!
আসর নামাজ পড়ে ক্যাথারিনকে ধন্যবাদ দিতে গেলাম কাজ বুঝে নিতে সাহায্য করার জন্য। সে বরং আমাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল ওর টিমে যোগদান করার জন্য! এই ভদ্রতা তো আমাদের থাকা উচিত ছিল! বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলাম। স্টেশনে দেখি বাড়ী গামী মানুষের ভিড়। আগামীকাল থেকে দেরী করে যাব, দেরী করে আসব- মাগরিবসহ পড়ে। অফিস থেকে সাথে নিরাপত্তারক্ষী এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে যায় কেউ সন্ধ্যার পর থাকলে, তাই চিন্তা নেই। কিন্তু আজ এই ভিড় ঠেলেই উঠতে হোল। ট্রেনে ঢুকেই বুঝতে পারলাম আজ কপালে দুর্ভোগ আছে। লোকজনের ঠেলাঠেলির মধ্যেই বাড়ী পৌঁছতে হবে। এই সময় এক চাইনীজ দাদা ইশারায় ডাকলেন। ওনার পাশের সিটটা খালি হয়েছে। আল্লাহর কাছে শোকর করলাম। এতগুলো সুন্দরী মেয়ের মধ্যে দাদাজানের আমাকেই চোখে পড়ল!
আসলেই আল্লাহর রহমতের সীমা নেই। যে যা চায় তাকে তিনি তাই দেন!
No comments:
Post a Comment